বিএনপি কি সত্যিই অহিংসা-ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে?

ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তার দল ক্ষমতায় গেলে কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে তার একটি রূপরেখা প্রকাশ করেছেন। এটির নামে ‘ভিশন ২০৩০’। বাংলাদেশে নির্বাচন এখনও দূরে আছে। সুতরাং এখনই ভিশন-২০৩০ ঘোষিত হওয়ায় বিএনপিকে অভিনন্দন জানাতে হয়। মনে হয়, আগামী সাধারণ নির্বাচনে তাদের যোগ দেয়া সুনিশ্চিত। তাদের মনমতো নির্বাচন না হলে তা বর্জনের এখন যত হুমকি-ধমকি তারা দেন না কেন, আখেরে তারা নির্বাচনে যোগ দেবেন- এবং তা হাসিনা সরকারের ব্যবস্থাপনাতেই। ‘ভিশন-২০৩০’ তারই আগাম ঘোষণা। পাঠকদের কাছে সবিনয়ে স্বীকার করি, ভিশন-২০৩০-এর ফিরিস্তি এত লম্বা যে, তার সবটা এখনও পড়ে উঠতে পারিনি। যেটুকু পড়েছি, তাতে মনে হয়নি, এটা দলের পণ্ডিতদের গবেষণাপ্রসূত কোনো কর্মসূচি। আওয়ামী লীগ এবং দেশের কোনো কোনো বাম দলের কর্মসূচি ও নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিগুলোই ঢেলে সাজানো হয়েছে। তা হোক, তাতে কিছু আপত্তি ছিল না, অপরকে অনুসরণ করে ভালো কাজ করার সদিচ্ছা প্রকাশ করা হলে সেটাকেও অভিনন্দন জানানো যায়। যদি প্রতিশ্রুতিগুলো আন্তরিকতাপ্রসূত হয়। বিএনপির এই ‘মহাভারতটি’ আগে পড়ে শেষ করি। তারপর তা নিয়ে বিশদ আলোচনার ইচ্ছা আছে। এ বিশাল কর্মসূচির কতটা বিএনপির নিজের এবং কতটা অপরের কাছ থেকে ধার করা এবং এগুলোর বাস্তবায়ন কেন বিএনপির দ্বারা সম্ভব নয়, তা নিয়ে আলোচনা করব ভবিষ্যতে। রাজনীতিতে election promise বা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বলে একটি কথা আছে।
এই প্রতিশ্রুতি কখনও পূরণ করতে হয় না। বিএনপির নির্বাচনী কর্মসূচির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে মনে হয়েছে এগুলো সেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, যা ক্ষমতায় গেলে বা না গেলেও পূরণ করতে হবে না। আজ তাই ‘ভিশন-২০৩০’ নিয়ে আলোচনা না করে বিএনপির নির্বাচন প্রতিশ্রুতি পালনে অতীতের রেকর্ড কী বলে, সেদিকে একটু আলোকপাত করি। আমার একটি ধারণা, খালেদা জিয়া যে বর্তমানে হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে চাচ্ছেন না, তার একটি বড় কারণ ২০০১ সালের নির্বাচনে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানকে হাতের মুঠোয় নিয়ে, বিদেশী কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ ডেকে এনে এবং মিডিয়া ক্যুর সাহায্যে বিএনপি সেবার যেভাবে নির্বাচনে জিতেছিল, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবার বিএনপির পন্থাতেই বিএনপিকে হটাবে বলে তারা হয়তো ভয় করছে। তারা বিশ্বাস করতে পারছে না, আওয়ামী লীগ তা করবে না। বিএনপির এই সন্দেহের কারণ, অপরাধ যারা করে তারা সর্বত্র স্বীয় অপরাধের ছায়া দেখতে পায়, বিএনপি তা এখন দেখছে। বিএনপির ভিশন এবং মিশনের কখনও মিল থাকতে দেখা গেছে কি? যা দেখা গেছে তা পরস্পরের বিপরীত। ২০০১ সালের নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচন শেষে ক্ষমতায় যাওয়ার পর খালেদা জিয়ার কথা (ভিশন) ও কাজের (মিশন) মধ্যে কোনো সমন্বয় লক্ষ্য করা গেছে কি? তিনি ক্ষমতায় বসেই পরবর্তী একশ’ দিনের একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এই একশ’ দিনের কর্মসূচিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন আমার বন্ধু শফিক রেহমান। তখনই আমার মনে হয়েছিল, কাককে ময়ূরপুচ্ছ পরানো হয়েছে। এই