উপন্যাস- 'লালঘর' by ইচক দুয়েন্দে


তিনটা বাজল। চিকচাক রুই-এর মনে হল জীবনে সে প্রথমবারের মতো স্পষ্ট করে দেয়ালঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি শুনল।

স্কিক স্কিক স্কিক করে ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা বিরতিহীন মন্থর ঘুরছে। চিকচাক রুই-এর মনে পড়ল না যে কখনো সে এভাবে এক এক সেকেন্ড সময়কে যেতে দেখেছে।

এদিকে তার বুকটা উঠছে এবং নামছে। এরকম একটা ব্যাপার ঘটে সে জানত। কিন্তু এটাও সে লক্ষ করল জীবনে প্রথমবারের মতো। পাকস্থলীটা একটু বা বেশ ফুলে যাচ্ছে ও সঙ্কুচিত হচ্ছে। এটা যে ঘটে সেটা তার এক্কেবারেই জানা ছিল না। এটাও একটা লক্ষ করবার মতো ব্যাপার। আজ রাতে সে নিজের নরম বিছানায় নেই। মাথার তলে তার বালিশ নেই। থাকার প্রশ্নও নেই। সে দাঁড়িয়ে আছে। রুই দাঁড়িয়ে আছে একটা বর্গাকৃতি ঘরে। ৯ ফুট X ৯ ফুট। উচ্চতা প্রায় ১২ ফুট। ইটে তৈরি, ঢালাই ছাদ, পলেস্তরা লাগানো চুনকাম করা দেয়াল ও ছাদ। ফ্যান ঝোলাবার আঙটাটা কাটা। ঘরটার এক কোণে একটা দরজা দিয়ে যাওয়া যায় একটি ছোট্ট ঘরে। ৩ ফুট X ৩ ফুট। প্রকৃতির ডাকে মানুষ সেখানে যেতে পারে। ঘুটঘুটে অন্ধকার সেটা, বাল্ব নেই। সামনে গরাদ। প্রায় ৩ ফুট চওড়া। এক পাল্লা দরজার মতো গরাদটা খোলা বা বন্ধ করা যায়। এটাই ঘরটিতে ঢুকবার বা বেরুবার একমাত্র পথ। এখন বাইরে থেকে তালা লাগানো। বাইরে একজন সান্ত্রি দণ্ডায়মান। চিকচাক রুই এই ঘরটিতে আটক।



যদিও ঘরটিতে সে একা দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সে একাকী নয়। তার আরও দশজন সঙ্গী আছে। তারা সব্বাই শুয়ে আছে ঘরটার মেঝেতে। কতোটা স্থান সাশ্রয় করে মানুষ শুয়ে থাকতে পারে, এটা তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। শীতকাল তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘরটিতে কোনোই আসবাব নেই।

অলৌকিকভাবে একটা কম্বল জুটেছিল। নীল রঙের সেই কম্বলটা মাটিতে বেছানো। সেই কম্বলটা টায়টোয় আশ্রয় দিতে পেরেছিল দশজনকে। তাও খুব কসরত করে। এদিকে সরে ওদিকে সরে। এপাশ ফিরে ওপাশ ফিরে। কিছুটা ধাক্কা মেরে। কাত হয়ে। অবশেষে দশজন জায়গা পেয়েছিল। কিন্তু একজন বাড়তি থেকে গেল। সে বেচারা চিকচাক রুই দণ্ডায়মান।

সান্ত্রিরও বসবার কোনো ব্যবস্থা নেই।

এই আধ ঘণ্টা আগেও তারা টুকটাক কথা বলছিল। এখন নীরব।

জনাকীর্ণ শহরটায় দিনের কর্মব্যস্ততার শেষে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। দূরে দ্রুতগামী যানবাহনের শব্দ এখন ভীষণ প্রকট হয়ে কানে বাজছে, যা দিনে অন্যসব শব্দের ভিড়ে থাকে ম্রিয়মাণ। ঘড়ির টিক টিক ঠিক ঠিক ধ্বনি, বুকের ভেতরের ধুকপুক ধ্বনির সঙ্গে একাকার হয়ে ছলাৎ ছলাৎ করে বাজে।

তারা আশঙ্কা করছিল ব্যাপারটা ঘটবে, কারণ তারা এ সম্পর্কে ফিসফাস শুনেছিল।

পাশের হাজতঘরে তালা খুলবার টকাং শব্দ হল। শব্দ হল খটখটাং গরাদের দরজা টানবার। কাউকে বের করা হল। কয়েকজন মানুষের পায়ের শব্দ শোনা গেল। কয়েকটি বলিষ্ঠ পায়ের ধপ ধপ শব্দ। এক জোড়া অনিচ্ছুক পায়ের ছেঁচড়ে চলার শব্দ।

পায়ের শব্দগুলো নিকটেই কোথাও বাঁক নিল। শুধুই শব্দ, কিছুই দেখা গেল না স্পষ্ট করে।

৪০ ওয়াটের বাল্ব-জ্বলা নীরব ঘরটায় শুধু চিকচাক রুই একা শুনছিল না শব্দগুলো। শুনছিল সব্বাই। শুয়ে থাকা দশজনের দেহগুলো হয়ে উঠল একটু বেশি টানটান। আর তাদের কানগুলো হয়ে উঠল উৎকর্ণ। যা তারা সরাসরি দেখতে পাচ্ছিল না, তাকে তারা অতি মনোযোগী শ্রবণ দিয়ে যথাযথভাবে কল্পনা করে নিতে চাচ্ছিল। শোনা গেল:

‘মার খাতে নাই চাইলে স্বীকার কর্‌।’

‘মায়ের কিরা স্যার, আমি চুরি করি নাই।’

‘আমরা সব জানি, বল্।’

ঠাস ঠাস থাপ্পরের শব্দ হল। ‘মারে বাবারে’ চিৎকার ভেসে এল।

‘বল্ কে কে ছিল তোর সঙ্গে?’

‘আমি চু-উ-রি করি নাই।’ এই কথার সঙ্গে সঙ্গে লাথির শব্দ শোনা গেল এবং চিৎকারজড়িত কান্না, ‘মারে বাবারে মরে গেলাম রে। মারে বাবারে মরে গেলাম রে।’ এবং কোঁকানির শব্দ।

আবার সপাং সপাৎ শব্দ শোনা গেল এবং সজোর চিৎকার ও কান্না।

‘আপনার পায়ে পড়ি, স্যার। আমি জানি না, স্যার।’

কান্নার শব্দ ও কণ্ঠস্বর থেকে মনে হল ছেলেটির বয়স সতের কি আঠার। আবারো ছেলেটির জোর চিৎকার ও কান্না শোনা গেল।

অবশেষে সে বলে ফেলে, ‘জী, আমি চুরি করছি স্যার।’

আবার প্রহারের শব্দ শোনা গেল।

ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে এবারে বলল, ‘আমি চুরি করি নাই স্যার।’

‘যা। ভাব্। ঠিক কর্‌। কী বল্‌বি।’

ছেলেটির গোঙানি ও কাতর কান্না শোনা গেল। পরবর্তী শব্দগুলো শুনে মনে হল তাকে ফিরিয়ে নেয়া হল হাজতঘরে।

কিছুক্ষণ কাতর কান্নার হুহু শব্দ শোনা গেল। তারপর রাত্রির নীরবতায় গেল হারিয়ে ঐ শব্দটুকুও।

যতক্ষণ ধরে ঐ ধ্বনি ও কথাগুলি তাদের কানে পৌঁছুল, তারা মনে মনে তার ছবি দেখল। শব্দ ধ্বনি থেমে গেল, কিন্তু কেউ মুখ খুলল না। যেন তাদের কোনো মন্তব্য নেই। কেউ কেউ নিজেকে ঐ ছেলেটির অবস্থানে ভেবে শিউরে উঠল। অন্যেরা ভাবল, অসম্ভব, অমন কিছু তাদের জীবনে ঘটতেই পারে না।

চিকচাক রুই সন্তর্পণে পায়চারি করল ঘরটির যৎসামান্য ফাঁকা জায়গাটুকুতে। মাঝে মাঝে সে থামল। আরও জোরালো করে সে তার কান পাতল। শুনল।


‘ইংরেজি প্যাটর প্যাটর করতেছিল কে? এখন বোঝ্। যা ঘানি টান লালঘরের,’ গরাদের ওপারে পৌঁছেই সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন দিল আনচান ভাই।

‘দিনের বেলায় কোন পাগলায় ড্রিংক করে? তোরা ড্রিংক করা কবে শিখলি? ফল্‌স। তোদের কোনো গাট্স্ নেই। তোরা কী করছিলি? পিকনিক? ধরল কেন? অফিসারের সঙ্গে ইংরেজিতে প্যাটর প্যাটর করছিল কে?’ তুনির চুমক জিজ্ঞেস করলেন তামাশার সুরে।

‘আপনিও এর মধ্যে?’ বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন ইন্টুম কাসকেট, পুঁই চুলভির দিকে তাকিয়ে।

‘ড্রিংক করলাম আমরা। ধরা পড়লি তোরা। আমরা তো এখনি ড্রিংক কর‌্যা আসতেছি,’ দিল আনচান ভাই সহাস্যে বললেন আবার।

কে আদেশ দিল, সেটা এক রহস্য। সান্ত্রি বিনা বাক্যব্যয়ে গরাদের তালা খুললেন।

তুনির চুমক একটা বিরাট বাক্স বাড়িয়ে দিলেন, ‘খা।’ তখন রাত ৪ টা।

বাক্স খুলে দেখা গেল সাত পদের চাইনিজ। দুই ডজন লোক খেতে পারে এত্তো খাবার। বারো ঘণ্টা যদিও তারা পানি ছাড়া আর কিছু খায় নাই, ঐ খাবারগুলো দেখে তারা নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে থাকল। তাদের জিহ্বায় কোনো রস এল না।

এদিকে মিয়ান টিনটুই ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন, ‘অফিসার আসল। ফ্লিজ ফ্যাল উঠে দাঁড়িয়ে তাকে একটা সালাম দিল। তারপর ফ্লিজ একটাও বাংলা বলল না। অনর্গল ইংরেজি বলল। অফিসারও বলল। অফিসার রজেট চিনচুই-এর কাছে গেল। রজেট চিনচুই-ও ইংরেজি চালাল। কী থেকে কী হয়ে গেল তারপর আল্লা মালুম। ওরা কী বলেছিল আমি বলতে পারব না।’

‘ছোট ভাইরা, তোমরা দুধের শিশু, তোমাদেরকে কেন ধরল, বুঝেছ। তোমরা জ্ঞান ফলাচ্ছিলে। বুঝলে আর কক্ষনো জ্ঞান ফলাবে না। কক্ষনো কোনো অফিসার দেখলে ইংরেজি বাতচিত দেবা না। ইংরেজি বলতে চাও ইংল্যান্ডে যাও, আমেরিকায় যাও। যাও ইন্ডিয়ায়, ওখানে মুচিরাও ইংরেজি বলে, কিন্তু মদ খাও এই দেশে আরাম করে। বত্রিশ বছর ধরে ড্রিংক করি। দেখা হলে জিজ্ঞেস করে। বলি, অভ্যাস। ছাড়ে দেয়। আমার সোনার দেশ।

‘কিন্তু আমেরিকায় যাও। ড্রিংক করবা। অত সহজ না। বেটি বারবার করে বলে, আব্বু আসো, আসো। শেষে গেলাম আমেরিকায়।

‘একদিন গেছি একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরে। দেখি বিয়ার। কিনলাম একটা। বের হলাম। সামনে রেলিঙওয়ালা বারান্দামতো। চমৎকার জায়গা। রেলিঙে হেলান দিলাম। টান মারলাম। এক চুমুক দিছি।

‘আর সাইরেন বাজে উঠল। তাকিয়ে দেখি ইয়া বড় এক মটর সাইকেলের পিঠে চড়ে এক সার্জেন্ট হাজির।

‘শালা এক ঘণ্টা ইংরেজিতে কী ঝাড়ল ও শালাই জানে। আমি এক বিন্দুবিসর্গ বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম পাবলিক প্লেস, ড্রিংক করা যাব না।

‘পাবলিকের …

‘দোকানের এক দেশি কর্মচারী এসে বাঁচাল। জরিমানা হল না। প্রথম বার তো। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল।

‘বেটিক বললাম, তোদের বেহেশতে থাক, আমি দোজখে ফিরে আগুন খাই। সাত দিন পর চম্পট।’

দিল আনচান ভাই তার গল্প শেষ করলেন।

‘ছোট ভাইরা, তোমরা ভেব না। তোমাদেরকে খামাখা ধরছে। সকাল নয়টা বাজতে বাজতে তোমরা বাড়ি যাবা,’ বললেন ইন্টুম কাসকেট নিশ্চিত করে।

তারা চলে গেল।

রেখে গেল সাহস।

তাদেরকে মনে হল ফেরেশতা।

আশ্বস্ত হল তারা, একটু আধটু খাবার খেল।


‘তুই ড্রিংক করতিস, এটা তো জানতাম না। একটু আধটু ইয়ে খাস, তা জানতাম। দিনে দুপুরে কী করতে ড্রিংক করছিলি? এই দ্যাখ আমার হাতে বোতল, বল্ এদেরকে ধরতে,’ হ্যাংলং ব্রিংলার তার হাতের মদের বোতলটি সান্ত্রির দিকে তাক করে বললেন মিয়ান টিনটুইকে।

‘দোস্ত, ব্যাপারটা ভুয়া। কে এই ভুয়া ব্যাপারটা রটাচ্ছে?’ মিয়ান টিনটুই আহত স্বরে বললেন।

‘ভুটক নন্দনচাট। চিনিস তো, দৈনিক সজীব সন্দেশের রিপোর্টার। আমি আর উবাব রহনাং মোটর সাইকেলে চড়ে পার্কের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। রাত ৩ টা। ভুটক জোরে চিৎকার করে আমাদেরকে থামাল। থামলাম। ও ওর গাড়ি থামাল।

‘নেমেই ওর ফার্স্ট কথা, ‘মিয়ান, জিয়াফ, রজেট গ্রেপ্তার হয়েছে। দিনে দুপুরে চরে বসে মদ খাচ্ছিল। বোতলসহ ধরে ফেলেছে। সঙ্গে মহিলাও থাকতে পারে।’

‘ভুটকের মুখ থেকে তখন যে গন্ধটা পাচ্ছিলাম, সে কথা তোদেরকে আর বললাম না। উবাব রহনাং তোদেরকে কতটা রেসপেক্ট করে তোরা তা কল্পনা করতে পারবি না। সে বলল, ‘কোনদিনও ওরা ড্রিংক করতে পারে না। ওরা খুব গুড পিপ্‌ল্‌। তোমরা ইচ্ছে করে ওদের চরিত্রহনন করছ। নিশ্চয়ই ধরলে অন্য কোনো কারণে ধরেছে।’

‘ভুটক বলল, ‘আমি নিজের কানে টপ অফিসারের কাছে শুনে আসছি।’

‘উবাব বলল, ‘আমি বিশ্বাস করি না।’

‘তারপর প্রায় একটা হাতাহাতির উপক্রম হল।’

শহরময় যে এরকম একটা ব্যাপার রটে গেছে সেটা জেনে সব্বার মনটা কেমন হয়ে গেল।

‘তোরা ভাবিস না। আমি গুরুর কাছ থেকে এক্ষুনি এলাম। আমি গুরুকে বলতেই তো গুরু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। উনি তক্ষুনি ডিসি সাহেবকে ফোন করলেন। ডিসি সাহেব জজ সাহেবকে ফোন করে দেবেন। জজ সাহেব এসপি সাহেবকে বলে দেবেন। একটা সিস্টেম আছে, তোরা ছাড়া পেয়ে যাবি। জানিস তো গুরু তো কোত্থাও যান না। ব্যাপারটা পলিটিক্যাল দিকে টার্ন নিতে পারে। আচ্ছা তোরা থাক্। চিন্তা করিস না। এই ছাড়া পালি বলে। আমি চলি। মন খারাপ করিস না,’ এসব কথা বলতে বলতে হ্যাংলং ব্রিংলার তার মাথার মাঝখানে লাল রিবনে বাঁধা খাড়া চুলের ঝুঁটি নাচিয়ে তার হাতের জনি ওয়াকারের বোতলটা ঘোরাতে ঘোরাতে উপস্থিত সান্ত্রিটির বিব্রত কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেন।

তখন এলেন সুদর্শন তিনাশ দ্রিপ্রাড়। এসেই বললেন, ‘মিয়ান ভাই শুধু একবার আমাকে খবর দিতেন। তাহলে আমি এতক্ষণে…। আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি উকিল খুঁজতে বেরুলাম। জরিমানার টাকাও করতে হবে জোগাড়। আর দেখতে হবে তদবিরে কী ফল ফলল। ইস্ কালকেই যদি জানতে পারতাম। ব্যাপারটা এতদূর গড়াত না।’

তিনাশ দ্রিপ্রাড় চলে গেলেন। কিন্তু ফিরে এল না কেউ।


‘কী অপরাধ আমাদের?’ মিয়ান টিনটুই বললেন। ‘আমরা কি খুন করেছি? আমরা কি ছিনতাই করেছি? আমরা কি ডাকাতি করেছি? আমরা কি চুরি করেছি? কেন আমরা হাজতে? কী আমাদের অপরাধ? আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি এই নগরীতে এমনকি একটা কাকও বলতে পারবে না কখনও তাদের একটা ঢিল মেরেছি। কোনোদিনও একটা বেড়ালকে লাত্থি মারি নাই। গরিবকে কোনো দিন ছোট চোখে দেখি নাই। অক্ষম ভিখারির জন্য স্কুলে পড়াবস্থায় একবার সঞ্চিত পাঁচ টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম। হায় প্রভু, এই তোমার বিচার! আমার সকল মানসম্মান লুণ্ঠন করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী- গাঁজাখোর-মাতালের সঙ্গে এক কাতারে ফেলে আমায় জেলে ঢোকালে?’

