ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত আপিলের রায় আশা এবং আশঙ্কা

বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে সংবিধানে ২০১৪ সালে যে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল এবং যে সংশোধনী হাইকোর্ট অবৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছিল। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা খারিজ করে দিয়েছেন। খবরটা শুনে খুশি হয়েছি এই ভেবে যে, আপিল বিভাগের এই সিদ্ধান্তের ফলে বেশকিছু দিন যাবত রাষ্ট্রের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছিল, এখন সরকার আদালতের এই সিদ্ধান্ত রিভিউর আবেদন না জানালে সেই দ্বন্দ্বের অবসান হবে। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতেই ফিরে এলো। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হল এটা বলা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সে কথা বলেছেন। এজন্য তার সরকার এবং প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চকেও অভিনন্দন জানাতে হয়। এই আপিল বিভাগ অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে কোনো কোনো শক্তিশালী মহল, এমনকি সরকারের আইন বিভাগের বিরোধিতাও উপেক্ষা করে যেভাবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিরুদ্ধে দেয়া হাইকোর্টের রায়কে বহাল রেখেছেন, তাতে বিচারপতি সিনহাকে পাকিস্তানের প্রয়াত বিচারপতি জাস্টিস কায়ানীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। কায়ানীকেও বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নানা অপবাদ ও অপপ্রচার সহ্য করতে হয়েছে। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকাকেও অভিনন্দন জানাতে হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার জাস্টিস কায়ানীর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, অথবা পরবর্তীকালে পাকিস্তানের এক প্রধান বিচারপতিকে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ যেভাবে সর্বোচ্চ আদালতে গুণ্ডা পাঠিয়ে বলপূর্বক তাকে আদালত ছাড়তে বাধ্য করেছেন, তার নজির সভ্য দুনিয়ার কোথাও নেই। পাকিস্তানের ওই প্রধান বিচারপতির অপরাধ ছিল তিনি নওয়াজ শরিফের ক্ষমতার অপব্যবহার আইনের শক্তিতে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন এবং নওয়াজ শরিফের আইনমন্ত্রীর নির্দেশে কোনো অন্যায় রায় দেননি।
বাংলাদেশে বর্তমানে আইনমন্ত্রী বা আইন বিভাগ যা-ই বলুন বা যা-ই করুন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সঙ্গে প্রধান বিচারপতির ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির অনেক চেষ্টা হলেও তা সফল হতে দেননি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় প্রধান বিচারপতি জাস্টিস সিনহার বিরুদ্ধে অনেক কুৎসা রটানো এবং অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এমন গুজবও ছড়ানো হয়েছে, প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে দু’একদিনের মধ্যেই অবসরে যেতে বলা হচ্ছে। শেখ হাসিনা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক করে পারস্পরিক আলোচনা দ্বারা এই ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো দাপট দেখাতে চাননি। ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে আপিল বিভাগের বর্তমান সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে।’ সর্বজনপ্রশংসিত বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধানেও বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ তথা সংসদ সদস্যদের হাতে ছিল। তখন কেউ এটার প্রতিবাদ করেননি। এখন দেখা যাচ্ছে, দেশের ১০ জন অ্যামিকাস কিউরি বা বিজ্ঞ আইনজীবীর মধ্যে নয়জনই হাইকোর্টের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার রায়ের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ড. কামাল হোসেনও রয়েছেন, যিনি বাহাত্তরের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা বলে দাবি করেন। বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের যে ক্ষমতা সংসদের ছিল, পরবর্তীকালে তা বাতিল করে বিচার বিভাগের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বাহাত্তরের সংবিধানের পুরনো ধারাটি অর্থাৎ সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা পুনর্বহালের জন্য ষোড়শ সংশোধনী আনে এবং সংসদে তা পাস হয়। এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট মামলা হলে হাইকোর্ট এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন। সরকার তার বিরুদ্ধে আপিল করে এবং আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি বহাল রাখেন। তার আগে তারা ১০ জন বিজ্ঞ আইনজীবীর মতামত চেয়েছেন। তাদের মধ্যে নয়জনই হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এখানেই প্রশ্ন, যেসব আইনজীবী ’৭২-এর সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে