গদ্যালোচনা- 'এল ডোর‌্যাডো সেরাফিনো!' by মীর ওয়ালীউজ্জামান

দিতির ঘুম ভাঙল সকালে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়ল। জানলার কাচের ভেতর দিয়ে বাইরেটা দেখেই শরীর আর মনের শ্রান্তি এক নিমেষে মিলিয়ে গেল। ঘন বৃক্ষশোভিত চারপাশ। উঁচু উঁচু গাছ। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। অরণ্যপ্রায় বৃক্ষরাজি গাঢ় সবুজ। কিচেনে ঢুকে দুধ গরম করল। টোস্ট, ডিমের ওমলেট আর পোচ, মাখন, মার্মালেড ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে ঋদ্ধর ঘরের দরজায় নক্ করল।


দরজা খুলে মাকে খাবারের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঋদ্ধ হাসল। ইউ আর ইমপসিব্ল, মা। বেড়াতে এসেও সাতসকালে আমার খাবার নিয়ে তোমার ব্যস্ততার শেষ নেই! টেইক আ ব্রেইক, মা। উই আর ভেকেইশ্যনিং! হয়েছে, হয়েছে, আমাকে আর ব্রেইক দিতে হবে না। আয়, আগে খেয়েনি’। তারপর বেরোব। তেমন-তেমন হলে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই—বলে অদিতি ছেলের হাতে দুধের গ্লাস ধরিয়ে দিল। পোচের হলুদ কুসুমে টোস্টের মুচমুচে কোণ ডুবিয়ে তুলে নিজেও কামড় বসাল।  ক্যালগারি থেকে এই ভ্যাঙ্কুভার ওরা মা-ছেলেতে পালা করে গাড়ি চালিয়ে এসেছে। চাট্টিখানি পথ নয়। পোঁটলাপুঁটলি গুছিয়ে নিয়ে দু’দিনে ১২০০ কিলোমিটার পেরিয়ে এসে ফেরিতে ওঠা। ফেরিবোটের ব্যবস্থা অবশ্য খুবই ভাল ছিল। ভ্যাঙ্কুভার থেকে একেবারে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলে স্ট্রেইট অব জর্জিয়া পার হয়ে এই সেরাফিনো পর্যন্ত আসে। আবার ফেরত যায়। ছয়তলা উঁচু একটা পুরোপুরি জাহাজের মতন ফেরি। একেবারে নিচের তলায় প্রায় শ’চারেক গাড়ি রাখার জায়গা। সবার ওপরে খোলা ডেক। ঋদ্ধ গাড়ি পার্ক করতে করতেই অদিতি বালিকার মত লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি টপকে ওপরে উঠে গিয়েছিল। পরপর তিনটে তলায় যাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসছে, কেউবা টিভি দেখছে, গিফট কর্ণারে ভিড় করছে কেউ। ওয়্যারলেস ইন্টারনেট কানেকশ্যন চাও? তাও রয়েছে। আরো রয়েছে বনেদি কফিশপ স্টারবাক আর রেস্তোরাঁ।
জাহাজঘাটা
একটানা দু’দিন হাইওয়ের ড্রাইভিংয়ের পর ওই অগাধ কালচে-নীল জলের সমারোহ মাকে যেমন আরাম দিচ্ছিল, ছেলেকে তেমন নয়। ঋদ্ধ বারবার বলছিল, কখন যে এই সমুদ্রযাত্রা শেষ হবে, মা! অদিতি পুরো পথটুকু আরামসে খোলা ডেকে বসে কাটিয়ে দিল। ভরদুপুরেই আকাশে কালোমেঘের ঘনঘটা। দেড়ঘণ্টায় জর্জিয়া প্রণালী পার হয়ে উনায়িমোতে নামা হল। ছোট্ট শহর উনায়িমো থেকে ফের স্থলপথে যাত্রা শুরু। ওটাই ছিল ওদের জার্নির শেষ পর্যায়। দ্বীপের মাঝ বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে টানা দুর্গম পর্বতমালা। সেরাফিনো পৌঁছনোর পথ ওই পাহাড়ের ধার কেটে কেটে তৈরি করা। মোট আড়াইশ’ কিলোমিটার পথের এক-তৃতীয়াংশে ৬৫টি ভয়ঙ্কর জটিলা-কুটিলা বাঁক। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার শর্টকাট বিকল্প রাস্তার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে মনে পড়ে অদিতির—বিবাহোত্তর দিনগুলির স্বল্পস্থায়ী আনন্দ, স্বচ্ছতা ও লাগামছাড়া সুখের স্মৃতি।