‘অজ্ঞতার অভাবে,’ লালু পাঞ্জুমম মৃদু হাসলেন। ‘অর্থাৎ আমি ইচ্ছা করলে এইখানে এই হাজত ঘরে আপনাদের সঙ্গে নাও আসতে পারতাম। এক্কেবারে পরিষ্কার। ওনারা আপনাদের সব্বার হাতে খট্টস হ্যান্ডকাপ হাতকড়া পরালেন। আমার হাতে পরালেন না। আপনাদেরকে গরুভেড়ার মতো তাড়িয়ে নিয়ে গেলেন ওনারা। আমার জানটা কেমন করে উঠল। বললাম আমারেও হ্যান্ডকাপ লাগান। ওনারা বললেন আর হ্যান্ডকাপ নেই। আমি আপনাদের পেছন পেছন গাড়িতে উঠে পড়লাম। এই যাকে বলে অজ্ঞতার অভাবে। আমার কিছু কিছু দোষ আছে। যেমন ধরেন আমি নাক খোটলাই। আমার কয়েকটা মাড়ির দাঁত নেই। এছাড়া কোল্ড স্টোরেজে আলু স্টক করি ও সিজনে বিক্রি করি। তিনিই জানেন কেন তিনি আমাকে এখানে রেখেছেন। আমার বউ একটু চিন্তা করছে। আমি নাই। আমে রাতে ফিরলাম না। আমি কোথায় গেলাম। আমার চরিত্র ভালো। তিনি বেশি চিন্তা করবেন না।’ ‘আমার আর কোনো ব্যক্তি-স্বাধীনতা থাকবে না,’ ফ্লিজ ফ্যাল নিশ্চিতভাবে বললেন। ‘আমার বউ বলবে তুমি নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছিলে। ভালো মানুষকে হাজতে পুরবে কেন? ছি ছি ছি তুমি মাদকদ্রব্য চোরাচালান করতে! আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। তোমার কোনো দোকান নেই, পাট নেই, নেই কোনো ব্যস্ততা। কোত্থেকে তুমি টাকা কামাও। বুঝলাম তুমি চোরাকারবারি। আমার ভাই বলবে ছি ছি ছি তুই বংশের কলঙ্ক। পাড়ায় আমি আর মুখ দেখাতে পারব না। লোকে ভাবে আমার অনেক অনেক টাকা। কেন ভাবে তাও আমি জানি। সব সময় আমার মুখে থাকে হাসি। অবলীলায় আমি ফিরিয়ে দিতে পারি বড় বড় চাকরির অফার। লোকে তো ভাববেই আমার অফুরন্ত টাকা। ভোঁ ভোঁ। আমার পকেট একদম ফাঁকা। যদি এরা সত্যিই মামলায় ফেলে দেয় জানি না কোত্থেকে দেব উকিলের টাকা।’

‘ইয়ে বাসুসুমে কিনসু ভি কুয়াকাটা হ্যয়,’ তিয়াস ঠিসটক অত্যন্ত প্রফুল্ল মনে বলে উঠলেন। ‘মিস্টার ইমুস ক্যাটস্, কী খবর? আপনার তদবিরে কী ফল ফলল? আমরা কেন এখনও ছাড়া পেলাম না। আমরা কি আদৌ ছাড়া পাব। না কি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের তোলা হবে আসামির কাঠগড়ায়? হুঁ! আচ্ছা! আমার মন বলে দিচ্ছে আমাদের উঠতে হবে না কাঠগড়ায়। কচু। কিসসু হবে না। আমি নাই। আমি বাড়িতে নাই। কেউ আমার খোঁজ করবে না। কেউ আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে না। কেউ জানবে না। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।’

‘আমার মনে হয়। বা আমি বিশ্বাস করি। বা আপনারা ধরে নিতে পারেন। আমি আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি,’ ইমুস ক্যাটস্ দ্বিধান্বিত চিত্তে বললেন।

‘কালকে রাতে দেখলাম আমার নিজের চোখে, এক সারি পিঁপড়া, লাল ছোট ছোট পিঁপড়া, পিল পিল করে পিঠে খাবারের বোঝা নিয়ে চলেছে, এই ঘরের মধ্যে দিয়ে। কোনো সান্ত্রি জোর করে তাদের ঢোকায় নি হাজতঘরে। নিজ ইচ্ছায় আপন আনন্দে তারা করে চলেছে শীতের খাবার সঞ্চয়। মনে হল আমরা সব্বাই ঐ পিঁপড়েগুলির চেয়েও অধম। কোনো পিঁপড়ে তার সহজাতি পিঁপড়েদের গ্রেফতার করে হাজতে পোরে না। কিন্তু আমরা পুরি। হে প্রভু, কেন তুমি আমাদের এত নিকৃষ্ট করে সৃষ্টি করেছ?’ ফিটিক চ্যাক হাহাকার করলেন। ‘আমাদেরকে ভাবতে হবে। তছনছ করে দিতে হবে। আমার রক্ত গরম হয়ে উঠছে। আমি হয়তো বিপ্লবী হয়ে যাব আগামী দিনে।’

‘ননসেন্স,’ অত্যন্ত মৃদু স্বরে শ্যামল চিল বললেন। ‘হ্যালুসিনেইশন। বিভ্রম। সুস্পষ্ট বিভ্রম। আপনাদের সব্বারই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। রাবিশ। মিস্টার ফিটিক চ্যাক, এটা শীতকাল। এখন পিঁপড়াদের দেখবার কোনো প্রশ্ন উঠছে না। আপনি গত রাতে পিঁপড়া দেখেন নি এখানে। প্লিজ আবোল তাবোল বকবেন না। আমি একদম আবোল তাবোল কথা সহ্য করতে পারি না। পৃথিবীতে আপনারাই প্রথম হাজত ঘরে ঢুকলেন না। আপনাদের আগেও কোটি কোটি লোক হাজতে কারাগারে ঢুকেছিল এবং আপনারা মরেটরে ফৌত হবেন, পচে মিশে যাবেন মাটিতে এবং আরো কোটি কোটি লোক ঢুকবে জেলখানায়। এই কাহিনী শেষ হবে না। আপনারা এখানে আরামে আছেন। আপনাদের কেউ লাত্থি মারে নি। ধাক্কা মারে নি। বাজে খিস্তিখেউর করে নি। বসতে দিয়েছে। হাতকড়া নিয়েছে খুলে কয়েক মিনিট পরে। আপনাদের জন্য তদবির চলছে। ছাড়াও পাবেন হয়তো কয়েক মিনিট পরে। দয়া করে নাটক ড্রামা যাত্রা করবেন না। শান্ত থাকেন।’

‘আপনি আমার যুক্তিকে ধুলিসাৎ করে দিলেন। রাবিশ বললেন। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আপনারা মানুষরা খুব খুব জঘন্য। আপনাদের সঙ্গে মেশা যায় না। কবুতরদের দেখুন তারা বাকবাকুম বাকবাকুম করে। শুধু বন্ধুত্ব। তারা শুধুই বন্ধুত্ব করে। কোনো ঝগড়াঝাঁটি খুন খারাবি নেই। দেখুন আমরা এখানে যারা আছি প্রায় সব্বাই মাস্টার ডিগ্রি হোল্ডার। যিনি আমাদের ধরলেন তিনিও মাস্টার ডিগ্রি হোল্ডার। কিন্তু তবুও তিনি আমাদের কুকুর বেড়ালের মতো ধরে ফেলবার আদেশ দিলেন। ছি ছি ছি,’ শ্যামল চিলের যুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন ফিটিক চ্যাক।

‘আপনাদিগের সৌভাগ্য,’ শ্যামল চিল সান্ত্বনা দিলেন। ‘আপনারা প্রত্যেকেই পাপী। বাট্ ছিঁচকে পাপী। আপনারা বড় বড় ডায়ালগ মারতে ওস্তাদ। জানেন, প্রাচীনকালে জেলখানা ছিল না, জরিমানা ছিল না। অপরাধী ধরা পড়লে হয় দেয়া হত মার্‌ অথবা কেটে নেয়া হত গর্দান, চড়ানো হত শূলে। বাঁইচে গেছেন। আল্‌সার দল। শুধু বড় বড় বক্তৃতা।’

তাদের হাতে হাতকড়া পরবার পরে, প্রথম কয়েক ঘণ্টা তারা বিশ্বাসই করতে পেরেছিল না যে তারা আটক। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল, এ কোনো ভ্রম নয়, নয় কোনো বাস্তব রসিকতা, সত্যিই তারা আটক। যে-সামান্য অজুহাতে তাদের ধরা হয়েছিল, তাকে তারা একটা অজুহাত বলে মানতেই পারছিল না। এই যেমনটা আমরা ভাবি, এক রকমের পাপ করে আরেক রকমের বিচার পেতে হয়, তাদের ভাবনার ধারাটা হয়ে উঠেছিল অনেকটা এরকম। কীভাবে কত দ্রুত এই আটক অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে, সেটিই ছিল তাদের মূল ভাবনা। তার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে তাদের মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল তাদের জীবনের নানা ঘটনা উপঘটনা ছোটখাট বা বড় পাপ-পুণ্য। শ্যামল চিলের আকস্মিক আক্রমণে তারা হতভম্ব হয়ে গেল। ঐ স্বল্পস্থায়ী হাজতবাস তাদের মনকে অসাড় করে দিয়েছিল। তারা গুনগুন করে অনেক যুক্তি সাজাল, শ্যামল চিলকে উচিত জবাব দেবার জন্য, কিন্তু মুখ ফুটে একটিও শব্দ করতে পারল না।


‘তিথি বরাভয়-এর কথা শুনলে, আজকে আমার এ দশা হয় না,’ ভাবল পুঁই চুলভি। ‘আমার এইসব আঁতলামি ভালো লাগে না। একটা মিশুক নিতাম। দু’জনে মিলে চলে যেতাম নগরীর সব সব কোলাহলের বাইরে। মিশুক গ্রামের মধ্যে এক নির্জন মাঠের মধ্যে থামত। হলুদাভ সবুজ ঘাস। বসতাম সেখানে আমরা। গাছে গাছে ঝরা পাতা। মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস। একবারে তরতাজা।

‘তিথি তার খরগোসের মতো পিটিপিটি চোখ মেলে ঝিলিমিলি বিস্ময়ে তাকাত। একটা ঘাস তুলে নিয়ে সে মুখে পুরে দিত। সে জিজ্ঞেস করত, ‘বলো তো ঘাস সবুজ কেন?’ আমি বলতে পারতাম না। কারণ আমি তো উত্তরটা জানি না।

‘তিথি তখন হাসত। তিথি বরাভয়ের দাঁতগুলো খুব যে সুন্দর তা বলা যায় না। তবু আমার প্রিয় বান্ধবী তো, আমি বলতাম, ‘তোমার দাঁতগুলো দুর্দান্ত, ইস্, আমারগুলো যা পচা।’

‘না, এখন কী যে বিপদে পড়লাম। আমার মাকে যে কী করে সামলাব? তিথিকে নিয়ে ভয় নাই। একটা বিরাট রোমহর্ষক গল্প ফেঁদে বসব।

‘বলব, ‘তোমার কথা না শুনে খুব ভুল হয়েছিল। তোমার বরদোয়া লেগে গেল।’ না ঠিক এ-ভাবে শুরু করাটা ঠিক হবে না। তিথি আবার মাইন্ড করবে। বলব, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে নাস্তাটাস্তা শেভটেভ গোসলটোসল সেরে রাস্তায় নামলাম। দ্রুত হাঁটছি। ফ্রেন্ডরা ওয়েট করছে। লেট হয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন মিস্‌ড্‌ কল পাচ্ছি। যেতে যেতে তোমাকে একটা এসএমএস করলাম।’ হ্যাঁ ঠিক হচ্ছে এ-ভাবে বললে জমবে। কী-যে মনোযোগ দিয়ে শুনবে আমার ছোট্ট খরগোসটা কানখাড়া করে। তারপর বলব, ‘দোস্ত বুঝলা একটা ঠোলা যাচ্ছিল। আমি একটুও খেয়াল করি নাই। হঠাৎ ওর পায়ের উপর আমার পড়ে গেছে পা।

‘আমি প্রথমেই ‘সরি’ বলছি। তারপরেই আমি বলছি, ‘আমি গভীরভাবে দুঃখিত; বলছি, ‘আপনার কি খুব লাগছে?’ ঠোলার হাঁটুতে থাকে বুদ্ধি। সে খামাকা গালাগালি, চিৎকার চোটপাট শুরু করল। আমি এত শান্ত মানুষ, কিন্তু সামলাতে পারলাম না নিজেকে, ‘বললাম, আমি একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক, তার যেমন আছে, আমারও তেমনি রাস্তা দিয়ে চলবার স্বাধীনতা আছে।’ কিন্তু সে বলে, ‘থানায় চলেন।’ লোকজন আমাদেরকে ঘিরে রাখল। আমি জোরে জোরে প্রতিবাদ করলাম। গাড়ি এল। আমাকে গাড়িতে তুলে ফেলল। ‘কর্তব্য পালনে বাধা প্রদানের সময়ে আমাকে গ্রেপ্তার করা হল।’

‘তিথি বলো এই দেশে কি থাকা যায়। চলো যে-দিকে দু’চোখ যায় চলে যাই। এই দেশে আর আর কোনোদিনও ফিরব না।

‘হয়তো আমার মন কেমন করবে আমার মায়ের জন্য। কিন্তু তাকেও নিয়ে চলে যাব সঙ্গে।

‘বাসায় থাকলে আজ সকালে খেতাম হাতে বানানো পাতলা ফিনফিনে তিনখানা রুটি, পেঁপে দিয়ে রান্না বুটের ডাল, একটু বুটের হালুয়া। শেষে এক কাপ ধূমায়িত দুধ চা। চা খেতে খেতে এসে যেত খবরের কাগজ। দেখতাম হেডলাইনগুলো। কতো খবর। কিন্তু কক্ষনোই মনে হত না আমি হয়ে যাব নিজেই খবর।

‘আমি সম্পূর্ণ নিরামিষাশী হয়ে যাবার কথা ভাবছি। মাছও নয় মাংসও নয়। শুধু শাকসবজি। কিছু দুধ মুড়ি খই। এই যে আমার খাদ্যাভ্যাস এবং সেই সঙ্গে বিদেশ চলে যাওয়া, তিথি বরাভয় বলে, এই দু’টোর একটা দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্ব তো থাকবেই। আমার ডান হাত আমার বাম হাতের মঙ্গল চায় না। আমার বাম পা আমার ডান পায়ের মঙ্গল চায় না। কিন্তু তিথি বরাভয় আমার মঙ্গল চায়। আমার মা আমার মঙ্গল চান। তিথি-র কোনো দুঃখ হোক সেটা আমি চাইব না। ধরা যাক, তার মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ল। এমন হলে আমার মনে খুব দুঃখ হবে। বলতে নেই, আমার মনে তিথির চেয়েও ভীষণ উদ্বেগ ও দুঃখ হবে। আমি ভাবব, আমি খুবই ভাবব তার ভালো চিকিৎসার জন্যে। আমি চেষ্টা করব একজন শ্রেষ্ঠ ডাক্তার খুঁজে বের করতে। আমার খুব কষ্ট হবে, তিথির যে-কোনো দুঃখে আমার এতটা কষ্ট হবে যে সেটা ঠিক আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

‘আমার মনটা কোমল। আমার প্রিয় উদ্ভিদ লজ্জাবতী লতা। মিমোসা। কর্কশ কিছু আমার ভালো লাগে না। পুরুষদের সঙ্গ আমার ভালো লাগে না। যদিও আমি একজন পুরুষ। পুরুষদের আমার জান্তব মনে হয়। মেয়েদের আমার অনেক অনেক বেশি মানুষ মনে হয়। তাদের হৃদয় আছে। তাদের মন আছে। তাদের সর্বোত্তম নিষ্ঠুরতা পুরুষদের চিমটির সমান। এই ঘরটায় এই এতগুলো মানুষের, পুরুষ মানুষের সঙ্গে থেকে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। এরা সব্বাই আমার বনধু। হ্যাঁ এরা, এরা আমার বনধু। অসহ্য! অসহ্য! আমার ব্রিদিং প্রবলেম হচ্ছে। আমার মার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। এদেরকে আমার একদম ভালো লাগছে না। এই ঠোলাগুলো ব্রুট। আমার বন্ধুরা ব্রুট। এদের কারো মধ্যেই প্রার্থিত কোমলতা নেই। এরা কেউ সভ্য নয়। এদের রক্তে এখনও নেচে চলেছে বর্বরতার কৃমি।

‘পৃথিবীটা যদি আমার আর তিথির মতো মানুষে ভরা থাকত তাহলে এখানে কোনো যুদ্ধ হানাহানি মারামারি কাটাকাটি খুনখারাবি ঝগড়া বিবাদ গণ্ডগোল কোন্দল ভুল বোঝাবুঝি থাকত না। তিথি যখন বলে, ‘চলো নদীর ধারে যাই’ আমি অনায়াসে বলি ‘চলো যাই’। কিন্তু অন্য মানুষেরা কী করে? তারা কথায় কথায় ঝগড়া করবে। ছোট্ট ব্যাপারকে বিশাল বানিয়ে ফেলবে। এরা কমপ্লেক্সে ভোগে। হ্যান করেঙ্গা ক্যান করেঙ্গা। বাস্তবে এরা ফুটা কাপ্তান। এদের সঙ্গে আমি যে কী করতে মিশেছি। তিথি আমাকে কতোবার বলেছে। বলেছে, ‘মনের মতো লোকের সঙ্গে মেশ। যাদের সঙ্গে তোমার মেলে। তোমার একটা সম্মান আছে। তুমি বোঝ না। পৃথিবীটা অসরল।’ আজ মূল্য দিচ্ছি তিথির কথা না শোনার। তিথি আজ তোমাকে কথা দিলাম, আর কক্ষনো আমি তোমার কথার অবাধ্য হব না।

‘আমার বন্ধুগুলো বর্বর ও অপরিণামদর্শী। পৃথিবীতে যে জেল আছে, হাজত আছে, তা এদেরই জন্য, এদেরকে ঠিকঠিকভাবে শায়েস্তা করবার জন্য। ওরা দেখতে পেল, একজন অত্যন্ত সম্মানিত বড় কর্তা ওদের কাছে এসেছেন। তার সঙ্গে মেপে হিসেব করে প্রয়োজনীয় কথা বল। ওয়াক ওভার দাও। না, ও মা, তর্ক! কথার ফুলঝুরি। সব জায়গায় ওস্তাদি কাজ করে না। সব জায়গায় এত কথা বলতে নেই। আমি তো সব সময় চুপচাপ ছিলাম। নাম জিজ্ঞেস করল, বললাম। পিতার নাম, বললাম। ঠিকানা, তাও বললাম। তারপর চুপ মেরে গেলাম। আর একটাও কথা বললাম না। এখন এরা হিস্ট্রি খুঁজছেন জেলখানার। রিসার্চ করছেন। ভালো লাগে না। আমি নিজের কাছে স্পষ্ট। আমি তিথিকে ভালবাসি।

