উপন্যাস- 'রৌরব' (পর্ব-তিন) by লীসা গাজী

(পর্ব-তিন)
এতো দুড়দাড় করে ওঠার পরও বিউটির উপস্থিতি ফরিদা টের পেলেন না। তিনি তখন কায়মনবাক্যে কাক তাড়াতে ব্যস্ত। এক সময় কাকটা ক্লান্ত হয়ে পাশের বাড়ির ছাদে গিয়ে বসলো কিন্তু ডাক থামালো না। এমন হঠাৎ রণে ভঙ্গ দেয়ায় ফরিদা বোকার মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন, টের পেলেন ব্লাউজের ভিতরটা ভিজে চুপচুপা হয় গেছে। ছাদের রেলিং ধরে কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। বুকের ধড়ফড়ানি সহ্যের মধ্যে আসলে ধীরে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেলেন। যদিও তার এক দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিলো, তবুও দরজা ভিড়ালেন, চাবি লাগালেন তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন। কাকে দেখাবার জন্য যে তিনি নিজেকে শান্ত সমাহিত করবার চেষ্টা করলেন কে জানে। হয়তো নিজেকে দেখাবার জন্যই — মানসিক জোর এখনও বহাল আছে, এত সকালে তিনি মাথা নোয়াবেন না, এই তথ্য নিজেকে জানানো জরুরি ছিলো । ঘরে ঢুকে ফরিদার চোটপাট দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। ছোট মেয়ের ঘর থেকে টিভির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, সোজা সেখানেই গেলেন।

সিনেমার বদল হয়েছে। বিউটি আধশোয়া হয়ে এখন ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ দেখার ভাণ করছে। যদিও এই সিনেমা তার অন্তত দশবার দেখা আছে। ফরিদাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বিউটি হাসবে, নাকি পাত্তা না দিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকবে মনস্থির করতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত মায়ের দিকে তাকালো।

— উঠ্, সিনেমা বন্ধ কর।

— কেন?

— কাজ নাই, কাম নাই শুধু সিনেমা! ফাজিলের বাচ্চা ফাজিল।

— কী কাজ করবো?

— কুনো কাজ না থাকলে হাঁটাহাঁটি কর। শুইয়া থাকতে থাকতে মাজা ব্যথা করে না?

— না করে না।

তর্ক করার কোনো ইচ্ছা এই মুহূর্তে বিউটির ছিল না, বাড়িতে এত লোক থাকতে ফরিদা যখন তার উপরেই চড়াও হলেন তখন আবার শিরায় শিরায় রাগ অনুভব করলো সে।

— সামনে থিকা সরেন, আপনের জন্য সিনেমা দেখতে পারতেছি না।

এবার ফরিদা একাই কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন বিউটির দিকে, বিউটি ভ্রূক্ষেপ করলো না। কী একটা সংলাপে জোরে শব্দ করে হাসলো। ফরিদা যথারীতি স্বাভাবিক হয়ে গেলেন।

— অনেকবার দেখছস না, এখনও হাসি আসে? বেকুবের বেকুব।

— হাসির সিনেমা হাসবো না তো কি মুখ গোঁজ কইরা বইসা থাকবো।

আলনার উপরের এলোমেলো কাপড় ফরিদা গুছিয়ে রাখছিলেন। মায়ের দিকে আড়চোখে একবার দেখে নিলো বিউটি। ছাদের ব্যাপারটা মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না। অথচ ফরিদাকে এখন দেখে বুঝবার জো নাই অল্প আগে তার কী বেদিশা অবস্থা গেছে।

— তোর আব্বা বাড়িতে যাবে?

— কোন বাড়িতে?

— তোর দাদার বাড়িতে। এতদিনে শরিকরা খবর দিছে তোর বাপে নাকি কিছু পাবে। বেশিরভাগই তো মইরা ভূত। আমি কই কী, দরকার নাই। একা একা যাবে, বয়স হইছে, পথে ভালো-মন্দ কিছু হইয়া গেলে তো গেলোই।

— আপনে আপারে কেন একা যাইতে দিলেন?

— আমি নিজেও জানি না।

সকাল থেকে এই প্রথম ফরিদা সত্য কথা বললেন। তিনি আসলেই জানেন না তার কেন এই মতিভ্রম হলো। এটা কি কোনো কিছুর আলামত। একটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে তারই ইঙ্গিত!

— এখন যদি আপা আর বাড়িতে ফিরা না আসে।

— এত কুকথা তোর মাথায় আসে কেমনে? বাড়িতে ফিরবো না তো যাইবো কই? যাওনের জায়গা কি আছে, জায়গা থাকলে তুই ঠিকই জানবি, এণ ক’ আছে?

— থাকতেও পারে।

থাবা মেরে বিউটির থুতনি চেপে ধরেন ফরিদা। বিউটির আমোদ লাগে। মায়ের প্রতি যে দুঃখবোধ অল্পণ আগে সে অনুভব করেছিলো তার ছিটেফোঁটাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তার চোখ আর হাসি দেখেই বুঝে যান ফরিদা যে মেয়ে তাকে ধাপ্পা দিচ্ছে। হিসহিসিয়ে উঠেন, “শয়তানের শয়তান, তোর দিন ঘনাইছে…!”

— দিন সবারই ঘনাইছে, সবচেয়ে বেশি ঘনাইছে আপনের।

থুতনি ছেড়ে দেন ফরিদা। বিউটি সিনেমা দেখায় মন দেয়, এই জায়গাটা খুব মজার।

ফরিদা বিউটির ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

— আম্মা, রাবেয়ার মাকে বলেন ডাইল বাইটা ফ্রিজে রাখতে। ডাইল বাটা আর নাই।

— আচ্ছা, বলবো নে।

ফরিদা আবার ফিরে আসেন।

— কয়টা বাজে? নামায পড়বি না?

নামাযের কথায় বিউটি তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। ওযু নাই ওযু করতে হবে। ফরিদাও নিজের ঘরের দিকে গেলেন। নামায পড়ে তারপর ইলিশ-পোলাও বসালেই চলবে।

ফরিদা ঘরে ঢুকে চোখ বন্ধ করে টানটান হয়ে কিছুণ শুয়ে থাকলেন। শুয়ে থেকেই তার মনে হলো, মোবাইল ফোনটা অন করতে হবে। কার ভয়ে ফোন অফ করে রেখেছেন! আলতু ফালতু মানুষের ভয় ফরিদা খানম করেন না। আস্তে ধীরে বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের কাছে আসলেন। নিজের প্রতিচ্ছবি আয়নায় দেখে টের পেলেন কত সুন্দরী ছিলেন তিনি!

সময় আর অবস্থার ফেরে এক সময়ের কাঙ্ক্ষিত মানুষও এক সময় তুচ্ছ হয়ে যায় — সেজন্য কোনো শস্তা অপরাধবোধে ভোগেন না ফরিদা। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ জীবনের মোড়ক দিতে যা করার দরকার তিনি করেছেন। তার মনে কোনো পাপবোধ নাই। কেন থাকবে, তবে এতোদিন পরে এই উপদ্রব উপস্থিত হওয়ায় উৎকণ্ঠা বোধ করছেন।

মোবাইল ফোনের সুইচ অন করলেন। সমস্যাকে এড়িয়ে গেলে সমস্যা আরও জাঁকিয়ে বসবে, সুতরাং মুখোমুখি হওয়াই ভালো। দেখা যাক, কার দৌড় কতো দূর।

মুখলেস সাহেব ঘরে ঢুকলেন, তিনিও নামায পড়বেন। স্ত্রীর থমকানো রূপ দেখে দ্বিতীয়বার তাকালেন। ফরিদাকে বিচলিত দেখাচ্ছে, ভাবলেন কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পেলেন না। আজকে এমনিতেই অনেক কিছু প্রথমবারের মতো ঘটছে। এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না কিভাবে ফরিদা লাভলিকে একা ছেড়ে দিলেন।

— বশির ফোন করছিলো।

— বশির কে?

— ইয়ার্কি করো না কি? বশির কে তুমি জানো না?

এইসব কী ঘটছে, এতদিন পরে বশির কী চায়? মুখলেস সাহেবের চেহারা ঝুলে পড়লো। তার ঝামেলা ভালো লাগে না। বারান্দায় পা নাচিয়ে হিন্দি গান শুনবেন, দুই একটা সিনেমা দেখবেন, মাঝে মধ্যে বাজার করে আনবেন, ভালো-মন্দ দু’টা খাবেন — এইভাবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারলেই তিনি খুশি। এ আবার কী যন্ত্রণা!

— কী চায়?

— আহাদ উথলাইয়া উঠছে। লাভলি, বিউটিরে দেখতে চায়। দেখাইতাছি, খেজুরের কাঁটা দিয়া দুই চোখ যদি না গালাইছি আমার নাম ফরিদা না।

মুখলেস সাহেব ফরিদার এই উগ্র মূর্তির সামনে থাকতে চাইলেন না। সুরুৎ করে বাথরুমে ঢুকে গেলেন, ওযু করতে হবে। তার এর মধ্যে না থাকাই ভালো, ফরিদা ঠিকই সব সামলে নিতে পারবেন। শুধু শুধু তিনি থেকে আরও ঝামেলার সৃষ্টি করবেন। এবং আশ্চর্য মুখলেস সাহেব আর দুশ্চিন্তাও বোধ করছেন না। অবশ্য সেটাও বিপজ্জনক। চিন্তিত চেহারা অন্তত ফরিদার সামনে দু’একদিন ধরে রাখতে হবে।

আধমরা মানুষটাকে কেন যে বলতে গেলাম — ফরিদার নিজের উপর বিরক্ত লাগছে। এখন সে আসলে মনে মনে চাইছে যাতে আবদুল বশির ফোন করে। এসপার-ওসপার একটা হয়ে যাক। লাভলি বিউটিকে দেখে সে কী কচুটা করবে? তার কাছে নিয়ে রাখতে পারবে, তার ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজনদের আসল কিচ্ছা বলতে পারবে? তাহলে ফরিদার ভয়টা কিসের?

— খালাম্মা, রান্না বসাইবেন না?

— আসতাছি, নামায পইড়া আসতাছি; তুমি যাও। বারান্দার ফুলগাছে পিচ্চি পানি দিছে? না দিলে এণ দিতে কও।

ফরিদা মুখলেস সাহেবের জন্য অপো করতে থাকেন। মুখলেস সাহেব বাথরুম থেকে বের হলে এই নিয়ে আর দ্বিতীয় বাক্য বলবেন না বলে মনস্থির করলেন ফরিদা।

* * *

লাভলির জন্ম হলো সকাল আটটা বত্রিশ মিনিটে। দিনণ সব কিছু মুখলেস সাহেব সবুজ মলাটের একটা খাতায় লিখে রেখেছেন। জন্মের দু’তিন দিন পরে বড় ভাবি হাসতে হাসতে বললেন, “আমাগো ফরিদা আর দুলামিয়া দুইজনের গায়ের রঙই তো মাশাল্লাহ পরিষ্কার। এই মাইয়া এতো কালা-কুলা হইলো কোই থিকা?”