অত্যন্ত সরু রাস্তায় অতি সাবধানে গাড়ি চালাতে চালাতে সে ঋজুর ভাবনা আপাতত জোর করে মনের ব্যাকইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়। রাস্তার একধারে এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়, অন্যপাশে অতলান্ত খাদ, গভীর লেইক। জিপিএস-এর দিকে পলক-পলক তাকিয়ে অদিতি মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছিল। প্রতিকূল পরিবেশে ঋদ্ধর গা গুলোয়। তাই বোট থেকে নেমেই অদিতি ওকে পেছনে আসনে শুইয়ে দিয়েছিল। পুরো পথ ছেলেটা ঘুমিয়ে এসেছে। ঋদ্ধর প্রজন্মের জাতকেরা কোনো কিছুতে আশ্চর্য বোধ করে না। লেইক, পাহাড়, জঙ্গল ও ছেলেবেলা থেকে বেশি-বেশি দেখেছে বলেই কিনা কে জানে, প্রকৃতি এখন নাকি ওকে আর তেমন টানে না। এই বয়সেই! অদিতি উৎকণ্ঠায় টান টান হয়ে অবশেষে শেষ বিকেলে গাড়ি নিয়ে প্যাসিফিক রিম নাশন্যাল হাইওয়েতে নামতে পারল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রিয়ার ভিউ মিররে দেখল, ঋদ্ধ উঠে বসেছে। প্রশস্ত রাস্তায় চলে দেখতে না দেখতেই সেরাফিনো এসে গেল।

আগেই ই-মেইল চালাচালি করে ঠিক করে রাখা গেস্ট-হাউসের দরজায় নক করতে মিসেস হাচিসন হাতে চাবি ধরিয়ে দিয়ে জানালেন, ঘরে সেরাফিনোর মানচিত্র ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। বেড়ানো সেরে যাবার আগে যেন চাবিটা ওর ঘরের দরজায় ঝুলিয়ে রেখে যাই। ভাড়া উনি কার্ডে চার্জ করে নেবেন। অদিতির ক্রেডিট কার্ডের নম্বর আগেই দেয়া রয়েছে।

স্নান-টান সেরে মা-ছেলে বেরিয়ে পড়ল। প্যাসিফিক রিম ন্যাশন্যাল হাইওয়ে সেরাফিনোর মধ্য দিয়ে লম্বালম্বি এগিয়ে গিয়ে উত্তরে ডাউন-টাউনে শেষ। পথের দুধারে বাড়ি, রেজর্ট, গিফট শপ, আর্ট গ্যালারি, গ্রোউস্যরি, সি-ফুড রেস্তোরাঁ আর ট্যূর অপারেটরদের অফিস। ফাঁকে ফাঁকে ঘন জঙ্গলের উঁকিঝুঁকি। অদিতি খুব রিল্যাক্সড মেজাজে গাড়ি চালাচ্ছিল। কী যে ভাল লাগছে এখানে এসে। ডাইনে-বাঁয়ে রাস্তা চলে গেছে বিভিন্ন সৈকতে। ও হরি! এটা যে দ্বীপদেশ, তাই তো প্রায় ভুলে গেছলাম মা! ঋদ্ধর উচ্চারণে মুগ্ধ অদিতির সম্বিত ফিরল। কেন যেন ওর কেবলই মনে পড়ছিল রেলিক হান্টার্সের সেই পুরাতত্ত্ববিদ অধ্যাপকের মন্তব্য, যে মাঝে-মাঝেই দর্শকদের উৎকণ্ঠায় কণ্টকিত করার পর বলত: ইউ এইন্ট সীন নাথিন্ ইয়েট! সেরাফিনোর অন্দরমহল মনে হচ্ছে এখনো আড়ালে।

বছর কয়েক আগে বন্ধু অ্যালিস্যন অদিতিকে সেরাফিনোর গল্প শুনিয়েছিল। অ্যালিস্যনরা বেড়াতে ভালবাসে। জানিয়েছিল, কবে যেন ভ্যাঙ্কুভার ভ্রমণে গিয়ে ওরা প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে জঙ্গল-পাহাড়ের দ্বীপদেশ সেরাফিনোতে পৌঁছে গিয়েছিল। অবাক হয়ে দেখেছিল, মহাসাগরের ঢেউ অবিশ্রাম আছড়ে পড়ছে সাদা বালুভূমে, যেখানে কমলা রঙের স্টারফিশ আর অসংখ্য জেলিফিশ রোদ পোহায়। দিনে, রাতে অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে। মিষ্টি কুয়াশার পাতলা চাদর জড়িয়ে হাজার বছর ধরে অটল দাঁড়িয়ে রয়েছে শীতের দেশের আশ্চর্য রেইনফরেস্ট। অগুণতি তিমি দক্ষিণের মেক্সিকো এলাকা থেকে পরিযান করে আলাস্কামুখো, ওই সেরাফিনো দ্বীপ ছুঁয়ে প্রায়। অদিতির সেই থেকে ভাবনা, একবার ওখানটায় যেতে হবে।