‘আমার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। আমি এদেরকে একটুও বুঝতে দেব না। কিন্তু এদের সঙ্গে আমি আর মিশব না। এদেরকে খরচ করে ফেললাম। দেখা হবে হাসব, কথা বলব, চা খাওয়াব। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। কোনো পার্টি, নো। কোনো পিকনিক, নো। বেড়ানো, নো। আড্ডা, নো। এদের সঙ্গে এসব চলে না। মাঝে মাঝে হাই হ্যালো করব। বুঝিয়ে দেব, আমি তাদের সঙ্গে আছি, আসলে কিন্তু আমি নেই। আমি চলে গেছি যোজন যোজন দূরে। আসলে আমি অন্যরকম। অনেকটাই অন্যরকম। আমাকে কেউ বোঝে না। এরা এন্তার বেন্তার কত কথা বলে চলেছে। এরা কেউ কি আমার মনের খোঁজ নিল? না, এরা নিজেদের জাহির করাতেই ব্যস্ত। তিথি আমাকে বুঝতে পারে। তিথির জন্য আমার মনটা কেমন করছে। প্লিজ তিথি তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। ছাড়া পাই, তোমার কথামতো আমি ধূমপান করব না আর। কথা দিচ্ছি। প্লিজ।’


‘আমি দৈনিক পরশপাথর থেকে এসেছি। আমি সাংবাদিক। সত্যের মূল তুলে উপড়ে ফেলতে চাই আমি। আপনারা একে একে আপনাদের নাম পরিচয় বলুন। নির্ভয়ে বলুন। নির্দ্বিধায় বলুন কী ক্রাইম আপনারা করেছেন। আপনাদের ছবিসহ আমরা ছেপে দেব। বলুন, বলুন, একে একে বলুন,’ সাংবাদিক হিপ হিপ হুররে অত্যন্ত দ্রুত ব্যস্ত কথাগুলো বললেন। ‘কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে এসে পৌঁছুবে দ্য জলপাই টিভি-র ক্রুরা। আপনারা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও কাভারেজ পেতে চলেছেন। রাতারাতি নিখরচায় আপনারা পৌঁছে যাচ্ছেন খ্যাতির উত্তুঙ্গ শিখরে। কুইক কুইক তাড়াতাড়ি বলুন। আমার সময় নেই। আই হ্যাজ নো টাইম। আই ইজ ভেরি ভেরি বিজি। এখান থেকে যেতে হবে পার্কে, সেখানে একটা চিতাবাঘ খাঁচা থেকে বেরিয়ে লণ্ডভণ্ড করছে সবকিছু। তারপর যেতে হবে হাসপাতালে, সেখানে এক ছেলের মাথায় মহিষের শিঙ গজিয়েছে, তুলতে হবে তার ছবি। একসঙ্গে সতেরটা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সামলাতে হয় আমাকে। ব্যস্ত, আমি খুব ব্যস্ত। আই ইজ ভেরি ভেরি বিজি। পুরুষের ছদ্মবেশে আপনাদের মধ্যে লুকিয়ে আছেন এক ডাকসাঁইটে মহিলা, এটা জেনে আমি ছুটে এসেছি, সব কাজ ফেলে। বলুন কে সেই নায়িকা? কে সেই হার্টথ্রব? এদেরকে আপনারা ঘুষ দিয়েছেন কত? দীর্ঘ আঠার ঘণ্টা কাটিয়ে দিলেন হাজতে। কীভাবে আমাদের চোখ এড়িয়ে? বলুন বলুন ঝটপট বলে ফেলুন। ভেতরে ভেতরে ডিল চলছে। মন্ত্রীমিনিস্টাররা দেনদরবার করছে। বিরাট বিরাট ব্যাপার। বলেন, বলেন, বলে ফেললেন কি জান পরিষ্কার। বলেন, কী করে পড়লেন এই জালে? কী ধরনের ক্রাইম? মার্ডার? কিডন্যাপ? হাইজ্যাক? ড্রিংকিং? স্টিলিং? ডাকাতি? আই এম নো এভ্রিথিং। আমার নাম হিপ হিপ হুররে। বাইরে আপনাদের জন্য আমার আরো ডজন ডজন সাংবাদিক ভাইরা অপেক্ষা করছে। ক্যামেরা হাতে রেডি। বাহির হবেন, আর ক্লিক ক্লিক। আর ক্লিক ক্লিক। সম্মান বাঁচাতে চান। মুখ খুলেন। বলেন সত্যি কথা। আমি সত্যের মূল উপড়ে তুলব। তবে ব্যবস্থা আছে। আপনারা যদি সব থামিয়ে দিতে চান। কিছু খরচ করতে হবে।’

‘প্লিজ এই টাকা কটি রাখুন,’ মিয়ান টিনটুই কিছু মুদ্রা ধরিয়ে দিলেন হিপ হিপ হুররের হাতে। ‘প্লিজ ছবিটবি তুলেন না, খবর ছাপিয়েন না। প্লিজ।’

‘যা দিলেন তাতে আমাদের প্রত্যেকের জন্য একটা করে চকলেট হবে না। প্লিজ কিছু বাড়িয়ে দেন,’ সাংবাদিক হিপ হিপ হুররে অনুরোধ করলেন।

‘এখন আমাদের পকেট ফাঁকা। মনে রাখবেন আপনার ছবি আমার মনে থাকবে আঁকা,’ মিয়ান টিনটুই প্রতিশ্রুতি দিলেন তাকে মনে রাখবার। ‘আমরা বস্তুতপক্ষে জানি না কেন আমাদের ধরা হয়েছে। যদি নিশ্চিতভাবে জানতাম আপনাকে এতক্ষণে বলে দিতাম।’

‘আচ্ছা দেখি সামলাতে পারি কি না?’ কণ্ঠে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করে সাংবাদিক হিপ হিপ হুররে তার ঘাড়ে ঝোলানো ব্যাগ ঠিকঠাক করে রওনা হলেন।

‘অদ্ভুত, তাই তো, আমাদেরকে ধরল কেন?’ রজেট চিনচুই বিষয়টা নিয়ে আলোচনায় যেতে চাইলেন। ‘আমার স্বভাবের একটা বড় দিক হল, আমি কিছুতেই রেগে যাই না। কক্ষনো এমন লাগামছাড়া কথা বলি না, যার জন্য পরে পস্তাতে হয় বা ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। দু’চার বোতল পান করলেও আমার নেশা হয় না। আমি জীবনে কোনোদিন পান করে আবোলতাবোল বকি নাই বা মাতলামি করি নাই। আমার শরীর ও মনের একটা চমৎকার মেলবন্ধন আছে। আপনাদের মনে আছে গতকালের সেই পড়ন্ত বিকেলে উদোম গায়ে আমি শুয়েছিলাম নদীতীরের বালিয়াড়িতে। কেমন ঝিমঝিম মাথা। যেন অনুভব করছি ঘূর্ণায়মান পৃথিবী। সূর্য অস্তায়মান। চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। আর আমার ডান হাতটা আমার মুখটাকে আড়াল করে রেখেছিল সূর্যালোক থেকে। আমার খুব ভালো লাগছিল। বেঁচে থাকা কতো না আনন্দের!

‘আমার সুন্দর মনোরম বিকেলটাকে একটা অচেনা জংলি উদ্ধত কণ্ঠস্বর নষ্ট করে দিল, ‘কে এখানে মরার মতো ঘুমায়?’ কিছুতেই আমার রাগ হয় না। লোকটির উদ্ধত বেরসিক প্রশ্নটার একটা যুৎসই জবাব দেয়াটা জরুরি জ্ঞান করলাম। এদের মতো লোককে প্রশ্রয় দেয়াটা ঠিক নয়। না শুনতে চাইতেই লোকটি তার পরিচয় দিলো এভাবে যেন শুনেই আমাকে ভড়কে যেতে হবে, উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করতে হবে। কিন্তু আমি শুধু আমার চোখটা খুললাম। হাতটা সরালাম আমার মুখ থেকে। দেখলাম লোকটাকে। আমাদেরই মতো একটা মানুষ। চেহারা বা পোশাকে একটুও আলাদা কিছু নয়। কিন্তু অতি উদ্ধত দৃষ্টি।

‘আমি ধারণা করলাম লোকটি আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থার কর্তাব্যক্তি হবে। আমি বললাম, ‘আমার ভালো লাগছে এখানে আমি ঘুমিয়ে আছি। আমি একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। অপর কোনো মানুষের বিরক্তি বা অসুবিধার কোনো কারণ না ঘটিয়ে আমার মনের মতো কিছু করবার স্বাধীনতা আমার আছে। আপনার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে আপনার ঘাড়ে চড়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের ভূত আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। আপনি আপনার পথে চলে যান। চাইলে একটু দূরে গিয়ে আমার মতো বিশ্রাম নিন। বিদায়।’ তার মুখটা থমথমে হয়ে উঠল। মনে হল তার ইচ্ছে করছে তখনি কিছু করে ফেলার। তারপর সে তার রাগটা সামলে নিল। সে তার পথটা একটু বদলাল এবং কিছুটা দ্রুত হেঁটে চলে গেল। সে আমার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল। আমি আবারো নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম নিতে লাগলাম। ক্রমে সূর্যের তাপ ম্লান হল। আমার ঐ কথাগুলির জন্য হাতকড়া পড়বে আমার হাতে, এ আমার যুক্তি-বুদ্ধি-জ্ঞানের অতীত। জানতাম আমি, হাজতে, কারাগারে যায় অপরাধীরা। আজ আমি সম্পূর্ণ নতুন কিছু জানলাম। মনে হল এতোটা কাল পৃথিবীতে কাটানোর পরও আমি শিশু।

‘আসুন, এই সুস্পষ্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে। আপোস করলে চলবে না। মিয়ান ওভাবে ঘুস দিয়ে ঠিক করলেন না। আমরা চোর দাগি আসামি নই। আমরা ন্যুব্জ, পরাজিত নই। জয় আমাদের হবেই।’

রজেট চিনচুই-এর কথা শেষ হলে মিয়ান টিনটুই বললেন, ‘আমরা দাগি আসামি নই বলেই আমাদের সুনাম রক্ষার জন্য চেষ্টা করতে হচ্ছে।’


‘আপনাদেরকে আদালতে যেতে হচ্ছে, এমনিতে ছাড়া পাবার আপনাদের আর কোনোই উপায় নেই, নগরীতে আপনাদের গ্রেফতারের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আপনারা আর আমাদের আয়ত্তের মধ্যে নেই। বিশেষ করে ঐ লোকটি (তিনি ফ্লিজ ফ্যালের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন),’ মসৃণভাবে দাড়ি কামানো, গোঁফওয়ালা, লম্বা, দেড়হারা, সুঠামদেহী, সুদর্শন, ওয়াকিটকিধারী, রোমান্টিক কর্তাব্যক্তিটি আটক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ কতোটা অন্ধকারাচ্ছন্ন তা সুদৃঢ় রূপে বর্ণনা করা শুরু করলেন। ‘যাই হোক ঐ লোকটি সবকিছু গোলমাল করে দিয়েছে। সে ওখানে অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেছে। ফোন করেছে সে আমাদের এক বড় কর্তার কাছে। তিনি আবার ফোন করেছেন আমার এক ডাইরেক্ট বড় কর্তার কাছে। আমার ডাইরেক্ট বড় কর্তাটি নিরপেক্ষ, সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ, অবিচল ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আপোসহীন আজীবন সংগ্রামী। পাশ্চাত্য শিক্ষায় তিনি সুশিক্ষিত। এই হেন অযাচিত, অনাকাঙ্ক্ষিত তদবিরে তিনি যারপরনাই ক্ষুব্ধ। আপনারা অপরাধী। কিন্তু প্রথমবার অপরাধ করেছেন, তাই তিনি এমনকি ভাবছিলেন তাঁর আপন ক্ষমতাবলে আপনাদেরকে ছেড়ে দেবেন, কিন্তু ঐ লোকটির অহেতুক, অশালীন তদবিরে তার মনটা গিয়েছে সম্পূর্ণ বেঁকে। আর কী যেন নাম উনার। আচ্ছা ফ্লিজ ফ্যাল। ফ্লিজ ফ্যাল আমাদের অফিসে যা বলেছে বা যা করেছে তা ট্রিজন-তুল্য। ট্রিজন কী বোঝেন? না বোঝেন না। যে দেশে থাকেন, সেই দেশের সংবিধান আইনকানুন বিধিবিধান জানতে হয়। ট্রিজন মানে হল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। আপনারা যতটা জুবুস্থুবু, খেয়ালি, স্টেটসে গেলে আপনাদের এয়ারপোর্ট থেকে আউট করে দিত। মিস্টার ফ্লিজ ফ্যালের কথায় আসি। সে আমাদেরকে হুমকি দিচ্ছিল। বলছিল তার কোন এক জেনারেল বন্ধু আছে, যে আমাদের সর্বনাশ করতে উদ্যত হলে, আমাদের কোনো রক্ষা নেই।

‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সভ্যদের ভয়ভীতি, হুমকি প্রদর্শন, কর্তব্য পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি মারাত্মক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ফ্লিজ ফ্যাল যে মারাত্মক দৃঢ়তার সঙ্গে হুমকি প্রদান করেছিল, তা আমরা হালকাভাবে নিতে পারি না। তার সঙ্গে কোনো পরাশক্তির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এবং আপনারা তার সহযোগী। আপনারা জেনে বা না জেনে জড়িয়ে পড়েছেন আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এক জঘন্য, ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রে।

‘আপনাদেরকে রিমান্ডে নিলেই আপনাদের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। আপনাদের পেছনে ও সামনে যে রাঘববোয়ালরা আছে, তারা ধরা পড়ে যাবে।

‘আমরা, আপনাদের ও আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিকে নিরবচ্ছিন্ন অতন্দ্র প্রহরা ও শৃঙ্খলা দিয়ে রক্ষা করে আসছি। কোনো অশুভ শক্তির চক্রান্ত এর ভরাডুবি ঘটাতে পারবে না।

‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমাদেরকে আইন জানতে হয়। আইন আমাদের বলে দেয়, কোনটি সঠিক আর কোনটি বেঠিক। আমাদের বাহিনীতে পদোন্নতি নির্ভর করে আইন জানার উপরে। সুশিক্ষার উপরে। সুপাণ্ডিত্যের উপরে। এখানে কোনো শর্টকাট নেই। আমরা অনড় ও অবিচল।

‘আমরা সব্বাই এক সঙ্গে ছুটিতে গেলে, হরতালে গেলে, এই দেশ যেত উচ্ছন্নে, মাত্র এক রাতে এই দেশ লুটপাট খুনখারাবিতে খতম হয়ে যেত।

‘আপনারা অপেক্ষা করুন, কিছুক্ষণের মধ্যে আদালতে নেব আপনাদের। বিজ্ঞ আদালত আপনাদের রিমান্ডে নেবার আদেশ দেবেন। এতদিন আমাদের সম্পর্কে বহু কল্পকাহিনী শুনেছেন আপনারা। আমরা শুধুই ঘুষ খাই। রিমান্ডে নেই, বুঝবেন আমরা কারা।’

রোমান্টিক কর্তাব্যক্তিটির মোবাইল বাজছিল। তাঁর কথার তোড়ে একটু বিলম্ব হয়ে গেলেও তিনি অতি দ্রুত মোবাইলে কথা শুরু করলেন, ‘জী, জী স্যার। হ্যাঁ, হ্যাঁ স্যার। জী, জী স্যার। আমি গাড়ি দেখছি স্যার। আচ্ছা, আচ্ছা স্যার। ঠিক আছে স্যার। উনাদের সব্বাইকে আপনার ড্রইং রুমে পৌঁছে দিচ্ছি স্যার। জী, জী স্যার। চা-টা স্ন্যাকস ইত্যাদি স্যার। হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার। সফট ড্রিংকস। আচ্ছা স্যার শীতের দিন। গরম কফি।’

‘আচ্ছা চলি। আমার ডাক পড়েছে,’ বলেই হঠাৎ করে রওনা হলেন রোমান্টিক কর্তা ব্যক্তিটি।

রোমান্টিক কর্তার কথাগুলো হজম করতে তাদের কিছুটা সময় লাগল। কিন্তু তার মোবাইল সংলাপ তাদের মনে এমন একটা অস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি করল যে তারা সহসাই ছাড়া পেতে চলেছে। এমনকি ছাড়া পাবার পরে তারা বড় কর্তার গৃহে আপ্যায়িতও হতে চলেছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাদেরকে মুক্ত করবার বিন্দুমাত্র উদ্যোগও কোথাও দেখা গেল না। মনে হল যেন পাহারা করা হল জোরদার, গরাদের শিকগুলো হয়ে উঠল আরো শক্তিশালী।

‘তাহলে আমিই দায়ী,’ ফ্লিজ ফ্যালের কথায় অনুতাপের রেশ দেখা গেল। ‘আমার বার্কি পরিস্থিতিকে এমন জটিল করে দেবে আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই। আমার এক ফ্রেন্ডকে মোবাইল করলাম। সে পাওয়ারফুল। সে বলল দুশ্চিন্তা কোরো না আমি দেখছি। আমার মনে পৃথিবী জয়ের আনন্দ হল। এই তো দু’মিনিটেই ছাড়া পাচ্ছি। তাই বার্কি নিতে ইচ্ছে করল। ওদেরকে জেনারেলের কথা বলে ভড়কে দিতে গেলাম। এখন কী করতে যে কী হয়ে গেল। আমি গভীরভাবে দুঃখিত।’

‘ফ্লিজ ভাইয়া, ভালো করছেন, ঐ বার্কিটা না নিলে আমরা এতক্ষণে গেছি। আমাদেরকে ভিতরে নিয়ে হাড় গুঁড়া করত। আমরা এতক্ষণে শেষ, পঙ্গু,’ তিয়াস ঠিসটক রক্ষা করতে চাইলেন ফ্লিজ ফ্যালকে।

ফ্লিজ ফ্যাল আশঙ্কা করছিলেন তার বন্ধুরা সব্বাই আক্রমণ করবে তাকে তার নির্বোধ আক্রমণাত্মক কথাবার্তার জন্য। কিন্তু দেখা গেল তারা সব্বাই নিঃসাড়, নিস্তেজ। রাতে তারা প্রায় কোনো আহার করেছিল না, সকালে যৎসামান্য। যে প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে তারা কথা বলছিল কিছুক্ষণ আগেও, তা হল উধাও। তাদের মনে এই নিশ্চিত বোধ এল যে আদালতে তাদেরকে তোলা হচ্ছে। সরাসরি ছাড়া পাবার উপায় নেই। সেখান থেকে তাদেরকে পাঠানো হতে পারে কারাগারে। অথবা নেয়া হতে পারে রিমান্ডে। অথবা তাদের হতে পারে জরিমানা ও তারা পেতে পারে ছাড়া। এই শেষোক্ত সম্ভাবনাকেই তারা মনেপ্রাণে চাইছিল। মনে মনে তারা মকশো করতে লাগল, কী বলবে আদালতে।