মন্তব্য মাটিতে পড়তে পারলো না, তার আগেই ফরিদার আম্মা পয়মন্ত মেঝো বউ বাঘের ক্ষীপ্রতায় কথাটা ধরে ফেললেন।

— না, এত কালা থাকবো না। রঙ খুলবো দেইখো নে। অবশ্য আমার শ্বশুর মশায়ের রঙ আবলুশ কাঠের মতো কালো ছিলো। আম্মার কথার উত্তরে বড় ভাবি লজ্জা পেয়ে জিভ কাটলেন। বেশ আশ্চর্যও হলেন। কারণ এইসব ছোটখাটো কথাবার্তায় আম্মা কখনই অংশগ্রহণ করেন না। এবং এও তিনি জানেন তার দাদা শ্বশুর মোটেও আবলুশ কাঠের মতো কালো ছিলেন না। তাকে তিনি দেখেছেন। তখন কবরে পা দু’টাই দিয়ে রেখেছিলেন যদিও তবুও স্পষ্ট মনে পড়ে তার গায়ের রঙ মোটেও কালো ছিলো না, আর আবলুশ কাঠের মতো তো না-ই। সেই দিনের পর থেকে ফরিদার মা মুখলেস সাহেবের সাথে নবজাত লাভলির চেহারার যে কতো মিল তা প্রমাণ করবার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। তিনি এমনকি হাসি আর চাউনিতেও মিল খুঁজে পেলেন।

* * *

মুখলেস সাহেব বাথরুম থেকে নিঃশব্দে বের হলেন, তারপরও ফরিদার চিন্তায় ছেদ পড়লো, তিনি খুশিই হলেন, আজাইরা চিন্তা যত কম করা যায় ততই ভালো। ফরিদার সাথে চোখাচোখি হবার সমস্ত সম্ভাবনা সমূলে উপড়ে ফেলে সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন নামাযের জায়গায়। এই ঘরে দু’টা জায়নামায সব সময় বিছানো থাকে। শুধু সেজদা দেয়ার জায়গাটা একটু মোড়ানো থাকে, পড়বার সময় সোজা করে নেন। মুখলেস সাহেব উবু হয়ে জায়নামায সোজা করলেন, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নামায শুরু করলেন। ফরিদা এক মনে মুখলেস সাহেবকে ল্য করছিলেন। এবার তিনিও ওযু করার জন্য বাথরুমে ঢুকলেন। ওযু করতে গিয়ে বারবার তার ভুল হচ্ছিলো। তিন বারের বার ওযু নির্ভুলভাবে শেষ করে ফরিদা বাথরুম থেকে বের হলেন।

নামায শেষ করে মোনাজাতের জন্য হাত তুলে অনেকণ বসে রইলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট করে আল্লাহ’র কাছে কিছু চাইলেন না। হঠাৎ নিজেকে খুব ছোট লাগলো, আল্লাহ’র কাছে চাইতেও ছোট লাগলো। কঠিন জিদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। না, কারও কাছেই কিছু চাইবেন না, খোদাতা’য়ালার কাছেও না। যে জটিল জীবন তিনি পার করেছেন এর চেয়ে জীবন আর কত জটিল হওয়া সম্ভব। হলে হবে, তিনিও দেখে ছাড়বেন।

জায়নামায ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ফরিদা। উবু হয়ে প্রান্তটা একটু মুড়ে রাখলেন। নিজের অজান্তেই তওবা কাটলেন তারপর ওয়াড্রোবের সামনে গিয়ে একদৃষ্টে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেলো, ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। যেন তার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে কেউ হেরে গেছে।

বিউটি নামায শেষ করে আবার সিনেমা ছাড়লো কিন্তু এবার আর দেখতে ভালো লাগলো না। কাহাতক একই দৃশ্য দেখে হাসা যায়। টিভি, ডিভিডি বন্ধ করে দিলো। ঘড়ির দিকে তাকালো, একটা বেজে পাঁচ। আপার আসতে দেরি নাই। আল্লায় জানে কী হাবিজাবি সব কিনে আনবে। কিছুই যে পছন্দ হবে না এই ব্যাপারে বিউটি নিশ্চিত। লাভলির পছন্দের সাথে বিউটির পছন্দ কখনই মেলে না। লাভলির সব সময় চাপা রঙ পছন্দ, বিউটির পছন্দ চড়া: লাল, ম্যাজেন্টা, হাওয়াই মিঠাই — এইসব। বিউটি চুল ছেড়ে রাখে, কখনও একটা বেণী করে, লাভলির চিরকালীন চুলের স্টাইল দু’পাশে দু’টা লম্বা বেণী। লাভলির কোনো ছিরিছাঁদ নাই। বিউটি সাজে, চিমটা দিয়ে ভ্রূ তোলে, নখে নেল পালিশ দেয়। লাভলির রিয়াজকে ভালো লাগে, বিউটি ভেবেই পায় না রিয়াজের মধ্যে ভালো লাগার কী আছে। রিয়াজকে পছন্দ না করলেও বিউটি এটাও সহ্য করতে পারে না যে রিয়াজ তাকে বাদ দিয়ে লাভলিকে পছন্দ করেছে। তবে হিসাব করলে বিউটির কাউকেই পছন্দ না। তার সবচেয়ে অপছন্দ মুখলেস সাহেবকে। কেন তা সে নিজেও জানে না। নিজের বাবার প্রতি এই তীব্র ঘৃণা তার কীভাবে জন্মালো এই নিয়ে বিউটির কোনো ধারণা নাই। অবশ্য এই খবর বাড়ির কেউ জানে না। কারণ সে যেমন কাউকে পছন্দ করে না তেমনি কাউকে বিশ্বাসও করে না। নিজের ঘরটাই বিউটির সবচেয়ে পছন্দের। ঘরেই থাকতে ভালো লাগে তার। বাইরে বের হওয়া তো দূরের কথা অন্য ঘরে যেতেও বেশি ইচ্ছা করে না। তবে চাইনিজ খাবার ব্যাপারে সে সব সময় এক পায়ে খাড়া। ফরিদা, লাভলি আর বিউটি মাসে অন্তত এক বার চাইনিজ খেতে যায়। সেই সময়টুকু নিজেকে তার খুব সুখী সুখী লাগে।

আজকে আপার সাথে খেলাটা খেলবে, … ভাবছে বিউটি। আজকে খেলাটা একটু পাল্টে দিলে কেমন হয়। আজকে খেলবে আপার ঘরে, আম্মাকে টারগেট না করে আব্বাকে টারগেট করবে। দেখি সে না আপা কে আব্বাকে বাগে পায়। একবার আপা আব্বা হবে, একবার সে নিজে।

খেলার প্রসঙ্গে চিন্তা করতে করতে উত্তেজনাবোধ করলো বিউটি। রান্নাঘর থেকে ইলিশ-পোলাওয়ের অসহ্য গন্ধ নাকে লাগলো। এই জিনিস একটু পরে খেতে হবে ভাবতেই উটকানি এলো। কার জন্মদিনে যে সে প্লাস্টিকের টেবিল কথ টেনে সব খাবার ছত্রখান করবে আল্লায় মালুম। আজকে সে এই বালের পোলাও ছুঁয়েও দেখবে না, হাঁসের মাংস দিয়ে খাবে। খাবারের কথা মাথায় ঢুকতে খিদা পেয়ে গেলো। কিন্তু আপা না আসা পর্যন্ত তো খাওয়া যাবে না; অবশ্য আসতে বেশি দেরিও নাই।

খাবারের গন্ধে গন্ধে বিউটি হালকা পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পিচ্চি টেবিল লাগাচ্ছে আর গুনগুন করে কী একটা গাইছে। জিনিসটা পিচ্চি এনেছে কি না কে জানে। আজকে না আনলে কপালে দুর্গতি আছে। শয়তান তিন দিন ধরে আজকে না কালকে, কালকে না আজকে করছে। জিনিসটা এমন কোনো সাংঘাতিক কিছুই না, গাঁজার পোটলা। বিউটি মোটেও গাঁজারু না, মাঝে মধ্যে বাথরুমে গিয়ে টানে, ভালো লাগে। পিচ্চি-ই প্রথম এনে দিয়েছিলো — বহুত সেয়ানা। আজ প্রায় বছর খানেক ধরে চলছে এই টানাটানি। এইসব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে তার হঠাৎ মনে পড়লো আপাকে আব্বা নিশ্চয়ই আজকে টাকা দিয়েছেন। অন্তত শ’খানেক টাকা আপার কাছ থেকে উদ্ধার করতে হবে।

প্রতি মাসে ফরিদা লাভলি আর বিউটিকে এক হাজার করে টাকা দেন। লাভলির টাকা লাভলির কোনো কাজেই লাগে না বলতে গেলে। মাঝে মধ্যে কোন্ আইসক্রিম বা ফুচকা আনিয়ে খায়, বাসার সামনের কুপারস-এর পেস্ট্রিও ওর খুব পছন্দ — সে আর কত টাকা, বাকিটা বিউটির পিছনেই খরচ হয়, তবে খাবার-দাবারও বেশিরভাগ বিউটির পেটেই যায়; — আর কুপারস-এর পেস্ট্রি যখন আনা হয় তখন মুখলেস সাহেব পর্যন্ত বিগলিত হয়ে যান। ডায়বিটিসের কারণে মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়া তার জন্য বিষতুল্য। কিন্তু পেস্ট্রি তাকে দিতেই হয় এবং তা ফরিদাকে লুকিয়ে। তারপরও বিউটির টাকা মাস না পুরাতেই হাওয়া। ডিভিডি কিনে আনে প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুই তিনটা। বেশির ভাগ সময় লাভলিই ফরিদার সাথে গিয়ে নিত্য নতুন হিন্দি সিনেমা নিয়ে আসে। এছাড়া বাসায় বিউটি তিনটা সিনে ম্যাগাজিন রাখে, দু’টা বলিউডের একটা দেশি। যদিও সে রাখে পড়ার বেলায় মুখলেস সাহেবও বাদ যান না। অসহ্য!

মুখলেস সাহেব বিউটির কিছু ব্যবহার করলে চামড়ার নিচ পযন্ত চিড়বিড় করতে থাকে তার। অথচ চমৎকার অভিনয়ের কারণে বাড়ির কেউ ব্যাপারটা ধরতে পারে না। এই যেমন পেস্ট্রি যখন আনা হয়, তখন বিউটি তার ভাগের থেকে প্রায় অর্ধেকটা মুখলেস সাহেবকে দিয়ে দেয়। কিছুতেই লাভলিকে দিতে দেয় না।

— থাক আপা, তোমারও পেস্ট্রি পছন্দ আব্বারও, আমার অতো ভালো লাগে না। আমার থিকাই দেই।

এই চরিত্র বহির্ভূত আদরে লাভলির মন ভিজে যায়। মুখে শুধু বড় বড় কথা, ভিতরটা আদতে নরমই — শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় ও। আর তখন বিউটি ভাবছে, ‘খা বুড়া, খায়া মর। পারলে আস্তো একটা কেক মুখে ঠুইসা দিতাম।’

পিচ্চি আচারের বাটিতে আচার নামাচ্ছে। ইচ্ছা করে একবারও বিউটির দিকে তাকাচ্ছে না।

— এই শয়তান মোমবাতি আনছস? তিনদিন ধইরা মোমবাতি আনতে বলি কানে যায় না?

মোমবাতি হচ্ছে গাঁজার ছদ্মনাম। অনেক ভাবনা চিন্তার পর এই নামটাই সন্দেহাতীত বলে মনে হয়েছে বিউটির। যে হারে ইলেকট্রিসিটি যায় একমাত্র মোমবাতিই ঘন ঘন আনানো যেতে পারে। ফরিদা রান্না শেষ করে খাবার ঘরে ঢুকলেন।

— এখন মোমবাতির কী দরকার? আমার ঘরে আছে, যা নিয়া আয়।

— না, আপনের মোমবাতি নিব কোন দুঃখে। ওরে আনতে বলছি আনছে কি না দেখি। না, আনলে ওর একদিন কী আমার একদিন। এই বদমাইশ আনছস?

— হ আনছি। আপনের ঘরে রাইখা আসছি।

— আমার ঘরে কখন রাইখা আসছিস?

— আপনে যখন ছাদে গেলেন।

— তুই ছাদে কখন গেলি?