মা ও ছেলে সেরাফিনো যাচ্ছে শুনে লেক্সাস উচ্ছ্বসিত। ভ্যাঙ্কুভারের মেয়ে লেক্সি গ্র্যাজুয়েশ্যন করে পড়তে এসেছিল ক্যালগারিতে। বর্তমানে অদিতির সহকর্মী। ওর মা ট্রাইবাল, বাবা ক্যারিবিয়ান। সমুদ্রে ট্রলিং করেন বাবা, মা নার্স। লেক্সি শৈশব থেকে জলে, জঙ্গলে অবারিত বিচরণ করে বড় হয়েছে। সারারাত বৃষ্টি ঝরার ঝমঝম শব্দ শুনেছে। প্রকৃতির সঙ্গে ওর নিবিড় সখ্য। ক্যালগারিতে বাস করে ও নাকি সেটা নতুন করে উপলব্ধি করছে। কফি ও লাঞ্চ ব্রেইকে ওর সঙ্গে গল্প করতে অদিতির ভাল লাগে। অবসর ও সুযোগ পেলেই লেক্সি সাইকেল ট্রিপে আটলান্টিক ক্যানাডায় অথবা চাঁদের আলোয় হিমবাহ দেখতে উত্তরাপথে ছোটে। ও প্রকৃতিকে ছুঁয়ে, ছেনে উপভোগ করতে ভালবাসে। ওর বয়ফ্রেন্ড অ্যালেক্স ছবি তোলে। ওই চমৎকার জুড়ির সঙ্গে অসামান্য রূপসী ক্যানাডীয় প্রকৃতির যেন গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক।

***

ঝিমুনির ঝোঁক কাটিয়ে অদিতি চোখ মেলে দেখল, ঋদ্ধর ছায়া দীর্ঘতর হয়ে ওকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে। দ্রুত বেড়ে ওঠা ছেলেকে দেখতে দেখতে সে বলল, ওমা, রোদ উঠেছে কখন? সেরাফিনোর ইতিবৃত্ত জানা হল তোর? উঠে বসে ছেলেকে কোকের ক্যান এগিয়ে দিল। হ্যাঁ মা, জানো, এখানকার টাউন লাইব্রেরিটা আশ্চর্য রকম রিচ। এক ঘণ্টায় এখানকার যা-কিছু-জানার-শোনার-দেখার, একটু নাড়াচাড়া করে এলাম। কোকের ক্যান খুলতে খুলতে ঋদ্ধ বলল। তোমাকে কখন সেগুলো শোনাব, মা? অদিতি হেসে ছেলের মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল ঘেঁটে দিল। অবিকল ঋজু চ্যাটার্জি। শুরু করুন, প্রফেসর চ্যাটার্জি। ছেলের চোখে চোখ রেখে অদিতি কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলে ওঠে, তুমি বলে যাও, বাবা। আমি আমার মতো জেনে-শুনে নিচ্ছি।

বালুতে কনুই গেঁড়ে কাত হয় ঋদ্ধ। গড়পড়তা ক্যানাডিয়ান জানে, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া এদেশের সর্বপশ্চিমের স্টেইট, ছেলে বলতে শুরু করে। সেই এলাকারও বাইরে দক্ষিণ-পশ্চিমে হচ্ছে গিয়ে তোমার, থুড়ি আমাদের এই ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপ। কাজেকর্মে লোকজন মেইনল্যান্ড থেকে ফেরিবোটে চড়ে এই আইল্যান্ডে আসে, যায়। আর, ইতোমধ্যে বুঝতে পেরে গেছ যে, মহাসাগরের একেবারে কোলে বসে আছে বলে ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ডে শীত কম—সারাদেশের মধ্যে এখানে শীত সবচে’ কম! জানুয়ারিতে ক্যানাডার প্রায় সবটাই যখন হিমাঙ্কের ৩০ ডিগ্রির নিচে কাঁপতে থাকে, তখন এখানে হালকা শীত! হালকা… মানে কত ডিগ্রি সেলসিয়াস বল্? মায়ের প্রশ্ন শুনে ঋদ্ধ উৎসাহিত হয়ে উঠে বসে। বলে, এই তোমার গিয়ে ধর শূন্যের এধার-ওধারে হোভার করে আর কি। সারাদেশের মধ্যে এখানে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। তাই এরকম গহীন বনের জয়জয়কার সবখানে। পর্যটনের আর্কষণ কিন্তু মেলাই রয়েছে। এই সেরাফিনো হচ্ছে পশ্চিমের শেষ বিন্দু। এখান থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে সরলরেখায় পশ্চিমে যেতে থাকলে জাপান পৌঁছে যাবে তুমি। আরেক ক্যান কোক বাস্কেট থেকে তুলে নিয়ে ঋদ্ধ তার সদ্য অর্জিত জ্ঞান রিকাউন্ট করতে থাকে, প্রায় হাজার পাঁচেক বছর যাবত আইল্যান্ডে ‘ফার্স্ট নেইশ্যন’-এর উপজাতিরা বসবাস করে আসছে—এদের মাঝে নু-সেরাফিন-নু উপজাতির মানুষ পশ্চিমদিকের এই সেরাফিনো, সিয়ারস আর মার্গস দ্বীপে। ক্যানাডার মূল ভূখ- থেকে বিছিন্ন থাকার কারণে আদিবাসীদের এক বিশিষ্ট সংস্কৃতি বহু বছর ধরে এখানে বিকাশ লাভ করেছে। ইউরোপীয়দের মাঝে স্প্যানিয়ার্ডরা প্রথমে সেরাফিনোতে এসে পৌঁছেছিল সেই ১৭৭৪ সালে। ক্যাপ্টেন ডন সেরাফিনোর নামে এই দ্বীপের নামকরণ হয়েছে। তাই নাকি রে, ঋদ্ধ? তুই তো সেরাফিনোর বিষয়ে একজন অথরিটি হয়ে গেছিস! অদিতির চোখেমুখে সত্যিকারের আগ্রহ আর জানার উদ্দীপনা লক্ষ্য করে ছেলে।
মিলেনিয়ামজীবী রেড সিডার
গোড়ায় এখানে অনেকদিন যাবত বসতি গড়ে ওঠেনি, মা। ঋদ্ধ গড়গড় করে বলে চলে। কারণ, এখানকার দুর্গম প্রকৃতি। ১৯৩২ সালে ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ডের মিউনিসিপ্যাল ম্যাপে সেরাফিনোকে একটি গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখনো এটি জেলেদের গ্রাম। হাজার দেড়েক অধিবাসীর এই দ্বীপে বিশুদ্ধ প্রকৃতির টানে মানুষ বেড়াতে আসেন। স্থানীয় মানুষেরাই যাবতীয় দোকান, রেস্তোরাঁ, হোটেল ইত্যাদি চালায় তাদের মতো, সাদাসিধে পুরনো পরিবেশ বজায় রেখে। ঝাঁ চক্চকে ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি-র মতো বহুজাতিক ব্যবসাদার এখনো আসতে পারেনি।

