বিশ্বমন্দা কাটার সংবাদে তেজি হয়ে উঠছে পণ্যবাজার



মেঘের কোণে রুপালি সূর্যের হঠাত্ ঝিলিকের মতোই মন্দা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনাগুলো উঁকি দিচ্ছে। জার্মানি থেকে জাপানে ভোক্তার দৃঢ়তর আস্থা, অভ্যন্তরীণ বা রপ্তানিমুখী শিল্পে উত্পাদন বৃদ্ধির মতো সূচকগুলো জানান দিচ্ছে সুদিন ফিরছে আবার। তবে বিশ্ব অর্থনীতির সেই সুদিন আসার আগেই পুরোনো এক শঙ্কা—মন্দা-পরবর্তী তেজি বাজার কি মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে? বিশ্বজুড়ে পণ্যের বাজারে (কমোডিটি মার্কেট) বেশ কিছু পণ্যমূল্যে অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, পূর্বাভাস আর ভবিষ্যদ্বাণী বিবেচনায় বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশটির অগ্রিম সতর্কতা আর কৌশল গ্রহণ জরুরি।
চিনি নিয়ে স্বস্তির খবর নেই: ব্যাপক উত্পাদন ঘাটতির শঙ্কা নিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই সপ্তাহ পর বাংলাদেশে আখ মাড়াই শুরু হচ্ছে আগামী ১৩ নভেম্বর। এবারের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ পাঁচ হাজার টন। এটি গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশে খরা দেখা দেয়নি, তবে আগের রোপণ মৌসুমটিতে ধানের দাম বেশি থাকা আর সার সংকটের কারণে আখ উত্পাদন নিশ্চিতভাবেই কম হচ্ছে এবার। সরকারি চিনিকলগুলো এবার উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে পুরোপরি সফল হলেও সেই চিনি দিয়ে দেশের মাত্র এক মাসের চাহিদা মিটবে।
১৮ অক্টোবর ভারত সরকার শুল্কমুক্ত চিনি আমদানির সুবিধা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে। মাড়াই মৌসুমের শুরুতেই ভারত হিসাব করেছে, খরার কবলে পড়ায় এবার আখের যে জোগান আসবে, তাতে ভরসা করা যায় না। অথচ এক বছর আগে এই ভারতই ছিল ব্রাজিলের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চিনি রপ্তানিকারক। এবার তারা আমদানি করেছে কমপক্ষে ৩০ লাখ টন চিনি। ভারতই চলতি চিনি সংকটের সূতিকাগার, তবে এবারের চিনি সংকট থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিচিত্র প্রভাবও শেখার আছে। ভারত যখন খরায় কুপোকাত, তখন অতিবৃষ্টিতে আখের ক্ষতি হয়েছে ব্রাজিলে।
সুতরাং বিশ্ববাজারের পরিস্থিতি বিবেচনায় সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত মজুুদ গড়তেই হবে বাংলাদেশকে। এর কোনো বিকল্প আপাতত নেই।
চাল নিয়েও সতর্কতা জরুরি: মধ্য অক্টোবরে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কমোডিটি ইনভেস্টর জিম রজার্স ঘোষণা করেছেন, এখন থেকে চালে আর তুলায় নিবদ্ধ হবে তাঁর দৃষ্টি। সামনের মাসগুলোতে এ দুটি পণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখেছেন কমোডিটি ইনভেস্টমেন্ট গুরু রজার্স।
চালের জন্য বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর নয়। তবে উত্পাদনে সংকট হলে, আর সেই সময় আমদানিতেও সংকট দেখা দিলে, বাংলাদেশের চালের বাজারেও পাগলা ঘোড়া ছুটবে—এটি নিকট ইতিহাসেরই শিক্ষা। ২০০৭ সালের নভেম্বরে সিডরে আমনের ক্ষতি এবং তার পরপরই ভারতে চালের রপ্তানিমূল্য বৃদ্ধি করলে ২৪ টাকা কেজির মোটা চাল ৩৪ টাকায় ঠেকেছিল চার সপ্তাহের মধ্যে।
সেই সময় অভ্যন্তরীণ জোগান ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ভারত চালের রপ্তানিমূল্য বাড়িয়েছিল। ভারত থেকে মোটা চাল রপ্তানি বন্ধ আছে। সুতরাং এবার সংকটের আশঙ্কা আরও প্রকট। গত সপ্তাহের পূর্বাভাস ছিল, খরায় চালের উত্পাদন প্রায় দেড় কোটি টন কম হবে ভারতে।