— আপনে যখন কাকের পিছে পিছে ঘুরতেছিলেন।

বিউটির উত্তরে ফরিদা মুহূর্তণ থমকে গেলেন, দ্রুতই আবার তা কাটিয়ে উঠলেন।

— তোদের না বলছি আমারে না জিজ্ঞাস কইরা ছাদে যাবি না।

— আপনে তখন ছাদে, আপনেরে জিজ্ঞাস করবো কীভাবে? রাবেয়ার মা বললো আপনে ছাদে, সেইটা শুনে গেলাম।

ফরিদা এই কথার আর উত্তর দিলেন না। কঠিন চোখে একবার তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। তাতে বিউটির কিছু এলো গেলো বলে মনে হলো না। সেও মোমবাতি নামের গাঁজার পোটলার খোঁজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে সে প্রথমে দরজা বন্ধ করলো। তারপর যথারীতি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার পিছনে গুঁজে রাখা পোটলা বের করলো, দু’টা ছিলো। একশ’ পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিলো, হারামির বাচ্চা হারামি মাত্র দু’টা পোটলা নিয়ে এসেছে। আমার সাথে ফাইজলামি করে। তোর ফাইজলামি বার করতাছি, দাঁড়া — কথাগুলো জোরেই বলে উঠলো বিউটি। আয়নার পিছনে পোটলা দু’টা আবার গুঁজে রাখলো। রাত্রে খাবে মনে মনে ঠিক করলো বিউটি। আর তুণি বসার ঘরের দেয়াল ঘড়ি জানান দিলো দু’টা বাজে। দু’টা বাজে এই উপলব্ধি বিউটিকে অসাড় করে ফেললো। হাতে-পায়ে জোর আসতেই দৌড়ে দরজাটা খুললো। আপা এখনও আসে নাই — দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো কাঠের পুতুলের মতো। ফরিদাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এক পা দু’পা করে মায়ের ঘরের দিকে এগোলো বিউটি।

অনেকণ ধরেই ভিতরের অস্থিরতা ফরিদার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিলো। মনে মনে তার জানাই ছিলো অন্তত দু’টা বাজার পনেরো মিনিট আগে লাভলি ঠিকই বাসায় ঢুকবে। এখন দু’টা বেজে গেছে, লাভলি ফেরে নাই। সে এখন কী করবে, কোথায় গিয়ে খুঁজবে। — না না, বাইরে তাকে শান্ত থাকতে হবে। ভিতরের তোলপাড় কেউ যেন ঘুণারেও টের না পায়।

বিউটি মায়ের ঘরে ঢুকে দেখলো ফরিদা রাস্তার দিকের জানালার পাশের বেতের চেয়ারে স্থানুর মতো বসে আছেন। নড়চড়হীন। বিউটি যে ঘরে ঢুকেছে এই বোধও আছে বলে মনে হলো না। মুখলেস সাহেবকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। দু’টা বাজার শব্দ শুনেই হয়তো কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছেন। এখন শুধু কেয়ামতের অপো!

এক সময় ফরিদা বিউটির উপস্থিতি টের পেলেন। দু’জন নিঃশব্দে দু’জনের মুখের দিকে খানিকণ তাকিয়ে থাকলো। নীরবতা ভাঙলো বিউটি।

— আম্মা খিদা লাগছে খাবো না?

— হ্যাঁ, রাবেয়ার মা’কে টেবিলে খাবার দিতে বল। টমেটোর সালাদ করে দিতে বলিস।

— আচ্ছা।

— তোর আব্বা কই দেখ, টেবিলে আসতে বল। তার বেলা করে খাওয়া ঠিক না।

স্বাভাবিক থাকার চেষ্টায় ফরিদার কথাগুলি ভাবলেশহীন কাটা কাটা শোনালো। দু’জনের কেউ লাভলি প্রসঙ্গে একটা কথাও বললো না। যেন এই বাড়ির মেয়েরা নিত্যই একা বাইরে যাচ্ছে আর আসবার সময় পার হয়ে গেলেও ফিরে আসছে না। বিউটি রাবেয়ার মাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে বেরিয়ে গেলো। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলো প্রায়, চকিতে দরজা ধরে নিজেকে সামলে নিলো, তারপর পিছন ফিরে ফরিদার দিকে তাকিয়ে ‘কী যে করি’ টাইপ একটা কুণ্ঠিত হাসি দিলো, আড়ষ্টভাবে মাথা চুলকালো। ফরিদা কিছুই বললেন না। হাসির জবাবে বরং তার চিন্তিত ভ্রূজোড়া আরও ভীষণ রকম বেঁকে গেলো।

তিনি অমঙ্গল চিহ্ন এখন চারিদিকে দেখতে পাচ্ছেন। অলীর একশেষ, হোঁচট খাওয়ার আর সময় পেলো না! ধাড়ি শয়তান। মনে মনে কথাগুলি কয়েক বার আওরালেন। দেয়াল ঘড়ির দিকে আরেকবার অবিশ্বাস নিয়ে তাকালেন। দু’টা সাত বাজে। এটা কী ভাবে সম্ভব।

বিউটি যতোটা পারা যায় নিজেকে সামলে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেখলো রাবেয়ার মা টমেটোর সালাদ বানাচ্ছে। বলার আগে কাজ করাও ফরিদা পছন্দ করেন না, মাতব্বরি তার দু’চোখের বিষ — তাহলে বলার আগেই রাবেয়ার মা সালাদ বানাচ্ছে যে বিষয় কী?

— রাবেয়ার মা কী করো?

— সালাদ কাটি ছোটো আফা, টমেটোর সালাদ।

— সালাদ বানাইতে কি আম্মা তোমারে বলছে?

— না বলেন নাই, কিন্তুক প্রত্যেক বছর আপনেদের জন্মবারে টমেটোর সালাদ বানাই। শসা দেওন যাবে না, শুধু টমেটো।

— নিজে থিকা মাতব্বরি করবা না। না বলা পর্যন্ত কোনো কাজ করবা না। বুঝলা?

— জে। টমেটোর সালাদ খাইতেন না?

— খাবো না কেন খাবো। আলগা মাতব্বরি করবা না এইটাই বললাম। মনে থাকবে?

— হ থাকবো।

— টেবিলে খাবার দাও। পিচ্চি কই?

— বাথরুম ধোয়।

পিচ্চিকে ধরতে হবে, একশো পঞ্চাশ টাকায় ছোট ছোট মাত্র দু’টা পোটলা কেন এর একটা বিহিত করতে হবে। শস্তা নাকি! যার যা খুশি করবে!

হনহন করে বিউটি নিজের ঘরে গেলো। উল্টা দিকের দেয়াল ঘড়ি কটকট করে তাকিয়ে আছে আর যেন তাকেই ব্যঙ্গ করছে। দেখ বিউটি দেখ, এত যে তোমার চোপা অথচ তুমি যা পারো নাই, তাই তোমার চোখের সামনে ‘শান্ত শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট’ বোন করে দেখাচ্ছে। তোমার জারিজুরি সব শেষ!

সেই মুহূর্তে বিউটির অসহ্য ক্রোধ হলো নিজের উপর, অসহ্য। সে কি না বাড়িতে বসেই কাটালো এতগুলি বছর। বসে কাটাবে না তো কী, তাকে তো কেউ টেনেও বের করতে পারে না বাড়ি থেকে। তার এতো কীসের ভয়! এই দম আটকানো চার দেয়ালের বাইরে তার অবস্থা কেঁচোর মত কেন। নিজের উপর ঘৃণায় হতাশায় গা রিরি করতে লাগলো। বাড়ির ভিতরেই যত হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা নইলে বাড়ির বাইরে বাচ্চাদের মতো নিরাপত্তাহীন আর অসহায়। এই সত্য প্রথম উপলব্ধি করে এতটুকু হয়ে গেল সে। পিচ্চিকে দাবড়ানি দেবার ইচ্ছা তার ভিতর থেকে সম্পূর্ণ লোপ পেলো।

পিচ্চি বাথরুম থেকে বের হলো তারপর ছোট আপার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জানতে চাইলো পোটলা পেয়েছে কি না। পিচ্চির সাহসে বিউটি স্তম্ভিত। দেখা যাচ্ছে এই বাড়িতে সে ছাড়া মোটামুটি কারুরই সাহসের কমতি নাই।

— মাত্র দুইটা পোটলা কেন?

— হাকিম ভাইয়ের কাছে স্টক নাই। নিজের থিকা দিছে। আরও দুইটা পাইবেন।

— পুরা টাকা দিলি কেন তাইলে?

— পুরা টেকা দেই নাই। আমার কাছে আরও দুইটার দাম আছে। আপনেরে ফিরত দেই নাই, কাইল পরশু গিয়া নিয়া আসুম।

— আব্বারে ডাক দে, বল টেবিল লাগানো হইছে।

— বড় আফায় কই গেছে? এখনতরি আসে নাই।

— ফড়ফড় করবি না, শয়তান… যা, এণ এই ঘর থিকা যা।

— না, চিন্তা হইতেছে দেইখা জিগাইলাম।

পিচ্চি ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই বিউটির প্রবল ইচ্ছা করলো বাথরুমে ঢুকে গাঁজার কাঠি বানিয়ে বড়সড় একটা টান দিতে। কিন্তু এখন দেয়া যাবে না, যেকোনো মুহূর্তে খেতে যাবার জন্য ডাক পড়বে। শালার জীবন, কিছুই নিজের ইচ্ছা মতো করা গেলো না!  ওদের খাবার ঘরটা ছোটোর মধ্যে নিঁখুতভাবে গোছানো। এটাকে ঠিক পরিপূর্ণ কোনো ঘর বলা যাবে না, বিভিন্ন ঘরে যাওয়ার জন্য একটা কমন জায়গা বলা চলে। রান্নাঘর থেকে বের হলেই খাবার জায়গা আবার রান্নাঘরের উল্টা দিকে পাশাপাশি দু’টা দরজা। একটা লাভলির ঘরের দরজা অন্যটা বিউটির। দু’টা ঘর ছাড়িয়ে গেলে ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মাথার মতো আরও দু’টা ঘর শেষ মাথার দুই প্রান্তে। বাঁয়ের ঘরটা বসার ঘর আর ডানেরটা ফরিদা আর মুখলেস সাহেবের শোবার ঘর। এই বাসার সবচেয়ে বড় ঘর সেটাই। বসার আর ফরিদাদের শোবার এই দু’টা ঘরই রাস্তার দিকে মুখ করে। অবশ্য ফরিদার ঘর থেকে যতো স্পষ্টভাবে রাস্তা দেখা যায় ততোটা বসার ঘর থেকে দেখা যায় না। যাই হোক, সেই খাবার জায়গায় একটা ছয়-সিটের ডাইনিং টেবিল বসানো। টেবিলের মাথায় মুখলেস সাহেবের নির্দিষ্ট জায়গা। তার বাঁ দিকে ফরিদা, ফরিদার পাশে লাভলি বসে, বিউটি ফরিদার উল্টা দিকের চেয়ারে বসে। এছাড়া একটা মিটসেফ আছে, ফ্রিজও এখানেই রাখা। বাঁ দিকের দেয়াল জুড়ে একটা আজমির শরিফের ছবি বাঁধানো।
ইতোমধ্যে খাবার দেয়া হয়ে গেছে, বেশ ধোঁয়া বের হচ্ছে। খাবারের ম ম গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বিউটির পক্ষে আর বেশিক্ষণ খিদে আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সে বেশ মরিয়া হয়ে উঠলো। সে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে পড়লো আর সেখান থেকেই জোরে ফরিদাকে ডাকলো। মুখলেস সাহেবকে ডাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা না থাকলেও ডাকতে হলো। কারণ তিনি এসে না বসা পর্যন্ত খাওয়া শুরু করা যাবে না। নিঁখুত হতে হবে, সবকিছু নিখুঁত।

— চিল্লাচিল্লি করতেছিস কেন?