এই দু’দিনে অদিতি যেটা বুঝতে পেরেছে, সেটা হল, সবকিছু মিলিয়ে সেরাফিনোর একটি স্বকীয়তা, বিশিষ্ট আত্মিক পরিচয় রয়েছে। বাইরের সজ্জায় প্রাচীনতার গন্ধ—দিদিমার সিন্দুকের ভেতর নাক ডোবালে ছেলেবেলায় অদিতি এই ন্যাপথলিনের পরিচিত পুরনো-পুরনো গন্ধটা পেত। বাড়িঘরের ভেতরে অবশ্য ব্যবস্থাদি অত্যাধুনিক, প্রয়োজনের সবই হাতের নাগালে! ওরা বিচেই খেয়ে নিল। বৃষ্টি নামল আবার। মা-ছেলেতে মিলে গাড়িতে উঠে সেরাফিনোর দক্ষিণে প্রায় ২৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে যে জাতীয় উদ্যান, সেদিকে চলল। পার্কের খাঁজে খাঁজে মেলাই ট্যূরিস্ট স্পট। ওরা প্রথমেই গেল ওই অঞ্চলের ‘ফার্স্ট নেইশ্যন’ অধিবাসীদের অতীত ও বর্তমান জীবনধারার প্রবাহ যেখানে বহমান, সেই পুকানিনিশ সেন্টারে। বোঝা যায়, পৃথিবীর আলো, হাওয়া, গাছ, প্রাণী আর প্রকৃতির যা কিছু সম্পদ, যা ওদের জীবনধারণে সহায়ক ভূমিকা রাখে, তার সবকিছুর কাছেই ওরা চিরঋণী। জীবনদর্শন সমুদ্র, জঙ্গল, পশু ও প্রকৃতিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। ঈগল পাখি ওদের প্রেম, শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের দীক্ষা দিয়েছে, ভালুকের কাছ থেকে ওরা পেয়েছে শক্তি, কালকে জয় করবার নিষ্ঠা ও একাগ্রতা পেয়েছে তিমির কাছ থেকে। সেই কোনকাল থেকে নু-সেরাফিন-নু মানুষেরা তিমি শিকার করে আসছে। এককালে তিমি শিকার-ই ছিল ওদের আর্থসামাজিক প্রধান কর্মকাণ্ড।

দুর্গমতার কারণে ওই এলাকায় চাষবাস বা পশুপালন সহজ ছিল না। পুরোপুরি প্রকৃতিনির্ভর ছিল আদিবাসীদের সংগ্রামী জীবনযাত্রা। কেবল জীবনধারণের প্রয়োজনেই ওরা শিকার করত। ওদের বিশ্বাস—জল, স্থল, আকাশ আর দিগন্ত—প্রকৃতির এই চার উপাদানের আত্মা বর্তমান। প্রথম তিনের সঙ্গে নিত্যদিন ওদের দেয়া-নেয়া চলেছে। দিগন্তের ওপারে অর্থাৎ পরপারের যে আত্মা—তাকে চোখে দেখা বা স্পর্শ করা সম্ভব না হলেও ওরা বিশ্বাস করে, এক সর্বশক্তিমান কোন না কোনভাবে জীবনকে ঠিকই নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে অলক্ষ্যে।

