প্রথম আলোর একজন পাঠকের পর্যবেক্ষণ by সৈয়দ আবুল মকসুদ

এই পাঠকেরাই প্রথম আলোর শক্তি
কোনো দৈনিক পত্রিকার ১৭টি বছর টিকে থাকা শুধু নয়; অপ্রতিরোধ্য থাকা খুব সহজ কথা নয়। ১৭ বছর অল্প সময় নয়। একসময় যে দেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল যেমন বেশি, তেমনি পত্রিকার অকালমৃত্যুর হার ছিল সম্ভবত পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। প্রথম আলো ১৭ পার করে ১৮-তে পড়েছে। তার জন্য পত্রিকার কর্ণধার ও তাঁর সহকর্মীদেরই শুধু অভিনন্দন প্রাপ্য নয়, তার পাঠকদেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। সুযোগ্য ব্যবস্থাপনা ও সম্পাদনার সঙ্গে পাঠকের অকুণ্ঠ সমর্থন পত্রিকার যাত্রাকে করেছে অপ্রতিরোধ্য।
কোনো পত্রিকার সাফল্যের পেছনে সম্পাদক, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদক, বিভাগীয় সম্পাদক প্রমুখের ভূমিকাই প্রধান। একসময় রীতি ছিল সহকারী সম্পাদকেরাই উপসম্পাদকীয় নিবন্ধগুলো লিখতেন—নামে অথবা বেনামে। বর্তমানে পত্রিকার বাইরের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সম্পাদকীয় বা প্রতিসম্পাদকীয় পাতায় নিবন্ধ বা কলাম লেখেন। তাতে বিচিত্র চিন্তাধারা বা মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে এবং একসুরো লেখা ও একঘেয়েমি থেকে পাঠক রক্ষা পায়। ১৭ বছরে দেশের বহু বিশিষ্ট ও খ্যাতিমান ব্যক্তি প্রথম আলোয় উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ ও কলাম লিখেছেন। প্রথম বছর খানেকের মতো বাদ দিলে গত ১৬ বছরে এমন একটি সপ্তাহ নেই যে সপ্তাহে প্রথম আলোয় আমার রচনা প্রকাশিত হয়নি। মাথামুণ্ডু যা-ই লিখি না কেন, গুণ নয়, সংখ্যা ও পরিমাণের দিক থেকে বিচার করলে—ছাত্রজীবনে রোল নম্বর নিচের দিকে থাকলেও—আমি প্রথম আলোয় ফার্স্টবয়। যদিও কোনো দৈনিকে একজন কলাম লেখকের অবস্থান বিত্তবান ভগ্নিপতির সংসারে বেকার শ্যালকের মতো—অস্তিত্বটা পাঠকের চোখে পড়লেও—পত্রিকার ভালোমন্দে তার কোনোই অবদান ও ভূমিকা নেই। লেখক হিসেবে নয়, ১৭ বছরের একজন পাঠক হিসেবে প্রথম আলো সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ দিলে আশা করি তা অশোভন হবে না। হবে না অপ্রাসঙ্গিকও।
একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের পাঠকশ্রেণি বিচিত্র। তাদের পছন্দের পত্রিকার কাছে বিচিত্র তাদের প্রত্যাশা। অট্টালিকাবাসী অথবা সবচেয়ে শিক্ষিত ও পণ্ডিতও কাগজ পড়েন, শণের ছাওয়া কুটিরে বাস করা অল্প শিক্ষিত গরিব মানুষটিও পড়েন। একবার জয়পুরহাটের এক গ্রামীণ বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। চা খাওয়ার জন্য আমরা থামি। সংখ্যালঘু বুনা জাতিসত্তার এক যুবক বাঁশের রাখারির তৈরি খাঁচা, খালুই প্রভৃতি বিক্রি করছিল রাস্তার পাশে বসে। আমার দিকে এগিয়ে আসে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ছেলেটি বলে, ‘ফুলবাড়ীর মাটির নিচের কয়লা তোলার আন্দোলনের খবর আপনেগো পত্রিকায় ছাপে। আমাগো খবরগুলো ২ নম্বর ৩ নম্বর পাতায় ছাপলে ভালো হইত। বেশি মানুষ পড়ত।’ কী সরল, নির্দোষ আবদার! সবাই চায় তার সম্প্রদায়ের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা বেশি মানুষ জানুক। ছেলেটি ভেবে থাকবে, ভেতরে মফস্বলের পাতার সংবাদটি যদি পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায়!
