আবার আমার দেশ by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যখনই বিদেশ ভ্রমণ করি, সদাই সতর্ক থাকি কতটা উপেক্ষিত হচ্ছি। সেই ছোটবেলায় যখন তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়ার সময়ে গ্রীষ্মের ছুটিতে ইউরোপে বেড়াতে যেতাম, তখন কুটিল ইউরোপের জটিল সীমানার কারণে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ট্রেনে ঘুমন্ত আমাদের জাগিয়ে সবুজ পাসপোর্ট এ পাশ-ও পাশ করে দেখে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় মনে করিয়ে দিত আমরা সম্ভবত অনাকাঙ্ক্ষিত দেশের নাগরিক। এই অনাকাঙ্ক্ষার কতটুকু স্বোপার্জিত আর কতটা আন্তর্জাতিক সমাজের চাপিয়ে দেওয়া, এটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। আমি যখন উর্দি-পরা মূর্ত ত্রাস সীমান্ত প্রহরীদের বৈধ পাসপোর্ট আর বৈধ ভিসা নিয়ে অবৈধ উৎপীড়ন মোকাবিলা করার জন্য ভয়ার্ত মনে অপেক্ষমাণ, তখন ১৬ বছরি এক মার্কিন মেয়ে পাসপোর্টের অংশটি পকেটের বাইরে দৃশ্যমান রেখে নিতান্তই অবহেলায় তার চরণযুগল পাদুকাসমেত আরেকটি সিটে উপস্থাপন করে পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রমমান সীমান্ত প্রহরীকে অবলীলায় উপেক্ষা করে চলেছে এবং তাতে যখন সীমান্ত প্রহরী তার ন্যায্য জিজ্ঞাসাটিও করছে না তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সভ্যতার সূতিকাগার ইউরোপও পাশবিক শক্তির পূজারি—এই দোষটি শুধু অশিক্ষিত পুরোনো যুগের জাতিদের মধ্যে নয়।
১। একসময় পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভবন ছিল তাইপেই ১০১। দর্শনের জন্য নিচের দিকের কোনো ফ্লোরে দেখলাম ঘড়ির মতো বৃত্তাকার জায়গায় পৃথিবীর শ খানেকের ওপর শহরের নাম রয়েছে, শুধু নেই বাংলাদেশের কোনো শহরের নাম, যে দেশটি সভ্যতার মুখ্য উপাদান সারা পৃথিবীর মানুষের ২ দশমিক ৪ শতাংশকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা দিচ্ছে এক-সহস্রাংশ ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে। এমনকি কলম্বোর নামও রয়েছে। এমন নয় যে আমাদের অক্ষাংশে আরও গুরুত্বপূর্ণ শহর রয়েছে।
২। সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাংকক থেকে উড়ে এলে বিমানের সিংহভাগ যাত্রী থাকবে বাংলাদেশের সরবরাহকৃত খবরের কাগজে, যা অবশ্যই কোনোভাবে বাংলাদেশি নয়, সব দেশের আবহাওয়ার তথ্য দেবে কিন্তু কোনো অদৃশ্য কারণে বাংলাদেশে যেহেতু আবহাওয়াই নেই আর তথ্য দেবে কীভাবে। সিঙ্গাপুরের আছে, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, দিল্লি আছে। এমনকি কলম্বো আর কাঠমান্ডুও বাদ যায়নি, কোনো কারণে পাকিস্তানও অবহেলার যোগ্য নয়, তবে সিংহভাগ বাংলাদেশের যাত্রীরা যেহেতু নিজেদের আবহাওয়া জানে, তাই অন্য দেশের তথ্য দিয়ে তাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা হয়। এটা কিন্তু শুধু আবহাওয়া নয়, এত বড় দেশের শেয়ারবাজারও কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ নয়, যেমনটি আমাদের খেলাধুলা এবং অন্যান্য বিষয়। একবার আমাদের গলফ খেলোয়াড় সিদ্দিকুর রহমানের খবর পড়ে কী-ই না গর্বিত মনে হয়েছিল নিজেকে।
৩। আরবের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলো আমাদের দেশের যাত্রী পরিবহনে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে আর আমাদের নিজেদের বিমান শুধু লোকসানি খাত। আমাদের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলো শ্রম দিয়ে যে পয়সাটি উপার্জন করে, তার সম্ভবত সিংহভাগ চলে যায় বিমানভ্রমণের খরচে। অথচ সেই যাতায়াতেও তারা সেবা, ভাষা এবং আপ্যায়নে আন্তরিকতার পরশ নেই। ৯০ শতাংশ বাংলাদেশি যাত্রীর জন্য পথনির্দেশক হয়তো অনর্গল হিন্দি বলে যাচ্ছে আর আমাদের সহজ-সরল খেটে খাওয়া মানুষগুলো ভাবছে যে আদর-আপ্যায়ন পেতে হলে অন্য ভাষা জানতে হবে। অনেক দিন আগের কথা, একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে পড়েছিলাম বিমান হতে পারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আয় করা