‘এই সবকিছুর আড়ালে রয়েছে একটা সূক্ষ্ম চক্রান্ত,’ ভাবলেন জিয়াফ ব্যানব্যাট। ‘আমাদের বিরুদ্ধে একটা আগাম গোয়েন্দা রিপোর্ট না থাকলে এরা আমাদেরকে কীসের ভিত্তিতে ধরল? এটা যে একটা চক্রান্তের ফল এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু থাক, বন্ধুদের সামনে এই হাজত ঘরে প্রসঙ্গটি আমি তুলব না। এদের সব্বাইকে দেখে রীতিমতো করুণা হচ্ছে। মনমরা হয়ে সব বসে আছে। ঘন ঘন যাচ্ছে ওরা ছোট্ট ঘরটায় প্রকৃতির ডাকে। সব্বাই ওরা অনভিজ্ঞ। জেলে বা হাজতে ওরা কোনোদিনও কাটায় নি। দুগ্ধপোষ্য শিশু। ওদের সৌভাগ্য জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা ওরা পেয়ে গেল। ভাগ্যিস ওদেরকে মারধোর করে নি।

‘প্রথমে আমার মনে হল ওরা আজকে রামধোলাই দেবে। আমাদের সামনে পৌঁছেই ওদের ডায়লগ, ‘কী, আমাদের বস্‌কে অপমান!’ আমি তক্ষুনি বুঝে গেলাম আজকে একটা খারাবি আছে। মনে মনে রেডি হয়ে গেলাম কীভাবে ব্যাপারটা ফেস করব। আমার মনে হয় আমিই একমাত্র ব্যক্তি ঐখানে ঐ কড়া পাহারার মধ্যে যে পালাতে চেষ্টা করেছিল। আমি যেই একটা ব্যাকওয়ার্ড মুভ দিলাম, অমনি একটি কিক্‌ খেলাম। কিক্ খাওয়ার কথাটা এখনো কাউকে বলি নাই। সম্ভবত অন্য কেউ দেখেও নাই। কাউকে এটা বলতেও চাচ্ছি না।

‘ওরা যখন গাড়িতে করে প্রথম ওদের অফিসে আমাদেরকে নিল, ওদের মধ্যে একজন আমাদেরকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আপনারা সব্বাই ফার্মের মুরগির মতো ধরা দিয়ে দিলেন। মস্ত এক ফাঁকা জায়গা, নদীর চরে ছিলেন আপনারা, আপনারা এগার জন এদিক-ওদিক দৌড়ালে, ইজিলি অর্ধেক পালিয়ে যেতে পারতেন। আপনারা পালাতে চেষ্টা করলে, আপনাদেরকে ধরতে আমরা পড়িমরি করে ছুটতাম না। আমরা মানুষ চিনি, বসের হুকুমে গিয়েছিলাম ওখানে, আমরা দেখে বুঝেছিলাম, আপনারা ক্রিমিনাল নন।’

‘ভদ্রলোকের কথাটা শুনে মনে মনে পস্তালাম। ঠিক, একদল ফিজিক্যালি ও মেন্টালি আনফিট লোকের মধ্যে আমি পড়ে গেছি। এরা বড্ড বকতে ভালবাসে, কিন্তু কোনো অ্যাকশন পছন্দ করে না। কিন্তু একটা প্রশ্ন, কীভাবে কেমন করে নিঃশব্দে, মিহির ফারতুই সটকে পড়ল। কোথায় সে হাওয়ায় মিশে গেল! কেমন করে গোয়েন্দারা জানল আমরা নদীর চরে ঐ জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে আছি! কে জানিয়ে দিল গোয়েন্দাদের! কে ছিল চর ওদের? এই বিষয়গুলি যদি আমরা স্পষ্ট করে জানতে পারতাম, তাহলে বোঝা যেত চক্রান্তটা। কে যেন বলল, কী একটা জরুরি মোবাইল কল পেয়ে মিহির ফারতুই দ্রুত রওনা হয়ে গেল। কে তাকে জরুরি কল দিল? গোয়েন্দাদের সঙ্গে তবে কি তার ছিল গোপন যোগসাজস!

‘আমাদের মধ্যে কারো সঙ্গে মিহির ফারতুই-এর কি ছিল বা আছে এক অপ্রকাশ্য শত্রুতা? সে কি সেই শত্রুতার জের টেনে ঘটাল এই ঘটনা!

‘উঁহুঁ, ব্যাপারটা এরা যেমন সহজভাবে নিচ্ছে, মোটেই তা তেমন সহজ নয়। মিহির ফারতুই খুবই বাজে ব্যবহার করছিল চিকচাক রুই-এর সঙ্গে পুরোটা পিকনিক জুড়ে। কেন মিহির ফারতুই উত্যক্ত করছিল চিকচাক রুইকে? তাদের মধ্যে কি ছিল পুরনো অজানা কোনো শত্রুতা?

‘আমি দুয়েকবার প্রসঙ্গটা তুললাম। না, ওরা কেউ আগ্রহী নয়। ওরা উড়িয়ে দিল। কিন্তু আমি অজস্র রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়েছি। আমি ছোটখাট কোনো ব্যাপারকেই উড়িয়ে দিতে পারি না। আমি সেই প্রথম থেকে ঘনিষ্ঠভাবে চিকচাক রুইকে দেখছি। এখানে সবচেয়ে মনমরা, চুপচাপ ও চিন্তিত মানুষটি হল সে।

‘কী ভাবছে সে? মিহির ফারতুই-এর সঙ্গে কতো পুরনো শত্রুতা চিকচাক রুই-এর? কী বিষয়ে শত্রুতা? ব্যবসায়িক লেনদেন? রাজনৈতিক? পারিবারিক? নাকি নিছকই ঈর্ষা — , পরশ্রীকাতরতাজাত? নাকি প্রেম?

‘থাক। আর ভেবে কাজ নেই। ভেবে ভেবে ভেবে আমার মাথার প্রায় সব চুলই গেছে পড়ে। মিহির ফারতুই-এর সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে বাকি চুলগুলিও যাক পড়ে তা আমি চাই না।

‘তবে আমি নিশ্চিত, আমি ছাড়া পেয়ে যাব। বিরাট কোনো ঝামেলা হবে না। আমার মন বলছে।

‘আমি জানি আমি কেন ধরা পড়েছি। এটা আমার বউয়ের বরদোয়া। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এটি আমি কোনোদিনই কাউকে বলব না।

‘কয়েক বছর আগের কথা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও কাজে বেরিয়েছি। এ-কাজ সে-কাজ ও-কাজ ব্যস্ততা। সারাদিন কেটে গেল। দুপুরে বাসায় ফেরা হল না। শেষে বাসায় ফিরলাম রাত আটটায়।

‘গ্রিলের দরজা। বাহির থেকে তালা লাগানো ও খোলা যায়। আমি তালা খুললাম। ভেতরে ঢুকলাম। এবং তারপর শুরু হল। আমার বউ আমার দিকে পরপর ছুঁড়ে মারল ছয়টা বালিশ। ভাগ্যিস বাসায় মাত্র ছয়টা বালিশই ছিল। পরে জেনেছিলাম, সে আমাকে ঝাঁটা ছুঁড়েই মারতে চেয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সে অনেকক্ষণ ধরে আমার উপরে রেগে ছিল তাই সে কী করবে বা না করবে সে-সম্পর্কে দীর্ঘক্ষণ ভাবার অবকাশ পেয়েছিল। তাই সে বালিশই নিয়েছিল বেছে।

‘আমার অপরাধ ছিল তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে আমি উধাও হয়ে গিয়েছিলাম। বাসার ডুপ্লিকেট চাবিটাসহ। ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ছিল না।

‘আমার বউ বলেছিল, ‘তুমি আমাকে আর আমার অবলা বাচ্চাটাকে আজ জেল খাটালে। আজকে আমি মায়ের বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম যাওয়া হল না। তুমি প্রতিদিনই দুপুরে বাড়ি ফের। আজকে তুমি ইচ্ছে করেই ফিরলে না। তুমি পাপ করলে। তুমি একদিন জেল খাটবে।’

‘কিন্তু আমার বউ একটা ব্যাপার জানত না। আমি এরই মধ্যে অর্থাৎ তার সঙ্গে বিয়ের আগেই জেল খেটেছিলাম। ব্যাপারটা তাকে বলি নাই। কারণ সে ভীরু ও সরল প্রকৃতির। সঙ্গে সঙ্গে সে ভেবে বসতে পারত আমি চোর বা ডাকাত। তাই বিষয়টা সম্পর্কে উচ্চবাচ্য না করাই ভালো মনে করেছিলাম।

‘আমি পলিটিক্যাল ব্যাপারে জেলে ছিলাম। ডিটেনশন এক মাসের। ডিভিশন পেয়েছিলাম। আমরা অর্থাৎ বিশ-পঁচিশ জন একত্রে জায়গা পেয়েছিলাম একটা ঘরে। সব্বাই রাজনৈতিক কর্মী। আমরা ছিলাম রাজবন্দি। ছিল বেশ একটা অন্য রকমের মর্যাদা। তাস পিটে, দাবা খেলে, আড্ডা দিয়ে, হৈ হুল্লোড় করে কীভাবে একটা মাস কেটে গিয়েছিল বুঝতেই পারি নি।

‘এবারে ব্যাপারটা খুবই নীচ। অভিযোগ অস্পষ্ট। কে জানে কী চক্রান্ত চলছে। একটা ব্যাপার, এখানে আমি ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কেউ কক্ষনো কারাবাস করে নি। এটা ভেবে কি আমার মনে গর্ব হচ্ছে? না বোধ হয়।’


‘অধমের নাম আগা আবদুর রহমান,’ প্রায় কুর্নিশ করে নতুন সান্ত্রি তার পরিচয় ঘোষণা করলেন। ‘স্যার, আপনারা সবাই প্রফেসর। আমাদের জাতির গৌরব। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আপনারা সেই মেরুদণ্ডের মেরুদণ্ড। কী এক সামান্য অপরাধে আজ আপনারা হাজতে। হ্যাঁ, স্যার আমি অভিযোগ শুনেছি। আপনাদের আদালতে তুলবে, দুই একশ জরিমানা করবে। তারপর ছেড়ে দেবে। তা আর দুই এক ঘণ্টার মধ্যেই আপনাদেরকে নিয়ে চলে যাবে। হয়তো গাড়ি ব্যস্ত আছে তাই বিলম্ব হচ্ছে। স্যার, আপনারা নাস্তা-পানি করেছেন?’

‘আপনাকে দেখে মনে পড়ে গেল মুজতবা আলীর চরিত্র আবদুর রহমানের কথা। প্রিয় আগা, আপনি যদি একটু চায়ের ব্যবস্থা করেন, আমরা কৃতজ্ঞ হব,’ মিয়ান টিনটুই তাকে সালাম নিবেদন করে অনুরোধ করলেন এবং সান্ত্রি আগা আবদুর রহমান বিনাবাক্যব্যয়ে এই অনুরোধটি রক্ষা করলেন।

‘স্যার, এমএ পাশ করলেই একজন ব্যক্তি প্রফেসর হতে পারে না, একজন ব্যক্তিকে জ্ঞানের জাহাজ হতে হয় প্রফেসর হতে হলে। আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল হব প্রফেসর। কিন্তু হতে পারিনি। আমার এই সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনে আমি কক্ষনো কোনো প্রফেসরকে ধৃত হতে দেখি নাই। তাই গতকাল রাতে যখন আমি শুনলাম আপনাদের মতো স্বনামধন্য একদল প্রফেসর ধৃত হয়েছেন, আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল, আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আকুল আকাঙ্ক্ষায়। ডিউটি নিয়ে চলে এলাম আপনাদের সান্নিধ্যে। জ্ঞানী ব্যক্তিদের সান্নিধ্য আমি এক কাপ সুপেয় মধুর চেয়েও অধিক পছন্দ করি। আপনাদেরকে দেখে আমার মনে আনন্দ হচ্ছে,’ আগা আবদুর রহমান তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন শিশুরা যে-বিস্ময়ে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের দেখে।

‘আহ্ স্যার, আপনাদের বেল্ট ও মাফলারগুলো খুলে নিয়ে ওরা রেখে দিয়েছে। ইস্ স্যার, আপনারা কতই না কষ্ট পেয়েছেন। ওগুলো দিয়ে অনেক হাজতি আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করে, তাই এই নিয়ম। মানুষ হাজতে বা কারাবাসে খুব লজ্জা পায়। খবরটা জানাজানি হয়ে যায়। তখন সমাজে রি রি পড়ে যায়। তাই তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। স্যার, আপনারা বিষয়টা সহজভাবে নেন। জীবনে ভুল হয়ে যায়, অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যায়,’ আগা তাদের দরদভরে সান্ত্বনা দিলেন।

‘স্যার, আমার বুকের মধ্যে একটা ইচ্ছা কিলবিল করছে। বলেই ফেলি, স্যার। এই চাবিটা দিয়ে তালাটা খুলে বলি, স্যার, আপনারা মুক্ত, ফ্রি চলে যান পাখা মেলে,’ আগা আবেগদীপ্ত স্বরে বললেন।

‘আপনার মতো মহৎ-হৃদয় মানুষকে এখানে পাব এ ছিল আমাদের স্বপ্নের অতীত,’ মিয়ান টিনটুই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।

‘স্যার, গতকাল সন্ধ্যায় আপনাদেরকে দেখেছিলাম এক ঝলক, কী জোয়ান, কী চেহারা, কী লাশ আপনাদের, আজকে স্যার, বিশ্বাস হচ্ছে না সেই আপনারা বসে আছেন এখানে। ইস্ স্যার, আপনাদের বডিগুলা আধখানা হয়ে গেছে। কোনো দানাপানি পান নাই, কোত্থেকে থাকবে শরীর? স্যার, আপনারা কি পলিটিক্স করতেন?’ কৌতূহল প্রকাশ করলেন আগা।

‘না না, রাজনীতি আমরা করি না। বলতে পারেন কেউ কেউ কিছুটা সাহিত্যিক,’ মিয়ান টিনটুই এর স্বরে অস্বস্তি প্রকাশ পেল।

‘আপনাদের পোশাক-লেবাস দেখেই বুঝেছিলাম আপনারা হবেন সংস্কৃতিমনস্ক সাহিত্যবোদ্ধা,’ আগা বললেন।

‘আগা, আপনি কি কবি? এত সুন্দর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছেন আপনি,’ মিয়ান টিনটুই সপ্রশংস স্বরে বললেন।

‘জী, টুকটাক লিখি। যেমন ধরুন শামুকে আমার ছ’টি কবিতা বেরিয়েছে। কলমিলতায় তিনটে। শিগগিরই একটি দৈনিকে আমার কবিতা বেরুবে। কিন্তু আমি কোত্থাও বলিনি আমি কোন ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। স্যার, আরেকটা সিক্রেট ব্যাপার আমি বলি আপনাদের, আমি একজন বিএ, এবং শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন আমাদের ওসি সাহেবও একজন বিএ,’ সরল খুশি মনে বললেন আগা।

সেই সময়ে আরেক সান্ত্রি এগিয়ে এলেন। ইনি পক্বকেশ বৃদ্ধ। এই কথাবার্তার মধ্যে তিনিও ঢুকে পড়লেন। হাজত ঘরে ওরা এগার জন প্রায় কোনো কথাই আর বলছে না। শুধু একে একে তারা ছোট্ট ঘরটায় প্রকৃতির ডাকে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। তারা নিঃশব্দ কিন্তু তাদের মনগুলো ভীষণ অস্থির। হাজত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তারা উদ্গ্রীব। এভাবে ছোট্ট একটা জায়গায় থাকতে তারা ছিল অনভ্যস্ত।

‘আমার নাম গোপেল পমেটম। এই ডিপার্টমেন্টে সাঁইত্রিশ বৎসর সার্ভিস করছি। আর একটা বছর তারপর রিটায়ার। যে পোস্টে ঢুকছি ঐ পোস্টেই রিটায়ার। তেল দিতে পারলাম না। তিনবার সাসপেন্ড হইছি। একবার চাকরি যাবার লাগছিল। তাঁর কৃপা, যায় নাই। আমগোরে সময় ডিপার্টমেন্টে ঢোকা সহজ আছিল না। ধরেন, দাঁড়ালেন লাইন পা ফাঁক করে, যদি পা ঠিক কইরা না দাঁড়ইতে পারেন তো আউট। তারপর এই আপনার পোশাকটোশাক খুইলা যন্ত্রপাতি সবটা ঠিকঠাক আছে কিনা হেইডা দেইখা লইত। হার্ড টেরনিং। বরফের মতন ঠাণ্ডা পানির মদ্য দিয়া সান্তার কাট। ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা মাইরা দৌড়াও, ইত্যাদি। কিন্তু এক্ষণ কী হয়? অফসার হইতাছে, কীভাবে হইতাছে? প্রাইম মিনিস্টারের পোলা টিকরি টুকরতের পকেটে ঢালো লাখ টাকা তারপর অফসার হও। হেই টেককা ইনাগোরে তো তুলতে অইবো। তাই হেরা আপনাগো কি ধরব, নাকি আমরা আপনাগো ধরব?

