মাহিদ হত্যা: তদন্তে আলো ফেলে একটি রিকশার ছবি by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

ঘটনাটি ঘটেছে রাতের অন্ধকারে। রাতের অন্ধকারের মতো পুলিশও ছিল অন্ধকারে। আঁধারে আলো হয়ে দেখা দেয় এক পথচারীর মোবাইল ফোনে ধারণ করা একটি ছবি। সে ছবিতে দেখা যায় একটি রিকশার পেছনের ছবি। মাহিদ আল সালাম হত্যা রহস্য উদঘাটনে সে ছবিই পুলিশের সামনে আলোর রেখা হয়ে দেখা দেয়। সে আলোর রেখা ধরেই সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) জ্যোতির্ময় সরকারের নেতৃত্বে তদন্ত দল পৌঁছে যায় ঘাতকের কাছে।
একটি মোবাইল দোকানের কর্মচারী ছবিটি তোলেন। রিকশার ছবিটিকে সামনে রেখেই তদন্ত এগুতে শুরু করে। পুলিশ তাদের নিজস্ব বিভিন্ন সূত্রের প্রয়োগ করে সন্ধান চালায় ছবির রিকশাটি খুঁজতে। সফলও হয়। রিকশার সন্ধান মেলে, সন্ধান মেলে চালকেরও। আখালিয়ায় সিটি কাউন্সিলর মখলিসুর রহমান কামরানের বাসার পাশের মজনু মিয়ার গ্যারেজ থেকে আটক করা হয় রিকশাচালক জয়নাল আবেদীন ভাণ্ডারিকে। ব্যাটারিচালিত ওই রিকশা চালকের বাড়ি দিনাজপুরে। ঘটনার রাতে তিনিই মাহিদকে বন্দর থেকে রিকশায় তুলেন। সেখান থেকে পাঠানটুলা হয়ে নিয়ে আসেন কদমতলিতে। পুলিশকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দেন ভাণ্ডারি। জানান, কালো রঙের পালসার মোটরসাইকেলে আসা একদল তরুণই হামলা চালিয়েছিল মাহিদের ওপর। রিকশাচালকের বর্ণনা মতে, লম্বা চুলের লিকলিকে শরীরের এক তরুণ মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলো। অন্ধকারে এর বেশি কিছু আর ঠাহর করতে পারেননি ওই রিকশাচালক। অন্ধকারে দেখা আবছা সে বর্ণনাই পুলিশের সামনে আলোর রেখা তৈরি করে দেয়। পুলিশ এবার নতুন উদ্যমে মাঠে নামে। রিকশাচালকের দেয়া বর্ণনামতো চালক আর মোটরসাইকেলের খোঁজ চলতে থাকে নগরজুুড়ে। সফল হয় পুলিশ। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা কবরস্থানের পাশ থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা এলাকার সোয়াব মির্জার ছেলে মির্জা আতিক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার তায়েফ মুহাম্মদ রিপনকে। আতিকের স্বীকারোক্তি অনুসারে মাহিদকে ছুরিকাঘাতে ব্যবহৃত ছোরাও উদ্ধার করে পুলিশ। বুধবার রাত ১টার দিকে গ্রেপ্তার করা হয় আরো এক ছিনতাইকারী বারখলার বাসিন্দা রাসেলকে।
অপরাধ তদন্তে জ্যোতির্ময় সরকারের ঝুলিতে আরো অনেক সাফল্য জমা আছে। ‘সূত্রহীন’ এ মামলাকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নেন। তাছাড়া এ মামলাটি বিশেষ কারণে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণও ঘটাচ্ছিলো। নিজে যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠ নিয়ে গায়ে পুলিশের পোশাক জড়িয়েছেন নিহত মাহিদ আল সালামও সেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) ছাত্র। মাহিদ যেন তারই ছোট ভাই। সিলেট নগরীর মদিনা মার্কেট এলাকার অ্যাডভোকেট এম এ সালামের ছেলে শাবির অর্থনীতি বিভাগের ২০০৮-০৯ সেশনের শিক্ষার্থী মাহিদ আল সালাম ২০১১-১২ সেশনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। চাকরির সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রোববার মধ্যরাতে বেরিয়েছিলেন তিনি। পথে নগরীর কদমতলি এলাকায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন তিনি। উরু ও হাঁটুর পেছনে ছুরিকাঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় তার। সে রক্তক্ষরণ নিজের হৃদয়ে টের পেয়েছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এসএমপির এডিসি জ্যোতির্ময় সরকার। নিজেই নিজের সামনে এ রহস্যের শেষ দেখার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। সফলও হন।
পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া মির্জা আতিক হত্যার দায় স্বীকার করে বুধবার আদালত ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তার ভাষ্যমতে, মূলত ছিনতাইয়ে বাধা প্রধান করায়ই মাহিদকে হত্যা করা হয়েছে। দুটো মোটরসাইকেলে করে তারা চারজন মাহিদের পথ রোধ করে। তারপর মাহিদের কাছ থেকে তার জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতে থাকে। মাহিদ তাদের বাধা দেন। তখনই ছুরির আঘাতে থামিয়ে দেয়া হয় তাকে। পরে ছিনতাইকারীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
ছিনতাই কাজে জড়িত চারজনকে আসামি করেই মামলা হয়েছে দক্ষিণ সুরমা থানায়। মামলায় আসামি করা হয় ৪ জনকে। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নাহিদ, রিপন, রাসেলের পর মামলার অপর আসামি ভার্থখলার শাকিল আহমদের সন্ধানে রয়েছে পুলিশ। সেই মূল ঘাতক বলে জানা গেছে। শিগগিরই তারও নাগাল মিলবে বলে পুলিশের আশা।
এসএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জ্যোতির্ময় সরকার রহস্য উদ্ঘাটনের পেছনে নিজের একক কৃতিত্ব মানতে চান না। তিনি মানবজমিনকে বলেন, এটা টিমওয়ার্ক। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায়ই অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.