‘রেইন ফরেস্ট’ বলতে মানুষ এশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার বৃষ্টি আর ভ্যাপসা গরমের অস্বস্তিতে ভরা ঘন বনের কথাই বোঝে। সেরাফিনোতে অদিতিরা টেম্পারেট রেইন ফরেস্টের দেখা পেল। বছরে প্রায় ৩২০ সেন্টিমিটারের মতো বৃষ্টি হওয়ার পরও ওখানকার তাপমাত্রা ৪-১২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তাই সেখানে গাছপালা আর জীবজন্তুও ক্রান্তীয় এলাকার থেকে ভিন্নতর। হাজার বছরের পুরনো পাইন জাতীয় গাছের দেখা মেলে! রেইন ফরেস্টের সাইন দেখে মা ও ছেলে গুটিগুটি বনে ঢুকল।

***  
আহা! সে কী সুন্দর, গহীন, গম্ভীর অরণ্যানী! পাক্র্স ক্যানাডা কর্তৃপক্ষ বনের ভেতর সুন্দর ‘ওয়াকওয়ে’ তৈরি করেছে। কাঠের পাটাতন ফেলে রেলিং দিয়ে ঘেরা সেই পথ বৃত্তাকারে বনের মধ্য দিয়ে ট্যূরিস্টদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। অভ্রভেদী উচ্চতা নিয়ে রেড সেডার বৃক্ষেরা নিস্তব্ধ, আদিম বনস্থলীতে সারিবদ্ধভাবে প্রায় দাঁড়িয়ে রয়েছে—অটল, স্বরাট। গাছের মোটা মোটা লাল গুঁড়ি অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। গুঁড়ির অসংখ্য ফাটলে সযত্নে সংসার পেতেছে মস্ আর ফার্নেরা। অনেক ক’জন মানুষ একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে বেড় দিলে যদি ঐ সব মহীরুহের একটাকে ঘিরে ধরতে পারে! ঐ কালজয়ী বৃক্ষদের ধরতে পারা কি অতই সোজা? পৃথিবীর কোনো বিপর্যয় যেন ওদের ছুঁতে পারেনি হাজার বছর।

কী সেই রহস্য যা রেড সেডারকে ওরকম দীর্ঘজীবী করেছে আর ঋজু চ্যাটার্জিদের অমন ভঙ্গুর? অদিতি ভাবে।

ঐ মুহূর্তে সেখানে আর কোনো দর্শনার্থী ছিল না। এবারে মা ও ছেলে রেলিং-এর ফাঁক গলে বনের সবুজ বিছানায় নেমে গেল। ঋদ্ধর পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা প্ল্যাস্টিক ব্যাগ বেরল। অদিতি ততক্ষণে একটু ফাঁকায় হাঁটু গেঁড়ে বসে বেশ কিছুটা নরম, ঝুরো মাটি দু’হাতের অঞ্জলিতে ধরেছে। ছেলে ব্যাগের মুখ খুলে ধরতে মা তাতে ঐ মাটি ভরতে লাগল। মাটি ভরা হলে আন্ডারগ্রোথের বুনো ঝোপঝাড় থেকে কিছু ফুল, ঘাস, লতাপাতা সংগ্রহ করা হল। ঐ মিশ্রিত নৈবেদ্য ওরা কয়েকটি গাছের গোড়ায় নিবেদন করল। যে কোনো পার্ক অথবা অভয়ারণ্যে গেলে অদিতি ও ঋদ্ধ এই রিচুয়্যল পালন করে।

ওয়াকওয়েতে উঠে পড়ে ওরা খুশিমনে এগোল। অনেকটা উঁচুতে দেখা গেল, গাছগুলো মাথার ওপরে ছাতার মতো ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। এক ছাতার গায়ে আরেক ছাতা যেন, ফাঁকে ফাঁকে প্রবেশ করছে অপরাহ্নের মিইয়ে যাওয়া আলো। সেই নরম রোদ্দুরের ছিটেফোঁটাও পৌঁছচ্ছে না গাছের তলদেশে। সারাদিন গাছের ছাতা বেয়ে টুপটাপ জল ঝরছে নিচে। সেই জল মিলেমিশে ধারারূপে বইছে ঐ প্রাচীন অরণ্যের মধ্য দিয়ে। চারধারে বহতা জলধারার কুলকুল ধ্বনি।
নির্জন বনপথ
ঋদ্ধ রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ওপরে তাকাল। আলো-আঁধারি, অজানা রহস্যময়তায় ঘেরা ঐ আবহে ওর গা ছমছম করে উঠল হঠাৎ। অদিতি মন দিয়ে ছেলেকে লক্ষ্য করছিল। ঋদ্ধর শরীর কেঁপে উঠতে সে ছেলেকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরল। একই সঙ্গে ভয়, বিস্ময় আর পারস্পরিক নির্ভরতা খোঁজা—সে এক অপূর্ব অনুভূতি। দুর্লভ আত্মোপলদ্ধি।

