কেটে যাক এই ঘোর

সুস্বাগত ইংরেজি নববর্ষ ২০১৮। আমরা পরস্পরের মধ্যে প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময় করছি। নব-আশা নব-উদ্দীপনায় এগিয়ে চলার সঙ্কল্প নিয়েছি। হঠাৎ মনে পড়ল, বহুবিতর্কিত কিন্তু বিখ্যাত ফরাসি ভবিষ্যৎ বক্তা নস্ট্রাডোমাস একসময় ঘোষণা করেছিলেন, ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর নাকি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, অথবা পৃথিবীর নবসূচনার দিন হিসেবে চিহ্নিত হবে। তার মতে ওইদিন পৃথিবীর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে, সেটা প্রাকৃতিক, পারমাণবিক বা অলৌকিক অর্থাৎ যেকোনোভাবে কিছু একটা ঘটতে পারে। এমন খবরে তখন হোঁচট না খেয়ে উপায় ছিল না। স্বাভাবিকভাবে দুর্বল মনে জাগে হতাশা। মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে তখন তো আধিভৌতিকে বিশ্বাস করতে থাকে। অবশ্য ভবিষ্যৎবাণীতে মুসলমানদের বিশ্বাস করতে নেই, তবে কেয়ামতের আলামত যে স্পষ্টতর হচ্ছে, সেটা বুঝি অস্বীকার করা যায় না। বর্তমানে অপার্থিব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিজ্ঞানীরা মহাকাশ বিচরণ করছেন। ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বই লিখে সাড়া জাগানো বিজ্ঞানী অধ্যাপক স্টিফেন হকিং তার ৭০তম জন্মদিনে বলেছিলেন, আগামী শতকে আমাদের নিকটতম গ্রহ মঙ্গলের বুকে নাকি গড়ে উঠবে মানব বসতি। পারমাণবিক যুদ্ধ অথবা বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার পরিণতিতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। ঘরবাড়ি বানিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করবে পৃথিবীর মানুষ। শতবর্ষ পরে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের বুকেও গড়ে উঠবে এ ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ মানববসতি। বিশ্বায়নের এ যুগে তবে কি পৃথিবীর অন্তিম অবস্থা! কতটুকু মানুষের জীবন, আর তার পতাকা! বস্তুত, বায়ুমণ্ডলে অস্বাভাবিক উষ্ণতাবৃদ্ধির কারণে প্রকৃতির মধ্যে ইতোমধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত বছর জাপান, নেপাল, ইকোয়াডোর, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, এল সালভেদর, মেক্সিকো, তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ায় সঙ্ঘটিত ভূমিকম্প, কোথাও কোথাও জলোচ্ছ্বাস এবং এখন চলছে ক্যালিফোর্নিয়ায় ভয়াবহ দাবানল।
এসব দুর্যোগে অসংখ্য লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছে অনেকেই। অনতি অতীতে জাপানের সুনামি ও পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা, থাইল্যান্ডের অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাস, নিউজিল্যান্ডের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প স্মরণ করিয়ে দেয় আবহাওয়া মণ্ডলের অস্বাভাবিক আচরণের কথা। মাঝে মধ্যে নানা সমীক্ষার মাধ্যমে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অদূর ভবিষ্যতের যে ভয়ালচিত্র তুলে ধরছেন সে ব্যাপারে যদি যথাযথ ও গুরুত্ব সহকারে দ্রুত সঠিক ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তবে চরম বিপদ থেকে রেহাই মিলবে না বলে তাদের হুঁশিয়ারি। আজকাল রাতে বিবিসি কিংবা ভয়েস অব আমেরিকার সর্বশেষ বিশ্বসংবাদ যখন শুনি, ঘুম হারাম হয়ে যায়। এখন দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতা উল্টালে দিনের কর্মচাঞ্চল্য নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বুকভাঙ্গাএত কান্না হচ্ছে প্রতিদিন, এত রক্তপাত! মানুষ মরছে, মানুষেই মারছে। সৃষ্টির সেরা জীব হলো নরাধম, মানুষ হয়েছে আজ মানুষের যম। সংবাদমহলও উত্তাল হয়ে ওঠে কঠিন আর নির্মম মৃত্যু নিয়ে। কোথাও আর সুস্বাদু খবর নেই! সময় প্রলেপ দিয়ে যায় বটে কিন্তু যন্ত্রণার বিষণ্ন বাতাসে থেকে যায় নিঃশব্দ নালিশ। দৈনন্দিন যাপনের মাধ্যমে প্রাত্যহিকতার চাপে দীর্ণ মানুষ। প্রাণ আছে বটে, জীবন নেই। চার দিকে গনগনে আগুনের আঁচ। প্রতিবাদ ও আর্তনাদ লুটাচ্ছে পথে পথে, কখনো মিশে যাচ্ছে অশ্রুজলে। এক নিগূঢ় নিয়তি যেন আঁকড়ে বসে আছে আমাদের ভাগ্যে। আমরা তার কাছে জানু, নতমস্তক। এক দিকে পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি, অপর দিকে বিশ্বময় হানাহানি রক্তপাত দিয়ে যেন এক অবিচল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হচ্ছে। একটার পর একটা দুর্ঘটনা আর বিস্ফোরণে সেটা ক্রমেই শক্ত হচ্ছে। জ্বলন সভ্যতার আদি, জ্বলনেই সভ্যতার বিনাশ। তবে কি আমরা শুরু ও শেষের এক অনিবার্য সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি, দাঁড়াচ্ছে আমাদের জ্বলন্ত জীবন! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথী, নিত্যনিঠুর দ্বন্দ্ব; ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভ জটিল বন্ধ’। জটিল ও অস্থির এ জগতে যেখানে পদে পদে বিভ্রান্তি, ধর্মের অমিয়বাণী সেখানে শান্তির হদিস দিতে পারে। এ কথায় সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা মহাজাগতিক সত্যে বিশ্বাসী, যেমন চন্দ্র, সূর্য, তারা, যেমন জল এবং আগুন, যেমন আকাশ ও পৃথিবী-সমস্তই ঐশী শক্তিতে পরিপূর্ণ।
প্রাণী ও বৃক্ষপুুুষ্প সমন্বয়ে প্রকৃতি এক অখণ্ড সূত্রে নিবদ্ধ, তাদের আধ্যাত্মিক আদর্শকে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবলভাবে প্রতিফলিত করেছেন। আজকাল ধর্মবাণীর গভীরে পৌঁছানোর যেকোনো চর্চায় আমাদের বিমুখতা, এক বিস্ময়কর জগতের সামনে আমাদের এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সৃষ্টি ও স্রষ্টা-উভয়েরই ব্যাপারে আমাদের সমান অনুসন্ধিৎসু হওয়া উচিত। কেননা এই বিশ্ব তো স্রষ্টারই রচনা। সে যা হোক, জীবন এখন নানা চাপে ও মানসিক অস্থিরতায় ভরা। ফলে সাধারণ মানুষের মনে শান্তি নেই। নানাধরনের মানসিক অসুস্থতায় অনেকেই আক্রান্ত। সমাজজীবনও আজ আর সহজসরল নেই, ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোও নানাভাবে বিপর্যস্ত। অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি তো রয়েছেই, তদুপরি মার্কিনি প্রাচুর্য এবং মানসিক অবসাদে অহরহ ঘটছে বিপত্তি, বিভ্রান্তি ও ভোগান্তি। ক্রমবর্ধমান লোভলালসা সভ্যতাকে অজানা এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে চলেছে। এর বাইরে সমাজনীতি, রাজনীতিও এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, স্বভাবিক জীবনধারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ব্যক্তিমানুষ আজ বিভ্রান্ত। তারা মুক্তির পথ খুঁজছে। কিন্তু কিছু একটা যেন ঘটছে, কিন্তু দুর্বোধ্য। এই পৃথিবী যেখানে এখন সর্বত্রই ফাঁদ, এই শতাব্দীতে যেখানে বিবর্ণ লণ্ঠনের মতো দুলছে ক্লিষ্টতা, আমরা যেন ওভাবে এক ঘোরের মধ্যে অবস্থান করছি!

No comments

Powered by Blogger.