দীপন হত্যাকাণ্ড: গোয়েন্দাদের হাত শূন্য by আবু সালেহ আকন

কে খুন করল, কারা হামলা চালালো সে সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত নয় পুলিশ-গোয়েন্দারা। অথচ গুনে গুনে চার দিন কেটে গেছে। তবে পুলিশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রেখেছে বলে জানা গেছে। তাদের মোবাইল কথোপকথন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশক দীপন হত্যা এবং লালমাটিয়ায় প্রকাশক টুটুলসহ তিনজনকে আহত করার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওপর হস্তান্তর হয়েছে। গতকাল থেকে ডিবি মামলা দু’টি নিয়ে কাজও শুরু করেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মিডিয়া সেলের ডিসি মুনতাসিরুল ইসলাম।
গত শনিবার রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের জাগৃতি প্রকাশনীতে হানা দিয়ে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে দুর্বৃত্তরা গলা কেটে হত্যা করে। প্রায় একই সময় লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতেও দুর্বৃত্তরা হানা দেয়। সেখানে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল ও লেখক-ব্লগার সুদীপ কুমার ওরফে রণদীপম বসু এবং ব্লগার তারেক রহিমকে কুপিয়ে ও গুলি করে আহত করে দুর্বৃত্তরা। তন্মধ্যে তারেকের শরীরে গুলিবিদ্ধ হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হতাহত দুই প্রকাশকই গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত ব্লগার অভিজিত রায়ের বইয়ের প্রকাশক ছিলেন। অভিজিতের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’সহ কয়েকটি বই প্রকাশ করেন টুটুল। এই বই প্রকাশের পরই তাকে হুমকি দেয়া হয়। তার বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, এই হুমকির পর তিনি অনেকটাই সাবধানে ছিলেন। অপর দিকে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’সহ অভিজিতের কয়েকটি বই প্রকাশ করেছিলেন নিহত ফয়সল আরেফিন দীপন।
এ ঘটনায় সোমবার দুপুরে শাহবাগ থানায় দীপন হত্যায় স্ত্রী ডা: রাজিয়া রহমান জলি বাদি হয়ে হত্যা মামলা এবং মোহাম্মদপুর থানায় প্রকাশক টুটুল বাদি হয়ে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। মামলা দায়েরের আগ থেকেই তদন্ত শুরু করে পুলিশ-গোয়েন্দারা। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত ফলাফল শূন্য। গতকাল রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার বা আটক করতে পারেনি পুলিশ-গোয়েন্দারা। ডিসি মুনতাসিরুল ইসলাম বলেছেন, কোনো আটক বা গ্রেফতার নেই। মামলা দু’টির তদন্তভার পড়েছে ডিবির দক্ষিণ ও পশ্চিম টিমের ওপর। শুধু অভিজিতের বই প্রকাশই, না এর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা রয়েছে সে সম্পর্কেও নিশ্চিত নয় পুলিশ-গোয়েন্দারা। তবে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, কয়েকজনকে তারা সন্দেহ ও নজরদারির মধ্যে রেখেছে। এর সংখ্যা সাত-আটজন হতে পারে বলে জানা গেছে। এরা কারা সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। এ দিকে আজিজ সুপার মার্কেটে দীপন হত্যার ঘটনায় সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজের ওপর প্রাথমিকভাবে ভরসা করা হলেও ওই ফুটেজ দিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পায়নি গোয়েন্দারা। সূত্র জানায়, আজিজ সুপার মার্কেটের পাঁচটি গেটে পাঁচটি সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। কিন্তু ঘটনার সময় এর মধ্যে দু’টি ক্যামেরাই বন্ধ ছিল। বাকি তিনটিতে যে ছবি ধারণ আছে তা আবছা। তা দিয়ে এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। অপর দিকে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। সেখানকার দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করতে ম্যানুয়াল পদ্ধতির ওপরই নির্ভর করছে পুলিশ-গোয়েন্দারা।
এ দিকে এ হামলার শিকার লেখক-প্রকাশক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন চরম আতঙ্কের মধ্যে আছেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহতরা বলেছেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা এখনো শঙ্কার মধ্যে। আহত রণদীপম বলেন, ছয় বছর ধরে টুটুলের সাথে তার পরিচয়। সে থেকেই তিনি মাঝে মধ্যে ওই প্রকাশনায় গিয়ে আড্ডা দিতেন। ইতোমধ্যে ওই প্রকাশনী থেকে কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আগামী বইমেলায় ৪ পর্বের একটি বই প্রকাশ হওয়ার কথা। এ কারণেই ঘটনার দিন টুটুলের সাথে তিনি কথা বলতে যান। এ সময় প্রথমে দুই যুবক সেখানে প্রবেশ করে তাদেরকে জিম্মি করার চেষ্টা করে। তিনি তখন একটি চেয়ার ছুড়ে মারেন তাদের ওপর। এরপর তারা পিস্তলের মুখে জিম্মি করে সবাইকে কোপাতে শুরু করে। তিনি তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। ১৫-২০ মিনিট পরে তার জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখেন চেয়ারের পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় টুটুল পড়ে আছে। তারেককে না দেখে তিনি খুঁজতে শুরু করেন। একপর্যায়ে তাকে পাওয়া যায় বারান্দায়। তিনি প্রতিষ্ঠানের গেট খুলতে গিয়ে দেখেন বাইরে থেকে তালা মারা। তখন তিনি বারান্দা দিয়ে বাইরের লোকজনের সহায়তা চান। কিন্তু কেউ সহায়তা করতে এগিয়ে আসেননি। রণদীপম বলেন, তার বেশ কয়েকটি বই ছাপা হয়েছে। কিন্তু তার কোনো বইয়ে ধর্ম নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই। তিনি বলেন, দুর্বৃত্তদের হয়তো টার্গেট ছিল টুটুল। কিন্তু তারা পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, বাইরে থেকে কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে না যাওয়ায় একপর্যায়ে তিনি অনেককে ফোন করেন এবং ফেসবুকে স্ট্যাটাজ দেন। এরপর তাদের অনেক বন্ধুবান্ধব ছুটে যান ঘটনাস্থলে। তিনি বলেন, অতীতে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার কোনোটিরই বিচার হয়নি। এ জন্যই দুর্বৃত্তরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে গেছে।
ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ তারেক রহিমের শরীরে আগামীকাল বৃহস্পতিবার আরো একটি অপারেশন হওয়ার কথা রয়েছে। তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্র জানায়। আহত টুটুলের স্ত্রী শামীমা রুনা বলেছেন, এখনো আমরা চরম ভয়ে আছি। তিনি নিরাপত্তা দাবি করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। তিনি বলেন, আমরা ভয়ে আছি।
এ দিকে গতকালও আজিজ সুপার মার্কেট এলাকায় ছিল থমথমে পরিস্থিতি। এখানকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেছেন, মার্কেটের ভেতরে এমন একটি ঘটনা ঘটবে তা এখনো তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না।

No comments

Powered by Blogger.