গাজায় ইতিহাসের বর্বর দিন

ইট-কংক্রিট-পাথরের ধ্বংসস্তূপ। এর মধ্যে আসবাবপত্রের টুকরো। তার মধ্যেই স্থানে স্থানে উঁকি দিচ্ছে মানুষের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও রক্তমাখা শরীর। ধূসর ধুলোও রক্তে লাল। তা থেকে বেরোচ্ছে উৎকট গন্ধ। অদূরে মানুষের আর্তচিৎকার আর প্রাণভয়ে দিগি¦দিক ছোটাছুটি। আহতদের আর্তনাদ আর স্বজনের মরদেহ বুকে ধরে আহাজারিতে ভারি হাসপাতালের বাতাস। প্রিয় সন্তানের লাশ বুকে নিয়ে বিধাতার কাছে আর কত আর্জি জানাবেন বাবা, গর্ভে ধারণ করা শিশুকে শুধু চোখের জলে কী করে দাফনের জন্য তুলে দেবেন মা, চোখের সামনে এমন রক্ত-নদে ডুবে কী করে প্রিয় মুখগুলোকে স্বজনরা দেবেন অভয়! না, হল না। ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় গাজায় যে ভয়াবহ বিপর্যয়- কোন ভাষায় তা লেখা সম্ভব? মারকোভা ট্যাংকের গোলা, বিমান থেকে ছোড়া শেল আর পদাতিক বাহিনীর গুলিতে রোববার একদিনেই এখানে প্রাণ হারালেন দেড়শ’ ফিলিস্তিনি। হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে শুরু করতে হল প্রায় দেড় হাজার নিরীহ ব্যক্তিকে। বাড়িঘর আর স্বজন, একসঙ্গে সবই হারিয়ে যে কয়েক হাজার মানুষকে ঠাঁই নিতে হল আশ্রয় কেন্দ্রে- কে কীভাবে এসবের বর্ণনা লিখবে!

