চীনে সেন্সরশিপের খড়গ, হয়রানির শিকার সাংবাদিক, আইনজীবী

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গত মাসে তাদের সংবিধান পরিবর্তন করে। এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা যাবজ্জীবন পর্যন্ত অনুমোদন করা হয়। ঠিক এর কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট সি জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে যেকোনো কথা, তার সমালোচনাকে কঠোর হাতে দমন করা হচ্ছে।  সবকিছুতে সেন্সরশীপ আরো করা হচ্ছে। যেমন ‘এমপেরর সি’ ‘দ্য এমপেররস ড্রিম’ এবং ‘ড্রিম অব রিটার্নিং টু দ্য গ্রেট কিং’ ‘উইনি দ্য পু’ এ জাতীয় শব্দের দিকে ধারালো সেন্সরশীপ আরো করা হচ্ছে। এমন রিপোর্ট করেছে চায়না ডিজিটাল টাইমস। এমন সেন্সরশিপ এখন চীনে নতুন কিছু নয়। কয়েক মাসে চীনে এর রীতি আরো গ্রাস করেছে। আরো নিয়ন্ত্রণমুলক টুলস এসেছে। যেমন ভারচুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন)। এর মাধ্যমে ফায়ারওয়ালকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়। তবে তারাও এখন অনুমোদিত নিউজ আউটলেটকে ছাড় দিচ্ছে। যেসব আইনজীবী সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্ব করছেন তাদেরকে বাধা দেয়া হচ্ছে। গত ৩০ শে জানুয়ারি সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব চায়না ঘোষণা করে যে, ৪৬২টি ওয়েবসাইট ও সামাজিক মিডিয়াকে অনলাইনে সংবাদ পরিবেশনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। যদি অনুমতি না নিয়ে কোন আউটলেট সংবাদ ভিত্তিক ওয়েবসাইট প্রকাশ করে তাহলে তাদেরকে ৩০ হাজার ইউয়ান জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। পরের মাসে প্রশাসন সামাজিক যোগাযোগ বিষয়ক মিডিয়াগুলোর ব্যবহারকারীদের জন্য কিছু নির্দেশনা প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ব্যবহারকারীকে অবশ্যই তাদের বৈধ নাম প্রকাশ করতে হবে। ব্যক্তিগত আইডি প্রকাশ করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানে আছে তার কোড নম্বর প্রকাশ করতে হবে। দিতে হবে ফোন নম্বর। এরপরই অনলাইনে কোনো পোস্ট প্রকাশ করতে পারবে। এই বিধিবিধান কাযৃকর হয়েছে ২০ শে মার্চ থেকে। ওদিকে শিল্প ও তত্য মন্ত্রলালয় থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, সুষ্ঠুভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে ৩১ শে মার্চ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে লাইসেন্ন নেই এমন সব ভিপিএন’কে। এর অর্থ হলো, ব্যক্তিবিশেষ ও বিদেশী কোম্পানিগুলো, যাদের ভিপিএন ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে তাদেরকে শুধু রাষ্ট্র অনুমোদিত ভিপিএন ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ভিপিএন ব্যবহারের অনুমতি আছে তাদের। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)কে ইংরেজি ভাষার একটি মিডিয়ার একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক বলেছেন, চীনে তাদের রিপোর্টিং করার জন্য ভিপিএন অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই সাংবাদিক বলেছেন, এটা ছাড়া তারা রিপোর্ট ও ছবি পাঠানোর ক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করছেন না। এ ছাড়া তার সম্পাদক, সহকর্মী ও সাক্ষাতকার দেয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।  চীনে এটাই প্রথম এ রকম ঘটনা নয়। কর্তৃপক্ষ এর আগেও মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করতে এমন সব ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে। ৬৪ তিয়ানওয়াং নামের মানবাধিকার বিষয়ক একটি সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটে কাজ করেন পু ফেই। তিনি সিডিজে’কে বলেন, ২০১৬ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে এই সাইটের যেসব স্বেচ্ছাসেবক আছেন তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ওয়েইবো’তে কোনো একাউন্ট খুলতে পারছেন না। তাদেরকে বাধা দেয়া হচ্ছে বা ব্লক করা হচ্ছে। যখনই তারা নিবন্ধন করতে যান তখনই এমন ঘটনা ঘটছে। ফলে সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ যেন, প্রযুক্তির ব্যবহার করছে সাংবাদিকদের পিছু নিতে। একজন সাংবাদিক সিপিজেকে বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন উইচ্যাট নামের ম্যাসেজিং যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। ওই সাংবাদিক বলেন, অধিকতর শত্রুতামুলক বিষয় হলো, আমার উইচ্যাট একাউন্ট জোর করে লগআউট করে দেয়া হচ্ছে। এক সপ্তাহের বেশি সময় আমাকে উইচ্যাট একাউন্ট ব্যবহারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদি ধরেন উইবো’র কথা। সেখানে আমার ব্যক্তিগত ম্যাসেজিং ফাংশন স্থায়ীভাবে বিকল করে দেয়া হয়েছে অথবা ফিল্টার করা হচ্ছে।
