অভিজিৎ খুনের ছক জেনেছে পুলিশ

বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০১৪ সালের মাঝামাঝিতে। হত্যাকারীদের ওপর নির্দেশ ছিল অভিজিৎ রায় দেশে না আসা পর্যন্ত তাঁর বাবা অধ্যাপক অজয় রায়কে অনুসরণের। আর অভিজিৎ দেশে আসার পর তিনি কোথায় উঠেছেন, সে সম্পর্কে খুনিরা খবর পেয়েছিলেন অজয় রায়ের বাড়ির গৃহকর্মীর কাছ থেকে। অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে গত নভেম্বরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশি তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। গত ৫ নভেম্বর পুলিশের হাতে সোহেল ওরফে সাকিব, ১৭ নভেম্বর মোজাম্মেল হুসেইন ওরফে সায়মন এবং ২৪ নভেম্বর আরাফাত গ্রেপ্তার হন। সোহেল ও সায়মন আগেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সর্বশেষ গতকাল সোমবার জবানবন্দি দেন পুরস্কারঘোষিত আসামি সাজ্জাদ ওরফে শামস ওরফে আরাফাত। আরাফাত বলেছেন, তিনি ওই দলে চাপাতিসহই উপস্থিত ছিলেন। অন্যরা ব্যর্থ হলে তাঁর যোগ দেওয়ার কথা ছিল।  কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসামিরা তাঁদের বলেছেন ওই হত্যাকাণ্ডে মোট আটজন অংশ নেন। চারজন ছিলেন অপারেশন টিমে, বাকি চারজন ছিলেন ইন্টেল গ্রুপের। অপারেশন টিমের চারজন সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। বাকি চারজনের দায়িত্ব ছিল অভিজিৎ রায়ের গতিবিধির ওপর নজর রাখা, ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদে পালানো নিশ্চিত করা এবং হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেওয়া। তিন আসামির মধ্যে সোহেল বিয়ে করেছেন সায়মনের বোনকে। সোহেলদের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারীতে। ঢাকায় সোহেল ব্যবসা করতেন। সায়মন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র ছিলেন। আরাফাত ঢাকা কলেজে পড়তেন, তবে পড়ালেখা শেষ করেননি। সায়মনের ল্যাপটপ থেকে তাঁদের টার্গেটে থাকা খুনিদের তালিকা পাওয়া গেছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামিরা বলেছেন, তাঁরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান ও চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ জিয়াউল হকের নির্দেশে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে অজয় রায়ের পিছু নেন। তার আগে তাঁরা ঢাকার বাড্ডা ও দক্ষিণখানে সৈয়দ জিয়াউল হকের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তিনিই টার্গেট ঠিক করে দেন এবং প্রাথমিক তথ্য সরবরাহ করেন। আসামিরা জানতে পারেন, অধ্যাপক অজয় রায় বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নেন। তাঁরা রাজধানীর বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যেতে শুরু করেন। একসময় তাঁরা অজয় রায়কে চিনে ফেলেন ও তাঁকে অনুসরণ করতে শুরু করেন। তাঁরা অজয় রায়ের বাসার সামনে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতেন, ওই বাসায় কে কাজ করে, কারা যাতায়াত করে, সব তথ্যই সংগ্রহ করে নেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিজিৎ এসেছেন এ খবর তারা আচমকা পায়। বাড়ির গৃহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পারে অভিজিৎ রায় দেশে এবং তিনি ইন্দিরা রোডের একটা বাসায় উঠেছেন। এরপর তারা ইন্দিরা রোডের বাড়িটিও চিনে নেয়।’ ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশে এলেও তাঁরা অভিজিৎ রায়কে কাছ থেকে দেখেন বেশ পরে। তাঁরা অভিজিৎ বইমেলায় কখন আসেন, সে বিষয়ে খোঁজ নিতে তাঁরা জাগৃতি প্রকাশনীতে যান। এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি যান বইমেলায়। সেদিনও তাঁদের হত্যার প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু তাঁরা অভিজিৎকে খুঁজে পাননি। তাঁরা খুব কাছ থেকে অভিজিৎকে দেখেন একটি রেস্তোরাঁয়। যতক্ষণ তাঁরা রেস্তোরাঁয় ছিলেন, ততক্ষণই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা হাজির ছিলেন সেখানে। ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁরা অভিজিৎ রায়কে বইমেলায় পেয়ে যান। আসামিরা যে চারজন হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন তাঁদের নাম জানিয়েছেন পুলিশকে। তবে তদন্তের স্বার্থে পুলিশ তাঁদের নাম প্রকাশ করতে চায়নি। এ বিষয়ে জানতে অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়ের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অভিজিৎকে তিনি বাংলাদেশে আসতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ১২ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ তাঁকে জানান, তিনি টিকিট করে ফেলেছেন। মাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে, একবার দেখেই চলে যাবেন। পুলিশের বক্তব্যে এখন কিছুটা আস্থা পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি। আর অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা প্রথম আলোকে গতকাল বলেন, তাঁদের দেশে আসার খবর খুব কম মানুষই জানত। তবে দেশে আসার পর অনেকেই তাঁদের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছে। সেখান থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা জানতে পারেন। তাঁরা ঘটনার দিন দুপুরে ধানমন্ডিতে একটি রেস্তোরাঁয় বিরিয়ানি খেতে গিয়েছিলেন বলেও জানান।

No comments

Powered by Blogger.