খাত। কেন আমরা সেই বিমানকে ক্ষতিতে নুইয়ে পড়া অবস্থায় দেখছি। আমাদের নেতাদের মধ্যে এমন কেউ সাহসী ও যোগ্য নেই, যিনি দেখিয়ে দিতে পারেন আমরাও পারি। এর জন্য বিদেশি যাত্রীদের ডাকতে হবে না, নিজের দেশের যাত্রীদের দেশের পতাকাবাহী বিমানে উঠতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশের অর্থে আকাশভ্রমণে ভারতে নিজেদের পতাকাবাহী বিমান ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা ছিল, এতে আমাদের গণতান্ত্রিক (স্বেচ্ছাচারিক!) অধিকার কিছুটা ক্ষুণ্ন হলে অসুবিধা কী? এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় ছেলেমেয়েকে যেকোনো স্কুলে ভর্তি করা যায় না, এলাকার স্কুলে ভর্তি করতে হয় তাতে তো আর তারা গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মনে করছে না। এটা কারও ব্যক্তিগত সংগতির ওপর নির্ভর করে না দেশের কল্যাণই এখানে মুখ্য।
৪। শুধু বাইরে বলি কেন দেশেও কিন্তু আমাদের এই সহজ-সরল খেটে খাওয়া জীবনের আনন্দ পরিত্যাগ করা মানুষগুলো যাদের রেমিট্যান্সের সুবাদে বিশ্বের অর্থনৈতিক চরম মন্দার দিনগুলোতেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল ছিল রাজনীতির শাখের করাতে পিষ্ঠ হয়েও এই মানুষগুলো বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশে যাওয়ার পথে এবং ফেরার পথে রীতিমতো নিগৃহীত, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা চলছে তাদের বোর্ডিং কার্ডটি পূর্ণ করে দেওয়ার জন্য বিমানবন্দরে পর্যাপ্তসংখ্যক লোক নিয়োগ করা যেতে পারে, তাদের ভিসা পাসপোর্টে ভুল এই কথা বলে হয়রানির জন্য বড়সড় সাজার ব্যবস্থা করে এই হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের দূতাবাসে কর্মরত সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে এই খেটে-খাওয়া মানুষের পাঠানো রেমিট্যান্সেই তাঁদের বেতন হয়। সুতরাং তাঁদের যেকোনো কাজ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত করে ফেলা উচিত। দূতাবাসের অবহেলায় যদি এই মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে বাংলাদেশও ওই পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
৫। ১৯৯৮ সালের কথা। আমাদের ছেলেরা ভ্যালাডলিদ বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত অনলাইন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় খুব ভালো করার জন্য তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের নগদ অর্থ পুরস্কার দিয়ে উৎসাহিত করেছিলেন। তখনো ওই সাইটের পুল ডাউন মেনুতে অনুল্লেখ্য কিছু দেশের নাম থাকলেও বাংলাদেশের নাম ছিল না। এখনো প্রয়োজনীয় নানা সাইটের পুলডাউন মেনুতে বাংলাদেশের নাম নেই। অস্ট্রেলিয়া তাদের ভিসার কার্যক্রম বাংলাদেশ থেকে তুলে নিয়েছে, কানাডার কথাও একই। ভিসা করতে হলে বাংলাদেশের নাগরিকদের ব্যাংকক কিংবা দিল্লি যেতে হয়, কখনো বা কলম্বো, জিআরই পরীক্ষাও নাকি দেওয়া যায় না।
নানা সীমাবদ্ধতায়, আইনকানুনে বাধা হয়ে যাচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের। এটা নিয়ে ভুক্তভোগীরা উচ্চারণ করতে পারছে না, সরকারও বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিমানের অবতরণেও নাকি নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। আন্তদেশীয় সম্পর্ক সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত, শক্তির তারতম্য দিয়ে নয়।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানাভাবে আমরা জাতি হিসেবে যে বিব্রত, এটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে আমাদের আত্মসম্মানবোধকে বিশ্বদরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নানা দেশের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আমাদের আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হতে হবে, যা ছাড়া জাতীয় প্রতিষ্ঠা হবে কেবলই মরীচিকা।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.