‘আপনারা ইয়াং ম্যান। আপনারা লিকার উকার খাইছেন। আমরা যখন ইয়াং ছিলাম লিকার উকার ধুমছে খাইতাম। শালা হামলে পড়লাম। ধরলাম দুটা মাতাল। তারপর ওদের পইসাতেই মদ খেইলাম। আমার নাম গোপেল পমেটম। ধরেন লোকে লিকার খাইল, ধরা পড়িল। আমরা বলিলাম দশ দশ করিয়া দিয়া দাও, কোর্টে তুলিলে বিশ বিশ করিয়া নিবে। উহারা টংকা দিল আমরা ছাড়িয়া দিলাম। আপনারা কি লেরকি উরকি নিয়া পাকড়াও হুইছেন। না? ঠিক হ্যয়।

‘আপনাগো কেসটা খুব জটিল। খুবই জটিল, এটাকে বলা যায় সিটন পিস্টন ধরনের। উনারা আমাদের বিশেষ বিভাগের নোক। উন্নাদের অন্নেক রঅস্য। স্যার, আপনাদের যে কত্তা বড় বিপ্পদ আসতেছে এটা ভাব্যে আমার বুকে ভিমিকম্প হয়ে যাচ্ছে। খুব টরচার হব স্যর।

‘আপনারা খরচার ব্যাপারে কিপটা। কলেজ গিয়াছেন তাই আপনাগোর নলেজ আছে। নো নলেজ উইদাউট কলেজ। কিন্তুক আপনাদের পকেট ফানকা। সব্বোনাশ। আপনাগোর কেনি লাঙুলে ফুটাইপ পিন। কিক্কুস। পায়ের নাঙুলে ফুটাইপ পিন। তারপর দিবক শক। পরথম অল্পক। তাপ্পর বহুত। ধরামতো পড়িলেন আচ্ছড়ি। গুরুমতো। যা বুঝবার বুইজ্‌ঝা লন। জান শ্যাষ। আমার দুইডা বাড়ি। থির্‌রিশ বিগা দানি ঝমি। মাইগোরে বিয়া দিছি। পোলারা হগ জুয়ান। একটাক প্রফরেছ কচ্ছি। একটা ডিবি পাইয়া ম্মেরিক্‌কায়। আরো টচ্চারের কতা কইতে পাত্তাম, কইলাম না। আপনাগোরে মুখ শুক্কাইয়া গেছে। আপনেরা হার্টফেইল কইত্তেন তাই কইলাম না। রেডিক থাক্কেন। আপনাগো নলেজ আচ্ছে। আপনাগো কানকো দিয়া নলেজ গড়াইয়া আছছে। কিন্তুক আপনাগো পঙ্কেট ফাঙ্কা। আগা, যাই, তুই থাউকগা। আম একটুক গড়াগ্গড়ি দিয়া আইসি। যন্তরপাত্তির সব ঢিল্লা হইয়া গেল্ রে। কিচ্ছুক চিমচিকা ধইরা আইনছে। রসকস সিঙ্গারা বুলবুলি কিচ্ছুক নাই। অপদ্দাত্থ। সক্কাল হইত্তক গলা ভিজ্জইবার জন্য এক ক্‌হাফ চা পাইলাম না। থাক আগা। বেহকখুফ।’

সান্ত্রি গোপেল পমেটম প্রস্থান করলেন।

১০

‘এত ছোট ছোট চুল রেখেছিস কেন তোরা,’ এগারজনকে উদ্দেশ করে হাজতঘরে ঢুকেই অচেনা লোকটির প্রশ্ন। যখন তিনি হাজতঘরটার সম্মুখের করিডোরে দেখা দিয়েছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে ওদের এগার জনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা কাঁপুনি নেমে গিয়েছিল। তার হাতে ছিল হাতকড়া, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি। করিডোরটা ভর্তি হয়ে গেল সান্ত্রিতে।

‘কই জবাব দিলি না, তোরা ঠসা নাকি?’ নবাগত আবার প্রশ্ন করলেন। তিনি ছিলেন খালি গায়ে, পরনে হাফ প্যান্ট। খালি পা। কালো। উজ্জ্বল দেহ। বিন্দুমাত্র মেদ নেই তার দেহে। সুউন্নত মেরুদণ্ড। তীক্ষ্ণ নাক। তীব্র অথচ সুগঠিত মুখমণ্ডল। উজ্জ্বল অতি ধারালো ক্ষীপ্র চোখ। কালো কুচকুচে ঝাঁকড়া চুল। তার বয়স আন্দাজ করা অসম্ভব। পঁয়ত্রিশ থেকে পঁচপান্নর মধ্যে হতে পারে।

তার সঙ্গে কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। কিন্তু এগার জনের সব্বার মনেই একটা অনুভূতি এল: লোকটি সশস্ত্র। পায়ে তার জুতো ছিল না। কিন্তু মনে হল তার পা জোড়া শক্তিশালী জুতোয় ঢাকা। আর জুতোর ফাঁকে ফাঁকে মোজা ঘেঁষে তিনি গুঁজে রেখেছেন এক ডজন ছুরি। তিনি যদি চান, তিনি একাই, তাদের এগার জনকে করতে পারেন সম্পূর্ণ পরাস্ত।

এর মধ্যেই বাইরে থেকে গরাদের তালা আটকে গিয়েছিল।

‘কী-রে তোরা বোবা নাকি?’ আবারো প্রশ্ন করলেন তিনি।

‘তোদের চুলে বেণী কোথায়? ছেলেদের মতো প্যান্ট শার্ট পরেছিস কেন তোরা? আর তোদের বুক চ্যাপ্টা কেন?’

রজেট চিনচুই, এগার জনের মধ্য থেকে প্রথম কথা বললেন, ‘আমাদেরকে তুই তোকারি করছেন কেন?’

‘প্লিজ, আপনি চিনচুই এর কথায় কিছু মনে করবেন না। আপনি আমাদের বড় ভাইয়ের মতো। আপনি আমাদেরকে আদর করে তুই বলতেই পারেন। প্লিজ মাইন্ড করবেন না। দেখতেই পাচ্ছেন, আমরা সব্বাই ছেলে বা পুরুষ। আমরা অ্যাডাল্ট। কেন আমাদেরকে মেয়ে জ্ঞান করে ঠাট্টা মস্করা করছেন?’ মিয়ান টিনটুই দ্রুত কথাগুলি বললেন রজেট চিনচুই-এর কথা আর বাড়াতে না দিয়ে।

‘আচ্ছা! তাহলে তোরা ছেলে? এই হাজত ঘরে তোরা ঢুকেছিস কেন? ঢোকার সময় দেখিস নি গরাদের উপরে লেখা ‘মহিলা’?’ তিনি ভীষণ মজা পেয়ে হাসলেন। ‘বস্, বস্ বসেই থাক তোরা। আমি এখানে তোদের পরে এলাম। আগেই চলে যাব। এরা আমাকে খরচ করে দেবে। আমার নাম উল্লাস ছাপ্পান্ন। আমার মাথার দাম লাখ টাকা। তোদের মতো ফুলবাবুদের ধরল কেন?’

ফ্লিজ ফ্যাল বললেন, ‘আপনাকে করিডোরে দেখলাম। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমশীতল স্রোত নেমে গেল। আপনি ভয়ঙ্কর। আপনাকে দেখে আমার, আমাদের ভয় লেগে গেল। এখন আর লাগছে না। কারণ আপনার নাম জানলাম। আমাদেরকে, আচ্ছা আমাদেরকে ধরেছে কেন? সংক্ষেপে বললে বলা যায় আমরা একজন বড় অফিসারের সঙ্গে ইংরেজিতে তর্ক করেছিলাম। এই সামান্য একটা ব্যাপার।’

‘ফুঃ। ফুঃ। আমি তিনটা ঠোলা নিকেশ করেছি। ওরা আমাকে পাকড়াও করার জন্য কমপক্ষে পঞ্চাশ বার অ্যাটেম্‌প্ট নিছে। দুইতিনবার প্রায় জালে পড়ে গেছিলাম। নিজের দেশ থেকে আমি নিরুদ্দেশ দশ বছর। হঠাৎ হঠাৎ বাড়ি যাই। আর যেই গন্ধ পাই, পালাই। তাই লালঘরে আমি তোদের জুনিয়র।

‘আমার বডিতে রাখতাম ছাপ্পান্নটা চাকু। বিশ-পঁচিশটা জোয়ান মরদকে আমি একাই একশ আটকে দিতাম। কাল ভোররাতে আমাকে ঘুমের মধ্যে ধরে ফেলল। বেইমানটা রাতে নিশ্চয়ই আমার ভাতে ঘুমের ওষুধ দিছ্ল। খাতে খাতে সন্দেহ হচ্ছিল। ঘুম দিলাম। কী ঘুম! জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘুম। নইলে বাতাসে আমি বিপদের গন্ধ পাই। আমার মন বলে দেয় কী ঘটবে।

‘ঘুম ভাঙল। দেখলাম হাতে হাতকড়া, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি। আজই আমার জীবনের শেষ দিন,’ ঘোষণা করলেন উল্লাস ছাপ্পান্ন, স্বপ্নাচ্ছন্ন মৃদু হাসি হাসলেন।

‘ভাইডি, কী নাম তোর,’ উল্লাস ছাপ্পান্ন জিজ্ঞেস করলেন মিয়ান টিনটুইকে। মিয়ান টিনটুই তার নাম বলতেই উল্লাস ছাপ্পান্ন বহু কসরৎ করে বহু কষ্টে তার হ্যান্ডকাফ পরানো হাত দিয়ে তার হাফপ্যান্টের একটা গোপন পকেট থেকে কয়েকটা পাঁচশ টাকার নোট এবং দু’টো খাম বের করলেন এবং বললেন, ‘তুই ভালো ছেলে, এই টাকা কটা রাখ্ আর আমার এই চিঠি দু’টা পোস্ট করে দিস। পিকনিক করিস।’

মিয়ান টিনটুই টাকাটা না-নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করে অসফল হলেন। এবং তখন দণ্ডায়মান সান্ত্রি খটাংটকাং করে তালাটা খুললেন এবং গরাদ খুলে গেল। দুই জন সবল সান্ত্রি উল্লাস ছাপ্পান্নকে দুই পাশ থেকে চেপে ধরে নিয়ে যেতে উদ্যত হল। যাবার আগে উল্লাস বলে গেলেন, ‘তোরা ভালো। তোদের চুলের কাটিং এবং চোখের চাউনি বলে দেয় তোরা ভালো। ছাগলের যে দুধের বাচ্চাগুলো থাকে ঐগুলির মতো তোরা ভালো। এগারটা মেয়ে আমার। যদি আমার মেয়েদের আগেই বিয়ে না দিতাম, তোদেরকে আমার জামাই করতাম। মেয়েগুলার মুখ আর কোনদিনও দেখতে পাব না। যাই।’

উল্লাস ছাপ্পান্ন চলে গেলেন। ফাঁকা হয়ে গেল করিডোর। তার পিছু পিছু সব সান্ত্রি চলে গেল। তাদেরকে পাহারা দেবার জন্য রইল শুধু একজন।

স্বস্তির নিশ্চিন্ত ভাব প্রকাশ করে ইমুস ক্যাটস্ বললেন, ‘ওকে দেখলাম, মনে হল একটা বুচার, আমার জিভ শুকিয়ে গেল। গলা শিরশির করতে লাগল। মনে হল আমার গলায় কেউ চাকু চালাচ্ছে। ও চলে গেছে, আমার কী যে ভালো লাগছে। যদি আর দুই এক দিন এখানে থাকতে হয়, কোনো প্রব্লেম নেই, আমি এখানে থাকতে পারব।’

জিয়াফ ব্যানব্যাট উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘বেটা প্রথমে আমাদেরকে একটা শান্টিং দিল। পরে এমন একটা ভাব যে পারলে আমাদেরকে জামাই করে। বিষয়টা সন্দেহজনক। বেটা ওদের চর হতে পারে। মিয়ান, খামটা খুলে দেখ। ওর মধ্যে কী ঝামেলা রেখে গেল কে জানে। তোমরা ভুলে যেও না, ঐ অফিসারটা এসে আমাদের শাসিয়ে গেল, কী যেন রিমান্ডে না ডিমান্ডে নেবে। প্লিজ, মিয়ান খামটা খুলে দেখ্, দেখ্ কী ষড়যন্ত্রের জাল মেলে গেল।’

আবেগ-উদ্দীপ্ত স্বরে মিয়ান টিনটুই বললেন, ‘অ-স-ম্ভ-ব। আমার কাছে বিশ্বাস করে খাম দু’টি রেখে গেছে। ছাড়া পাব। সোজাসুজি একটা ডাকবাক্সে ফেলে দেব। আমি আমার কথা রাখব। যদি ঐ লোকটা, আচ্ছা, উল্লাস ছাপ্পান্ন যদি একশটা মার্ডারও করে থাকে, মনে হল আমার, সে অন্যায় করে একটা মার্ডারও করে নি। আমার মন বলে সে শক্তের যম নরমের ভক্ত। সে গ্রেট। আমি জীবনে কক্ষনো এমন চমৎকার, দুর্দান্ত, ফার্স্ট-ক্লাস মানুষ দেখি নাই। দুঃখিত। স্যরি। আমি তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে পারব না। আমাদেরকে যদি রিমান্ডে নেয়, যদি ঐ চিঠি দু’টির মধ্যে সত্যিই বিপদজনক কিছু থাকে, দায় দায়িত্ব সব আমার। বন্ধুরা, বল, কিছু খাবা? উল্লাসজি আমাকে ষোল হাজার টাকা দিয়ে গেছেন।’

ওরা শুধু চা খেতে চাইল।

১১

‘মা, আপনার নাম জানতে পারি কি?’ সবিনয়ে প্রশ্ন করলেন লালু পাঞ্জুমম। তাদের গরাদের সামনে চার ফুট দূরে ছিল আরেকটি গরাদ। সেই গরাদের উপরে লেখা ছিল ‘পুরুষ’। কিন্তু ঐ ঘরটায় দেখা যাচ্ছিল শুধু একজনকে, সে এক বালিকা। লালু-র প্রশ্নটি ছিল তার উদ্দেশে। ইতোমধ্যে সান্ত্রি বদল ঘটেছিল। নয়া সান্ত্রিকে কিছু বখশিশ দিয়ে লালু এই কথা বলবার অধিকার লাভ করেছিলেন।

‘মেরা নাম তিঞ্জি খর্খর, আমি একটা গিরগিট্টি টিকটিকি,’ হি হি হেসে বালিকাটি উত্তর করলেন। তিনি লম্বায় হবেন দুই হাত। চুল ঝাঁকড়া লাল। গায়ের রং হলুদাভ লালচে ফর্সা। পুষ্ট গোলগাল শক্তিশালী দেহ। চোখ টলটলে স্বচ্ছ দীপ্ত। গালে টোল। কপালে টিপ সোনালি। পরিধানে তার কী ছিল বলা শক্ত।

লালু পাঞ্জুমম ব্যাকুল স্বরে বললেনে তিঞ্জি খর্খরকে, ‘আপনেরে আমি খুব লাইক কর্ছি এবং আমি সিউর আমার ওয়াইফ আপনেরে দেখবেন এবং লাইক কর্বেন। অনেকদিন ধইর‌্যা আমরা একটা বাচ্চা খুঁজিচ্চি। আমাদের কোনো বাচ্চা নাই। আমাদের বাচ্চা হইয়্যা যান আপনে। আমি জানলাম আপনার কোনো বাপ মাউ নাই। অথবা থাকলিউ প্র্যাক্টিকালি তারা কোনো খোঁজখবর রাখেন না। আপনি পড়ালিখা কর্বেন। ইশকুলে যাবেন। ভালোমন্দ খাবেন। টিভি দ্যাখবেন। আমাক আব্বা বলে ডাকবেন আর আমার ওয়াইফকে মা কবেন। আমাদের জান ভইর‌্যা যাবে।

‘শুধু একটা কথা। কথার কথা। যা আমি শুনছি। এবং এক কান দিয়া শুনিয়া আরেক কান দিয়া বাহির কইর‌্যা দিছি। তবু জিজ্ঞাস কর্তি হয়, তাই কর‌্যা। এরা কওয়া কওয়ি করে যে আপনে একটা মার্ডার কর্ছেন। যদিও আমি তাতে পেত্যয় যাই না। আসলেই আপনে কি একটা মার্ডার কর্ছেন? আমি শুধু একবারের তরে শুনতে চাই, আপনি সত্যি করে কয়ে দেন, ‘না আমি কোনো মার্ডার করি নাই’,’ লালু পাঞ্জুমম অবশেষে থামলেন।

‘মার্ডার আবার কী? সে কি গায়ে মাখে না চুলে দেয়?’ বিস্ময়জড়িত কণ্ঠে তিঞ্জি খর্খর বললেন।

প্রায় হাততালি দিয়ে উঠলেন লালু পাঞ্জুমম, ‘আমি বুঝিছি। আমি বুঝিছি। মা, আপনে মার্ডার করেন নি। আপনে রেডি হন। চলেন আমার সঙ্গে। আমি এখন থেকি আপনার আব্বা।’

‘আমার আব্বা হল বিরগিট্টি, তুই আমার আব্বা না। মেরা নাম তিঞ্জি খর্খর। গেট আউট,’ তিঞ্জি খর্খর বললেন।

‘আপনের আব্বা তো পচা। তিনি তো আপনার কোনো খোঁজখর্বর লন না। এই যে আপনে লালঘরে আছেন, তিনি তো কোনো খোঁজ লইলেন না। এই দিকে আমি আপনারে দেখছি, আর আমার মনে মায়্যা পইড়্যা গেল। আমি ভাবি আর ভাবি কীসে আপনার মঙ্গল হয়। মা চলেন। আপনে খুব ভালো মেয়্যা আমি বুজ্‌ঝা গেছি,’ লালু পাঞ্জুমম বললেন।

‘আমার আব্বু বিরগিট্টি বির্রাশি হাত লম্বা। এক লাফে পার হয় এক খাল। দুই লাফে পার হয় এক নদী। আমি গিরিগিট্টি টিকটিকি অর গায়ে বেড়াই সুরুত সুরুত। অর চুলে আমার বাসা। ঘুমাই নাকুস নুকুস মজা। অক্ চিমটি কাটায় হয়েছে আমার সাজা। ফুস ফা। আমার আব্বু দুই আঙুল দিব এই গরাদের ভিতর ত্তো শিক হইয়া যাব বাঁকা, আমার এক কান ধরিয়া মারিব টান তো আমি পগাড় পাড়। তুই অযথা ইচ্ছা করস না পিলপু উজ্জিরের বেটা। তোর রান দিয়া কাবাব বানাব। দেখ আমার সিনা,’ তিঞ্জি খর্খর এ-কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে লালু পাঞ্জুমম ও তার সঙ্গীরা চোখ বন্ধ করল।

‘তুই জানিস আমার চল্লিশ পোলা আর পঞ্চাশ মাইয়া। এক হাঁক পাড়ব তো সক্কল হাজির। তোক খায়া ফেলাব। হি হি হি হি। তুই হজাম হয়্যা যাবি। লিচি পালচি উলা যা,’ এই কথাগুলি বলার পরে তিঞ্জি খর্খর হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

ঠিক ঐ সময়ে দুই গরাদের মাঝখানে হাজির হল তিন সান্ত্রি। সেখানে উপস্থিত সান্ত্রিকে তারা বলল তিঞ্জি খর্খরের গরাদের তালা খুলতে। তারা তাকে আদালতে নিয়ে যেতে এসেছে।