হঠাৎ বৃষ্টি নামল মুষলধারে। মাথার ওপরে বিটপী ছাতায় বারিপাতের শব্দ, কিন্তু ছিটেফোঁটার চেয়ে বেশি জল নিচে পৌঁছচ্ছে না। অন্ধকার নেমে এল ঝুপ করে। ঋদ্ধ চমকে উঠে তার ভিডিও ক্যামেরা গুটিয়ে ফেলল। গাছের নিচে বাঁধাকপির সাইজের মস্ত পাতাওয়ালা বুনো ঝোপে সাদা সাদা ফুলের কুঁড়ি ফুটল। সেই ফুলের তীব্র বুনো গন্ধে জেগে উঠল ট্রি ফ্রগের দঙ্গল। সেই ব্যাঙপ্রবরেরা দলে দলে হেঁড়ে গলার কোরাসে ডাক পাঠাতে লাগল ওদের দয়িতাদের লক্ষ্য করে। ওরকম কর্কশ ডাকে কেউ কি সাড়া দেয়? অদিতি স্থাণুপ্রায় দাঁড়িয়ে ভাবে। প্রাণিজগত রহস্যময় বটে! নেহাতই নিস্তব্ধ এক বনে হঠাৎ বৃষ্টি মুহূর্তে হট্টগোল বাঁধিয়ে দিল! অবাক বিস্ময়ে প্রকৃতি ও প্রেমের খেলা দেখতে দেখতে ওরা উপলব্ধি করে, বৃষ্টিতে দুজনেই ততক্ষণে ভিজে সারা। শীত করছে বেশ। ক্ষিদেও পাচ্ছে আবার। বিচের ধার ঘেঁষে অনেকগুলো সীফুড রেস্তোরাঁ। সহজেই অনেক কাজ মেলে। ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা সেখানে কাজ করে টিউশ্যন ফিজ যোগাড় করে। সেরাফিনোতে এখন ট্যূরিস্ট মোটামুটি ভালই দেখা যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরে ইউনিভার্সিটি খুললে ওরা যে যার মতোন ফিরে যাবে। লুজান নামের যে মেয়েটি ওদের খাবার সার্ভ করল, সে ভিক্টোরিয়াতে জুলজি নিয়ে পড়ছে। ওখান থেকে ভিক্টোরিয়া চার ঘণ্টার ড্রাইভ। এখানে রেস্তোরাঁ মালিকের বাড়ির বেইসম্যন্টে থাকে। উইকএন্ডে মাঝে মাঝে বাড়ি যায়। লুজান গত তিন বছর এভাবেই তার পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছে। মিষ্টি হেসে জানালো, এখানকার বিশেষ আকর্ষণ স্টিম্ড ক্র্যাব। খেয়ে বুঝল ওরা—সত্যিই সে সুখাদ্য অতি টাটকা, স্বাদু ও নরম। সামনেই ক্র্যাব ডক। ঝড়জলের কারণে গত দু’দিন জেলেরা সমুদ্রে যাচ্ছে না। নইলে এসময়ে ওরা ডক জুড়ে জেলেদের আনাগোনা দেখতে পেত। ট্রলার ভর্তি করে সবাই স্যামন, হ্যালিবাট আর ট্রাউট নিয়ে আসে, লুজান বলল। এলাকায় মানুষজন কম হওয়ায় জল দুষণমুক্ত আর সমুদ্রে মাছের জন্য প্রচুর খাবার।
মহীরূহ
অদিতিরা রাস্তায় নামল আবার। ছেলেমেয়ের দল সার্ফিং বোর্ড নিয়ে বিচের দিকে যাচ্ছে। সন্ধ্যেবেলা পর্যন্ত ওরা সার্ফিং করবে। সেরাফিনোতে গোয়ার মতোই অনেক ক’টি বিচ। দুরন্ত প্রশান্ত মহাসাগরে সার্ফিং-য়ের মজাই আলাদা। পৃথিবী বিখ্যাত সব সার্ফারদের বাস এই সেরাফিনোতে। এছাড়া, দেশ বিদেশের নামী সার্ফাররাও সমুদ্রের নেশায় ওখানে ভিড় করে। দূর থেকে ওরা ঢেউয়ের মাথায় ক’জন মানুষকে নৃত্যপর বিন্দুর মতো দেখতে পায়। মনে মনে অদিতি ওদের সাহস ও শারীরিক দক্ষতার প্রশংসা না করে পারে না।

***

পরদিন প্রত্যূষে উঠে অদিতি, ঋদ্ধ বড় বিচটায় পৌঁছল। এই বিচের সাদা বালিতে ছড়িয়ে আছে শুকনো গাছের গুঁিড়, ছোটবড় পাহাড়ের মতো পাথরের চাঁই। লেক্সির কাছে শোনা কমলা স্টারফিশ, কালো মুসেল, দৈত্যাকার বেলুনের মতো সব সমুদ্র শৈবালের মেলা। সমুদ্রের তীর ধরে ওরা বহুদূর হেঁটে গেল। জল বেশ ঠাণ্ডা। স্নান করা বোধহয় এ যাত্রায় হয়ে উঠবে না। আকাশ আলোয় ভরিয়ে দিয়ে সূর্যদেব হেসে উঠলেন। দূরে পাহাড়, কাছেই সমুদ্র আর আলোর মেলামেশায় এক অপূর্ব ছবি আঁকা হয়ে গেল যেন। হাতের মুঠোয় এঁটে যাবে, এমনি ছোট্ট ছোট্ট পাখিরা রোদ পোহায়। ঋদ্ধ হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে ওদের মাঝে ঢুকে পড়ল। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা অমনি ওকে ঘিরে যেন নেচে উঠল, ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল।

