বঙ্গবন্ধু ‘বনাম’ শহীদ জিয়া by আসিফ নজরুল

প্রথম আলোর ২৭ মার্চ সংখ্যায় ‘বঙ্গবন্ধু “বনাম” শহীদ জিয়া’ শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। এর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে টরন্টো থেকে অধ্যাপক মোজ্জাম্মেল খান ৬ এপ্রিল এবং ঢাকা থেকে জনাব এনামুল হক ৭ এপ্রিল প্রথম আলোতে লিখেছেন। তা ছাড়া প্রথম আলোর ওয়েব সংস্করণে এই লেখার ওপর ৭৩টি মন্তব্য ছাপা হয়েছে। ওয়েবে অধিকাংশ পাঠক আমার লেখার বক্তব্য সমর্থন করলেও কয়েকজনের মন্তব্যে কিছু সমালোচনা করা হয়েছে।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত উল্লিখিত দুজনের লেখায় এবং ওয়েবে প্রকাশিত কয়েকটি মন্তব্যে আমার নিবন্ধ সম্পর্কে মূলত চারটি আপত্তি বা প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এগুলো নিম্নরূপ:
১. আমার লেখাতে বিশেষ করে শিরোনামে বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়ার তুলনা করা হয়েছে, যা অনভিপ্রেত। ২. জিয়াকে শহীদ জিয়া নামে লেখা হয়েছে, এটি সংগত কি না। ৩. জিয়াউর রহমানের শাসনকালে বহু সামরিক অফিসারকে অভ্যুত্থানকালে ও পরে হত্যা করা হয়েছে—এ প্রসঙ্গে আমি কিছু লিখলাম না কেন। ৪. বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করতেন—এটি আমি কীভাবে লিখলাম।
প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপনকারীদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সবিনয়ে আমার বক্তব্য এবার পেশ করছি। প্রথমত, আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শহীদ জিয়া বা অন্য কারও তুলনা করিনি, বরং প্রকারান্তরে তুলনা করার প্রবণতার সমালোচনা করেছি। বঙ্গবন্ধুকে যেখানে আমার লেখাতে অতুলনীয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধানতম ব্যক্তি বলা হয়েছে, সেখানে তুলনা কোথায় করা হলো? আর লেখার শিরোনামে ‘বনাম’ কথাটি উদ্ধৃতি চিহ্নের ভেতরে লেখা হয়েছে। তুলনা করার প্রবণতার বিরুদ্ধে আমার প্রশ্ন বা ভিন্নমত আছে বলেই এই উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। মূল লেখায় যেভাবে বলেছি, এখনো ঠিক সেভাবেই বলি, বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সকল প্রেরণার উৎস, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। তাই বলে এই স্থপতির নির্দেশ, চেতনা, রূপকল্পকে যারা চরম ঝুঁকি নিয়ে ’৭১-এর নয় মাসে বিভিন্নভাবে বাস্তবায়ন করেছেন, তাদেরকে খাটো করার কোনো অবকাশ নেই, এর কোনো প্রয়োজনও নেই।
দ্বিতীয়ত, জিয়াকে শহীদ জিয়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটো দলের একটি তাঁকে শহীদ জিয়া হিসেবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানায়। তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর এই প্রকাশভঙ্গিকে সম্মান জানিয়ে আমি বরাবর মরহুম জিয়াউর রহমানকে শহীদ জিয়া নামে লিখি। বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের বা খালেদ মোশাররফকে যদি উল্লেখযোগ্য কোনো জনগোষ্ঠী শহীদ কর্নেল তাহের বা শহীদ খালেদ মোশাররফ হিসেবে উল্লেখ করে, তাহলে আমিও তা-ই করব। মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রাখার কারণে তাঁরা আমাদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাঁদের প্রতি যেকোনোভাবে প্রকাশিত শ্রদ্ধায় শামিল হতে পারলে অন্য অনেকের মতো আমিও নিজেকে ধন্য মনে করব।
তৃতীয়ত, আমি আমার লেখায় কারও শাসনকাল নিয়ে আলোচনা করিনি। শহীদ জিয়ার শাসনকালে কতজন সামরিক অফিসারকে বিচার কিংবা হত্যা করা হয়েছে তা যেমন আমি আলোচনা করিনি, তেমনি অন্য কারও শাসনকালে কতজন রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীকে হত্যা করা হয়েছে তাও আমি উল্লেখ করিনি। আমার লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার ঘোষণাকেন্দ্রিক। আমি মূলত যা বলতে চেয়েছি তা হচ্ছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধে যাঁরাই অবদান রেখেছেন, তাঁদের সবাইকে আমাদের শ্রদ্ধা করা উচিত। বেশি অবদান যাঁর তাঁকে সম্মান জানাতে গিয়ে অন্যদের খাটো বা অস্বীকার করা অনুচিত, বেশি অবদান যাঁর, তাঁকে খাটো বা অস্বীকার করা আরও অনুচিত।
চতুর্থত, শহীদ জিয়ার আমলে বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে তার কিছু বর্ণনা আমাকে টেলিফোনেও কেউ কেউ দিয়েছেন। তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। শাসক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে, কিন্তু তাই বলে স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় অবদানকে অস্বীকার করার অধিকার অবশ্যই কারও নেই। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর অবদানকে মুছে ফেলার চেষ্টা যেটুকু করেছেন তা তাঁর সম্পর্কে বাজে উচ্চারণ করার মাধ্যমে যৌক্তিক করার চেষ্টা অন্তত করেননি। অথচ পরবর্তী বিএনপি বা আওয়ামী লীগ সরকারগুলো এ দুটো কাজই করেছে, করে চলেছে।
উপরিউক্ত চারটি প্রসঙ্গ ছাড়াও আরেকটি কথা বলতে হয়। অধ্যাপক মোজ্জাম্মেল খান লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতার পারিপার্শ্বিক প্রমাণ আছে। তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দূতাবাসে চাকরি দেওয়া, সংবিধানে তাঁদের ইনডেমনিটি দেওয়া—এসব পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে এই সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করা খুব কঠিন কাজ নয়। তিনি এই প্রসঙ্গে আমার অভিমতও সম্ভবত জানতে চেয়েছেন। আমার বক্তব্য হচ্ছে, জনাব খানের পর্যবেক্ষণ সঠিক হলে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচারকালে এই সংশ্লিষ্টতা পরিষ্কারভাবে উদ্ঘাটন করা হলো না কেন? খুনের সঙ্গে কারও সংশ্লিষ্টতা থাকলে তা অবশ্যই সেই খুনের বিচারের মাধ্যমে উদ্ঘাটিত হওয়া উচিত। তা না করে এটি রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়বস্তু হিসেবে বছরের পর বছর জিইয়ে রাখা সম্ভবত কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়।
আমি সত্যি বিশ্বাস করি, পরলোকগত নেতাদের অবদানকেন্দ্রিক বিতর্কে আবদ্ধ থাকার প্রবণতা থেকে বড় দুটো রাজনৈতিক দলের যথাসম্ভব সরে আসা উচিত। তাদের উচিত সুশাসনের লক্ষ্যে কর্মসূচি ও কার্যপরিকল্পনাভিত্তিক বিতর্কে নিয়োজিত থাকা, সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় কাজ দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করা। উচিত ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের কার কী অবদান তা ইতিহাসবিদ, গবেষক ও লেখকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.