যেইমাত্র লালু পাঞ্জুমম ঐ সান্ত্রিগুলির উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন, তিনি হৈ হৈ হাউহাউ করে উঠলেন। ‘টাকাগুলা দেন,’ বলেই তিনি মিয়ান টিনটুই-এর কাছ থেকে সবগুলো টাকা প্রায় কেড়ে নিলেন, যা উল্লাস ছাপ্পান্ন দিয়েছিলেন মিয়ানকে।

লালু পাঞ্জুমম টাকাগুলি সান্ত্রিদের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন, ‘প্লিজ এই টাকাগুলি নেন। আর দয়া করে আমার মেয়েটাকে নিয়ে যাবেন না। সে আমার আপন মেয়ে। প্লিজ আরো টাকা লাগে পরে দিব। জমি বিক্রি কইর‌্যা দিব।’

‘এই মেয়েটার মাথায় ছিট, জানতাম,’ বললেন সান্ত্রিদের মধ্যে থেকে একজন। ‘ইতিমধ্যে আমাদের পুরা ডিপার্টমেন্টে প্রর্চার হয়ে গেছে আপনারা বেআক্কেল লোক। আপনি কী মনে করে আমাদেরকে টাকা দিতে যাচ্ছেন? দুনিয়া উল্টে গেলেও যখন হুকুম হইছে, এ্যাক আমরা নিয়া যাব আদালত। লাক টাকা দ্যান, কোটি টাকা দ্যান, কোনো কাজ হইব না। বেআক্কেল।’

‘আপনারা সব পারেন,’ অত্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে আবেগভরে বললেন লালু পাঞ্জুমম। ‘আপনারা ফাঁসির আসামির বডি চেঞ্জ কইর‌্যা বাঁচাইয়া দিতে পারেন। নিরীহ লোককে ফাঁসির আসামি বানাইতে পারেন। আমার মেয়েটাক এখানে রাখে যান। আমি ইনার সব কাগজপত্র পরিষ্কার করি নিব। ইনি অত্যন্ত খাঁটি মিয়া। না জেনে না শুনে তিনি বলে ফেললেন আমার আব্বার নাম ‘পিলপু উজির’। ইনি আমার মা, ইনি আমার কন্যা। ইনাক আমি বাঁচাব। ইনি আমার জীবন। ইনিই আমার ভবিষ্যৎ। আমি আমার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ইনাক বাঁচাব।’

‘ঐ সবই গুজব। ডাহা মিথ্যা কথা। আমরা হুকুমের দাস। আইনের নিয়মে আমরা বাঁধা। হাকিম নড়ে কিন্তু হুকুম নড়ে না। খোল। কোর্টের টাইম যায় যায়,’ সান্ত্রিটি তার বা তাদের পুরোপুরি অপারগতা প্রকাশ করলেন।

লালু পাঞ্জুমম আরো বিভিন্নভাবে তাদেরকে অনুরোধ করলেন। তার কথাবার্তা ক্রমে অসংলগ্ন হয়ে উঠল। তার কথাবার্তায় সান্ত্রিরা হয়ে উঠল ভীষণ অসন্তুষ্ট। অবশেষে লালু পাঞ্জুমম যখন দেখলেন তার কথা রাখা হল না ও গরাদ দরজা খুলে তিঞ্জি খর্খরকে নিয়ে সান্ত্রিরা চলে যাচ্ছে, তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মিয়ান টিনটুইকে জড়িয়ে ধরে।

‘লিচি পালচি উলা যা,’ যাবার সময় তিঞ্জি খর্খর এই কটি শব্দ বারবার আউড়াচ্ছিল।

তিঞ্জি খর্খর ও সান্ত্রিরা চলে গেল।

একমাত্র যে সান্ত্রি, যিনি সেখানে কর্তব্যে নিরত ছিলেন মুখ খুললেন, ‘আপনাদের কথাবার্তা বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে আপনারা এই দেশের মানুষ না। ঐ যে উনি, যিনি ঐ মেয়েটাকে দত্তক নিতে চাইলেন, মেয়েটার সঙ্গে এমনভাবে আপনি টাপনি করে কথা বলতে লাগলেন যে আমি তো আশ্চর্য হয়ে গেছি। উনার চেয়ে বয়সে কতো ছোট, হয় তুই না হলে তুমি বলবেন। কিন্তু কী ঢং। আপনারা সত্যি করে বলেন তো, আপনারা কি এই দেশের লোক, না প্রতিবেশী দেশ থেকে এসেছেন? রিমান্ডে নিলে সব বেরিয়ে যাবে। আচ্ছা, আচ্ছা (এ-সময়ে মিয়ান টিনটুই তার দিকে চা খাবার জন্য কিছু মুদ্রা বাড়িয়ে দিলেন)। আপনারা প্রফেসর, অতিরিক্ত পড়ালেখা করে মাথা খারাপ করে ফেলেছেন।

‘বুঝলেন। অর্ডার। অর্ডার হল আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অর্ডার হল আমি ঘুমালাম। অর্ডার হল আমি খালাম। অর্ডার হল আমি বদলি হলাম। অর্ডার হল আপনাক ধরলাম। অর্ডার হল আপনাক কোর্টে চালান দিলাম। অর্ডার হল আপনাক জেলে রেখে আলাম। অর্ডার হল আপনাক ছাড়ে দিলাম। আমাকে কে অর্ডার দিল? আমার বস দিল। তাকে কে অর্ডার দিল? তার বস দিল। তাকে কে অর্ডার দিল? তার বস দিল। তাকে কে অর্ডার দিল? তার বস দিল। তার বসকে কে অর্ডার দিল? তার বস। সকলেই বলল, ইয়েস স্যার।

‘অর্ডার হইল ফাঁসি হইল। অর্ডার আসিল ফাঁসি থামিয়া গেল। অর্ডার হইল বডি চেঞ্জ হইল। ফাঁসির আসামি বাঁচিয়া গেল। আপনার বডিতে গাঞ্জা পাওয়া গেল। অর্ডার হইল যদু মিঞার বডিতে গাঞ্জা বাহির হইল। অর্ডার হইল আপনারা পড়িলেন ধরা, অর্ডার হইল আপনারা পাইলেন ছাড়া।

‘অর্ডার, অর্ডার। অর্ডারই সব। অর্ডারই মা-বাপ। যে-দিন অর্ডার কম হয়, যে-দিন কোনো অর্ডার আসে না, মনে হয় সব ফাঁকা। খাবার বিস্বাদ। খামাকা। অর্ডার হইব। খাড়াক দাঁড়াইব। স্যালুট দিব। বলিব, ইয়েস স্যার।

‘কিন্তু সবই নিয়মের মদ্যে। এক চুল নড়িবার উপায় নাই। আপনারা প্রফেসর। কিন্তু এই বিষয়গুলি আপনারা বুঝেন না, আমি আশ্চর্য হইয়া যাই। যাই।’

১২

‘এরা মানুষ গড়ার কারিগর, প্রফেসর,’ আঙুল তুলে দেখলেন ঝুঁটিধারী, বিনুনিওয়ালা, পাঞ্জাবি ও জিনসপরা ভদ্রলোকটি, লালঘরে আটক এগারজনকে। বিনুনিওয়ালার সঙ্গীরা, যারা হবে সংখ্যায় ছ’সাতজন, বিস্মিত-আনন্দিত চোখে, ঘনিষ্ঠ চোখে তাদেরকে দেখল। ‘হুম! আপনারা শিক্ষক। ছাত্রদেরকে কী শেখাবেন বা শেখাচ্ছেন তার চমৎকার নমুনা দিলেন।

‘হুম! আমরা সরাসরি এসি সাহেবের চেম্বার থেকে আসছি। উনি বললেন, যদি বিশ্বাস না হয়, যান আপনারা নিজের চোখে দেখে আসেন, কাদেরকে হাতেনাতে ধরে ফেলছি। তাই না এসে পারলাম না।

‘আপনাদের মতো লোকেদের কারণেই আমাদের সমাজটা অধঃপতনে চলে যাচ্ছে। আমি স্ট্রংলি সাজেস্ট করি, যখন শিক্ষিত লোকেরা এ-ধরনের ক্রাইম করবে, তাদেরকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দিয়ে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যে, কেউ ভবিষ্যতে ওরকম ক্রাইম করার কথা ভাববে না।

‘আমি সব সব শুনেছি, আপনাদের নিজেদের সাফাই আর গাইতে হবে না।

‘মদ খেয়ে, মাতাল টইটম্বুর হয়ে নদীর চরে আপনারা হৈহল্লা, নাচগান করছিলেন।

‘সুন্দর বিকেল। পরির মতো অপরূপ দুই ষোড়শী এসেছে নদীতীরের সুশীতল বাতাসের স্নিগ্ধ পরশ নিতে। তারা ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রজাপতির মতো। মনে তাদের স্বপ্ন, দেখবে তারা স্বর্গীয় সূর্যাস্ত।

‘কিন্তু তারা জানে না, সুসভ্যের ছদ্মবেশে একদল বর্বর, তাদের পিছু নিয়েছে।

‘ঐ বর্বর, মানবতার দুশমনদের অধিকাংশের গায়েই নেই কোনো জামা, একজন এমনকি উলঙ্গ হয়ে পড়েছে।

‘ষোড়শী দু’টির সাহসের আমি প্রশংসা না করে পারি না। দেশে যে বিশৃঙ্খলা ও হানাহানি চলছে তার মধ্যেও তারা প্রকৃতির আনন্দে অবগাহন করতে একটুও পিছপা নয়।

‘তারা লক্ষ্য করল একদল জংলি তাদের ফলো করছে, না তাদের বুক একটুও কাঁপল না। তারা ভান করল, যেন তারা দেখতেই পাচ্ছে না, জংলিগুলোকে।

‘ষোড়শী দু’টো দুই প্লেট ফুচকা অর্ডার করল। ধীরেসুস্থে চারিয়ে চারিয়ে তারা ফুচকা খেল। জংলি বর্বরগুলো সেখানেও হাজির। তারাও অর্ডার করল ফুচকা। এবং হাভাতের মতো খেল।

‘ফুচকা খেয়ে ষোড়শীদ্বয় মনের আনন্দে পরস্পরের সঙ্গে বকবক করে চলেছে, তারা ঢলে পড়ছে একে অপরের গায়ে।

‘তাদের দেখাদেখি আপনারা এই বেহেড মাতালগুলি, ঐ জংলিগুলি, ঠিক ঐ কাজটিই শুরু করল। একে অপরের গায়ে ঢলাঢলি করতে লাগল।

‘যখন দুই ষোড়শী একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে, যখন দুই পুষ্পশাখা একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে, সৃষ্টি হয় এক স্বর্গীয় সৌন্দর্যের।

‘কিন্তু যখন কিছু জংলি বুরবক তথাকথিত যুবক সেই একই কাজটি করে, তা হয়ে ওঠে জঘন্য, দৃষ্টিপথে তা ঠেকে বিদ্ঘুটে।

‘ঠিক তাই ঘটেছিল, আমাদের এসি ভাইয়া ল্যুইস নারা-র চোখে। তিনি নদীতীরে এক নৌকার গলুইয়ে বসে দূরবীন চোখে নিসর্গ দেখছিলেন। কিন্তু সত্যিই তিনি নিসর্গের সৌন্দর্য দেখছিলেন না। তিনি নদীতীরে গিয়েছিলেন একটা সিক্রেট মিশন নিয়ে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে।

‘দূরবীনে তিনি আকাশের পাখিদের দেখলেন। দেখলেন দূরের নৌকাদের। চরে ছুটোছুটি করা বাচ্চাদের দেখে তার মনে পড়ে গেল তার শৈশবের কথা।

‘এভাবে দেখতে দেখতে হঠাৎই ল্যুইস ভায়ের চোখে পড়ে গেল দুই ষোড়শী। আর তিনি দেখতে পেলেন একদল নির্মম গুণ্ডা তাদেরকে ঘিরে ফেলবার পথে।

‘তার রক্তটা টগবগ করে উঠল। ভাবলেন বৃথাই আমি ট্রেনিং নেই নি। এই নদীচরের পবিত্রতাকে এক সঙ্ঘবদ্ধ চক্র কলুষিত করে চলেছে। আজকে তিনি তাদের দেবেন সমুচিত শিক্ষা।

‘দূরবীনে ওদের অবস্থান আবারো তিনি ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর খালি চোখে ওদের অবস্থান বুঝে নিলেন। তারপর খালি হাতে চরে নেমে একটু হালকা এক্সারসাইজ সেরে নিয়ে, মনে মনে দ্রুত প্ল্যানটা ছকে নিয়ে, তাঁর ফোর্সকে মুভ করবার অর্ডার দিয়ে, ল্যুইস ভাইয়া অকুস্থলের দিকে ধাপ বাড়ালেন।

‘আপনারা প্রফেসরের ছদ্মবেশী মানবতার দুশমনরা জানতেন না, আপনাদের যম রওনা হলেন অপারেশনে।

‘এসি ল্যুইস ভাই অকুস্থলে পৌঁছে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, ষোড়শীদ্বয় তখনও একে অপরের সঙ্গে খুনসুটি করে মনের আনন্দে চরের মধ্যে দিয়ে নেচে নেচে চলেছে। একদল ধেড়ে শয়তান যে তাদেরকে চেস করছে, এ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই।

‘এসি ল্যুইস নারা একজন অত্যন্ত অভিজ্ঞ সুযোগ্য অফিসার। তিনি বুঝতে পারলেন ঐ ষোড়শীদের মধ্যে একটা ডিফেন্স মেকানিজম কাজ করছে। ওরা ভাবছে, ওরা নিরুদ্বিগ্ন থাকলেই, আক্রমণকারী বা ঘাতকরা ওদের পেয়ে বসবে না।

‘কিন্তু এসি ল্যুইস ভাই জানতেন, প্রফেশনাল ক্রিমিনালদের এভাবে থামানো যায় না। ওরা তাদের টারগেট হিট করবেই। তাই তিনি দ্রুত এগুলেন।

‘কাছাকাছি পৌঁছে তিনি শুনলেন, আপনারা, ঐ জংলিগুলো গান গাচ্ছে, উদ্দেশ্য দুই ষোড়শীর মনোরঞ্জন। সবচেয়ে যেটি ছিল মারাত্মক, ষোড়শীদ্বয়ের সম্ভাব্য গতিপথে তারা একটা পিরামিড বানিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পিরামিডটার প্রথম ধাপে ছিল ৪ জন, দ্বিতীয় ধাপে ২ জন, এবং শীর্ষে এক জন। ঐভাবে পিরামিড বানিয়ে তারা শিস দিচ্ছিল, চিলচিৎকার করছিল, অশ্লীল, মুখে আনা যায় না এমনসব বাক্য বলছিল ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছিল।

‘কিন্তু এক্সট্রিমলি সারপ্রাইজিং ম্যাটার, ষোড়শীদ্বয় তখনও ভ্রূক্ষেপহীন, চরে প্রস্ফুটিত একগুচ্ছ নীল ফুলের গন্ধ শুঁকছে।

‘এসি ল্যুইস ভাই মনে মনে আলেক্সান্ডারের মতো বললেন, কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস! যা বুঝবার তিনি বুঝে গেলেন। কেসটা দাঁড়াবে না। ভিক্টিমরা অ্যাটাকারদেরকে ইনডালজ করছে। ভেরি ব্যাড। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, কর্তব্য পালনে তিনি পিছপা হবেন না।

‘আপনাদের এগারজনের সামনে গিয়ে এসি ল্যুইস ভাই দাঁড়ালেন। তার কাছে দু’টি রিভলভার। একটি অফিসিয়াল ও আরেকটি তার ব্যক্তিগত প্রিয় মাউজার।

‘তিনি ইচ্ছা করলে, দুই হাতে দুই রিভলভার ধরে তক্ষুনি আপনাদের ধরে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি রিস্ক নিলেন না। আপনাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আপনাদেরকে ব্যস্ত রাখলেন। ফোর্স এসে গেল, আপনারা গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন।

‘এসি ল্যুইস ভাই, পায়েল ও দোয়েলকে, হ্যাঁ, ষোড়শীদ্বয়ের নাম, বললেন কোনো ভয় নাই। তারা অভিযোগ করুক তিনি সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু ওরা কিছুতেই রাজি হল না। ওরা শুধু হাসে। শেষে এসি ল্যুইস ভাই, ঐ পায়েল-দোয়েলকে নিজ খরচায় দুই প্লেট ফুচকা খাওয়ালেন। তারপর তাঁকে থ্যাঙ্কস-ট্যাঙ্কস দিয়ে, ভাইয়া আবার দেখা হবে, ইত্যাদি বলে তারা চলে গেল।’

বোধ হল বিনুনিওয়ালা ভদ্রলোকের গল্প শেষ হল।

‘ডাহা মিথ্যা। সম্পূর্ণ বানোয়াট। আমরা ঐ ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে আদৌ জড়িত ছিলাম না,’ রজেট চিনটুই বললেন।

‘আইনের হাতে পড়লে, প্রথমে সক্কলেই এমন অস্বীকার করে। কিন্তু যখন উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ দেখা দেয় তখন সকল সাধুই বাপ-বাপ বলে সব স্বীকার করে ফেলে। ইভ্স্ টিজিং খুব ড্যাঞ্জারাস ক্রাইম। বিরাট শাস্তি হয়ে যেতে পারে। আপনাদের ক্যারিয়ার শেষ,’ বললেন বিনুনিওয়ালা।

‘আপনি কি সাহিত্যিক?’ ফ্লিজ ফ্যাল প্রশ্ন করলেন।

‘নো। আই অ্যাম এ জার্নালিস্ট,’ বললেন বিনুনিওয়ালা।

১৩

সকলেই চুপ। তারা যেন আর মনে মনে নিজের সঙ্গেও কথা বলছিল না। যখন কথা, শব্দ ও কাজ থেমে যায়, মনে হয় সময়ও থেমে গেছে। ঐ ছোট্ট ঘরটায় পরিবেশটা হয়ে উঠেছিল থমথমে, সময় শ্লথ, প্রায় স্তব্ধ।

খালি মেঝেতে এবং রাতে পাওয়া সেই নীল কম্বলটার ওপরে তারা বিক্ষিপ্ত শুয়ে বসে ছিল। ব্যতিক্রম: শ্যামল চিল ও মিয়ান টিনটুই দাঁড়িয়ে ছিল। তাদেরকে খুবই অস্থির দেখাচ্ছিল। ইমুস ক্যাটস্ ও পুঁই চুলভি দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে গুটিসুটি শুয়ে ছিল। তিয়াস ঠিসটক, চিকচাক রুই ও ফিটিক চ্যাক দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছিল। রজেট চিনচুই বসে উল্টে পাল্টে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একটা কাগজের ঠোঙার ওপরের লেখাগুলো পড়ছিলেন। জিয়াফ ব্যানব্যাটও ছিলেন বসে এক ঠ্যাং উচুঁ করে, তার চোখ ঘুরছিল ঘরটার সবখানে।