এমন ঝলমলে রোদ্দুরে আজ তিমি দেখতে গেলে কেমন হয়! অদিতি ভাবল। পর্যটকদের জন্য এখানে বড় আকর্ষণ এই মাঝসমুদ্র্রে গিয়ে তিমিদর্শন। ব্রেইকফাস্ট সেরে ওরা জনি’জ হোয়েলওয়াচ-এর দপ্তরে ঢুকে দু’টো টিকিট কিনল। আড়াই ঘণ্টার ভ্রমণ। বুকিং ক্লার্ক মেয়েটি জানালো, সমুদ্র যেহেতু অশান্ত, যাত্রীদের বেশ দুলুনি সহ্য করতে হতে পারে। অদিতি ঋদ্ধর পানে তাকাতে সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানান দিল, কুছ পরোয়া নেহি, মা।

লোকে জানে, পরিযায়ী পাখিরা শীতে উষ্ণতার সন্ধানে দূর দূর দেশে উড়ে যায়। জানা ছিল না যে, তিমিরাও ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে দেশান্তরী হয়। প্রায় ২০,০০০ তিমি ছোট ছোট দলে প্রতি বছর প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে দক্ষিণের মেক্সিকো থেকে উত্তরে আলাস্কায় পরিযান করে থাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চলে এই পরিযাত্রা। একটি পূর্ণবয়স্ক তিমি তার প্রায় ৩০টন ওজনের দেহ নিয়ে দিনে গড়ে প্রায় ৮০ কিলোমিটার অনায়াসে সাঁতরে এগোয়। এই পরিযান পথে ওরা উপকূলীয় জলস্রোত থেকে অসংখ্য ছোট ছোট জলজ জীব ধরে খায়। আলাস্কা অঞ্চলের সমুদ্র গরমকালে তিমিদের জন্য পুষ্টিকর খাবারে পরিপূর্ণ থাকে। আলাস্কায় শীত শুরুর প্রাক্কালে তিমিরা আবার দক্ষিণে ফিরে যায়।

ফেরিতে অদিতি, ঋদ্ধকে নিয়ে জনা পনেরো ট্যূরিস্ট উঠলে ফেরিচালক-কাম-গাইড জনসন জানিয়ে দিল, ফেরিচালনায় ওর তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে, কাজেই ওর ওপরে উপস্থিত সবাই ভরসা রাখতে পারেন। বড় দলটি নিউ জার্সি থেকে সড়কপথে এসেছে। গত দু’দিন ওরা ঝোড়ো আবহাওয়ার কারণে এখানে অপেক্ষা করছিল। সেরাফিনোতে এসে হোয়েল দেখবে না তা কি হয়?

ফেরি ছেড়ে দিল। চলছে দুলে দুলে। যতদূর দৃষ্টি যায়, সমুদ্র উত্তাল। ঘোর কাল্চে নীল জলে সূর্যের আলো পড়ে, ঝলমল করছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ঢেউয়ের দুলুনিতে অদিতির অস্বস্তি হতে লাগল। রোলিং কি একটু বেশিই হচ্ছে? ঋদ্ধর চোখমুখের অবস্থাও আশ্বস্ত হবার মতো নয়। ছেলে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঁজল। অদিতি প্রমাদ গুনল। সবে তো যাত্রা শুরু হল! ইষ্টনাম জপ করা ভিন্ন আর তো কোনো উপায় জানা নেই। উল্টোদিকে বসা ভদ্রমহিলা ওদের অস্বস্তি টের পেয়ে মুঠো মুঠো পেপারমিন্ট লজেন্জ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, মুখের ভেতর রাখ দু’টো, ভাল লাগবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা খানিকটা চাঙ্গাবোধ করতে লাগল। জনসন মাইকে তিমিদের পরিযানের খুঁটিনাটি বর্ণনা করে চলেছে। বেশির ভাগ তিমি এই সময় নাগাদ উত্তরে পৌঁছে গেলেও ওদের গোটা পঞ্চাশেক বছর বছর এই এলাকার সমুদ্রে থেকে যায়। কারণ এখানকার মৎস্যসম্পদের প্রার্চুয। সেরাফিনোর আশেপাশে হাম্পব্যাক তিমিদের দেখা যায়। এরকম নানা কথার মাঝে ফেরিতে হঠাৎ যেন সাড়া পড়ে যায়। সবাই বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়ে। জনসনের কণ্ঠ আবার গমগম করে, সামনেই একদল হাম্পব্যাক। আমরা বেশি কাছে যাব না। ওরা বিরক্ত হতে পারে।  অদিতিরা সামনে তাকিয়ে দেখল, কালচে বাদামি রং-এর হাম্পব্যাক তিমির মসৃণ পিঠ সাবম্যারিনের মতো ভেসে উঠছে। গোটা তিন-চারেক হবে। ওদের মাঝে একটি হঠাৎই তার মাথা উঁচিয়ে আকাশের দিকে কয়েক মিটার উপরে তীব্র বেগে জলের ফোয়ারা তৈরি করল। তারপর আরেকটা, তারও পর আরেকজন। নিকট সমুদ্রে যেন কোনো জাদুবলে এক সারি ফোয়ারা তৈরি হল। দীর্ঘক্ষণ শ্বাস ধরে রেখে তিমিরা এভাবেই নিঃশ্বাস ছাড়ে। কী বিশাল মহিমা! জনসন বলছে, ‘টার্ন, টার্ন, টার্ন প্লি-ই-ই-জ।’ যেন ওর অনুরোধ শুনতে পেয়েই একটি তিমি পুরোপুরি উল্টি খেয়ে ওর লেজ মেলে ধরল সদ্যফোটা ফুলের মতো। তারপরই পুরো দলটা জলের অতলে অদৃশ্য হল।

