কারও কারও জন্য সুখবর -জলবায়ু পরিবর্তন by মুশফিকুর রহমান

বিশ্বের উষ্ণায়নে আমরা যত উদ্বিগ্ন, পৃথিবীর সবাই নিশ্চয়ই তেমন নয়। ধরা যাক বিশাল গ্রিনল্যান্ডের কথা। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর ও উত্তর মেরু অঞ্চলের বিশাল দ্বীপদেশ গ্রিনল্যান্ড। আয়তনে ফ্রান্সের প্রায় চার গুণ কিন্তু জনসংখ্যা সব মিলিয়ে মাত্র ৫৬ হাজার। সম্প্রতি গ্রিনল্যান্ডে কয়েকটি সাড়াজাগানো ঘটনা ঘটেছে। ১৮৯৩ সালে এক খ্যাপা ডাচ উদ্ভিদবিদ যে চারটি পাইনগাছ গ্রিনল্যান্ডে লাগিয়েছিলেন (গ্রিনল্যান্ডের প্রাচীনতম পাইনগাছ), দীর্ঘ নিদ্রার পর সেসব পাইনশীর্ষে নতুন সবুজ কুঁড়ি ফুটে বেরোচ্ছে। গ্রিনল্যান্ডের মানুষের দৃষ্টিতে এ যেন পাইনগুলোর নতুন জীবনলাভ। বিষয়টি বুঝতে বিবেচনায় নিতে হবে যে গ্রিনল্যান্ডে পাইনজাতীয় বৃক্ষের সাকল্যে মাত্র নয়টি লাগানো বন রয়েছে। আলুসহ আমদানি করা সবজি ছাড়া গ্রিনল্যান্ডবাসীর সবুজ সতেজ সবজি খাওয়ার অভিজ্ঞতা তেমন হয় না। কিন্তু পৃথিবী উষ্ণ হয়ে ওঠায় সচরাচর সবজির খামারগুলোও বদলে যেতে শুরু করেছে। সম্প্রতি স্থানীয়ভাবে চাষ করা আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি দোকানে এই প্রথম বিক্রির জন্য এসেছে। আটটি কৃষিখামার বাণিজ্যিকভাবে আলুর চাষ শুরু করেছে। পাঁচটি খামার অন্যান্য সবজির চাষে হাত দিয়েছে। কেউ কেউ বাড়ির সংলগ্ন বাগানে অল্প কিছু স্ট্রবেরি ফলাতে পেরে ভীষণ খুশি।
কেনেথ হোয়েগ নামের মুখ্য কৃষি উপদেষ্টা আশাবাদ প্রকাশ করেছেন যে গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চল যেহেতু উষ্ণ হয়ে উঠছে, সুতরাং সে অঞ্চল সবজির ক্ষেত ও সবুজ বনে ভরে না ওঠার কোনো কারণ তিনি দেখেন না। গ্রিনল্যান্ডের ৮০ শতাংশ জায়গাজুড়েই পুরু সাদা বরফের আচ্ছাদন। সেখানে সামান্য কয়েক ধররের কৃষিখামার বা সবুজ সবজির ক্ষেত বিশাল পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ। কেবল পুরোনো পাইনগাছে নতুন কুঁড়ি ফোটার অভাবিত ঘটনাই নয়, গ্রিনল্যান্ডের সন্নিহিত সাগরে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ পানির কড মাছের আনাগোনাও চোখে পড়ছে। ১০ বছর আগেও সেখানে মধ্য মে থেকে মধ্য সেপ্টেম্বরের অপেক্ষাকৃত উষ্ণ সময়কাল এখন প্রায় তিন সপ্তাহ প্রলম্বিত হয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের ৫১টি ভেড়ার খামারের মালিক খুশি—তাঁদের ভেড়াগুলো মাঠে কয়েক দিন বেশি সময় চড়তে পারছে।
শিকারের অভাবে গত ১০ বছরে আট হাজার শিকারির মধ্যে টিকে থাকা মাত্র দুই হাজার গ্রিনল্যান্ডীয় শিকারি খুবই উদ্বিগ্ন—তাদের শিকারগুলো ক্রমেই দুর্গম মেরু অঞ্চলে সরে যাচ্ছে। গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণে কৃষির সম্ভাবনার চিহ্নগুলো তাদের জন্য বিরাট পাওয়া বৈকি।
কেবল গ্রিনল্যান্ড একা নয়, কানাডা, রাশিয়াসহ উত্তরের অনেক দেশেই এখন অনেক নতুন সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। দীর্ঘ সমুদ্রপথ সংক্ষিপ্ত করে রুশ নাবিকেরা উত্তর মেরু দিয়ে জলপথে বাণিজ্যিক জাহাজের ভ্রমণের সম্ভাবনা সক্রিয়ভাবেই বিবেচনা করছেন।
গ্রিনল্যান্ডের অর্থ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী অ্যালেকা হ্যামন্ড কৃষিতে স্বনির্ভরতার স্বপ্নই কেবল দেখেননি; বরফ গলে যাওয়া দ্রুততর হওয়ায় ভবিষ্যতে গ্রিনল্যান্ডে জলবিদ্যুত্ উত্পাদন, তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আহরণের বর্ধিত সম্ভাবনা নিয়েও আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। এরই মধ্যে গ্রিনল্যান্ড মার্কিন কোম্পানি অ্যালকোয়ার সঙ্গে এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এই সমঝোতার অধীনে অ্যালকোয়া সেখানে অ্যালুমিনিয়াম উত্পাদন কারখানা স্থাপন করবে এবং গ্রিনল্যান্ডের বিশাল জলসম্পদ ব্যবহার করবে। মন্ত্রী আশাবাদী, আবহাওয়ার উষ্ণায়নে যে নতুন সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে, তাতে বরফের দেশ গ্রিনল্যান্ডে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বাড়বে এবং ডেনমার্কের বার্ষিক ৬০০ মিলিয়ন ডলারের (গ্রিনল্যান্ডের বার্ষিক বাজেটের অর্ধেক) সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমবে।