সাংবাদিকরা মনে করছেন, তাদের উইচ্যাট একাউন্টের এক্সেস পেয়ে যাচ্ছে সরকারি কর্মকর্তারা। এর মধ্য দিয়ে তারা সাংবাদিকদের ওপর নজর রাখছে। একজন সাংবাদিক বলেছেন, অন্য শহরে আসা একজন সফররত বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে উইচ্যাটে কথা বলার পর স্থানীয় কর্মকর্তারা ওই বন্ধুর পারিবারিক খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাদের পরিবারে একজন সাংবাদিককে ঠাঁই না দেয়ার জন্য শাসিয়ে যাচ্ছেন। ওই সাংবাদিক সিপিজে’কে আরো বলেছেন, কর্মকর্তারা তাদের পূর্ণাঙ্গ নাম ও তাদের সংবাদ মাধ্যমের নাম নিয়ে নিচ্ছেন। এমন কড়াকড়ি নজরদারির অর্থ হলো, উইচ্যাট ও সিনা উইবো ব্যবহার ক্রমবর্ধমান হারে বাতিল করছেন সাংবাদিকরা। ওই সাংবাদিক বলেন, এর অর্থ হলো চীনে সাংবাদিককরা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। আমার সাক্ষাতকারের বিষয়টিও অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল হয়ে পড়েছে। এটা কঠিন হলেও আমরা তো তা বন্ধ করতে পারি না। কারণ, এতে আমাদেরকে আরো বেশি পেশাদারিত্ব দেখাতে হয়। সৃষ্টিশীলতা দেখাতে হয়। অব্যাহত রাখতে হয় রিপোর্টিং।
চীনে যে শুধু ইন্টারনেট বা সামাজিক মিডিয়ার গলা টিপে ধরা হয়েছে তা-ই নয়। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনালের চীনা প্রতিনিধি ফরাসি সাংবাদিক হেইকি শমিডট। মার্চের শুরুর দিকে তাকে আটক করে বেইজিং পুলিশ। প্রায় এক ঘন্টা তাকে আটকে রাখা হয। তার ভয়েস রেকর্ডার জব্দ করা হয়। এসব কথা সিপিজেকে বলেছেন ওই সাংবাদিক। হেইকি শমিডট বলেছেন, তাকে থামানো হয়। সংবিধান সংশোধনের ভোট নিয়ে একটি মলে লোকজনের সাক্ষাতকার নেয়ার বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাংবাদিকদের যখন দীর্ঘ সময় আটক রাখার চেয়ে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়, সেখানে স্থানীয় সাংবাদিক ও মিডিয়ার সোর্স, তাদের পরিবার ও আইনজীবীরা রয়েছেন আরো কঠিন ঝুঁকিতে।
চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক চেন সিয়াওপিংয়ের রিপোর্টের বদলা নিতে কর্তৃপক্ষ আপাতদৃষ্টে মনে হয় তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গেছে। এরপর গুয়াংঝৌ শহরে তার বাড়ি থেকে কিভাবে তার স্ত্রী নিখোঁজ হলেন তা নিয়ে জানুয়ারিতে প্রামাণ্য ডকুমেন্ট উপস্থাপন করে সিপিজে। ১০ই ফেব্রুয়ারি পুলিশ আটক করে সু কিংন’কে। তিনি নিরপেক্ষ মানবাধিকার বিষয়ক গবেষক। তার নিউজ এজেন্সি সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এমন তথ্য দিয়েছে রেডিও ফ্রি এশিয়া। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সমালোচনা করে একটি লেখা পুনর্মুদ্রণ করেছিলেন সাংবাদিক সান লিন। তার বিষয়ে কয়েকদিন আগে রেডিও ফ্রি এশিয়াকে সাক্ষাতকার দেন সু কিন। এর কয়েকদিনের মধ্যেই সু কিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার পরিবারকে এ কথা জানিয়ে দেয় পুলিশ। আলোচিত এ দু’জনই এখনও জেলে রয়েছেন।
শুধু সাংবাদিকরাই নন। সাংবাদিক ও  সরকারের সমালোচকদের প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবীরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ৬৪ তিয়ানওয়াং নিউজভিত্তিক ওয়েবআসিটের প্রকাশক হুয়াং কি’র প্রতিনিধিত্ব করছিলেন আইনজীবী সুই মুকিং। কিন্তু গুয়াংডং ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস তাকে নিষিদ্ধ করে ১২ই ফেব্রুয়ারি। স্থানীয় আইন মন্ত্রণালয় থেকে ওই আইনজীবীকে একটি নোটিশ পাঠানো হয়। তাতে অসভ্য, আক্রমণাত্মক কথাবার্তার জন্য তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। সুই মুকিং সিপিজেকে বলেছেন, তাকে এভাবে নিষিদ্ধ করায় অন্য আইনজীবীরা আতঙ্কিত হবেন, যারা মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলেন। মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীদের কথা বলেন। রাজনৈতিক অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের পক্ষে কথা বলেন। চীনে জেলে আছেন সাংবাদিক ওয়াং শুরোং। তার প্রতিনিধিত্ব করছেন আইনজীবী লিন কিলেই। তিনি সিপিজেকে বলেছেন, সুই মুকিংকে নিষিদ্ধ করার পর তিনি চাপ অনুভব করছেন। তবে মানসিকভাবে তিনি প্রস্তুত আছেন। না হয় জেলই হবে। তিনি বলেন, আমি মনে করি আমি একজন আইনজীবী। আমার মক্কেলের পক্ষাবলম্বন করা আমার দায়িত্ব। আমার বেশির ভাগ মক্কেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জনস্বার্থ বিরোধী অথবা সামাজিক ইস্যু নিয়ে কথা বলা। আমি তাদের পক্ষে কথা বলছি। আমি তাদের হয়ে কথা বলে যাবো।

No comments

Powered by Blogger.