বিশ্লেষকরা বলছেন, পাঁচ বছরে তো বটেই, ১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিন-ইসরাইল ভয়াবহ যুদ্ধের পর থেকে একদিনে এমন বিপর্যয় দেখেনি গাজা। আর ইসরাইলি হামলার ১৪তম দিনে এসে সোমবার নিহতের সংখ্যা গিয়ে ঠেকল ৫২৩-এ। আহতের ক্ষেত্রে তা প্রায় পাঁচ হাজার। এ ক’দিনে ৮৫ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন ৬৭ স্কুলে জাতিসংঘের গড়ে তোলা আশ্রয় কেন্দ্রে। ইসরাইলের দাবি, হামাস জঙ্গিদের ওপর হামলা চালাচ্ছে তারা। কিন্তু পরিসংখ্যান প্রশ্ন তুলছে- কোথায় হামাস জঙ্গি? নিহতদের এক-পঞ্চমাংশ অর্থাৎ শতাধিকই শিশু। অর্ধেক, অর্থাৎ প্রায় আড়াইশ’ই নারী। বাকিরাও প্রায় সবাই নিরীহ বেসামরিক পুরুষ। হামাস যোদ্ধাও আছেন- কিন্তু খোদ ইসরাইলের বিবৃতির যোগফল বলছে, তা মাত্র ২৩!
এ অবস্থায় সোমবার গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। মধ্যপ্রাচ্য-সংকট নিয়ে আজ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রুদ্ধদ্বার জরুরি বৈঠক শেষে এ আহ্বান জানানো হয়। এদিন একই আহ্বান জানিয়েছেন ইসরাইলের মিত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। তবু থামেনি ইসরাইলের কামান। পাষাণের বন্দুকের গুলি। বরং সোমবার গাজার উপকণ্ঠ দেইর আল বালায় এক হাসপাতালেও হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। আল-আকসা নামের ওই হাসপাতালে হামলায় অন্তত ৫ জন নিহত ও ৭০ জন আহত হন। গাজায় চালানো ইসরাইলের বিমান হামলায় এদিন এক পরিবারেরই নয় সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সাতজনই শিশু। একটি মোটরবাইকে চালানো হামলায় মারা যান আরেক ফিলিস্তিনি। দক্ষিণ গাজার ১৬ বাসিন্দা এদিন মারা যান বিমান হামলায়। সোমবার এছাড়াও গাজার পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর শেইজিয়া, বাইত হানুনসহ কয়েকটি এলাকায় ইসরাইলি হামলায় মারা গেছেন আরও অর্ধশত ফিলিস্তিনি। এদের প্রায় সবাই নিরীহ নাগরিক।
এর আগে রোববার শুধু শেইজিয়াতেই ইসরাইলি ট্যাংকের গোলায় মারা যান ৭২ জন। সোমবার সকালে এদের ৪৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। রাফায় নিহতের সংখ্যা ১৫। গাজায় বিভিন্ন স্থানে ২০টির বেশি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে সোমবারও, রোববার মারা যান তারা। রোববার যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে মাত্র ১০ জন হামাস যোদ্ধা বলে দাবি করেছে ইসরাইল। তবে হামাসের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বিবৃতি মেলেনি। ইসরাইল আরও জানিয়েছে, হামাসের আক্রমণে তাদের ১৩ সেনা এদিন (রোববার) মারা গেছেন। এর আগে ৫ সেনাসহ ইসরাইলের মোট ২০ জন মারা গেলেন ১৪ দিনে। অবশ্য এদিন হামাসের যুদ্ধ শাখা ইজ্জাদিন আল কাশেম ব্রিগেড দাবি করেছে, শাওল আরন নামে এক ইসরাইলি সেনাকে রোববার বন্দি করেছে তারা। যদিও ইসরাইল এ খবরকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
জাতিসংঘের আহ্বান : জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন গাজায় ইসরাইলের গোলা নিক্ষেপকে ‘অত্যন্ত ন্যক্কারজনক পদক্ষেপ’ বলে বর্ণনা করার পর নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে বসে। রোববার রাতে জর্ডানের অনুরোধে বৈঠকটির আয়োজন করা হয়। নিরাপত্তা পরিষদের সবচেয়ে দুর্বলতম পদক্ষেপ ‘শুধু চাপ দেয়ার’ বিষয়ে একমত হন এর ১৫ সদস্য দেশ। এরপরই বান কি মুন অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানান।
ইসরাইলের পক্ষে ওবামা-ক্যামেরন : নিরীহ নাগরিকদের ওপর ইসরাইলের রোববারের বর্বরতম হামলার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে ফোন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সোমবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন ওবামা। উভয় পক্ষের প্রাণহানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।’ তিন দিনের মধ্যে এ নিয়ে নেতানিয়াহুর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় ফোনে কথা বললেন ওবামা। সর্বশেষ ফোনালাপে ইসরাইলের নিজের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। একই সঙ্গে গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সোমবার মিসরের রাজধানী কায়রো আসেন। সেখানে তিনি মিসর ও অন্যান্য দেশের নেতাদের সঙ্গে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরের বিষয়ে আলোচনা করেন।
মধ্যপ্রাচ্য-সংকট নিয়ে নেতানিয়াহুর সঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও কথা বলেছেন। তিনিও ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
হামাসদের ধ্বংস না করা পর্যন্ত লড়াই চলবে- নেতানিয়াহু : নিজেদেও সেনা নিহতের সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছলেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজায় অভিযান চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সেনা হারানোর ঘটনায় ইসরাইল সরকার ‘গভীর বেদনা’ অনুভব করছে জানিয়ে তিনি গাজার লড়াই আরও দীর্ঘ করার জন্য হামাসকে দায়ী করেন। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের শুরু। এরপর থেকে নিয়মিত রক্ত ঝরলেও আজও তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বাধীন সত্তা মেনে নিতে রাজি নয় ইসরাইল।
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইলের সর্বশেষ হামলার সূত্রপাত ইসরাইলি তিন কিশোরকে সম্প্রতি অপহরণ ও হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। হামাসই ওই ঘটনা ঘটায় বলে মনে করে ইসরাইল। তবে হামাস তা অস্বীকার করে। পরে ফিলিস্তিনি এক কিশোরকে একইভাবে হত্যা ও অপহরণের পর উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়।

No comments

Powered by Blogger.