কেবল গ্রিনল্যান্ড একাই নয়, বিশ্বের উষ্ণায়নে মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি অবস্থানের দেশগুলোতেও কৃষির জন্য ইতিবাচক পরিবেশ বাড়বে। কেউ কেউ তো বরফঢাকা দেশগুলোকে অবকাশযাপনকেন্দ্রের প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠার ভাবনায় বেশ আমোদিত হয়ে উঠছেন। উত্তরের বরফাচ্ছাদিত অঞ্চল মঙ্গোলিয়া, কানাডা ও উত্তর ইউরোপের দেশগুলো সেই সুদিনের জন্য এখন থেকেই বিভিন্ন পরিকল্পনা তৈরি করছে।
কিন্তু পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠলে সমগ্র পরিবেশে যে পরিবর্তনগুলো অবধারিত হয়ে উঠবে, তা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে। বিজ্ঞানীদের অনেকে স্পষ্টই মনে করেন, অল্প কিছু মানুষের জন্য অর্থনৈতিক লাভ বয়ে আনলেও বৃৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্যই তা হবে বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে ২০৩০ নাগাদ পৃথিবীর উষ্ণায়নের ফলে বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করবে। এরই মধ্যে বিশ্বের উষ্ণায়ন ৩২৫ মিলিয়ন মানুষের জীবনে মারাত্মক প্রভাব স্পষ্ট করছে। আগামী ২০ বছরে পৃথিবীর প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ মানবিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কেবল বৈশ্বিক উষ্ণায়নজনিত প্রভাবে। সূত্র মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বছরে প্রায় ৩৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হবে।
আগামী ডিসেম্বরে কোপেনহেগেনে জলবায়ু নিয়ে বিশ্ব সম্মেলন হবে। সেখানে বর্তমান সময়ে মানবসভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রজ্ঞানির্ভর চুক্তিতে উপনীত হতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে। বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের আশা যে প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় রেখে কার্যকর, ন্যায়সংগত ও মেনে চলার বাধ্যবাধকতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে, যাতে এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ এবং ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জনগোষ্ঠীর গরিব অঞ্চলগুলোর স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।
বর্তমানে যতটা ধারণা করা সম্ভব তা থেকে দেখা যায়, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বছরে অন্তত ৭০ মিলিয়ন মানুষ বন্যায়, আট মিলিয়ন মানুষ খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া দেশের আট শতাংশ নিম্নাঞ্চল স্থানীয়ভাবে জলমগ্ন হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধিতে উপকূল ও প্লাবনভূমি অঞ্চলের আরও ব্যাপক অঞ্চল আংশিক ও দীর্ঘ বন্যার কবলে ডুবে থাকবে। আবহাওয়ার এলোমেলো আচরণ আরও স্পষ্ট হবে এবং ব্যাপক অঞ্চলে লবণাক্ত জলের প্রকোপ বাড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিতে বাংলাদেশে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, বনাঞ্চলের দ্রুত সংকোচন ও পানীয় জলের ব্যাপক সংকট মোকাবিলায় যে বিপুল সম্পদের দরকার হবে, তা বিবেচনায় নিলেই বোঝা যায়, বিশ্বে এ সংকট মোকাবিলায় কত বিলিয়ন ডলার বাড়তি সম্পদের সংস্থান প্রয়োজন। চাইলেই তা যথেষ্ট পাওয়া যাবে না এবং আবার ঠিক সবার ভাগ্যে তা ন্যায্য হিস্যা হিসেবে আপনা থেকেই আসবে না। এ জন্য যেমন দেশের ভেতরে হোমওয়ার্ক, লক্ষ্যনির্দিষ্ট মানসম্মত গবেষণা প্রয়োজন; একইভাবে বিশ্বপরিসরে কূটনৈতিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নেগোসিয়েশনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন আলোচনার অধীনে বিভিন্ন সহায়তা ও দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক আলোচনা বৈঠকগুলোতে জাতির প্রয়োজনের প্রতিশ্রুতিগুলো আদায় করা সম্ভব হবে।
মুশফিকুর রহমান: খনি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.