—খিদা লাগছে। দুইটা বাজছে অনেক ক্ষণ।

এটা সে কী বললো, এটা কী মনে করিয়ে দেবার মতো কোনো কথা। এই কথার পর মা, মেয়ে দু’জনেই দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালো। সেখানে অবশ্য পোনে একটা বেজে ঘড়ির কাঁটা বছর খানিক ধরে দম নিচ্ছে। আল্লাহ’র রহমত! দু’টা বাজার পরেও ঘড়ির কাঁটা ছুটে চলেছে এই দৃশ্য না দেখাই ভালো।

—রাবেয়ার মা, বলছি না খাওয়ার সময় কাছে থাকবা। লাভলির প্লেটটা সরাও।

রাবেয়ার মা ইতস্তত করে লাভলির প্লেট সরালো। ফরিদা বিউটির দিকে তাকিয়ে কারণ ব্যাখ্যা করলেন।

—খালি প্লেট দেখতে ভালো লাগে না।… লাভলি আসলে প্লেট আবার দিয়া যাইও।

শেষের কথাটা রাবেয়ার মা’কে উদ্দেশ্য করে। মিটসেফের ভিতরে প্লেট রাখতে গিয়ে ফরিদার কথা শুনে সে উপরে রাখলো।

—খালুজানরে ডাক দেও।

—পিচ্চি ডাকতে গেছে।

বিউটি তথ্য যোগান দিলো। ফরিদা হাঁসের মাংসের বাটিটা টেনে নিলেন, নাকের কাছে ধরে গন্ধ শুঁকলেন। তাকে সন্তুষ্টই মনে হলো।

—রাবেয়ার মা মাংসের পাতিলটা নিয়া আসো, আর তোমাদের বাটি।

রাবেয়ার মা সঙ্গে সঙ্গে পাতিল আর বাটি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। মনে হলো এতক্ষণ সে এগুলি হাতে নিয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো, বলা মাত্র বান্দা হাজির। এই ক্ষিপ্রতায় ফরিদা খুশি হলেন। গলার হাড় এবং ডানা ছাড়াও দু’জনের জন্য দু’টা আস্ত মাংস আর হাঁসের চামড়া দিলেন ঝোলসহ। মন তার আজকে দরাজ হয়ে গেল নাকি কোনো কারণে অথবা এলোমেলো চিন্তায় এতটাই অন্যমনস্ক যে চাকর-বাকরদের মাংসও দিয়ে দিচ্ছেন অবলীলায়। বাটির দিকে তাকিয়ে রাবেয়ার মা’রও চোখ কপালে উঠলো।

—খালাম্মা এই তরকারী আমার আর পিচ্চির লাইগ্গা।

—কথা কম বলবা, তরকারী দুপুর আর রাত্র মিলা খাবা। এইগুলান নিয়া যাও আর একটা প্লেট নিয়া আসো।

—জে।

—তুমাদের ভাত রান্ধো নাই তো?

—জে না।

‘জে না’ বলতে গিয়ে রাবেয়ার মা’র বত্রিশ পাটির দাঁত বের হয়ে গেলো। মুখলেস সাহেব বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে এসে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলেন। বিউটির দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসলেন আর সাথে সাথে বিউটির মুখ কঠিন হয়ে গেলো। বিউটি যে মুখলেস সাহেবকে দেখতে পারে না এই তথ্য সবার অজানা থাকলেও মুখলেস সাহেবের কাছে তা পানির মতো পরিষ্কার। কিন্তু তিনিও এই বিষয়টাকে কখনও লোকচক্ষের সামনে আসতে দেন নাই। খুব স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছেন —মেয়ে বাপকে কঠিন অপছন্দ করবে এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে, হরদম ঘটছে —ভাবটা এমন!

দ্বিতীয় দফায়ও ফরিদা রাবেয়ার মা আর পরিবারের দু’জনকে চমকে দিয়ে ইলিশ মাছের সুন্দরমতো দু’টা টুকরা আর গাদাখানিক পোলাও ওদের জন্য প্লেটে বেড়ে দিলেন। আজকে ফরিদার মনটা নরম, আহারে —এই ভেবে মুখলেস সাহেব বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা বড়সড় নিঃশ্বাসটা গিলে ফেলতে গিয়ে বিষম খেলেন। সাথে সাথে এক চুমুক পানি খেয়ে কাশি সামলালেন। এদিকে বিউটি ভাবছে, এতোদিনে আম্মা ভালো ধরা খাইছেন —এই চিন্তা বিউটির মাথায় আসার সাথে সাথে ঠোঁটের বাম কোণায় তীর্যক হাসি দেখা গেলো।

ওরা নিঃশব্দে খাচ্ছে। চপত চপত শব্দে মুখলেস সাহেবের খাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু শোনা যাচ্ছে না। আজকের ইলিশ-পোলাও বিউটিকে অবাক করে দিয়ে দুর্দান্ত লাগছে খেতে। টেবিলে বসে গন্ধেই টের পেয়েছিলো বিউটি রান্না হয়েছে ফাটাফাটি। রাবেয়ার মা আর পিচ্চির জন্য ফরিদার বেড়ে দেওয়া শেষ হতে বিউটি এক রকম হুমড়ি খেয়ে পড়লো খাবারের উপর। টেবিলে একটা পদ কম —দই বেগুন দেখা যাচ্ছে না। ফরিদা বেমালুম ভুলে গেছেন।

মুখলেস সাহেবও গভীর আনন্দে খেয়ে চলেছেন। শুধু ফরিদা খেতে খেতে কখনও ঠোঁট কামড়ে ধরলেন, দু’বার কারণ ছাড়াই শিউরে উঠলেন, একবার পানি খেতে গিয়ে ঠোঁটের কাছে গ্লাস আনার আগেই গ্লাস কাৎ করে দিলেন, ফলে বেশ খানিকটা পানি ঠোঁট গড়িয়ে তার শাড়িতে পড়লো। কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলেও অসাধারণ দক্ষতায় এইসব ছোটোখাটো ঘটনাগুলি ধামাচাপা দিতে পারলেন অথবা ভাবলেন পেরেছেন। একবার শুধু বিউটি মুখে নলা দিতে গিয়ে থমকে মায়ের দিকে তাকালো। পাছে মায়ের দুরবস্থায় আবারও হাসি আসে এই ভয়ে চটজলদি চোখ সরিয়ে নিলো।

—রাবেয়ার মা, দই আর পায়েসের বাটি ফ্রিজ থিকা বার করো।

সেদিন আর কেউ পায়েস বা দই খেলো না। মুখলেস সাহেবের খাওয়ার ইচ্ছা ছিলো তাকে খেতে দেয়া হলো না। বিউটি গলা পর্যন্ত খেয়েছে, পেটে এক ফোঁটাও জায়গা ছিলো না আর কিছু খাওয়ার। বিকালে খাবে বলে উঠে পড়লো। আর ফরিদার পায়েসের বাটির দিকে তাকাতেই গা গুলিয়ে উঠলো, খাবার তো প্রশ্নই উঠে না।

খাওয়া শেষ হতে যে যার ঘরের দিকে পা বাড়ালো শুধু মুখলেস সাহেব ছাড়া। আজকে উনি ঠিক করেছেন পারতপক্ষে ফরিদার সামনে পড়বেন না। লাভলি ফিরে আসুক তারপর তুলকালাম যা হবার হওয়ার পরে বারান্দা থেকে বের হবেন। যদিও এখন বেশ শীত শীত লাগছে। বারান্দায় গিয়ে শালের উপর কম্বল জড়িয়ে বসবেন ঠিক করলেন। তিনি জানেন এখন ফরিদা বা বিউটি দু’জনের কেউই তাকে সহ্য করতে পারবে না —তার দিকে তাকালেই মেজাজ চড়তে শুরু করবে ওদের। শুধু শুধু ওদের মেজাজ খারাপ করানোর কী দরকার? তিনি চুপচাপ বারান্দায় বসে নিচু ভলিউমে গান শুনবেন —না, আজকে বোধহয় গান শোনা ঠিক হবে না। তাতেও ক্ষতি নাই, নতুন দু’টা সিনেমার পত্রিকা আছে সেগুলি দেখতে দেখতেই ঘণ্টাখানেক আরামে কাটিয়ে দিতে পারবেন। একটু ঘুমিয়েও নিতে পারেন। বারান্দায় গেলেই পিচ্চি বখশিশের লোভে লোভে ঠিকই চলে আসবে, তখন তাকে মাথায় হাত বুলাতে বলবেন বা পাকা চুল বেছে দিতে বলবেন। সে একটা একটা করে চুলের গোড়ায় হালকা টান দিবে আর অনায়াসে তার চোখ বুজে আসবে।

* * *

অনেকক্ষণ থেকে মনিপুরি পাড়ার একশ’ পনেরো বাই তিন বাড়িটার উপরে একটা একটা করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। শীতের এই অপরাহ্ণে কালো কালো মেঘের দল কোথা থেকে বিশেষ করে এই বাড়িকে উদ্দেশ্য করে ছুটে আসছে বলা মুশকিল। তবে কাকের কালো মখমল শরীরে ভর করে যে আসছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। এই বাড়ির উপর এসে ট্রাক থেকে সশস্ত্র সৈন্য নামার মতো টুপ টুপ করে নেমে পড়ছে। পুরো বাড়িটা যেন উপরে মেঘ আর ভিতরে আটকা-পরা বাসিন্দাদের নিয়ে একটা যতিচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

মেঘ জমতে শুরু করেছে ফরিদার মাথার ভিতরেও। জমাটবাঁধা শক্ত মেঘ। এরা কখনও দুই ভ্রূর ঠিক মাঝখান দিয়ে গণ্ডারের শিংয়ের মতো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে, আবার কখনও গুড় গুড় শব্দে ডাকছে। বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ফরিদার কপালের ঠিক মাঝখানের জায়গাটুকু একবার ফুলে উঠছে আবার নেতিয়ে পড়ছে, আবার ফুলে উঠছে। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে কি না তাও ঠাহর করতে পারছেন না তিনি। এতো কিছুর মধ্যেও মুখলেস সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলেন, হাজার হোক তাকে একা থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। এখন যদি মুখলেস সাহেব তার মুখের সামনে হ্যাঙ্গারের মতো ঝুলে থাকতেন তাহলে অবধারিত ভাবে ফরিদার সমস্ত বিদ্বেষ, হতাশা, ক্ষোভ তার উপরে গিয়ে পড়তো। আসলে মুখলেস সাহেব মোটেও ফরিদাকে একা থাকার সুযোগ করে দেন নাই বরং নিজেকে রক্ষা করেছেন মাত্র। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!
গত পনেরো মিনিট ধরে ফরিদা শোবার ঘরের এক প্রান্ত থেকে হেঁটে অন্য প্রান্তে যাচ্ছেন আবার ফিরে আসছেন। ঘড়ির দিকে তাকাতে তার ইচ্ছা করছে না। চারটা বাজলেও অবাক হবেন না। চুপ করে বসে যে ভাববেন তাও পারছেন না, কিছুই মাথায় খেলছে না। কী নিয়ে যে ভাববেন সেটাও মাঝে মাঝে মনে থাকছে না। লাভলি এতটা বেপরোয়া হবে তা ফরিদার কল্পনার বাইরে ছিলো। বিউটির কথামতো সত্যি সত্যি যদি আর না ফেরে? কিন্তু যাবে কই? —চল্লিশটা বছর পেলে পুষে বড় করেছেন —সেই মেয়ে কি তার সাথে এতো বড় বেঈমানী করতে পারবে। দুই মেয়ের জন্য লাভলি কী করেন নাই। পরিবারের সাথে সম্পর্ক বলতে কিছু নাই, সামাজিকতার ধার ধারেন না। দুই মেয়ের আরাম আয়েসের জন্য জীবনপাত করেছেন। ওদের চাহিদা, নিরাপত্তার উপর আর কোনো কিছু অগ্রাধিকার পায় নাই। আর কী করতে পারতেন তিনি? ওদের বিয়ে পর্যন্ত দেন নাই। কে জানে বিয়ের পরে কী জীবন অপেক্ষা করছে, এই ভয়ে কোনো পাত্রই ধোপে টেকে নাই।

টেলিফোন বাজছে অনেক ক্ষণ থেকে। অন্তত পাঁচটা রিং হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো কিন্তু ফরিদা শুনতে পেলেন না। আবার টেলিফোন বাজতে শুরু করেছে। এবার দৌড়ে টেলিফোনের সামনে গেলেন ঠিকই কিন্তু ধরলেন না, ওয়াড্রোবের পাশে বরফ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একবার হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নিলেন।

আবার টেলিফোন বাজছে, যে করছে সেও কম যায় না। তুমি তুলবা না তোমার ঘাড়ে তুলবে!