***

বিকেলে অদিতির মনে পড়ল লেক্সির কথা আবার। ‘সেরাফিনোর আর্ট গ্যালারি গুলোতে অবশ্যই একবার যেও—যদি ঐ জায়গার আত্মার খোঁজ পেতে ইচ্ছে হয়।’ টাউন সেন্টারে রাস্তার দু’ধারে অনেকগুলো আর্ট গ্যালারি। স্থানীয় শিল্পীদের নানারকম কাজ—কাঠখোদাই, কাচ গলিয়ে করা বিচিত্র শিল্পকর্ম দেখল ওরা। প্রকৃতির—বিশেষ করে, বৃষ্টির আশ্চর্য মেদুর রূপ মূর্ত সেসব কাজে। ঋদ্ধ মাকে ডাকল, ‘মা, এই ছবিটা দেখো!’ অদিতি এগিয়ে গেল সেদিকে। একটি বিশাল বৃক্ষ, যাকে আকাশ পরম মমতায় যেন কাছে টেনে নিতে চায়। সূর্যের স্নেহালোকে ধন্য সে মহীরূহ। মানুষের নাগালের অনেক, অনেক ওপরে গাছ আর আকাশের সে এক আর্শ্চয সেতুবন্ধন।
সামুদ্র্রিক মাছ, স্থানীয়দের প্রিয় খাবার, তিমিদেরও।
সেরাফিনোয় প্রকৃতি আজও আদি ও অকৃত্রিম রয়ে গেছে। এটা অবশ্য খুব সহজে ঘটেনি। ১৯৯৩ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া গভর্ণমেন্ট বেসরকারি কম্প্যানিদের এই এলাকায় গাছ কাটবার অনুমতি দিলে হাজার হাজার মানুষ তার প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। খবর ছড়ালে তাতে গ্রীন পীস, মিডনাইট ল্যাম্প ইত্যাদি সংগঠনের অ্যাক্টিভিস্টেরা যোগ দেয়। ইউনেস্কো ২০০০ সালে সেরাফিনোকে ‘বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ’ অর্থাৎ সংরক্ষিত প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য এলাকা ঘোষণা করে।

সরকার ওই এলাকা ও ‘ফার্স্ট নেইশ্যন’-ভুক্ত অধিবাসীদের সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য ট্রাস্ট তৈরি করেছে, যার দেখাশোনার দায়িত্ব স্থানীয় অধিবাসীদেরই। এদের কেউ শিল্পী, কেউবা মাছধরা, কেউ দোকানকর্মী। এদের সম্মিলিত চেষ্টায় সেরাফিনো আজও থেকে গেছে ‘গড্স ওউন ল্যান্ড’। অপসৃয়মাণ টেম্পারেট রেইনফরেস্ট, তিমির দঙ্গল আর বিরল সামুদ্রিক সব প্রাণী—এখানকার সব সম্পদ যেন প্রকৃতি নিজের হাতে যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে। সেরাফিনো যেন এক জীবন্ত মিউজিয়াম। স্থানীয় মানুষ গর্ব করে তাই বলতে পারেন, ‘সেরাফিনো হচ্ছে বৃক্ষপ্রেমীদের শেষ তীর্থস্থান।’
===========================
মীর ওয়ালীউজ্জামান
জন্ম
চৌগাছা, মাগুরা ১৯৪৯
m.waliuzzaman@gmail.com
১৯৬৯ সালে ইংরেজি দৈনিক দি পিপল-এ সাব এডিটর হিসেবে সাংবাদিকতার শুরু।
মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলা সাপ্তাহিক শতাব্দী সেতুতে কাজ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ করার পর কিছুকাল মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে ইংরেজি পড়ান। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে ১৯৮০ পর্যন্ত কাজ করেন। মাসিক গণস্বাস্থ্য সম্পাদনা করেন ১৯৮৩ পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে নানা আন্তর্জতিক ও দেশীয় উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর-এ কন্ট্রিবিউটিং এডিটর হিসেবে যুক্ত আছেন।  

bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ মীর ওয়ালীউজ্জামান

এই গদ্যালোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.