একশ’ দিনের কর্মসূচিতে বলা হয়েছিল, সরকার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রেখে দেশ পরিচালনা করবে। বাস্তবে দেখা গেল, প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের শত্রু এবং পাকিস্তানের গণহত্যার সহযোগীদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদে বসানো হয়েছে এবং স্বাধীনতার শত্রুরা মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে রাজপথে সগর্বে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যে মতিউর রহমান নিজামী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতার পতাকা পা দিয়ে মাড়িয়েছিলেন, তার গাড়িতেই স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় পতাকাটি উড়ছে।
নারীর সম্ভ্রম ও নিরাপত্তা রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি ছিল বিএনপির; দেখা গেল ক্ষমতায় বসার আগেই সেই প্রতিশ্রুতি নির্মমভাবে লংঘিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার অজুহাত তুলে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে চলেছে হিংস্র হামলা। পূর্ণিমা শীলসহ অসংখ্য সধবা, বিধবা ও কুমারী নারীর ওপর চলে গণধর্ষণ। একশ’ দিনের কর্মসূচি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল। দেখা গেল সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাওয়া ভবন নামে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির ভয়াবহ দুঃশাসন। দেশে গণতান্ত্রিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ছিল বিএনপির। দেখা গেল সেখানে দলতন্ত্রের বিষাক্ত থাবা গোটা প্রশাসনকে গ্রাস করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে হয়তো পরিবারের কোনো সদস্যের সামান্য সম্পর্ক আছে বা ছিল, এই অজুহাতে সামরিক ও অসামরিক প্রশাসনে চলে নির্মম ছাঁটাই, পদাবনতি, বদলি এবং ওএসডি করে রাখা। খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভাতেই বা কারা ছিলেন? একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুরা তো ছিলেনই, তার সঙ্গে ছিলেন পুলিশের খাতায় নাম লেখানো চোরাচালানি আসামি, অতীতের গলাকাটা সন্ত্রাসী, এমনকি খুনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিও। শিক্ষা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও বিএনপির শাসনামলে আফগানিস্তান স্টাইলের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাস শামসুন্নাহার হলে মধ্যরাতে পুলিশ ঢুকিয়ে ছাত্রীদের ওপর যে বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছিল, তা কোনো সভ্য সমাজে কখনও ঘটেনি। ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রথম পুলিশ ঢুকিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে বা সামরিক শাসনামলেও এমন ঘটনা ঘটেনি। সহজ মূল্যে সার সরবরাহের দাবিতে আন্দোলন করেছিল কৃষক, তাদের ওপর গুলি চালিয়ে ১৮ জনকে হত্যা করে বিএনপি সরকার। দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করার ঘোষণা ছিল বিএনপির। দেখা গেল দেশ সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলা ভাইদের আবির্ভাব ঘটে এ সময়েই। খালেদা জিয়ার মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলা ভাই বলে দেশে কেউ নেই। এটা মিডিয়ার প্রচার।