—হ্যালো?

—হ্যালো।

—হ্যাঁ বলেন, বলেন আপনে কী চান ?

—আমি তো কোনো দিনই কিছু চাই নাই ফরিদা।

—ইয়ার্কি মারার সময় এখন না। বিশ/বাইশ বছর পরে আপনে যখন আবার ফোন করা শুরু করছেন, তখন মতলব কিছু আছেই। সেইটা কী তা যত তাড়াতাড়ি খোলাসা করবেন তত আমাদের দুইজনের জন্যই মঙ্গল।

—তুমি একটুও বদলাও নাই ফরিদা। ইস্পাতের মতো শক্ত।

—এইসব ধানাই পানাই দয়া কইরা বাদ দেন।

—মেয়ে দুইটারে একটু দেখতে চাই ফরিদা। আমি কে কী বিত্তান্ত কিছুই বলবো না, শুধু মেয়ে দুইটারে চোখের দেখা দেখতে চাই।

—অসম্ভব।

—আমার কর্তব্য আমি করছি ফরিদা এখন তোমার কর্তব্য তুমি করো। আমাদের দুইজনেরই বয়স হইছে। শরীর আমার খুবই খারাপ, যেকোনো সময় আল্লাহ’র দরবারে ডাক পাইতে পারি, মেয়ে দুইটাকে দেখলে মনে শান্তি পাবো।

—বললাম তো কোনোদিনই সম্ভব না। আর আপনে কারে ভুলান, কী কর্তব্য করছেন? —সময় সময় টাকা পাঠাইছেন এই তো? —আপনে করছেন পাপের প্রায়শ্চিত্ত আর কিছু না। নিজের পুলাপানের সামনে গিয়া কইতে পারবেন লাভলি আর বিউটি কে, পারবেন?

—না, এই বয়সে তাদের এত বড় শোক দিতে চাই না। খোদেজাও মারা গেছে বেশিদিন হয় নাই। আমি কারো ক্ষতি করবো না। শুধু আইসা একটু দেইখা যাবো। ওদের জন্য কিছু টাকা দিয়া যাবো।

—টাকা দিতে চাইলে দিবেন, কিন্তু মেয়েদের সাথে দেখা হবে না।

আসলেই ইস্পাতের মতো ঠাণ্ডা আর কঠিন শোনালো ফরিদার গলা। আবদুুল বশির সাহেব ফরিদার কথার পর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

—মেয়ে দুইটারে পাইয়াও তুমি সুখি হইলা না ফরিদা!

—আমি অসুখী এই সংবাদ আপনেরে কে দিছে।

আবারও বেশ কয়েক সেকেন্ড বশির সাহেব চুপ —শুধু ফোনের অন্য প্রান্তে তার ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফরিদার কপালের নিচে জমাট বাঁধা মেঘ আলগা হতে শুরু করেছে। যেকোনো মুহূর্তে প্রবল বিদ্যুতের ঘায়ে বৃষ্টি নামবে অথবা জমাট মেঘপুঞ্জ বাতাসের তোড়ে উড়ে চলে যাবে ফরিদাকে আরও শক্ত আরও কঠিন হবার সুযোগ করে দিয়ে।

—মেয়ে দুইটারে বিয়া দিলা না কেন ফরিদা, এত বড় ক্ষতি কেন করলা? ওদের চিন্তায় রাত্রে ঘুমাইতে পারি না…

আরও কিছু হয়তো তিনি বলে যাচ্ছিলেন কিন্তু সেগুলি শোনার মানসিক শক্তি ফরিদার ছিলো না। ফোন কেটে দিলেন। ওয়াড্রোব-এর উপর দুই হাত রেখে তার উপর মাথা রাখলেন। এক সময় ওয়াড্রোবের গা ঘেঁষে মাটিতে বসে পড়লেন। চোখ থেকে পানি টপ টপ করে পড়ছে, বাধা দিলেন না ফরিদা —যতোটুকু আছে বেরিয়ে যাক!

মেয়ে দু’টাকে কীভাবে তিনি আল্লাহ’র তিরিশটা দিন আগলে রেখেছেন। মুরগি তার ছানাগুলিকে যেভাবে পালকের নিচে রেখে দেয়, তিনি তাই করেছেন। জগতের সব কিছুতেই ফরিদার গা গুলায়, গা ঘিনঘিন করে —মেয়েদেরকে সেগুলির কোনো কিছুর ছায়াও মাড়াতে দেন নাই। মেয়েদেরকে তিনি রক্ষা করেছেন এই কথা কেউ বোঝে না। না বুঝলে নাই, তিনি কারও ধার ধারেন না। মেয়েরা তার ভালো আছে এইটাই সবচেয়ে আসল কথা।

ফরিদার তক্ষুনি মনে পড়লো লাভলি বাসায় নাই। বুকের ভিতর থেকে জানটা এক লাফে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। ঠিক সেই সময় ফরিদা নিশ্চিত হলেন লাভলি কোথায়। আবদুুল বশির যতই ফোন করে ভাওতা দিক না কেন, তিনি হলফ করে বলতে পারেন লাভলি এখন আবদুুল বশিরের জিম্মায়।

সে কি তাহলে মেয়েকে সব কথা বলে দিবে। না, এটা সে করবে না। তাহলে সে কী বলবে মেয়েকে?

ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে ফরিদার। ইচ্ছা করছে বিউটির ঘরে গিয়ে মেয়েটার হাত ধরে চুপ করে বসে থাকতে। কেউ যদি তখন তাদেরকে তালা মেরে রাখে তাহলে আরও ভালো হয়।

লাভলি এখন বশিরের সাথে কোথায় আছে, কী করছে, দুপুরে কি কিছু খেয়েছে? অবশ্যই খেয়েছে —বশির ঠিকই লাভলিকে খাওয়াবে, হয়তো খুব ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে খাইয়েছে। বড়লোকী জাহির করতে হবে না! সব কিছু শোনার পর লাভলি যদি আর এই বাড়িতে ফিরে আসতে না চায়, এই মায়ের মুখ যদি আর দেখতে না চায়! না, সেটা কখনও হবে না, ফিরে সে আসবেই, হাজার হোক ও ফরিদার মেয়ে —মায়ের কথার অবাধ্য হতে ওরা দুই বোনের কেউই শেখে নাই।

* * *

নাইওর থেকে ফিরে ফরিদা কমলাপুরে কবি জসিম উদ্দিন রোডের শেষ মাথার প্লটটায় স্বামীর সাথে এসে উঠলেন। মুখলেস সাহেব ধরেই নিয়েছিলেন বিয়ের পরে নতুন বউ যে হতাশা আর গ্লানি নিয়ে বাপের বাড়িতে নাইওর করতে গেলেন, তার ফিরে আসার সম্ভাবনা শূন্য। কিন্তু যখন ফিরে এলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে হাসি মুখে ফিরে এলেন তখন মুখলেস সাহেব গভীর ধন্ধে পড়ে গেলেন। এরকম আস্তো একটা সুন্দরী মেয়েকে পাশে নিয়ে বসবাস করা তার জন্য ভয়াবহ।

—আমি সত্যিই বিয়া করতে চাই নাই ফরিদা, তুমি বড় ভাইজানকে জিজ্ঞাস করো।

—শুনো, তুমি আমার স্বামী। তোমার লজ্জা মানে আমার লজ্জা। এই বিষয় নিয়া আমরা আর কোনোদিন কথা বলবো না। এই বিষয়ে কথা বলা আজকেই শেষ, মনে থাকে যেন।

—তুমি জীবন কেমনে পার করবা?

—তোমারে একটা সত্য কাহিনী বলি, আমার আপনা ফুপাতো বোনের কথা, বিয়ার পরের দিন তার স্বামীরে সাপে কাটলো। সে জীবন পার করছে শ্বশুর বাড়িতে, অন্যের ফুট-ফরমাশ খাইটা। সেই তুলনায় আমি তো ভাগ্যবতী। আমার স্বামী জীবিত, সুস্থ। এই নিয়া আর দ্বিতীয় কথা না।

ফরিদা সংসার পাতলেন তিন কামরার টিনের বাড়িতে। বাড়িটা খুব পছন্দ হলো তার। শহরের মধ্যে বাড়ি কিন্তু গ্রাম গ্রাম ভাব। মূল বাড়ির সাথে লাগোয়া আর একটা ছোট ঘরে রান্নার ব্যবস্থা। রান্নাঘর ঘেঁষে এক চিলতে পাকা জায়গায় টিউব অয়েল বসানো। সেখানে বাসন, কোসন ধোয়া, হাত-মুখ ধোয়া। বাড়ির পিছনে অনেকখানি খালি জায়গা। সেখানে তারা সব্জির বাগান করলেন। ছুটির দিনে বাগানে বসে চা খেতেন, টুকটাক গল্প করতেন। খুব সুখি ছিলেন তখন, শুধু মাঝে মধ্যে মাঝরাতে উঠে বসে থাকতেন ফরিদা, এই যা। মুখলেস সাহেবে টের পেতেন ঠিকই কিন্তু কখনও জানতে দেন নাই।
একদিন মুখলেস সাহেব অফিস থেকে ফিরলেন তার গ্রাম সম্পর্কের এক চাচাতো ভাইকে সাথে নিয়ে। ভদ্রলোক মুখলেস সাহেব থেকে অন্তত বছর পাঁচ/ ছয়ের বড়, নাম আবদুুল বশির। বিয়ের পরে স্বামীর দিকের আত্মীয়ের দেখা ফরিদা পান নাই-ই বলা চলে। তাই একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে আসায় বেশ অবাক হলেন। সেদিন মুখলেস সাহেবকে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত উৎফুল্ল দেখালো। ফরিদাকে ভালো-মন্দ রান্না করতে বললেন। বাগান থেকে কাঁচা টমেটো নিজে তুলে এনে দিলেন আর চিংড়ি মাছ দিয়ে রাঁধতে বললেন। চিংড়ি মাছ সাথে নিয়েই এসেছিলেন আর একটা মুরগি। বাসায় পিঁয়াজ বেশি নাই বলতেই পিঁয়াজ আনতে ছুটলেন।

—ফরিদা, বশির ভাই আর আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। বশির ভাইয়ের আম্মা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কতো কিছু যে খাওয়াইছেন চাচি-আম্মা, সে তোমারে বইলা শেষ করা যাবে না।

—তোমরা বাগানে বসো, আমি চা কইরা আনতেছি।

—বাগানে কাঁচা টমেটো আছে, না কি সব পাইকা গেছে?

—আছে।

—কয়টা তুইলা আনি। কাঁচা টমেটো দিয়া চিংড়ি মাছ রানবা। চিংড়ি মাছ সাথে নিয়া আসছি। মুরগি আনছি, আলু আর কাঁচামরিচ দিয়া পাতলা ঝোল করবা।

—রানবো যে পিঁয়াজ বেশি নাই ঘরে। দুইটা আছে তাও শুকনা।

—আচ্ছা, তুমি চা বানাও আমি সামনের দুকান থিকা পিঁয়াজ নিয়া আসি।

পিঁয়াজ আনার জন্য মুখলেস সাহেব তড়িঘড়ি বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এলেন।

—বাড়িতে মুড়ি টুড়ি আছে না কি? তাইলে চায়ের সাথে দিতে পারতা। না কি আমি নিয়া আসবো?

