এক হাজার চারশ’ ব্যাংক হিসাব জব্দ

আইনি ব্যবস্থা না নেয়া হলে শুধু ফ্রিজ করে লাভ হবে না। কারণ এভাবে হিসাব বেশিদিন আটকে রাখা যায় না : ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জঙ্গি ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন, অর্থ পাচার, জালিয়াতি ও চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে লেনদেন হয়েছে- এমন সন্দেহে ফ্রিজ (জব্দ) করা হয়েছে ১৪৩০টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট)। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) জব্দ করেছে এক হাজার ৩৭৫টি। বাকি ৫৫টি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের পর আদালতের নির্দেশে জব্দ করা হয়। গত ছয় বছরে (২০১০-১৫) এ হিসাবগুলো জব্দ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ওপর তৈরি করা এশীয় প্যাসিফিক গ্রুপের (এপিজি) প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। অর্থ পাচারের মান নির্ধারণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা (এপিজি) সম্প্রতি এ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ রোববার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, দেশে জঙ্গিবাদে প্রচুর অর্থায়ন হয়েছে। এই অর্থ এসেছে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমেই। ব্যাংকিং সিস্টেম সঠিকভাবে চললে জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধ হবে। তাই ব্যাংকিং পদ্ধতিটাকেই সোজাপথে আনার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, হুন্ডির মাধ্যমেও জঙ্গি অর্থায়ন হচ্ছে। এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে তা বন্ধে কাজ করছে। জানতে চাইলে বিএফআইইউ মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, সন্দেহজনক লেনদেন হলে যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ (জব্দ) করা হয়। তদন্তের স্বার্থে এসব ব্যাংক হিসাবের তথ্য দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), সিআইডিসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠানো হয়। অপরাধের ধরন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সংস্থা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পাশাপাশি বিএফআইইউ নিজেও ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। ধারাবাহিকভাবে জব্দকৃত ব্যাংক হিসাবের ২০ শতাংশের বেশির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বিএফআইইউ নিজেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক হিসাব জব্দ নিয়ে এপিজির রিপোর্ট উদ্বেগজনক। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় অর্থ পাচার বেড়েছে। এটি দেশের উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, কোনো তথ্য পেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে কোনো ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে। তবে আইনি ব্যবস্থা নেয়া না হলে শুধু ফ্রিজ করে কোনো লাভ হবে না।
কারণ ফ্রিজ করা হিসাব বেশিদিন আটকে রাখা যায় না। এপিজি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিএফআইইউর জব্দ ১৩৭৫টি ব্যাংক হিসাবের মধ্যে ৮টি হচ্ছে নন-ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এবং ৬টি হচ্ছে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট। শুধু বিএফআইইউর মাধ্যমে জব্দ হয়েছে ১৩৬১টি হিসাব। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালে সবচেয়ে বেশি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়। কারণ ওই বছর মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি ডেসটিনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর সঙ্গে অনেক ব্যাংক হিসাব জড়িত ছিল। অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এ কোম্পানির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এছাড়া অর্থ পাচারের জন্য তিনটি ঘটনা সরাসরি শনাক্ত করা হয়। যার মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ২৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জব্দ হিসাবগুলোর মধ্যে জঙ্গি অর্থায়নের কারণও রয়েছে। যার মধ্যে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ায় মার্কিন জোটের বিমান হামলায় নিহত আইএসের প্রধান হ্যাকার বাংলাদেশী নাগরিক সাইফুল হকের (সুজন) দুটি ব্যাংক হিসাবও আছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা, সুরিনাম ও স্পেন থেকে এ হিসাবগুলোতে টাকা এসেছে। জানা গেছে, ঢাকার কারওয়ান বাজারে সাইফুল হকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আইব্যাকস লিমিটেড ও আইব্যাকস টেলি ইলেক্ট্রনিকস লিমিটেডের মাধ্যমে জঙ্গি অর্থায়নের সন্ধান পায় পুলিশ। পরে সেটি জানানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, ২০১২-১৫ সাল পর্যন্ত আইব্যাকস লিমিটেড ও আইব্যাকস টেলি ইলেক্ট্রনিকস লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যাংক হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের (এফটিটি) মাধ্যমে ২ কোটি ২২ লাখ টাকা জমা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও মেইন্টেন্যান্স চার্জ হিসেবে এসব অর্থ পাঠানো দেখানো হয়। বিদেশী রেমিট্যান্স ছাড়াও ওই হিসাব দুটিতে বিভিন্ন সময়ে নগদ অর্থ জমা হওয়ার সন্ধান পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এফটিটি ও নগদ জমার একটি বড় অংশ উত্তোলন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, সাইফুলের ব্যাংক হিসাব দুটি থেকে অধিকাংশ সময় নাহিদউদ্দোজ্জা মিয়ার মাধ্যমে নগদ লেনদেন হয়। এছাড়া মো. আতাউল হক, জাহাঙ্গীর, মো. মশিউর রহমান, মো. আনিসুর রহমান, মামুনুর রশিদ, আবুল হাসনাত, মাহবুবুল হক, কালাম, মুন্না, হোসেন আহমেদ, মিঠু, মাহি, মো. অলি, মো. আবু হানিফ, অজিত বাবু, মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম নামে এই হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তবে যারা টাকা তুলেছেন তাদের বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বা হিসাব পরিচালনা সংক্রান্ত কোনো তথ্য পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এপিজির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংক্রান্ত মোট ৩৪৭টি ঘটনার তদন্ত করেছে। এর মধ্যে দুর্নীতিবিষয়ক ৮৭টি, প্রতারণা ও জালিয়াতি সংক্রান্ত ১০৩টি, অর্থ আত্মসাৎবিষয়ক ১৮টি, মানব পাচার সংক্রান্ত ২১টি, মাদক পাচার সংক্রান্ত ১২টি, চোরাচালান বিষয়ক ৯টি। এছাড়া অপহরণ সংক্রান্ত ৪৭টি, চাঁদাবাজি সংক্রান্ত ১১টি, হত্যাকাণ্ড নিয়ে ১৩টি, জাল নোটবিষয়ক ঘটনা ৫টি, যৌতুক সংক্রান্ত ১টি, যৌন হয়রানি ৬টি, অর্থ চোরাচালান ১১টি ও আয়কর অপরাধ সংক্রান্ত ৩টি ঘটনার অনুসন্ধান করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিএফআইইউ। বিএফআইইউর বাইরে দুদক তদন্তের পর তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ৫৫টি হিসাবও জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ৭টি হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেয়া হয়। ২০১৩ সালে জব্দ করা হয় ১৩টি ব্যাংক হিসাব। একইভাবে ২০১২ সালে ২৩টি হিসাব জব্দের নির্দেশ দেন আদালত। ২০১১ সালে ৭টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। ২০১০ সালে ৫টি হিসাব জব্দ করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জব্দ ওইসব হিসাব ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় তিনশ’ সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসে। এসব অভিযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করছে। তদন্তে মাসে ৪০ থেকে ৫০টি লেনদেনে জঙ্গি, সন্ত্রাসী অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ থাকার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এ মুহূর্তে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন, মানি লন্ডারিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ভুয়া আইডি কার্ড, চুরি, সন্দেহজনক লেনদেনসহ মোট ২৭টি অপরাধমূলক আর্থিক লেনদেনের ওপর বিশেষ নজরদারি করছে বিএফআইইউ।

No comments

Powered by Blogger.