ফ্লিজ ফ্যাল প্রায় পদ্মাসনে ছিলেন নীল কম্বলের ওপরে। তার চোখ বন্ধ। ঠোঁট মৃদু নড়ছিল।

একজন সান্ত্রিকে সেই শুরু থেকে গরাদ দরজার সামনে দেখা যাচ্ছিল। কয়েক ঘণ্টা পরপর সান্ত্রিটি শুধু বদলে যাচ্ছিল। সান্ত্রি এখন গরাদ দরজা থেকে খানিকটা দূরে।

সাংবাদিক এবং অন্য কোনো দর্শনার্থীও নেই।

সময় দুপুর একটা থেকে দেড়টা।

তাদের চুলগুলো এলেমেলো।

চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে ও উদ্দেশ্যহীন।

জামার উপরের বোতামটা সব্বারই খোলা।

একটা মোটা টিকটিকি একমাত্র বাল্বটির কাঠের হোল্ডারের ওপরে শুয়ে আছে।

শ্যামল চিল ও মিয়ান টিনটুই দাঁড়িয়ে থাকায় ক্ষান্ত দিল।

শ্যামল চিল, তিয়াস ঠিসটককে আলতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ালে আরাম করে বসলেন। মিয়ান টিনটুই কোনোভাবে একটু জায়গা করে নিয়ে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে বসলেন।

যেন আর কেউ তাদের সম্পর্কে আগ্রহী নয়। এমনকি তারা নিজেরাও আর তাদের নিজেদের সম্পর্কে আগ্রহী নয়। হতাশা। নৈরাশ্য। অবসাদ। যা ঘটে ঘটুক। যারা শুয়েছিল তারা ভাব করল ঘুমানোর। যারা বসেছিল তারা বন্ধ করল চোখ। আর ভাবা যায় না।

১৪

‘আপনাদেরকে আর কিছুক্ষণের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হবে,’ এক কর্মকর্তা খুবই সাদামাটাভাবে ঘোষণা করলেন।

‘আমাদেরকে কি তবে আদালতে নেয়া হবে?’ জিজ্ঞেস করলেন মিয়ান টিনটুই।

কিন্তু তার প্রশ্নটির প্রতি একটুও মনোযোগ না দিয়ে কর্মকর্তাটি চলে গেলেন।

১৫

ছোট্ট ঘরটায় সব্বাই একে একে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। তারা কি কলরব করে একে অপরকে অভিনন্দিত করল? না, না, না। ইতোমধ্যে তারা ঐ ঘরটিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। নানাজনের নানা কথায় তাদের ধারণা হয়েছিল যে তাদের পরবর্তী গন্তব্য আদালত। যদিও কর্মকর্তাটির ঘোষণা ছিল দ্ব্যর্থহীন, ‘ছেড়ে দেয়া হবে।’

তারা পানি খেল।

পোশাক-আশাক ঝাড়ল।

সোয়েটারের কোঁচকানো অংশগুলো টেনে ঠিকঠাক করল। কেউ কেউ তাদের সোয়েটার খুলে ফেলল।

যাদের পরনে ছিল জ্যাকেট, তারা হয় চেন খুলল অথবা চেনটা লাগাল। অথবা জ্যাকেটটা খুলে ঘাড়ে নিল।

ফ্লিজ ফ্যাল সব শেষে উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখে স্মিত হাসি। কেউ খেয়াল করল না।

কিছুক্ষণ আগে ঘরটি ছিল সম্পূর্ণ নিস্তেজ। এখন সেখানে প্রাণের স্পন্দন। মনে হল তারা একে অপরকে ধাক্কা মেরে ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি করবে।

এমন একটা ঘোষণার পরেও সান্ত্রিরা দূরে দূরে। গরাদের তালা খুলবার কোনো উদ্যোগই দেখা গেল না কোত্থাও।

কিছুটা দূরে একদল মানুষ এগিয়ে আসতে চাইল, তাদেরকে কর্তব্যরত সান্ত্রিরা রূঢ়ভাবে দূরে সরিয়ে দিল।

ধীরে ধীরে প্রত্যেকে উত্তেজিত হয়ে উঠল।

ঐ ঘরটায় কিছুক্ষণ আগে সময় হয়ে উঠেছিল শ্লথ, স্তব্ধ। কিন্তু এখন সময় হয়ে উঠল দীর্ঘ, প্রলম্বিত। একেক সেকেন্ড যেন একেক ঘণ্টা।

অপেক্ষা, অপেক্ষা, অপেক্ষা।

অসহ্য, অসহ্য, অসহ্য।

কিন্তু যতক্ষণ-না গরাদ দরজা খোলে, যতক্ষণ-না তারা বের হয় মুক্ত বাতাসে, মুক্ত পৃথিবীতে, তার আগে তাদের মনেই হতে চাইল না, নিষ্কৃতি বা মুক্তি সম্ভব।

যদি তাদের পাখা থাকত, তবে শোনা যেত তাদের পাখার ব্যর্থ ঝটপট ধ্বনি। তাদের মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। আসন্ন মুক্তির উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় তাদের মন ছটফট করছিল। কিন্তু অজানা এক আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন তারা আনন্দ প্রকাশে ছিল সঙ্কুচিত।

১৬

‘আপনারা একে একে বেরিয়ে আসবেন, না না এক্ষুনি নয়, সমস্যা আছে,’ একজন কর্মকর্তা, যাকে বেশ দায়িত্বশীল বলে মনে হল, বলে চললেন। ‘ঐ যে ঐদিকে তাকান। ওখানে একটা ঘর আছে। বুঝতে পেরেছেন? আচ্ছা আপনারা একে একে এখান থেকে বেরুবেন। এদিক ওদিক তাকাবেন, যদি সাংবাদিক দেখেন, এবাউট টার্ন, যাওয়ার দরকার নেই। ফিরে আসবেন। থানার সামনেটা সাংবাদিকে গিজগিজ করছে। আপনারা গেলেই ছবি তুলবে। ঢি ঢি রি রি পড়ে যাবে। আমরা তা চাই না। আপনারা ঐ ঘরটায় গিয়ে বসবেন। যাবার সময় এদিকে ওদিকে হালকা চালে তাকাবেন, মনে হবে যেন আপনারা এখানেই কাজ করেন, নিজস্ব জায়গা। নিজের অফিসের মধ্যে ঘুরছেন।

‘ঐ ঘরটায় গিয়ে বসবেন। একটু অপেক্ষা করতে হবে সেখানে। তারপর আপনাদেরকে একটা কাঁটাতারের বেড়া টপকাতে হবে। খুব কঠিন কাজ নয়। আমরা পোলের এপারে ওপারে দুটো মই রাখব। তারপর সহজেই টপকাতে পারবেন। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে লোক থাকবে আমাদের। তারা আপনাদেরকে কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছেড়ে দেবে। তারপর আপনারা ফ্রি। শুধু অনুগ্রহ করে খেয়াল রাখবেন কোনো অচেনা লোক অর্থাৎ সাংবাদিক আপনাদেরকে ফলো করছে কি-না। জী, নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে আপনাদেরকে গাড়িতে নেয়া হবে।

‘আমরা সাংবাদিকদের অলরেডি বলেছি, আপনাদেরকে আমরা আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ওরা বিশ্বাস করে নি। আমরা ওদেরকে অফিস থেকেও বের করে দিয়েছি। কিন্তু ওরা এখনও গেটের কাছে ভিড় করে আছে।

‘তাহলে, ওকে। আপনারা সময় হলে একে একে বা দুয়ে দুয়ে বেরুবেন। আমি সান্ত্রিকে অর্ডার দেব। সে একটু পর পর এসে দরজা খুলে দেবে। আচ্ছা চলি।’

তার দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গেলেন চলে।

‘ফ্রেন্ডরা, এইটা কী ধরনের মুক্তি আমার মাথায় ঢুকল না। লোকটা আমাদেরকে এমন একটা মতলব দিয়ে গেল, যা ভেবে আমার বুক কেঁপে যাচ্ছে। আপনারা কি বুঝতে পারলেন, সে আমাদেরকে পালানোর বুদ্ধি দিয়ে গেল। এখন, ধরেন, যখন আমরা কাঁটাতারের বেড়া পার হচ্ছি বা টপকাচ্ছি, যদি তখন ফায়ার ওপেন করে। আমার রক্তাক্ত দেহ সেখানে পড়ে আছে ভেবে আমার রক্ত হিম হয়ে আসছে,’ কথা কটি বলে শ্যামল চিল বসে পড়লেন।

‘আপনারা তো দেখলেন, আমি কতো সুন্দরভাবে ব্যাপারটা বোঝাতে চেষ্টা করলাম সাংবাদিক ভাইদের। তাদেরকে চকোলেট চ্যুইংগাম খাবার জন্য কিছু মুদ্রা দিলাম। আমার মনে হয় ওরা কিছু করবে না। তবু এরা কী-কারণে আমাদেরকে এত জটিলভাবে ছাড়তে চাচ্ছে বুঝলাম না। ফ্রন্ট গেট দিয়ে বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে যাব। কে কী বলবে? না, ব্যাপারটা আমার পছন্দ হল না,’ মিয়ান টিনটুই বললেন।

‘আপনারা এত ভীতু,’ বললেন রজেট চিনচুই তিরস্কারের স্বরে। ‘আমাদেরকে গুলি করলে এই থানা ঘেরাও হয়ে যাবে। আমরা নামহীন গোত্রহীন নই। আমাদের পরিচিতি আছে। সুপরিচিতি। আমি মনে করি না, এরা কোনো রিস্ক নেবে বা এদের কোনো মন্দ উদ্দেশ্য আছে। আপনারা নির্ভয়ে বেরুতে পারেন।’

‘বিশ্বাস করে ঠকবেন না,’ সতর্ক করে দিলেন জিয়াফ ব্যানব্যাট। ‘যখন থেকে এই বিপদে পড়েছি, আমার কপালের দুই দিকে চমকাচ্ছে। আমার মন বলছে, খুব খারাপ কিছু ঘটবে, ঘটতে চলেছে। যখন এই অফিসারটা সবিস্তারে আমাদের মুক্তিদানের প্ল্যানটা বলল, ওটাকে আমার মনে হল, একটা গভীর চক্রান্তের অংশ। আমরা পালাতে চেষ্টা করব থানা থেকে। দু একজন মারা যাবে। দু’একজন গুলি খেয়ে পঙ্গু হবে। আর সবাই জেল ভেঙে পালানোর চেষ্টা করার অতিরিক্ত একটা মোকদ্দমায় পড়ে যাব। আমার এভাবে মুক্তি পেতে ইচ্ছে করছে না।’

তারা এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলে চলল, কিন্তু তাদেরকে ছেড়ে দেবার কোনো উদ্যোগই দেখা গেল না। উদ্যোগ বলতে বোঝায় গরাদের তালাটা খোলা ও যেতে বলা, কিন্তু সেটুকুই ঘটল না দীর্ঘক্ষণ।

‘আমাদের সন্দেহ অমূলক, সেইসঙ্গে আমাদের সন্দেহের যুক্তিযুক্ত কারণও আছে। দেখুন সেই কতক্ষণ আগে ওরা ঘোষণা দিল, ছেড়ে দেবে, কিন্তু এখনও কি দিল? কারণও তো ওরা বলে গেল, সাংবাদিকরা গিজগিজ করছে,’ ইমুস ক্যাটস্ হাসিমুখে বললেন। ‘পুলিশরাও মানুষ। এই যে এতক্ষণ আমরা ওদের আতিথ্যে আছি, ওরা কি আমাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেছে? কী বলছেন? রিমান্ডে নেবার ভয় দেখিয়েছে? এতটা সময় গেল একবারও খেতে দেয় নি। ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমরাও তো ওদের জেনারেলের ভয় দেখিয়েছি। ভদ্রভাবে কথা না বলে, প্রথম থেকেই ওদের চ্যালেঞ্জ করে এসেছি। আর ওরা কোত্থেকে খেতে দেবে? এ-জন্য সরকার ওদের কোনো ফান্ড দেয় না। ওরা কি ওদের সামান্য বেতনের টাকা দিয়ে আমাদের খাইয়ে, নিজের পরিবারবর্গকে অনাহারে রাখবে?’

‘আপনি যতই বক্তৃতা দেন আর ওদের মহত্ত্বের কথা বলেন আমি কোনোদিনও তা বিশ্বাস করব না,’ রজেট চিনচুই, ইমুস ক্যাটস-এর কথার মাঝপথে বাধা দিলেন। ‘এই যে দেখুন ওরা বলে গেল, ছেড়ে দেবে, কিন্তু দিচ্ছে না, কেন দিচ্ছে না, বলুন তো? ওরা ঘুষ চায়। কিন্তু আমাদের কাছে চাইতে পারছে না।’

‘এই যে এতগুলি ঘণ্টা কেটে গেল, একজন পুলিশও প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে, পরোক্ষে বা অপরোক্ষে কি আমাদের কাছে ঘুষ চেয়েছে?’ প্রশ্ন রাখলেন ইমুস ক্যাটস্ তারপর নিজেনিজেই উত্তর দিলেন, ‘না, চায় নি। এখন পুলিশে কাজ করে শিক্ষিত লোকেরা। তারা কমপক্ষে এসএসসি পাশ। এখন পুলিশে ভূরিভূরি বিএ-এমএ পাশ লোকেরা কাজ করে।’

‘প্লিজ ওয়াশ, অয়েল, ফ্রাই অ্যান্ড ইট দেম,’ চিকচাক রুই বলে উঠলেন। ‘তাদের শিক্ষাদীক্ষার অনন্য সাধারণ নমুনা হল কোনো পরোয়ানা ছাড়া আমাদেরকে আটক করে হাজতে ফেলে রাখা। আর এই যে সাংবাদিক, সাংবাদিকরা ধরে ফেলল, খেয়ে ফেলল। কে ওদেরকে ডাকল? কে ওদেরকে আমাদের পরিচয় বলল? এখন ওদের মামাত ভাই সাংবাদিকদের জন্য আমাদেরকে কাঁটাতারের বেড়া টপকাতে হবে?

‘বুঝলেন, ব্যাক্টেরিয়া। পুলিশ একটা ব্যাক্টেরিয়া। আপনি একটা মানুষ। একটা ভদ্রলোক। একটা নিরীহ লোক। আপনি যেই পুলিশে ঢুকলেন, আপনার শরীরে পুলিশের ব্যাক্টিরিয়া ঢুকে গেল। আপনি হুকুম তামিল করতে শুরু করলেন। যা বলা হল আপনি তাই করতে লাগলেন। আপনার আমার কাছে যা সহজ সাধারণ ঘটনা, ছোটখাট তর্কবিতর্কের ব্যাপার সেটাই পুলিশের হাতে পড়লে কোর্ট কাচারির ব্যাপার। ৭ ঘণ্টার ব্যাপার পুলিশের হাতে পড়লে ৭ বছর ধরে চলে। এটা আমাদের দেশ, আমরা ভাই ভাই। আমাদের একথা সেকথা কাজিয়া ফ্যাসাদ ঝগড়া বিবাদ হবে। আমরা নিজেরাই মেটাব। কেন আমাদের মধ্যে থেকে কিছু লোক পুলিশ সেজে সারাজীবন আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে থাকবে?’

১৭

‘কিট কটাং খটং’ শব্দ করে গরাদ দরজার তালাটা খুলে গেল। পুঁই চুলভি ও ইমুস ক্যাটস্ প্রস্তুত ছিল, এই শেষ মুহূর্তগুলির অঘোষিত নেতা চিকচাক রুই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন ওরা দু’জন থাকবে প্রথম গ্রুপে। ওরা বেরিয়ে গেল। একবারও পেছন ফিরে না তাকিয়ে তারা সামনে হেঁটে গেল। তারা ধীর স্থির অথচ ত্রস্ত। সামনে গিয়ে তারা ডানে বাঁক নিল। আবার তারা বামে বাঁক নিল। তারপর আবার তারা বামে বাঁক নিল। তাদেরকে এক ঝলক দেখা গেল তখন। দূর থেকে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। মনে হল ঘরটা সুন্দর আসবাবে সাজানো, সেখানে তারা ঢুকল। মনে হল ঘরটায় একটায় ডাইনিং টেবিল আছে, আস্তে আস্তে বিভিন্ন পদের খাবার সেখানে এসে জমা হচ্ছে।

ইতোমধ্যে গরাদ দরজা আবার তালাবদ্ধ হয়ে গেছে। এবং সান্ত্রিটা আশেপাশে নেই।

ছোট্ট ঘরটায় কারো মুখেই প্রায় রা নেই।

দমবন্ধ। প্রতীক্ষা।

কয়েকটা অতি দীর্ঘ মিনিট কেটে গেল। সান্ত্রিটা এগিয়ে এলেন। কিট কটাং খটং শব্দে তালা খুলে গেল।

বেরুল মিয়ান টিনটুই ও শ্যামল চিল। তারা ধীরে অথচ দ্রুত হেঁটে চোখের আড়ালে চলে গেল। একবারও ফেরাল না ঘাড়। ঐ সেই ঘরটা যেখানে মনে হচ্ছিল ডাইনিং টেবিলে চমৎকার সব খাবার সাজানো, সেখানে তারা ঢুকল।

আবারও তালা আটকে গেল।

এবং সান্ত্রি চলে গেলেন।

নিস্তব্ধ। অধীর প্রতীক্ষা। হৃদপিণ্ড ধুকপুক করছে।

আস্তে আস্তে আস্তে আস্তে সময় এগুচ্ছে।

মনে হল কর্তৃপক্ষ আবারও ভুলে গেছে তাদেরকে। একটা কোনো গোলমাল হয়েছে। কোনো ভুলবোঝাবুঝি। তাদের মুক্তি স্থগিত হয়ে গেছে। যারা ইতোমধ্যে বেরিয়ে গিয়েছিল তারা যদি একবারে বাহিরে গিয়ে না থাকে, হয়তো তাদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে আবারও এই ঘরে।

সান্ত্রি এগিয়ে এলেন। খটাং তালা খুলে গেল।

লালু পাঞ্জুমম ও রজেট চিনচুই যাত্রা করল। যাত্রার ঠিক আগে লালু পাঞ্জুমম বললেন, ‘আমার মেয়েটাক নিয়ে যাতে পারলাম না। কী সুন্দর মেয়ে ছিল।’ তারা চলে গেল।