রাখার বিরোধিতা করেননি, বিশেষ করে ড. কামাল হোসেন, যিনি ’৭২-এর সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা, তিনি আকস্মিকভাবে মত পাল্টে হাসিনা সরকার কর্তৃক আনীত ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে চলে গেলেন কেন? এই সংশোধনী তো ছিল বাহাত্তরের সংবিধানের পুরনো ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন। হঠাৎ এই বিজ্ঞ ও প্রবীণ আইনজীবীর মতিগতি ঘুরে গেল কেন? সে কি কেবল হাসিনা-সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার অভিলাষ থেকে? আপিল বিভাগের ষোড়শ সংশোধনীসংক্রান্ত রায়ে বিএনপি নেতারা আনন্দে বগল বাজাচ্ছেন। বিএনপির এক নেতা বলেছেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণায় সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।’ আমার প্রশ্ন বিএনপির শাসনামলে তো বিচার বিভাগের হাতেই বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল? তারপরও পূর্বতন আওয়ামী সরকারের আমলে নিযুক্ত উচ্চ আদালতের ১০ জন বিচারকের নিযুক্তি বাতিলের সুযোগ পেয়েছিল কীভাবে বিএনপি সরকার? বাংলাদেশে আইনের শাসন তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষিত হোক, এটা আমাদের সবারই কাম্য। এজন্য জাস্টিস সিনহার সাহস ও প্রজ্ঞাকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু কাজীর গরু কেবল কেতাবে থাকলেই চলবে না, গোয়ালেও থাকা চাই। এর অর্থ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেয়া হলেই বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের খপ্পরমুক্ত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দরকার সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিচারপতি কায়ানী, বিচারপতি মুর্শেদ, বিচারপতি সিনহার মতো সাহসী মানুষ। নইলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না। আমরা পাকিস্তানে কী দেখেছি? বিচার বিভাগ অধিকাংশ সময় সামরিক ও অসামরিক দুই ধরনের সরকারেরই আজ্ঞাবহের ভূমিকা পালন করেছে। বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিন সরকারকে বরখাস্ত করলে তমিজউদ্দিন খানের মামলায় সিন্ধু হাইকোর্ট বড়লাটের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করেন। সামরিক সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করলে প্রধান বিচারপতি মুনীর এই রায়কে বাতিল করে আইয়ুবের সামরিক শাসনকে বৈধ বলে রায় দেন। তিনি এখন ইতিহাসে ধিকৃত। বাংলাদেশে একশ্রেণীর বিচারপতি বারবার সামরিক শাসকদের সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে বিচার বিভাগের সম্মান ও মর্যাদা এবং স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করেছেন। জেনারেল জিয়া বিচারপতি সায়েমকে, জেনারেল এরশাদ বিচারপতি আহসানউল্লাহ চৌধুরীকে এবং বিএনপি বিচারপতি সাত্তারকে তাদের ক্ষমতার স্বার্থে কিছুদিন শিখণ্ডীর মতো ব্যবহার করে পরে কমলার খোসার মতো দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। সুতরাং বিচার বিভাগকে শুধু স্বাধীনতা দিলেই চলবে না। সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সাহসী ও প্রজ্ঞাবান বিচারক চাই। আমেরিকায় তো বিচারক নিয়োগ করেন নির্বাহী বিভাগের প্রধান রাষ্ট্রপতি। তা সত্ত্বেও এবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেক গণবিরোধী (ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রণসহ) এক্সিকিউটিভ অর্ডার একজন ফেডারেল জজ ঠেকিয়ে দিয়ে দেশকে একটি সর্বনাশা পরিস্থিতি থেকে বাঁচিয়েছেন। আবার এর আগে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের (সিনিয়র) আমলে নিযুক্ত সুপ্রিমকোর্টের একশ্রেণীর বিচারকই পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে বিতর্কিত নির্বাচনে বুশ জুনিয়রকে জয়ী ঘোষণা করেছিলেন। আমেরিকার নিকৃষ্টতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি পরিচিত। সুতরাং বিচার বিভাগ শুধু স্বাধীন হলেই চলবে না। এই স্বাধীনতা ব্যবহারিক অর্থে সফল করে তোলার জন্য স্বাধীন মনের নির্ভীক ও নিরপেক্ষ বিচারক চাই। নামে স্বাধীন, কাজে নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ বিচারব্যবস্থা যে কোনা দেশের জন্য কল্যাণকর হয় না। তাতে বিচার বিভাগকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ নির্বাহী বিভাগ আরও বেশি পায়। বাংলাদেশে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পরও বিচার বিভাগের ভূমিকা দেশে নিরপেক্ষ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা কতদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে, তা নির্ভর করে বিচারকরা কতটা নিরপেক্ষ ও সাহসী ভূমিকা পালন করতে চান বা পারেন তার ওপর। আমার প্রত্যাশা, তারা তা পারবেন। তবু ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার বিষয়ে মনে আশা এবং আশঙ্কা দুই-ই রয়ে গেল।
লন্ডন, ৯ জুলাই, রবিবার ২০১৭

No comments

Powered by Blogger.