সিরিয়ার সেনাবাহিনীর কথা ভুললে চলবে না by রবার্ট ফিস্ক

সিরিয়ার কমান্ডাররা এখন রাশিয়ার
প্রতিটি বিমান হামলা সমন্বয় করছে
মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার দুঃসাহসী অভিযান নিয়ে পৃথিবী এখনো রাগে গরগর করছে। রাশিয়া সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ব্যাপারে নাক গলানো থেকে বঞ্চিত করেছে, কোন একনায়ক বেঁচে থাকবে আর কোন জন মারা যাবে। কিন্তু এই ডামাডোলের মধ্যে আমরা একটি প্রতিষ্ঠানের কথা ভুলে যাচ্ছি। সেটি হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা সেই রাষ্ট্রের মধ্যে ক্রিয়াশীল আছে, রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে, যে রাষ্ট্রকে আবার মস্কো রক্ষা করতে চায়। সেই প্রতিষ্ঠানটি হলো সিরিয়ার সেনাবাহিনী। রাশিয়া নিজের ক্ষেপণাস্ত্রের প্রচারণা দিচ্ছে, আর সিরিয়ার সেনাবাহিনী মাস কয়েক আগেও লোক ও অস্ত্রবলে কমজোর থাকলেও হঠাৎ করেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে। আমরা মনে করতে পারি, এ বছরের শুরুর দিকে এই সেনাবাহিনী প্রায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল, বাশার আল-আসাদের সরকার নিজের শেষ দেখে ফেলেছিল।
ক্ষমতার পালাবদল ঘটানোর জন্য আমরা ঘুণে ধরা সেনাবাহিনীকে নামিয়েছিলাম। সিরিয়ার সেনাবাহিনী জিসর আল-সুগুর ও পালমিরায় হারছিল। ফলে আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, বাশারের রাষ্ট্র এমন জায়গায় চলে গিয়েছিল, যেখানে আর সামান্য কিছু হলেই তার পতন হতে পারে।
এরপর ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র বহর নিয়ে হাজির হলেন, আর পুরো পরিস্থিতি বদলে গেল। আমরা যখন গোঁৎ গোঁৎ করছিলাম যে রাশিয়া মধ্যপন্থী বিদ্রোহীদের ওপর বোমাবর্ষণ করছে, তখন আলেপ্পো ও ওরোন্তসের উপত্যকার আশপাশে সিরিয়ার সেনাবাহিনী নুসরা ফ্রন্টের বিরুদ্ধে যে অভিযান চালাচ্ছে, সেদিকে আমরা নজর দিইনি। অথচ মার্কিন জেনারেলরা বলেছিলেন, মধ্যপন্থীদের অস্তিত্ব নেই।
সিরিয়ার কমান্ডাররা এখন রাশিয়ার প্রতিটি বিমান হামলা সমন্বয় করছে। তারা প্রতি রাতে ২০০ থেকে ৪০০টি হামলা সমন্বয় করছে। এখন সে সংখ্যাটা প্রায়ই ৮০০-তে চলে যাচ্ছে। না, রুশরা যে মানচিত্রের প্রতিটি রেফারেন্স অনুসারেই হামলা করছে, ব্যাপারটা তা নয়। সিরিয়া দেখেছে, রুশরা ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে হামলা করতে চায় না, তারা আফগানিস্তানে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের কাছে সিরিয়ার জ্বলন্ত হাসপাতাল ও মৃত বরযাত্রীদের রেখে যেতে চায়। তবে নীতির পরিবর্তন যেকোনো সময় হতে পারে। বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণে বেসামরিক মানুষ নিহত হবে না, তা হতে পারে না। আর সেটা করতে হলে অন্য দেশের সীমানাও অতিক্রম করতে হয়।
যৌক্তিক পরম্পরায় রুশরা তুর্কিদের বলেছে, এই যুদ্ধ সমন্বয়ের তথ্যটা মার্কিনদের হাতে যাওয়া উচিত। আরও উল্লেখযোগ্য খবর হচ্ছে, সিরিয়ার ভূমধ্যসাগর উপকূলে রুশদের ঘাঁটির সঙ্গে তেল আবিবের ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হটলাইন যোগাযোগ চালু হয়েছে। আরও অবিশ্বাস্য খবর হচ্ছে, ইসরায়েলের বিমানবাহিনী একসময় গোলান উপত্যকায় সিরিয়া ও ইরানের বেসামরিক মানুষের ওপর বোমা হামলা চালালেও হঠাৎ করেই তারা আকাশ থেকে উধাও হয়ে গেছে। অন্য কথায় বললে, রাশিয়া এক বড় অভিযানে নেমেছে, সিরিয়ায় তারা এক মাসের জন্য ঘুরতে আসেনি। এটা অনেক দিন ধরে চলবে বলেই মনে হয়।