তালা আটকে গেল। এবং খটাং খুলে গেল।

যাত্রা করল তিয়াস ঠিসটক ও ফিটিক চ্যাক। এক-পা দু-পা করে তারা আগাল। ডান দিকে বাঁক নিল। এবং সঙ্গে সঙ্গে অ্যাবাউট টার্ন। তারা দু’জনেই সমস্বরে অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় চিৎকার করে উঠল, ‘সা-ং-বা-দি-ক।’

তারা প্রায় ছুটে ছোট্ট ঘরে ফিরে এল। তারা আতঙ্কিত নয় কিন্তু বিব্রত।

‘ওরা সম্ভবত এই দিকে আসছে’, ফিটিক চ্যাক বললেন। ‘ওরা এখানে আসবে। ওরা টের পেয়ে গেছে যে, আমরা পালিয়ে যাচ্ছি। স্যরি, আমরা তো আর সত্যিই পালিয়ে যাচ্ছি না। মানে আমরা একটু টেকনিক্যাল ওয়েতে বেরিয়ে যাচ্ছি। যাই হোক এখন আমাদেরকে এখন ওয়েট করতে হবে। ওরা আসবে এবং জিজ্ঞেস করবে, আমাদের মধ্যেকার অবশিষ্ট ব্যক্তিরা কোথায়? এজন্য আমরা ঐ কোণাটায় গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকব। যাতে ওরা গুনে না বুঝতে পারে আমাদের মধ্যে কয়জন পালিয়ে গেছে। স্যরি, আমার আবারও ভুল হয়ে যাচ্ছে, মানে বেরিয়ে গেছে। আর ওরা যদি খুবই চাপাচাপি করে, ওদের কাছে পরিচিত, মিয়ান টিনটুই-এর কথা জিজ্ঞেস করে, বলে দেব ওখানে, ঐ টয়লেটে আছে।’

তিয়াস ঠিসটক কিছু একটা বলতে চাইছিলেন। তারপর তিনি চেপে গেলেন।

ছোট্ট ঘরটায় সব্বাই দাঁড়িয়ে গেল। তারা উত্তেজিত। তাদের চুল একটু একটু খাড়া হয়ে গেল ।

ততক্ষণে সান্ত্রি গরাদের বাহিরে তালা আটকে দিয়েছিলেন।

‘আমি অ্যাসাইলাম সিক করতে যাচ্ছি। নেক্সট ইয়ারে এ-সময়ে আমি জুরিখে,’ বললেন তিয়াস ঠিসটক তার দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে।

কয়েক মিনিট কাটল লম্বা দীর্ঘ। খটাং করে পুনরায় গরাদ খুলে গেল। ফিটিক চ্যাক ও তিয়াস ঠিসটক একটুও দেরি না করে এবারে সোজা হাঁটা দিল। বুক চিতিয়ে। ডোন্ট কেয়ার। মাথা উঁচু করে। এবং সহসাই তারা অদৃশ্য হল।

আবার তালা আটকে গেল।

চিকচাক রুই, জিয়াফ ব্যানব্যাট ও ফ্লিজ ফ্যাল রইল অবশিষ্ট, ঘরটিতে।

দূরে ঐ ঘরটাকে তাদের কাছে রহস্যময় লাগছিল। যেখানে ডাইনিং টেবিলে সাজানো ছিল থরে থরে সুস্বাদু খাবার। তাদের মনটা বারে বারে ঘুরে যাচ্ছিল ঐ ঘরটায়। সেখানে সাজানো ছিল মনোরম নরম সোফা। তাদের বন্ধুরা সেখানে হেলান দিয়ে আরাম করছে। বোধহয়, রজেট চিনচুই একজন বড় অফিসারের সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলছে। ঐতো হাঁটছে ফিটিক ও তিয়াস।

প্রকৃতপক্ষে অনতিদূরের ঐ ঘরটায়, তারা জানত ওরা অপেক্ষা করবে কিছুক্ষণ। কিন্তু ঐ ঘরটার ভেতরের কিছুই স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছিল না। আভাস থেকে অনুমান।

প্রতীক্ষা। উত্তেজনা। তারা তিনজনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আবারও মনে হল তাদের কথা কারো মনে নেই। তারা বিস্মৃত পরিত্যক্ত। সান্ত্রিটিও আর দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই।

সান্ত্রিটি একবার দেখা দিলেন।

ফ্লিজ ফ্যাল প্রায় লাফ দিয়ে গরাদের কাছে পৌঁছুলেন এবং ঔচিত্য অনৌচিত্য ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, ‘আমাদেরকে কখন ছাড়বেন?’ এবং তৎক্ষণাৎ যোগ করলেন অনুরোধ, ‘প্লিজ তালা খুলুন। আমরা বের হই।’

সান্ত্রি যেন অনুরোধটা শুনতে পেলেন না। তিনি করিডোরের শেষ প্রান্তে চলে গেলেন। ঘাড়ে ঝোলানো বন্দুকটা একটু ঠিক করে বসিয়ে, তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। অনেকক্ষণ তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

যে সম্ভাবনাটি বারবার উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল ফ্লিজ ফ্যালের মনে, তা হঠাৎ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সে তার বেয়াদপির মূল্য দিতে যাচ্ছে। সব্বাই ছাড়া পেলেও তারা তিনজন আর ছাড়া পাচ্ছে না। তাদের জন্য ওরা পৃথক কিছুর ব্যবস্থা করছে।

এদের হাতে ধরা পড়ার পরে সে তাদের এক কল্পিত জেনারেলের নামে হুমকি দিয়েছিল। এরা এখন ঐ হুমকির জবাব দিতে যাচ্ছে।

তারা নিজ নিজ ভাবনায় মগ্ন হল।

একজন কর্তা ব্যক্তি এলেন। দাঁড়ালেন গরাদের ওপারে। বললেন, ‘দুঃখিত। আপনাদের বেরুতে দেরি হবে।’

ফ্লিজ ফ্যালের মনে হল তার উদ্বেগটা তবে সত্য হল।

কিন্তু কর্তা ব্যক্তি আরও বিশদ করলেন, ‘সাংবাদিকরা এসেছে আমাদের অফিসে। তারা হৈ চৈ করছে। তর্কবিতর্ক করছে। ওরা দাবি করছে, আমরা আপনাদেরকে গোপনে ছেড়ে দিচ্ছি। ওরা শান্ত হোক। চলে যাক। আপনাদেরকে আমরা একে একে ছেড়ে দিচ্ছি। অর্থাৎ আপনারা বেরুবেন একে একে।’

১৮

তারা তিনজনই দাঁড়িয়ে থাকল। অনেকক্ষণ।

চিকচাক রুই একটু পানি পান করলেন। ডান পা টা সামনে এগিয়ে দিয়ে দুই হাতের আঙুলগুলো পরস্পরের ফাঁকে গুঁজে রেখে, চোখ খোলা রেখে, অথচ কোনো দিকে না তাকিয়ে তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।

‘পৃথিবীতে যে কারাগার নামে একটা জিনিস আছে, এ আমার জানাই ছিল না। বহুবার শুনেছিলাম। বর্ণনা শুনেছিলাম বহু মানুষের মুখ থেকে। বর্ণনাগুলি কি মনে রেখেছিলাম? এরকম একটা মর্মান্তিক জিনিস পৃথিবীতে আছে, সিরিয়াসলি কি তা নিয়ে ভেবেছিলাম?

‘শুনেছি বাতাসে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস আছে। এই শুনেছি মাত্র। পরীক্ষা করে দেখেছি কী পদার্থ তারা, কী তাদের ধর্ম, বর্ণ ও গন্ধ? তাহলে কী করে বলি জানি তাদের?

‘কারাগার, জেলখানা, পুলিশ-হাজত এগুলি কি একই জিনিস না একটু ভিন্ন ভিন্ন তা বলতে পারব না। কারাগারে শাস্তিপ্রাপ্ত আর বিচারাধীন উভয় প্রকারের মানুষদেরকেই কয়েদি বলে কিনা সে-সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই।

‘আইনভঙ্গ করলেই প্রায় বিনা ব্যতিক্রমে মানুষের হাতে কেন পরাতে হবে হাতকড়া? কেন করতে হবে বন্দি?

‘এই নিয়ম তো চালু হয়েছিল ‘জোর যার মুল্লুক তার’ যখন চালু ছিল পৃথিবীতে তখন।

‘জয়ীরা বন্দি করত পরাজিতদের। জয়ীদের দাসে পরিণত হত পরাজিতরা।

‘সাম্য, মৈত্রী, গণতন্ত্রে পরিচালিত একটি রাষ্ট্র কী করে তার নাগরিকদের শাস্তি দেবার জন্য কারাগার রাখে?

‘সুস্থ, সুখী মানুষেরা কখনো অপরাধ করে না। অপরাধ করে যারা অসুস্থ ও অসুখী। সেই তথাকথিত অপরাধীদের দরকার সুচিকিৎসা, শাস্তি নয়।

‘শুনেছি ভাসানি, বঙ্গবন্ধু জীবনের একটা দীর্ঘ সময় জেলে কাটিয়েছিলেন। তাঁদের মতো মহৎ মানুষেরা কতো অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধেই-না আন্দোলন করেছিলেন। কেন তাঁদের অ্যাজেন্ডায় জেল এল না? কেন তাঁরা দাবি করলেন না, জেল তুলে দিতে হবে? তাঁরা দাবি তুলতে পারতেন জেলখানাগুলোকে স্কুল বা হাসপাতালে পরিণত করার।

‘তাঁরা তাঁদের আপন জাতিকে মুক্ত করেছিলেন, পরাধীনতার গ্লানি থেকে। বিশাল প্রলয়ংকর কাজ। তাঁদের মেধা, দূরদৃষ্টি ও সাহস ছিল। তাঁরা ডাক দিতেন। জনসাধারণ তাঁদের ডাকে সাড়া দিত।

‘বিদ্রোহী কবির সেই অমর গানটা গেতে গেতে ছুটে যেত জনতা: কারার ঐ লৌহকপাট / ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট / রক্তজমাট শিকলপূজার পাষাণবেদী …

‘তছনছ করে দিত তারা। জেলখানা উঠে যেত। পৃথিবীতে আমাদের দেশ থেকে প্রথম জেলখানা উঠে যেত।

‘আমি ভাসানী বা বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টা হলে আইডিয়াটা তাদেরকে দিতাম। তাঁরা এত খুশি হতেন যে, আমার পিঠে একটা বিরাশি শিক্কা থাপ্পর মেরে বলতেন, ‘সাব্বাশ রুই!’

‘কিন্তু কেন তাঁরা কাজটা করলেন না? হয়তো আমার মতো একজন যোগ্য উপদেষ্টার অভাবে। অথবা হয়তো তাঁরা চেয়েছিলেন জেলখানা থেকে বেরিয়ে ক্ষমতাশালী হয়ে তাঁদের শত্রুদেরকে আবার জেলখানায় পুরতে।

‘তবে দুইজনার বোধহয় জেলখানাতে নিরিবিলি সময় কাটাতে বেশ ভালো লাগত। বাহিরে থাকলে যা পপুলারিটি! জান যাওয়ার জোগাড়!

‘আজ আমি আমার মধ্যে একটা নেতৃত্বের কোয়ালিটি দেখছি। এদের সব্বাইকে যেভাবে ক্রমান্বয়ে যেতে বলছি, তা তারা মানছে। তাই বলা যায় না, এই ইস্যুতে আমি একটা বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি।

‘বিশাল আন্দোলন। গণজোয়ার। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর সব দেশেই, আন্দোলনটা একটা ব্যাপক পপুলারিটি পেয়ে যেত।

‘কারণ জেলখানা থাকবার ফলে সভ্য দেশগুলির শতকরা পঞ্চাশ ভাগ লোক আইন ভঙ্গ করবার অপরাধে কমপক্ষে আধঘণ্টা থেকে ঊর্ধ্বপক্ষে সত্তুর বছর জীবনে একবার করে জেলখানা বা তার উপকণ্ঠ হাজতঘরে দিন কাটায়।

‘বর্বর দেশগুলির একশভাগ লোকই জেলখানায় কাটায় কারণ তারা তো হয়ে থাকে সভ্য দেশগুলির কয়েদখানা।

‘থাক আমার মাথাটা ঝিম্‌ঝিম্ করছে। আমার শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে।

‘আমাদের এই প্রিয় গ্রহ পৃথিবীটাই তো শূন্যে ভাসমান এক বিশাল কারাগার।

‘আমার মাথাটা ঝিম্‌ঝিম্ করছে।

‘কয়লাখনির গভীর সুড়ঙ্গে কালিঝুলিমাখা যে-মানুষেরা ঘোরে, এখন আমার প্রাণ কাঁদছে তাদের জন্য। কী কষ্টেই-না কাটে তাদের জীবন। দুর্ঘটনা ঘটলে, মৃত্যু। মৃতদেহও যায় না পাওয়া।

‘আমার মাথাটা ঝিম্ঝিম্ করছে। মনে হচ্ছে আমার কাছে গায়েবি আইডিয়া আসছে।

‘সমুদ্রের তলদেশে যায় ডুবুরিরা। ঘোরে সাবমেরিন। করুণ, কী করুণ মৃত্যু হয় তাদের হঠাৎ, আকস্মিক।

‘জলে ডুবে যায় জাহাজ, নৌকা। কত-না মানুষ মারা যায়।

‘খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠে দুঃসাহসী পর্বতারোহীরা। আচমকা পড়ে গিয়ে ডেড।

‘আর খুঁতখুঁতে বিজ্ঞানীরা এক সেন্টিমিটারের ১০০০ কোটি ভাগের ১ ভাগে কী কণিকা আছে তার করেন সন্ধান, নাওয়া খাওয়া ভুলে, নিজেদের বন্দি ক’রে গবেষণাগারে, যা আর এক কারাগার।

‘কারাগার। কারাগার।

‘একটি বের হওয়া ও বাহির হবার পথ। ফ্ল্যাট বাড়ি। গ্রিলে ঢাকা ব্যালকনি। সেও এক কারাগার।

‘দেশ রাষ্ট্র পাসপোর্ট ভিজা। বড় বড় কারাগার।

‘কবর, আরেক কারাগার।

‘অদৃশ্য মৃতলোক, সবচেয়ে বড় কারাগার।

‘সেখানে আমার ভাইটা চলে গেছে। সে আর কোনোদিনও ফিরবে না। আমার বড়ভাইটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। কী তার চেহারা! কী তার বডি! কী সুন্দর টানা চোখ! কী অপূর্ব ভ্রূ! কী দারুণ বুকের ছাতি! গায়ের রং টসটসে লাল। কমলালেবুর রঙ হার মানবে।

‘পুরুষ হোক মেয়ে হোক, যে তাকে একবার দেখবে, কাজকাম ভুলে সে শুধু তাকেই দেখবে এক পলক। পাঁচশ হাজার মেয়ে তাকে পাওয়ার জন্য পাগল। কিন্তু চোখ তুলে সে কাউকে দেখে না।

‘এক দিন সে পথে হাঁটে। আমাদের গ্রামে কাজ করে এক লোক নেভিতে। সে আমার ভাইকে দেখে। তার চোখে আর পলক পড়ে না। সে তাকিয়ে থাকে। সে জেনে নেয় আমার ভাইয়ের নাম পরিচয়, তারপর বলে, আমি তোমাকে নেভিতে ভর্তি করে নেব। তুমি পড়াশুনো করো।

‘আমার ভাইয়ের মাছ ধরার শখ। নদীতে যায় মাছ ধরে। বন্ধুবান্ধব সঙ্গে নিয়ে। একদিন মাছ ধরতে গিয়ে সে আর ফিরল না। গোসল করতে গিয়ে বেকায়দামতো লুঙ্গিটা তার মাথায় আটকে গিয়েছিল। ভালো করে আর সাঁতরাতে পারে নি। খরস্রোতা নদী তাকে টেনে নিয়েছিল।

‘নদীর সব জেলে বড় বড় জাল ও বঁড়শি নামিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে তিন দিন পর তাকে পেয়েছিল।

‘আমার বড়ভাই আর কোনোদিনও মায়ের কোলে ফিরে আসবে না। মৃতলোক থেকে আর কেউ ফিরে আসে না।

‘লজ্জা। লজ্জা। লজ্জা। ছি ছি ছি। আমরা বেরুব। ঢি ঢি রি রি পড়ে যাবে। কলঙ্ক। দুর্নাম। এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো ছিল।

‘যদি একটা ধাপ বাড়ালেই যাওয়া যেত মৃতলোকে, যে কারাগার থেকে কেউ ফিরে আসে না।’

বেনাপাত্তুঙ্কু লালঘর।
লালঘর নিপাত যাক।

রাজশাহী, মার্চ-এপ্রিল ২০০৭
================================
ইচক দুয়েন্দে
ইচক দুয়েন্দের জন্ম চাঁপাই নবাবগঞ্জে ১৯৬০ সালে। তাঁর পূর্বসূরিরা বসবাস করতেন রাজশাহী থেকে ১৪ মাইল দূরে ব্রহ্মপুর গ্রামে। তাঁর শৈশবে এবং যৌবনে বাবার চাকুরিসূত্রে উত্তরবাংলার বিভিন্ন অংশে ইচক বসবাস করেছেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। পরিবারটি রাজশাহী শহরে বসতি গাড়ে ১৯৭৬ সালে। তখন থেকে দুটো বড় বড় বিরতি বাদে ইচক এই শহরে বসবাস করছেন। ১৯৮২-৮৫ সালে তিনি পারিবারিক খেতখামার দেখাশোনার কাজে ব্রহ্মপুরে ছিলেন। ১৯৮৮-৯৪ পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন একজন সম্পাদক, প্রুফসংশোধক, লিপিসজ্জাকার এবং গ্রন্থ প্রকাশক হিসেবে। রাজশাহীতে ফিরে ১৯৯৫ সাল থেকে এখন অবধি ইচক দুয়েন্দে মানুষজনকে ইংরেজিতে কথা বলা শেখাচ্ছেন।

ইচক দুয়েন্দের ইংরেজিতে লেখা উপন্যাস: We Are Not Lovers (২০০৩)।
তাঁর পিতৃদত্ত নাম মুহম্মদ শামসুল কবীর এবং ডাকনাম কচি।
শামসুল কবীর নামে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: কচিসমগ্র (২০০৪)।

ichokduende@yahoo.com
=======================



bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ ইচক দুয়েন্দে


এই উপন্যাস'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.