এমন পাঠকও আছেন যাঁরা শুধু পড়েন না, পড়ে বিষয়বস্তু মনে গেঁথে রাখেন। এ রকম প্রথম আলোর কিছু শিশু-কিশোর পাঠকও আমি দেখেছি। বান্দরবানের লামা উপজেলায় পাহাড় ও গহন অরণ্যবেষ্টিত শহীদ আল বোখারী মহাজাতকের প্রতিষ্ঠিত কোয়ান্টাম স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তারা ১৫টির বেশি জাতিসত্তার ছাত্রছাত্রী দেশের মূল স্রোত থেকে দূরে, কিন্তু তারা পাচ্ছে আধুনিক শিক্ষা এবং রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, নৃত্য প্রভৃতি আধুনিক সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ। বিদ্যুৎ নেই, কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থায় ঘণ্টা দুই টিভিও দেখতে পারে। পত্রিকার মধ্যে প্রথম আলো নিয়মিত পড়ে; অন্য দু-একটি কাগজও। আমি কথা বলে দেখেছি, কোন লেখক কী কী লেখেন, তা তাদের অনেকটা মুখস্থ। স্বপ্ন নিয়ে হোক, ছুটির দিনে হোক, বন্ধুসভার পাতা হোক বা নারীমঞ্চ হোক, অথবা আনন্দ হোক—তারা খুঁটিয়ে পড়ে। শুধু পড়েই না, পড়ে তা নিয়ে আলোচনা করে। শহরের ছেলেমেয়ের অনেক সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হলেও এদিক থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত ছেলেমেয়েরা বরং ভাগ্যবান। তাদের চিন্তা করার অবকাশ আছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডা এবং এদিকে মালয়েশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম আলোর রয়েছে লাখ লাখ পাঠক। ওসব দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা ও গবেষণা করছেন বহু বাংলাদেশি। হঠাৎ হঠাৎ কোনো দিন খুব ভোরে অথবা রাতে ফোন আসে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত কোনো লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁরা কথা বলেন। সমর্থন করে হোক বা ভিন্নমত প্রকাশ করে হোক—তাঁরা দীর্ঘ আলোচনা করেন। প্রবাসীরা দেশের সমস্যা নিয়ে একটু বেশিই ভাবেন। তাঁরা দেখতে চান দেশের বাস্তব অবস্থার বস্তুনিষ্ঠ চিত্র। সেটা তাঁরা সম্ভবত প্রথম আলো থেকে পান।
গত ১৭ বছরে বাংলাদেশে চার ধরনের সরকার ছিল বা রয়েছে। এই সময় দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন ঘটেছে। অভাবিত উন্নতি হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে, অন্যদিকে অবক্ষয়ও দেখা দিয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। গত ১৭ বছরের বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে যখন কেউ গবেষণা করবেন, প্রথম আলো হবে তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক। মোটের ওপর সব ধরনের উপাদানই এখানে পাওয়া সম্ভব।
সব কাঁটা উপেক্ষা করে এক আলোকিত জাতি গঠনে প্রথম আলোর ভূমিকা আরও আপসহীন হবে—প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তার একজন পাঠক ও লেখক হিসেবে এই আমার প্রত্যাশা।
প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পলিসি কী, তা সম্পাদক ও তাঁর সহকর্মীরাই জানেন, বাইরে থেকে আমরা সে সম্পর্কে অবগত নই। কিন্তু প্রকাশিত প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রভৃতি থেকে পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারে এর নৈতিক অবস্থান কী। নিছক পেশাদার খবরের কাগজ নয়, তার চেয়ে কিছু বেশি। পাঠক মোটের ওপর বুঝতে পারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে চার মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি প্রথম আলোর অঙ্গীকার অবিচল এবং এগুলোর সঙ্গে আপসও করে না। সামাজিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতাগুলোকে প্রতিহত করার সাহস প্রদর্শনে পিছপা হয়নি প্রথম আলো।
নারীর প্রশ্নে প্রথম আলো আপসহীন। নারীর সমস্যা শনাক্ত করায় ক্লান্তিহীন। নারীর অগ্রযাত্রার পথে যেসব বাধা, তা অব্যাহত আলোচনায় আসে। বাল্যবিবাহ-যৌতুকসহ নারীর বিকাশ বিঘ্নিত করে যেসব শত্রু, তাকে প্রতিহত করার পরামর্শ থাকে। যেসব ক্ষেত্রে নারী তাঁর মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর এরই মধ্যে রেখেছেন, যাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁদের সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, যেন অন্য মেয়েরা উদ্বুদ্ধ হন।