—মুড়ি নাই কিন্তু চিড়া আছে, ভাইজা দিবো নে, যাও। তুমি এত অস্থির হইতেছো কেন?

ফরিদার কথায় মুখলেস সাহেব একটু মিইয়ে যান, যেন তার অভিসন্ধি ফরিদা ধরে ফেলেছেন —আমতা আমতা করে কী একটা বলে ঘর থেকে প্রায় পালিয়ে গেলেন।

—না, অস্থির না —ছোট থাকতে উনাদের অনেক খাইছি, আদর পাইছি…

আহারে, নিজের বলতে লোকটার কেউ নাই, কে কবে আদর করেছিলো তার জন্য এখনও কত উতলা —ফরিদা গভীর মায়াবোধ করলেন মুখলেস সাহেবের জন্য।

শোবার ঘর থেকে রান্নাঘরে যাবার সময় সেই প্রথম ফরিদা আবদুুল বশির সাহেবকে দেখলেন। খুবই সাধারণ চেহারা, রঙ বেশ কালো, তবে উঁচা-লম্বা। তাকে দেখে নিজের অজান্তেই ফরিদা আঁচল দিয়ে ঘোমটা টানলেন।

—আসসালামালাইকুম।

—ওলাইকুম আসসালাম, ভাবি সাহেব। আপনেদের সংসার দেখতে আসলাম। বাড়ি তো চমৎকার।

—জি, ভালো করছেন। বাগানে বসেন ভাইজান, চা আনতেছি।

—মুখলেস কই গেলো?

—একটু দুকানে গেছেন, এখনি চইলা আসবেন।

ফরিদা রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি বসিয়ে ভাবলেন, স্বামী বড় মুখ করে একজন মেহমান নিয়ে এসেছেন, তার যতœ তিনি সাধ্যমতো করবেন। দুই মুঠ বুটের ডাল ভিজালেন, মাংসের মশলা দিয়ে রাঁধবেন —মুখলেস সাহেব খুব পছন্দ করেন।

সেদিন রাতে মেহমান বিদায় হওয়ার পরে মুখলেস সাহেব গল্প করলেন কীভাবে আবদুুল বশিরের পরিবার তার মতো এতিমকে আপন করে নিয়েছিলেন। মায়ের আদর-যতœ কী তার ছোটখোটো নমুনা আবদুল বশিরের মায়ের কাছেই তিনি পান।

এর সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা, একদিন মুখলেস সাহেব অফিস ছুটির ঘণ্টাখানেক আগে বাড়িতে ফিরলেন। খাওয়া দাওয়া করলেন তারপর ধীরে সুস্থে কথাটা ফরিদার কাছে ভাঙলেন।

—বশির ভাইয়ের সাথে কালকে দেখা হইছিলো। অফিসে আসছিলেন। তোমার রান্নার স্বাদ না কি এখনও জিব্বায় লাইগা আছে।

—তাই না কি? বলো নাই তো?

—বলি নাই, না? চট্টগ্রামে বশির ভাইয়ের বিরাট এক্সপোর্ট ইমপোর্টের কারবার, বুঝলা? সেই কারবার ঢাকাতেও আনতে চান। সেই কারণেই ঢাকায় আসা, আপাতত হোটেলে উঠছেন। কতোদিন আর হোটেলে থাকা যায়, বুঝলা না?… মানে, আমি উনারে একটা প্রস্তাব দিছি… আমাদের খালি কামরাটায় উনি কয়েক মাস থাকুক। উনারও খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা থাকবে না, আমাদেরও বাড়তি কিছু পয়সা সংসারে আসবে। তুমি কী বলো?

বুদ্ধিটা ফরিদার ভালোই মনে হলো। বিশেষ করে বাড়তি পয়সা আসার ব্যাপারটা তো খুবই ভালো। খুশি মনে রাজি হয়ে গেলেন।

—হ্যাঁ, উনি খালি ঘরটায় আরামে থাকতে পারবেন। ওই ঘরে খুব হাওয়া হয়… কত দিবে কিছু বলছে?

—না, তবে খারাপ দিবে না। উনার হাত খুব দরাজ।

দরাজ হাতের নমুনা ফরিদাও পেয়েছেন। নতুন বউয়ের মুখ দেখা উপলক্ষ্যে সেদিন আবদুুল বশির সাহেব বেশ কিছু টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন। ফরিদা প্রথমে নিতে চান নাই।

—নেন ভাবি সাহেব, মনে করেন বড় ভাসুর আপনেরে দিচ্ছে, না নিলে বেয়াদবি হবে।

—আরে নাও, নাও… বশির ভাই অতি অবশ্যই বড় ভাসুর।

ফরিদা সেদিন লাজুক হেসে টাকা ক’টা হাতে নিয়েছিলেন। পরে একান্তে গুণতে গিয়ে ওর চোখ প্রায় কপালে উঠে গেছে —১০০ টাকা! এত টাকা এমনি এমনি কেউ কাউকে দেয়! সুতরাং টাকা যে ভালোই পাওয়া যাবে সে বিশ্বাস ফরিদারও হলো —তাই স্বামীর প্রস্তাবে একেবারেই আপত্তি করলেন না, বরং হাসিমুখে অনুমতি দিলেন।

এক মঙ্গলবার সকালে শুধু একটা ছোটো কালো সুটকেস হাতে আবদুুল বশির সাহেব কবি জসিম উদ্দিন রোডের ১১ নম্বর বাড়িটায় উঠে এলেন। ঠিক সেই মুহূর্তটা থেকে ফরিদার জীবন ভয়ানক পাল্টে গেলো। শুরুর দিকে পুরো ব্যাপারটাই ছিলো এক ধরনের খেলা। যেন ফরিদা বিংশ শতাব্দীর দ্রৌপদী, পার্থক্যের মধ্যে তার স্বামী দু’টা। এক স্বামী যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মপ্রাণ অন্য স্বামী অর্জুনের মতো বীর্যবান!

বিয়ের পরে সেই পয়লা মুখলেস সাহেব নিঃশঙ্ক, ভারশূন্য বোধ করলেন। তার ঘাড়ের উপর থেকে বিশাল এক বোঝা তিনি নামিয়ে ফেলতে পেরে সুখী, অনুতাপশূন্য। ফরিদা সেই থেকে ভয়াবহ ভারে নত, পাপ-বোধে গলা পর্যন্ত নিমজ্জিত আর তা ঢাকতে ইস্পাতের মতো শক্ত, ছুরির ফলার মতো ধারালো। তবে জোর করে মাথা উঁচু করতে গিয়ে বুকের পাঁজর নতুন চাঁদের মতো বেঁকে গেলো। আপাত দৃষ্টিতে ওদের সংসারে কোনো খুঁত ছিলো না। সারা দিন ফরিদার কেটে যেতো সরল স্বাভাবিক জীবন নিখুঁতভাবে চালাতে। দিনের বেলা নাস্তা বানানো, নাস্তা খেয়ে মুখলেস সাহেব আর আবদুল বশির সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার পরে পনেরো মিনিটে গোসল সারা, সাহেবদের ছেড়ে যাওয়া কাপড় গুছিয়ে রাখা, ঘরবাড়ি সামলানো, কাপড় ধোওয়া তারপর রান্নার যোগাড় করা, রান্না সেরে বাগানে হাঁটাহাঁটি, শখ করে কখনও চা খাওয়া এবং সাহেবদের জন্য অপেক্ষা করা। তারা ফিরলে ভাত বেড়ে দেয়া, যত্ন করে খাওয়ানো, আবার বিকালে চায়ের পানি বসানো, নাস্তা দেয়া, ঘর ঝাঁট দেয়া… সংসারধর্ম পালন। রাতের বেলাও কেটে যেতো সরল স্বভাবিক তালে-বেতালে। শুধু কোনো কোনো রাতের মধ্য প্রহরে, যে সময় পেঁচা একটানা ডাকে আর বাদুরের রক্ত পিপাসা বেড়ে যায়, ফরিদা জ্ঞানশূন্য বিছানা থেকে নেমে পড়েন, ভূতে পাওয়া মানুষের মতো দরজা খোলেন—ক্যাঁচ শব্দে প্রতিবারই ভীষণ চমকে ওঠেন, তারপর উত্তরমুখী ঘরের দিকে অবিচল হেঁটে যান। উত্তরমুখী ঘরের দরজা খোলাই থাকে।

ফরিদা বিছানা ছাড়া মাত্র মুখলেস সাহেব এক ঝটকায় উঠে ঠায় বসে থাকেন। তখন তাকে ঘন ঘন শ্বাস টানতে দেখা যায়। ফরিদা না ফেরা পর্যন্ত প্রবল নিঃশ্বাসের কষ্ট নিয়ে তিনি ঘাড় গুঁজে বসে থাকেন, ঘোড়ার ডাকের মতো শ্বাস টানার তীক্ষ্ণ শব্দ ছাড়া তাকে মৃত মনে হয়। ফিরে আসা ফরিদার পায়ের শব্দ কানে আসা মাত্র মুখলেস সাহেবের মৃত শরীরে প্রাণের সঞ্চার হয়, তিনি লক্ষী বাচ্চার মতো গুটিসুটি মেরে আবার ঘুমিয়ে পড়েন এবং সঙ্গে সঙ্গে গভীর ঘুমে তলিয়ে যান। একটু আগ পর্যন্ত যে তার মরণ দশা চলছিলো সেটা তখন দেখে বোঝার কোনো উপায় থাকে না।

তবে একটা বিষয় ফরিদা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন আর তা হলো দিনের বা রাতের জাগ্রত-সময়ে ফরিদা এবং আবদুল বশির সাহেবকে কখনও এক মুহূর্তের জন্যও বেচাল হতে দেখা যায় নাই; নিজেদের মধ্যে প্রগলভ হতে দেখা যায় নাই, এমনকি মুখলেস সাহেবের অনুপস্থিতিতেও না। মুখলেস সাহেবের প্রতি এই সম্মানটুকু তারা সচেতনভাবেই দেখাতেন এবং এই একটা বিষয় মেনে চলার ব্যাপারে ফরিদা যার পর নাই কঠোর ছিলেন।

কতোক্ষণ মাটিতে বসে আছেন ফরিদার হিসাব নাই—এক ঘণ্টা দুই ঘণ্টা? ঘাড় উঁচু করলেই জানা যাবে, কিন্তু ইচ্ছা করলো না। ভাঁজ করে রাখা মিনার সমান কাপড়ের স্তূপের মতো স্মৃতি তার ভিতরে জমাট হয়ে আছে। হঠাৎ কোনো একটা স্মৃতি ভাঁজ ভেঙে খুলে পড়লে মুশকিল—পুরনো গন্ধ, যন্ত্রণা, বিবমিষা বেরিয়ে আসবে আর পুরো শরীর পাক দিয়ে উঠবে। স্মৃতিকে ফরিদা ভয় পান, ধারে কাছে ঘেঁষতে দিতে চান না। আবার কী মনে পড়ে যায়—চোখ মোছেন ফরিদা। কান্নাকাটি অনেক হয়েছে, এভাবে জীবন চলবে না। তাকে আবার পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। লাভলিকে যদি বশির সব বলেই থাকে তো বলুক। আসুক সব কিছু সামনে। তিনিও দেখবেন উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ তার তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসারে চোট লাগাতে পারে কি না? আর যদি পারে তাহলে এমন সংসার থাকলেই কী আর না থাকলেই কী। ভাবলেন বটে কিন্তু এক মনে ‘সুবাহানাল্লাহ’ ‘সুবাহানাল্লাহ’ পড়ে গেলেন। এই মুহূর্তে ফরিদা চাইছেন লাভলি যাতে দেরি করে আসে, তাহলে তিনি সামলে নেবার সময় পাবেন। তাকে নরম দেখালে চলবে না। এই পৃথিবী নরমের যম।

ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো বিউটি। গত পরশু দিন সে প্রথম মাথায় পাকা চুলের হদিস পেয়েছে। কানের লতির কাছে একটা নিরাপরাধ সাদা চুল! দৈর্ঘ্য বেশি না। বেশ কিছু সময় সে সাদা চুলের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার মানে সায়াহ্ন প্রায় এসেই গেলো। কোন এক বিচিত্র কারণে তার একটুও মন খারাপ হলো না বরং এক ধরনের স্বস্তিবোধ হলো। সুন্দর-বান্দরে এখন আর কিছু যায় আসে না। দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সে যে বত্রিশ ঘণ্টা শুধু রূপচর্চায় কাটায় সেটা নিছক সময় পার করা, আর কিছু না। সময় অবশ্য পার হয়েই যায়। গান শোনা, সিনেমা দেখা, ম্যাগাজিন পরা, রূপচর্চা আর ঘুম… বরং দিনের দৈর্ঘ্য হিসাবে চব্বিশ ঘণ্টা মাঝে মধ্যে কম মনে হয়। তবে আজকে সময় কাটছে না, কিছুতেই না। যা যা সে প্রতিদিন করে তার কিছুই করতে ইচ্ছা করছে না। এই আয়না দিয়ে যদি বাইরের পৃথিবীটা দেখা যেতো—আপা কী করছে, কোথায় আছে, কার সাথে আছে? বিউটি ভেবেই পাচ্ছে না এতটা সময় লাভলির কেন লাগছে। জানা মতে বাইরের পৃথিবীতে সময় কাটাবার মতো ওর কেউ নাই। সত্যিই কী নাই? কারণ লাভলি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে কিছুই বলা যায় না। অন্তত বিউটি বলতে পারবে না। কারণ দু’ একটা যা বিপজ্জনক কাণ্ড তাদের সংসারে ঘটেছে তার প্রায় সবগুলিই আপাত দৃষ্টিতে এই বোকাসোকা মেয়েটাই করেছে। সুতরাং বাইরের পৃথিবীতে ওর কোনো রসের মানুষ থাকলেও থাকতে পারে। অবশ্য বিউটির মন এতে একেবারেই সায় দিচ্ছে না।… অ্যাকসিডেন্ট হলো না তো? কথাটা শুধু মনে এলো, কিন্তু কোনো দুশ্চিন্তাবোধ করলো না সে। বিউটি সবচেয়ে অবাক হচ্ছে ফরিদার প্রতিক্রিয়ায়। আপা যে এখনও বাসায় ফিরলো না তা নিয়ে কোনো উচ্চাবাচ্য নাই, মাথা কুটাকুটি নাই, শাসানো নাই—কোনো কিন্তু আছে, অবশ্যই এর মধ্যে কোনো কিন্তু আছে! হয়তো আম্মা-ই আপাকে কোথাও পাঠিয়েছে এবং ভালো করেই জানে আপার আসতে দেরি হবে। তাহলে সকালে যে বিউটির ঘর প্রায় ভেঙেই ফেলছিলো যাতে সে লাভলির সাথে যায়। না, কিছুই মেলাতে পারছে না বিউটি। মাথা জট পাকিয়ে যাচ্ছে, পরিষ্কার করা দরকার। এখন অবশ্য নিশ্চিন্ত মনে বাথরুমে ঢুকে গাঞ্জা টানা যায়। সেই বরং ভালো। গাঞ্জা টানবে আর শিস দিবে… সুখচিন্তায় নিজের মনে হাসলো বিউটি।

আবার আয়নার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। এখনও দেখতে খারাপ না, অন্তত আপার চাইতে ঢের ভালো। এই এতদিন পরেও বিউটি বিশ্বাস করতে পারে না রিয়াজ তাকে ফেলে কোন দুঃখে লাভলির জন্য ছোঁক ছোঁক করত। আহারে, কী বেদিশা অবস্থা দু’জনের। রিয়াজ নোট নিয়ে আসতো, ওরা সব সময় বিউটির ঘরের পড়ার টেবিলে বসত। দরজা তখন হাট করে খোলা থাকতো। আম্মা যেকোনো সময় ঢুকে যেতেন। কোনো রকম আগাম জানান দেয়ার তোয়াক্কা করতেন না। ওদের প্রেমাচার সব চলতো টেবিলের নিচে। বিউটি যেদিন প্রথম টের পেলো ভয়ে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। বিউটির সময়টা স্পষ্ট মনে আছে। দুপুর আড়াইটা। ওরা সবে ভাত খেয়েছে। নোট-ফোট নিয়ে লাভলি আর রিয়াজ বিউটির ঘরে এসে উপস্থিত।

—আমার ঘরে কী? এখন ঘুম দিব। আপা, তুমার ঘরে যাও তো।

—দুইদিন আমি আসতে পারবো না বিউটি। আজকে শুধু দেখায় দিয়া যাই। নোট-টাও যার কাছ থেকে আনছি তারে ফিরত দিতে হবে।

—আজকেই ফিরত নিয়া যাও, আমাদের নোটের দরকার নাই।

—আমার আছে। বেশিক্ষণ লাগবে না, সত্যি। একবার বুইঝা নেই পরে টুইকা রাখবো।

—তুমার ঘরে যাইতেছ না কেন?

—আম্মা তোর ঘরে বসতে বলছেন।

দুপুর বেলার ঘুম মাটি হবে ভেবে বিউটি খুব বিরক্ত হয়েছিলো। গজ গজ করতে করতে সে বাথরুমে ঢুকলো। বাথরুম থেকে বের হবার সময় তার কী মনে হলো সে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে বাথরুমের দরজা একটু খুলে তেরছা চোখে ওদেরকে দেখলো। দেখামাত্র তার পা হীম হয়ে গেলো—আপা মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসা ওর হাতে একটা বলপেন আর রিয়াজ ঝুঁকে সেকেন্ডের মধ্যে আপার ঠোঁটে চুমু খেলো তারপর কোনো শব্দ না করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার কাছে গিয়ে ভালো করে আশপাশ দেখলো। ফিরে এসে দ্বিতীয়বার কঠিন চুমু খেলো আর তারপর বিউটি যা দেখলো সেটা মনে করলে এখনও তার গা গুলিয়ে ওঠে। জঘন্য!  দেখলো, রিয়াজের হাত অবলীলায় লাভলির কামিজের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে, আর বেহায়া মেয়েটা তখনও নামাজের ভঙ্গিতে বসা। বিউটির পক্ষে আর বেশিক্ষণ দেখা সম্ভব হয় নাই। সে দরজা লাগিয়ে দিলো, তারপর বেসিনের সামনে গিয়ে একবার, দু’বার, তিনবার ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিলো মুখে ঘাড়ে। শরীরের মধ্যে কোনো শিহরণ অনুভব করলো না বিউটি, একটা জ্বালা অনুভব করলো, আর ঘৃণা। প্রায় বমি এসে গিয়েছিলো আর কি। বের হয়ে ওদের চেহারার দিকে কীভাবে তাকাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছিলো না। অনেকক্ষণ বাথরুমে বসে ছিলো। যখন বেরিয়ে এলো বিউটির নাক বিশ্রীরকম কুঁচকে ছিলো। যেন সে মরা ইঁদুর দেখেছে বা পচে গলে যাওয়া ইঁদুরের গন্ধ কেউ ওর নাকের সামনে ধরে আছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ওদের দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কোথায় যাবে, কী করবে ভাবতে গিয়ে বিউটির জিদ উঠে গেলো। আরে ঘরটা আমার, আমি বার হইছি কেন, দরকার হইলে ওই দুইটারে লাত্থি দিয়া বার করব। বদমাইশির একটা সীমা আছে—অবিকল ফরিদার মতো করে ভাবলো বিউটি তারপর বীরদর্পে আবার নিজের ঘরে ফিরে গেলো।

—তোমাদের নোট চালাচালি হইছে?

—এই তো প্রায় শেষ।

রিয়াজ ঢোক গিলে কথা শেষ করলো। লাভলির মাথা নিচু, নোটের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।

—বিউটি এক গ্লাস পানি আইনা দিবি?

—না।

—আচ্ছা, আমি আনতেছি।

রিয়াজ পানি আনতে গেলো। বিউটি শব্দ করে ডান পাশের চেয়ারটায় থপ করে বসলো। চার কোণা টেবিলের তিন দিকে তিনটা চেয়ার। একটা দিক দেয়ালের গায়ে লাগানো। মাঝখানের চেয়ারে রিয়াজ বসেছে। রিয়াজের বাম পাশে লাভলি বসা। সুতরাং লাভলি আর বিউটি তখন মুখোমুখি। ওই সময়ের ভাবনা আর অনুভূতি স্পষ্ট মনে পড়লো তার। দাঁত কিড়মিড় করে শুধু বলেছিলো—কত বড় আস্পর্দা, কত বড় আস্পর্দা। লাভলি এর কিছুই শুনতে পেলো না। ও তখন এই জগতে নাই।  ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো রিয়াজ এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢুকল, আলতো করে লাভলির সামনে রাখলো—রাখার সময় কিছু বললো কি না এখন আর তা মনে পড়ছে না বিউটির, শুধু মনে আছে কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাস তুলতে গিয়ে ওর হাত ফসকে গ্লাস পড়ে ছত্রখান। সেই শব্দে ফরিদা আসলেন, কিছুক্ষণ বকাবকি করলেন এবং আর দিগ্গজ হওয়ার দরকার নাই বলে রিয়াজকে বিদায় করলেন।

তারপর সেই ভয়ঙ্কর খেলা চললো কিছুদিন। টেবিলের নিচে চুমাচুমি, পায়ে-পা ঘষাঘষি, হাতাহাতি—কিছুই বাকি ছিল না। এইসব ঘটনা যেদিন ঘটত সেদিন রাতে বিউটি এক সেকেন্ডও ঘুমাতে পারত না। পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে থাকত। ঢোকে ঢোকে পানি খেয়েও সেই পিপাসা মেটে না এমন। বিউটির সবচেয়ে অবাক লাগে ভাবতে যে দুই গর্দভ মনে করত সে কিছুই টের পাচ্ছে না। বিউটি কি কাঠের দরজা না কি ফুল-লতাপাতা আঁকা প্লাস্টিকের টেবিল ক্লথ—বোধবুদ্ধিহীন জড় পদার্থ? এসব ভাবলে তার শুধু অবাকই লাগে না এক ধরনের তীব্র অপমানবোধ হয়। অপমানের জ্বালায় শরীর চিড়বিড় করতে থাকে। তার চেয়ে লাভলি যদি এসে তাকে অকপটে ওদের সম্পর্কের কথা বলতো তাহলে হয়তো এরকম অসহ্য জ্বলুনি হতো না। কিন্তু লাভলি ভান করতে থাকল যেন কিছুই ঘটছে না আবার অন্যদিকে টেবিলের নিচের নাটক চলতে থাকল বহাল তবিয়তে।

একদিনের ঘটনা—প্রেমপর্ব সবে সাঙ্গ হয়েছে। রিয়াজ চলে গেছে। লাভলি নোটের ছদ্মবেশে তার হাতে দিয়ে গেল রসময় গুপ্ত। সেদিন বিউটির মনে হলো তার আপাত ভোলাভালা বোন তার চাইতে কয়েক শ’ গুণ সরেস। তাকে এক ঘাট থেকে কিনে অন্তত চার ঘাটে বিক্রি করতে পারবে। গ্লানি আর হতাশার ভয়ঙ্কর রূপ দেখল সে নিজের মধ্যে। সেদিন সেই মুহূর্তে বিউটি সীদ্ধান্ত নিলো ফরিদাকে রিয়াজ আর লাভলির ঘটনা বলে দিবে এবং সেজন্য তার কোনো রকম অনুতাপ হল না। মনে মনে সে ভেবেও রাখল ফরিদাকে কী বলা হবে। ধানাই পানাইয়ের দরকার নাই কম কথায় কাজ সারা হবে।

সন্ধ্যাবেলা ফরিদা পিছনের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন। বুয়া পায়ের আঙুল মটকে দিচ্ছিল। বিউটি দেখে এলো লাভলির ঘর ভেজানো, আলতো করে দরজা খুলে দেখল ও গল্পের বই পড়ছে। ওকে জানান না দিয়ে আবার আস্তে দরজা ভিজিয়ে দিল। সোজা উপস্থিত হলো পিছনের বারান্দায়।

—-আম্মা, আপনেকে একটা কথা বলব। বুয়া, তুমি আমারে এক কাপ চা দেও।

ফরিদা বুঝলেন বুয়াকে বিউটি সরাতে চাইছে। এইসব ব্যাপারে তিনিও যথেষ্ট সচেতন। চাকর-বাকরের সামনে ঘরের কথা যেন কোনো অবস্থাতেই না বের হয় সেদিকে তার দৃষ্টি সজাগ। তিনিও চোখের ইশারায় তাকে চলে যেতে বললেন। বুয়া যথেষ্ট অনিচ্ছা নিয়ে বারান্দা ছাড়ল। বিউটি চট করে দেখে এল সে সত্যিই চলে গেছে না দরজার পিছনে লটকে আছে।

—এত ঢং করতেছিস কেন? কী বলবি?

ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুক্ষণ সময় নিল বিউটি। যেন তার বলতে খারাপ লাগছে বা আদৌ বলবে কি না সেই দ্বিধা এখনও ভিতরে কাজ করছে। যদিও বাস্তব মোটেও তা না। বলবার জন্য আসলে সে মরীয়া হয়ে উঠেছে।

—হা কইরা শ্বাস ফেলতেছিস কেন? কী হইছে?

—আম্মা, আপারে দেখলাম…

ফরিদা বেশ আয়েস করে চা খাচ্ছিলেন। তার দু’পা টেবিলে সোজাসুজি রাখা। বিউটির ইতস্তত ভাব দেখে সোজা হয়ে বসলেন আর লাভলির সম্পর্কে কথা বুঝতেই আরও সজাগ হলেন। খরগোশের মতো চকিতে তার কান খাড়া হয়ে গেল।

“আপারে দেখলি, কী দেখলি?” প্রায় হিসহিসিয়ে উঠলেন।

—কালকে আপারে দেখলাম রিয়াজের হাত ধইরা বইসা আছে।

এই কথা বলার পর বিউটি আর এক মুহূর্তও ফরিদার সামনে দাঁড়ালো না। যদিও সে মায়ের মুখের কারুকাজ দেখার জন্য মরে যাচ্ছিলো।

* * *

বিউটি এখনও আয়নার সামনে ঠায় দাঁড়ানো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কত কিছু চোখের সামনে ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। মাঝে মাঝে বিউটির মনে হয় সেদিন ফরিদাকে কথাটা না বললেও হত, অন্তত সে না বললেও পারত। যে বেপরোয়া গতিতে এগুচ্ছিল তাতে দু’একদিনের মধ্যে ফরিদা নিজে থেকেই টের পেতেন। সেটাই বরং ভালো হত।

বিউটি নিজেকে এক রকম জোর করেই আয়নার সামনে থেকে সরাল। দিনটা আজকে খাপছাড়া, সকাল থেকেই কী রকম একটা লাগছে। কিছুতেই শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার লাভলির বিষয় মাথায় ঘোরাফেরা করার আগেই একটা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিল। জাহান্নামে যাক সব। তার কী! মরুক!

বিউটি ধীরেসুস্থে বাথরুমে ঢুকল। আবার কী মনে করে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা হল। রাবেয়ার মা ঝাঁট দিচ্ছে। ইলিশ মাছের হালকা-পাতলা গন্ধ বাতাসে পাক খাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই বোধহয় খাওয়া শেষ করেছে ওরা।

—পিচ্চি কই?

—খালুজানের ধারে, ঘাড় টিপে। আজকে হেরে কোনো কামে পাই নাই।

—আম্মা তুমারে ডাইল বাটতে বলছিলেন?

—না, বলেন নাই।

—শেষ হয়ে গেছে। বাইটা রাইখো।

—আইচ্ছা।

বিউটি ঘরে ফিরে গিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগাল, আয়নার পিছন থেকে দু’টা পোটলার একটা হাতে নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকল, কাঠি বানাল তারপর ব্রেসিয়ারের ভিতর থেকে ম্যাচ বের করে ধরালো, আচ্ছাসে দম নিয়ে একটা টান দিলো। সাথে সাথে ঝিম ভাব পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। আহা কী সুখ! কমোডের সিট ফেলে দিয়ে তার উপর আরাম করে বসলো বিউটি। ছোট বড় টানে প্রায় অর্ধেকটা শেষ করে ফেলল। জিনিসটা ভাল। অনেকক্ষণ সিটের উপর নিশ্চুপ বসে রইল।

মুখলেস সাহেবকে অপছন্দ করার কোনো কারণ বিউটির জানা নাই। কিন্তু যতদূর মনে পড়ে সেই ছোটবেলা থেকেই এক ধরনের তীব্র বিতৃষ্ণা সে অনুভব করে। এই বিতৃষ্ণার জন্ম কোথায় সে জানে না। অথচ যে রকমের নির্বিরোধী জীবন মুখলেস সাহেব যাপন করেন সন্তান হিসেবে বিউটির তার প্রতি মায়া হওয়াই স্বাভাবিক। সারাটা জীবন ভদ্রলোক স্ত্রীর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে কাটিয়ে দিলেন। ঈশ্বরের আদেশ পালনের মতো অন্ধ বিশ্বাসে। প্রশ্নহীন, অভিযোগহীন। হয়তো সে কারণেই এত ঘৃণা। নাকি অন্য কোনো কারণ আছে, জানার বাইরের কোনো কারণ কিন্তু বোধের মধ্যে। কমোডের সিটে বসে বিউটি এই বিপুল প্রশ্নের মুখোমুখি হল আর এই নিয়ে ভাবতে তার খুব ভাল লাগল। মনে হল ভাবতে ভাবতে সে অনায়াসে আরও ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দিতে পারে।

* * *

মাটিতে এক ঠায় বসে থেকে ফরিদার ঝিমুনি এসে গেছে। আসরের নামাযের সময় পার হয়ে গেছে কি না মনে হতেই সচেতন হলেন, ঠেলেঠুলে উঠে দাঁড়ালেন। চা খেতে হবে নইলে মাথা ধরে যাবে—এরকম তুচ্ছ কথাও মনে এল। যথেষ্ট মনোযোগের সাথে ওযু করলেন, নামায পড়লেন। অন্যদিন নামাযে দাঁড়ালেই তার রাজ্যের কথা মনে পড়ে, রাবেয়ার মাকে কাপড় ধোয়ার সাবান বের করে দেয়া হয় নাই, পিচ্চি ডিম কিনে ভাঙতি পয়সা ফেরত দেয় নাই, চড় দিয়ে শয়তানের দাঁত ফেলে দেয়া দরকার, কালকে অনেক রাতে লাভলির ঘরের বাতি জ্বালানো দেখেছেন—বিষয় কী জানতে হবে। এইসব হাবিজাবি কথা জায়নামাযে খেয়াল হয়। আজকে সমস্ত মনোযোগ একাট্টা করে নামায পড়লেন। নামায পড়বার পরও ফরিদার মন শান্ত হলো না।

চায়ের কথা বলতে ঘর থেকে বের হলেন। অভ্যাস বশে ঘড়ির দিকে তাকালেন আর তাকিয়েই রইলেন। পাঁচটা বিশ—কী ভয়ঙ্কর কথা!

—রাবেয়ার মা, চায়ের পানি চড়াও।

—খালাম্মা, পিচ্চি আইজ কুনু কাম করে নাই কইলাম। সারাদিন খালুজানের ধারে।

রাবেয়ার মা’র কথায় ফরিদা কান দিলেন না। তিনি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলেন বিউটির ঘর বন্ধ।

—খালুজানরে চা দিছিলা?

—না দেই নাই।

—আমারে না জিজ্ঞাসা কইরা দিবা না। দিনে দুইবারের বেশি চা খাওয়া উনার জন্য ঠিক না।

—জি।

—এখন সবার জন্য বানাও।

ফরিদা ডিপ ফ্রিজ খুলে হাতে বানানো সিঙ্গারা গুনে গুনে ছয়টা বের করলেন।

—চায়ের সাথে এই সিঙ্গারা কয়টা ভাইজা দিও।

—জি।

বিউটির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফরিদা একবার ভাবলেন ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলতে বলবেন, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না করেই দরজার সামনে থেকে সরে গেলেন। এখন যদি বিউটি অযথা তর্ক শুরু করে দেয় তিনি মাথা ঠিক রাখতে পারবেন না। সবচেয়ে ভাল কাউকে না ঘাটানো। পিচ্চি আজকেও জানালার গ্রিল মোছে নাই—মনে পড়তে হন হন করে বারান্দার দিকে গেলেন। মুখলেস সাহেব মাথা নিচু করে ঘুমাচ্ছেন। তার থুতনি প্রায় বুকে ঠেকেছে আর পিচ্চি বারান্দার শেষ মাথায় গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও গলা নামালেন।

—পিচ্চি, পিচ্চি…

ফরিদার ডাক অত্যন্ত চাপা গলায় হলেও পিচ্চি ধড়ফড়িয়ে উঠলো। তিনি ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে পিচ্চিকে কথা বলতে নিষেধ করলেন। ইশারায় বাইরে আসতে বললেন আর নিজেও বেরিয়ে এলেন।

—সারাদিন কোনো কাজ-কাম নাই, না?

—খালুজানের ধারে ছিলাম খালাম্মা।

—খালুজানও ঘুমাইতেছে, তুইও ঘুমাইতেছিস—নবাব হইছস?

—জি না, ঘুমাইছি না।

—যা, সাবান পানি দিয়া জানালার গ্রিল মুছ গিয়া। কয়বার বলতে হয়?

ফরিদার সামনে থেকে যেতে পেরে পিচ্চি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। ফরিদা আবার খেই হারিয়ে ফেললেন। কী কাজে যে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন মনে করতে পারলেন না। এক পা দুই পায়ে বারান্দায় গেলেন। মুখলেস সাহেব ঘুমাচ্ছেন। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব একা লাগলো ফরিদার। আজকে তার জীবনে একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, কঠিন জটিলতা। তার বড় মেয়ে প্রথম একা বাড়ির বাইরে গিয়ে এমন একজন মানুষের খপ্পরে পড়েছে, যে মানুষ শুধুমাত্র একটা মুখের কথায় এই সংসার ধূলিস্মাৎ করে দিতে পারে। ফরিদা ঠিক করলেন লাভলি যখন ফিরে আসবে তিনি কিছুই বলবেন না বা জিজ্ঞেস করবেন না। অন্তত আজকে তো নাই-ই। আর আল্লাহ করুন লাভলিও যেন তাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে। জিজ্ঞেস করলে তিনি কী বলবেন বা বলা উচিৎ এই বিষয়ে ফরিদা আদতেই ভাবার কোনো সময় পান নাই। মুখের উপরে অস্বীকার করা যেতে পারে কিন্তু তাতে জটিলতা আরও বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। কোনো কারণ ছাড়া একটা লোক তো শুধু শুধু এরকম দাবি করতে পারে না। সত্য মিথ্যা মিলিয়ে বিশ্বাসযোগ্য একটা কিছু বলতে হবে, কিন্তু সেটা যে কী সেই বিষয়ে তার কোনো ধারণা নাই। নিজের পরিবারের সামনে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং তিনি কারও কাছে এতটুকু সহানুভূতিও প্রত্যাশা করতে পারছেন না।
==================================
লীসা গাজী
লেখক, অভিনেত্রী, নির্দেশক
leesa@morphium.co.uk

bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ লীসা গাজী
অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ

No comments

Powered by Blogger.