চট্টগ্রাম কারাগারে শীর্ষ সন্ত্রাসী খুন নানা প্রশ্ন

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে ৩২ নম্বর সেলে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত অমিত মুহুরি খুন হয়েছে। বুধবার মধ্যরাতে রিপন নাথ নামে যুবলীগের এক কর্মীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চট্টগ্রাম   কারাগারের মধ্যে অমিত মুহুরি ও তার খুনি রিপন নাথ সমর্থিতদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়। পরে কারাপুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নাছির আহমেদ অমিত মুহুরি খুন ও সংঘর্ষ হওয়ার সত্যতা স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছে। মামলায় রিপন নাথ (২৭)কেই আসামি করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বর্তমানে তাকে একটি নির্জন সেলে রাখা হয়েছে।
ওদিকে এ হত্যার পর চট্টগ্রামে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সুরক্ষিত কারাগারে এমন ঘটনা অথচ কারা রক্ষীরা কেউ জানলো না? হাজতিদের কারো কাছে কোন ধরনের অস্ত্র থাকার কথা নয়। প্রশ্ন উঠেছে, রিপন নাথ ধারালো অস্ত্র পেলো কোথা থেকে?
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নাছির আহমেদ জানান, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ৩২ নম্বর সেলের একটি কক্ষে থাকতেন অমিত মুহুরি ও অপর দুই কয়েদি রিপন নাথ ও বেলাল। বুধবার দিনগত রাত ১০টার দিকে সেলের ওই কক্ষে কথা কাটাকাটির জেরে অমিত মুহুরিকে প্রথমে ইটের টুকরো দিয়ে মাথায় আঘাত করে রিপন। ধারালো অস্ত্র নিয়ে উপর্যুপরি কোপাতে থাকে রিপন নাথ। কারারক্ষীরা গুরুতর আহত অমিতকে উদ্ধার করে প্রথমে কারা হাসপাতাল এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করে।
রাতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক খুরশীদ আনোয়ার চৌধুরী জানান, মাথায় গুরুতর জখম অবস্থায় অমিতকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তার মাথায় ২৬টি সেলাই পড়েছে। ভারি কোনো বস্তু দিয়ে তাকে মাথায় আঘাত করা হয়েছে। মারামারির কারণ এবং কারাকক্ষের ভেতরে ইট ও ধারালো অস্ত্র কীভাবে আসলো তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। রিপন নাথকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে।
চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক জহিরুল হক ভুঁইয়া জানান, রাত ১১টা ২০ মিনিটের দিকে অমিত মুহুরিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। এর আগে তাকে ২৮ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। কিন্তু রাত ২টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
নগর কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন জানান, অমিত মুহুরি একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির ১৫টি মামলা রয়েছে। পূর্বাঞ্চল রেলের কোটি টাকার দরপত্র নিয়ে জোড়া খুনের মামলার আসামিও তিনি। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-অর্থবিষয়ক সমপাদক হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবরের অনুসারী ছিলেন অমিত।
তিনি জানান, ২০১৭ সালের ১৩ই আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের এনায়েতবাজার এলাকার রানীরদিঘি এলাকা থেকে একটি ড্রাম উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথমে বোমা রয়েছে ভাবা হলেও ড্রাম কেটে ভেতরে লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ গলে যাওয়ায় তখন পরিচয় বের করা যায়নি। পরে এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ৩১শে আগস্ট ইমাম হোসেন ও শফিকুর রহমান নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানায়, ড্রামের ভেতরে পাওয়া লাশটি অমিতের বন্ধু নগর যুবলীগের কর্মী ইমরানুল করিমের। ৯ই আগস্ট নগরের নন্দনকানন হরিশ দত্ত লেনের নিজের বাসায় ইমরানুলকে ডেকে নেন অমিত। এরপর বাসার ভেতরেই তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর অমিতকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
অমিত মুহুরি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা সদরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ডা. মনোরঞ্জন মুহুরি চেয়ারম্যান বাড়ির অজিত মুহুরির ছেলে। অমিত এমইএস কলেজের সাবেক ছাত্র। অপরদিকে রিপন নাথ সীতাকুণ্ড উপজেলার মৃত নারায়ণ চন্দ্র নাথের ছেলে। নগরীর পাহাড়তলী থানার একটি অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন রিপন।