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রথম আলোর ভূমিকা অনেকটাই জিহাদি। কোনো আপস নেই, তা যত বড় ক্ষমতাধরই হোক। অ্যাসিডদগ্ধ হোন বা যেকোনোভাবে নির্যাতিত হোন, অসহায় নারীর পাশে প্রথম আলোর অবস্থান অনড়। ফলে মফস্বলের মেয়েদের মধ্যেও প্রথম আলো অতি জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছাতে হলে সাধারণ মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের সমাজে মানুষ নিপীড়িত হয় প্রতিমুহূর্তে। প্রশাসন থেকে অন্যায়-অবিচারের কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। সামাজিকভাবেও দুর্বলের পাশে বিশেষ কেউ দাঁড়ানোর ঝুঁকি নেয় না। বিশেষ করে যাদের দাঁড়ানো উচিত এবং যাদের সামর্থ্য আছে। রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার মূল্য সামান্যই। এ পরিস্থিতিতে দুর্বলের মধ্যে সাহসের সঞ্চার করতে পারে একটি প্রভাবশালী পত্রিকা। প্রথম আলো বিপদের ঝুঁকি নিয়েও দুর্বলের পাশে দাঁড়ায়। অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে। ১৭ বছরে বহু ব্যাপারে দেখা গেছে প্রবলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দুর্বলকে সমর্থন দিয়েছে। অসহায় ও দুর্বলকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে। একটি দৃষ্টান্ত। এক ঘোরতর অন্যায়ের শিকার হয় স্কুলছাত্র লিমন। প্রথম আলো ও আরও দু-একটি পত্রিকা তার পাশে না দাঁড়ালে চরম বিপদে পড়ে সে এবং তার বাবা-মা শেষ হয়ে যেত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রথম আলোর অবস্থান শক্ত।
বহু ব্যাধিতে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ আক্রান্ত। শিশু নির্যাতন তার মধ্যে প্রধান। শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রথম আলোর ক্রুসেড সর্বজনস্বীকৃত। জাতীয় পর্যায়ে দুর্নীতি এক মারাত্মক রোগ। সবচেয়ে বেশি যাঁরা ক্ষমতাবান, দুর্নীতি করার সুযোগ তাঁদের সবচেয়ে বেশি। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রশ্নে প্রথম আলো আপস না করার খেসারত বারবার দিয়েছে।
আমাদের সমাজে নানা দুর্বলতা রয়েছে। নিষ্ঠার অভাব প্রকট। তার ভেতরেও বহু মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। বহু মানুষ জনহিতকর কাজ করছেন। তাঁদের অনেকেই প্রচারবিমুখ। তাঁদের কাজের কথা দেশবাসী জানে না। সেসব কৃতী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে তাঁদের সম্পর্কে প্রচার দেয় প্রথম আলো। বিশেষ করে যেসব তরুণ-তরুণী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ও সৃষ্টিশীল কর্মে সফলতা দেখিয়েছেন, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম আলো অতি উদার।
সামগ্রিক বিশ্বপরিস্থিতি দুই দশক যাবৎ অতি জটিল। বাংলাদেশে একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এবং তার সব প্রতিবেশীই হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মপ্রধান। সব ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদ আজ সারা পৃথিবীতেই প্রবল। বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা বহুকাল থেকেই রয়েছে। তার মধ্যে যোগ হয়েছে রাজনীতিতে ধর্মীয় মৌলবাদ। মৌলবাদকে প্রতিহত না করে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ অসম্ভব। প্রথম আলো
ধর্মীয় মূল্যবোধকে শ্রদ্ধায় রেখে মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরোধিতা করে। বাংলাদেশ একটি সমন্বিত সংস্কৃতির দেশ। এখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ–খ্রিষ্টান প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এক অসাম্প্রদায়িক উদার সমাজ। সেই ধারাটিরই মুখপত্র প্রথম আলো।
যে কাগজ যত বেশি পাঠকপ্রিয় ও প্রভাবশালী, রাষ্ট্রের সব পক্ষই চাইবে তার আনুকূল্য ও সমর্থন। একটি বস্তুনিষ্ঠ কাগজের পক্ষে সবাইকে সন্তুষ্ট করা কঠিন। যে যখন পত্রিকা থেকে সমর্থন কম পাবে, অথবা তার স্বার্থ বিঘ্নিত হবে, তখন তার পক্ষে অসন্তুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। ১৭ বছরে বহুবার প্রথম আলো অনেকের অসন্তুষ্টির কারণ ঘটিয়েছে। কিন্তু পাঠকের আনুকূল্য ও সমর্থনের ঘাটতি ঘটেনি।
এ জগতে কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানই ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। পথ চলতে গিয়ে কখনো প্রথম আলো ভুলও করে থাকবে, কিন্তু ভুল স্বীকার করে সঠিক পথটি বেছে নিতেও মুহূর্ত দেরি করেনি। সে জন্যই তার অগ্রযাত্রা রয়েছে অপ্রতিরোধ্য।
সব কাঁটা উপেক্ষা করে এক আলোকিত জাতি গঠনে প্রথম আলোর ভূমিকা আরও আপসহীন হবে—প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তার একজন পাঠক ও লেখক হিসেবে এই আমার প্রত্যাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.