সিরিয়া আসলে পালমিরা পুনর্দখলের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিল, আইএস গত মে মাসে সেটি দখল করেছিল। কিন্তু রুশরা আলেপ্পো অঞ্চলের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে, এর আংশিক কারণ হচ্ছে তারা মনে করে, লাতাকিয়া উপকূলের আশপাশে তাদের ঘাঁটি দুর্বল। নুসরা ফ্রন্ট লাতাকিয়া ও তারতুসের দিকে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, আর মস্কো চায় না যে তার বিমানবাহিনী ভূমিতেই অন্য কারও লক্ষ্যবস্তু হোক। কিন্তু সিরিয়ার সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ চারটি ইউনিট মোতায়েন করেছে, তারা এখন তুরস্ক সীমান্তের দিকে এগোচ্ছে: প্রথম ও চতুর্থ ডিভিশন, রিপাবলিকান গার্ড ও স্পেশাল ফোর্সেস।
আইএসের রাজধানী রাকায় রাশিয়ার বিমান হামলায় আইএস আক্রান্ত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে, যদিও সিরিয়া এ কথা বলে বুক ফোলায় যে ওই শহর থেকে তারা অনেক গোয়েন্দা তথ্য পাচ্ছে। ব্যাপারটা সত্য হলে তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক হবে, কারণ আইএস ‘সরকারের চরদের’ নির্যাতন করে মেরে ফেলার ব্যাপারে ওস্তাদ। ফলে যে-ই দামেস্কে তথ্য পাঠাক না কেন, তাকে অনেক সাহসী হতে হবে। তারপরও ভ্রমণকারীদের কথা সত্য হতে পারে। রাকা থেকে দামেস্ক পর্যন্ত একটি নিয়মিত বেসামরিক যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে, এ এক অদ্ভুত ব্যাপার, কারণ বেসামরিক বাস সাধারণত যুদ্ধরেখা অতিক্রম করে থাকে। আর যাত্রীরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বললেও বাড়ি পৌঁছে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে দেয়।
হ্যাঁ, এসবই পুতিনের অভিযানের শুরু মাত্র। ইদানীং তিনি মধ্যপ্রাচ্যে বেশ যাতায়াতও শুরু করেছেন। এই অঞ্চলের আরেক স্তম্ভ মিসরের ফিল্ড মার্শাল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন, যিনি নির্বাচনে ৯৬ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন, যিনি এখন মিসর শাসন করেন। কিন্তু মিসরীয় সেনাবাহিনী সিনাইয়ে ছোট একটি যুদ্ধে লিপ্ত হলেও বড় যুদ্ধের কৌশলগত অভিজ্ঞতা তার নেই। আবার সৌদি আরব, আমিরাত ও জর্ডানের বর্তমান সামরিক বাহিনী ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া ও সুযোগমতো অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে আকাশ থেকে ছেলেখেলা প্রকৃতির হামলা চালালেও একটি প্রকৃত যুদ্ধ কীভাবে লড়তে হয়, সে অভিজ্ঞতা কি তাদের আছে? লিবিয়ার সেনাবাহিনী ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। ওদিকে ইরাকের সেনাবাহিনী ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ লড়াই করতে পারেনি।
কিন্তু একটি তথ্য এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
সিরিয়ার সেনাবাহিনী যদি এই যুদ্ধে জেতে, নিজেদের ধরে রাখতে পারে, সেনাসংখ্যা বজায় রাখতে পারে, তাহলে তারাই হবে এ অঞ্চলের সবচেয়ে সমর-প্রশিক্ষিত, নির্মম ও সমর-অভিজ্ঞ সেনাবাহিনী। এ মুহূর্তে তাদের লোক ও অস্ত্রবল দুটোই কম। সিরিয়ায় প্রতিবেশীরা যদি এ কথা ভুলে যায়, তাহলে তাদের কপালে দুঃখ আছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.