ভারত চালের আমদানি শুরু করলে বিশ্ববাজার আবার তেতে উঠবে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে বাংলাদেশেও প্রভাব পড়বে। চোরাচালানির দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে চালে। এ ধরনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি আছে কি?
মজুদ ও উত্পাদন নিয়ে আত্মতুষ্টি: ধানের দাম ব্যাপকভাব কমে যাওয়ায় আউশ উত্পাদন কম হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টির অভাবে আমন রোপণ বিলম্বিত হয়েছে। এর মধ্যে আবার হঠাত্ বন্যায় আমনের ক্ষতি হয়েছে বগুড়া আর কুড়িগ্রামের কোনো কোনো অঞ্চলে। গত সপ্তায় ইউএসডিএর পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রা থেকে লাখ দশেক টন আমন কম হবে এবার বাংলাদেশ। দুনিয়াজুড়ে কৃষি উত্পাদনের পূর্বাভাসের জন্য ইউএসডিএর ওপর আস্থাই সবচেয়ে বেশি।
কোনো মহাসড়কের পাশে সবুজ ধানক্ষেত দেখে কিংবা কোনো বিলে আগাম জাতের ধান কাটা দেখেই বাম্পার উত্পাদনের ধারণা নেওয়ার চর্চা আছে বাংলাদেশে। চালের মতো স্পর্শকাতর খাদ্যশস্যের জন্য এমনটি সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু আমন নয় আগামী বোরো রোপণ ও ফসল ঘরে ওঠা পর্যন্ত চাল নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে অন্তত প্রতিবেশী ভারতের পরিস্থিতি বিবেচনায়।
তুলা কেন জরুরি: চীন ও তুরস্কের পর পরিমাণগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশের পরিচিতি কটন-বেজড বা প্রাকৃতিক তুলা থেকে উত্পাদিত সুতা দিয়ে তৈরি কাপড়ে। কটন টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর আর জিন্স ও ডেনিম পোশাকে চীনের পরই দুই নম্বরে আমাদের অবস্থান।
তবে দেশে উত্পাদন থেকে এক হাজার টন তুলাও পায় না সুতাকলগুলো। তারা ২০০৮ সালে প্রায় ছয় লাখ টন তুলা আমদানি করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তুলা আমদানিকারক।
তুলার দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে মন্দা-পরবর্তী বিশ্ব্ববাজারে চীন, ভারত ও পাকিস্তানের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশকে। কারণ, এসব তুলা উত্পাদনকারী দেশের রপ্তানিকারকেরা স্থানীয় সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি সুবিধা পাবেন।
শুক্রবার নিউইয়র্ক কমোডিটি এক্সচেঞ্জে ডিসেম্বর ডেলিভারির প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ছিল ৭২ সেন্ট। দুই মাস আগে ছিল ৬০ সেন্টেরও কম। মার্কেট বিশ্লেষকদের মতে, মন্দা-পরবর্তী ব্যাপক চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানি মজুদ গড়ছে চীনের সুতাকলগুলো। ডলারের শক্তি হারানোও উসকে দিচ্ছে তুলার বাজার। ফরোয়ার্ড মার্কেট থেকে তুলা সংগ্রহের মতো ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় কি না, সেটি ভাবতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানিকারকদের।
জ্বালানি তেল: শুক্রবার নিউইয়র্ক বেঞ্চমার্ক ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮২ ডলার। এটি গত অক্টোবরের পর সর্বোচ্চ। দুই মাসে শতকরা প্রায় ১৫ ভাগের বেশি মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে জ্বালানি তেলের। প্রতি ব্যারেল ক্রুড অয়েল ১৪৭ ডলারে ঠেকেছিল গত ডিসেম্বরে। মন্দা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনায় আবার টগবগ করছে তেলের বাজার?
চিনি, চাল, চা, চকোলেট, পেঁয়াজ, রসুন এমনকি গরম মসলার বিশ্ববাজারও তেজি হচ্ছে। তাই সতর্ক দৃষ্টি রাখতেই হবে ব্যাপক আমদানিনির্ভর বাংলাদেশকে।

No comments

Powered by Blogger.