পরে আমেরিকার চাপে এ বাংলা ভাইদের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয় এবং তাদের ফাঁসি দিতে হয়। বিএনপির শাসনামলেই উগ্র মৌলবাদীদের অভ্যুত্থান ঘটে দেশে সরকারি প্রশ্রয়ে। হুমায়ুন আজাদের মতো বরেণ্য কথাশিল্পীর ওপর চলে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের হামলা। সেই হামলার পরিণতিতেই আজাদ মারা যান। খালেদা জিয়া অপরাধীদের ধরার ব্যবস্থা না করে বলেছিলেন, এটা আওয়ামী লীগ করেছে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে একটা ইস্যু দাঁড় করাতে চায়। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের জীবনের ওপর যখন মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা হামলা চালানোর চেষ্টা করে, তখনও খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘এটা একটা পরিকল্পিত নাটক।’ আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ কিবরিয়ার ওপর বোমা হামলা চালিয়ে তাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন হত্যাকারীদের ধরার বদলে বিএনপি থেকে বলা হয়, এটা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল। আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার সময়েও একই কথা বলেছে বিএনপি সরকার। বিএনপির প্রতিশোধের রাজনীতিতে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ছিল, শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড হামলা। এ হামলায় শেখ হাসিনার মৃত্যু ছিল প্রায় নিশ্চিত। তিনি আহত হলেও বেঁচে যান; কিন্তু নিহত হন আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী এবং আহত হন শতাধিক নর-নারী। এক্ষেত্রেও দেখা গেছে পুলিশ অপরাধীদের ধরার বদলে ঘটনাস্থলে অপরাধীদের শনাক্ত করার আলামত সরিয়ে ফেলতে ব্যস্ত। ২০০১ সালের বিএনপি সরকারের ভিশন ও মিশনের আর কত ফিরিস্তি দেব?
সেই সময়ের বিএনপি সরকারের একশ’ দিনের কর্মসূচি এবং ক্ষমতায় থাকার পূর্ণ সময়টাতে তাদের কার্যকলাপ কেউ যদি মিলিয়ে দেখেন, তাহলে তারা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন, তাদের বর্তমানের ‘ভিশন-২০৩০’ এর পরিণতি কী ঘটবে! রূপকথায় আছে, এক সিংহ বৃদ্ধ বয়সে নখ-দন্ত ও শিকার ধরার ক্ষমতা হারিয়ে একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং ঘোষণা দিয়েছিল, সে অহিংসা ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। সে বনের পশুপাখিদের অহিংসা ধর্মে দীক্ষা দেবে। তার ঘোষণায় বিশ্বাস করে বহু পশুপাখি অহিংসা ধর্মে দীক্ষা নিতে তার কাছে যেতে শুরু করল। সিংহ সুযোগ পেয়ে তাদের হত্যা করে খেয়ে ফেলত। তাকে আর শিকার ধরার পরিশ্রম করতে হতো না। এ সময় এক শিয়াল গেল সিংহের কাছে; কিন্তু গুহায় ঢুকল না। সিংহ বলল, ভাগ্নে এসো এসো, তোমাকে অহিংস ধর্মে দীক্ষা দেই। শিয়াল বলল, মামা, দীক্ষা নিতেই তো এসেছিলাম; কিন্তু এখন দেখছি যেসব পশুপাখি তোমার কাছে দীক্ষা নিতে এসেছে, তাদের পায়ের ছাপ সবটাই ভেতরের দিকে গেছে; কোনোটাই ফিরে আসেনি। আমি তাই এখান থেকেই বিদায় নিচ্ছি। ভেতরে এসে তোমার আজকের দিনের খোরাক হতে চাই না। বিএনপির ভিশন-২০৩০-এর ঘোষণা শুনেও দেশের মানুষ কি বিশ্বাস করবে, দলটি সন্ত্রাস ছাড়বে, সন্ত্রাসীদের ছাড়বে, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়বে, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির এককালের দুর্গ হাওয়া ভবনের স্বেচ্ছানির্বাসিত অথবা পলাতক নেতার প্রভাবমুক্ত হবে? সবচেয়ে বড় কথা, অহিংস গণতন্ত্রের দীক্ষা নেবে? এই ব্যাপারে কেউ যদি সন্দেহ পোষণ করেন, তাকে কি দোষ দেয়া যাবে? উপকথার সিংহ ও শিয়ালের গল্পটির নীতিকথা আমাদের কী শেখায়?
লন্ডন ১৪ মে রবিবার, ২০১৭

No comments

Powered by Blogger.