ওসি জানান, রিপন নাথ (২৩) গত ৯ই এপ্রিল সন্ধ্যায় ছুরি নিয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানার সাগরিকা এলাকায় অর্গানিক জিন্স নামে একটি পোশাক কারখানা জিম্মি করার ঘটনা ঘটান। ওই সময় তিনি হাতে থাকা কাগজে মোড়ানো একটি ছুরি নিয়ে কারখানায় ঢুকে পড়েন। কারখানার নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে বাধা দিলে এক নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে তার ধস্তাধস্তিও হয়। পরে তিনি কারখানার কনফারেন্স রুমে ঢুকে যান। তখন রুমে পোশাক ক্রেতাদের সঙ্গে কারখানার কর্মকর্তাদের সভা চলছিল। এ অবস্থায় রিপন রুমে ঢুকে তার হাতে থাকা ছুরি নিয়ে সবাইকে জিম্মি করে ফেলেন।
খবর পেয়ে পাহাড়তলী থানা পুলিশের একটি টিম কারখানায় ছুটে আসে। সবাই মিলে তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেও কিছুতেই সে তা শুনছিল না। উল্টো রুমে থাকা কয়েকজনকে হত্যার হুমকি দিতে থাকে সে। নানাভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে তাকে তার পছন্দসই খাবার খাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে রাজি হলে তাকে চাহিদামতো খাবার সরবরাহ করা হয়। পরে কৌশলে পুলিশ তার ছুরিটি জব্দ করে তাকে আটক করতে সমর্থ হয়।
এ ঘটনায় কারখানার শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এমনকি নিরাপত্তাকর্মীরাও ভীত হয়ে পড়ে। এতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় বন্ধ ছিল কারখানার কাজকর্ম।
অমিত ছিল রিপনের বন্ধু: বুধবার দিনগত রাত দুটায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সামনে অমিত মুহুরির পিতা অজিত মুহুরি বেশ কয়েকবার বলেছেন, রিপন তো অমিতের বন্ধু ছিল। বন্ধুই যদি হয়ে থাকে, কারাগারের ভেতরে কেন তারা প্রাণঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল? মনে হচ্ছে এটি একটি সুপরিকল্পিত হত্যা।
অমিত মুহুরির উত্থান যেভাবে: খুন দিয়েই অপরাধজগতে অমিত মুহুরির হাতেখড়ি। এ কারণে অপরাধজগতে নামার শুরু থেকেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেন তিনি। নিজেকে যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দেয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই পরিচিতি পান তিনি। অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় হয়ে পড়েন অমিত মুহুরি।
ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হিসেবে নগরীর নন্দনকানন, সিআরবি থেকে শুরু করে লালদীঘি, আন্দরকিল্লা পর্যন্ত তার একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয়। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখল- বেদখলের ঘটনায় নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি এ এলাকার অপরাধের সকল ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন তিনি।
নন্দনকাননকেন্দ্রিক যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অনুসারী হিসেবে যুবলীগের রাজনীতিতেও তিনি হয়ে উঠেন প্রভাবশালী। দুঃসাহসিকতার জন্য দলে ছিল অমিত মুহুরির আলাদা সমাদর। নেতৃত্বের গুণাবলী এবং খুব সহজে অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা মাত্র আড়াই বছরে তাকে চট্টগ্রামের অপরাধ জগতে আলাদা পরিচিতি এনে দেয়। পরিচিতির ব্যাপকতা আসে সিআরবির ডবল মার্ডারের মাধ্যমে। বারে বারে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া অথবা গ্রেপ্তার হলেও অল্প সময়ের মধ্যে বের হয়ে আসা তাকে আরো বেপরোয়া করে তোলে।
নগরীর নন্দনকানন এলাকার বাসিন্দা অজিত মুহুরির বড় ছেলে অমিত। গ্রামের বাড়ি রাউজান পৌরসভা এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। এসএসসি পাস করেন রাউজান পৌরসভার সুরেশ বিদ্যায়তন থেকে। এর পর চট্টগ্রাম শহরে এসে ওমর গণি এমইএস কলেজে ভর্তি হলেও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেন নি। বন্ধুকে ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে মুহুরির উত্থান।
অমিত মুহুরি গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। কয়েকজনকে নৃশংস কায়দায় খুন করেন। আরো কয়েকজনকে মারাত্মক আহত করেন। সিআরবিতে জোড়া খুনের অন্যতম আসামি তিনি। ২০১৩ সালের ২৪শে জুন টেন্ডারবাজির ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী সাজু পালিত ও হেফজখানার ছাত্র আরমান হোসেন মারা যান। ওই ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন অমিত মুহুরি। কিছুদিন পর জামিনে বের হয়ে এসে যুবলীগের নেতা পরিচয় দিতে শুরু করেন অমিত। এরপর এলাকায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং একইসঙ্গে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের গতি বাড়িয়ে দেন অমিত মুহুরি। ২০১৭ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি নগরীর আমতল এলাকায় খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী ইয়াছিন আরাফাত। এ ঘটনায় অমিত মুহুরির জড়িত থাকার প্রমাণ পায় পুলিশ। অমিত মুহুরির বিরুদ্ধে একাধিক খুনসহ অন্তত ১৩টি মামলার খোঁজ পাওয়া গেছে। আরো বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.