ঋণখেলাপিদের শাস্তি কবে হবে?

দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের চরম দুরবস্থায় আজ এই লেখা লিখতে বসেছি। বলতে পারেন, বিবেকের তাড়নায় লিখছি। অবস্থাটা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কিছু কথা না বললেই নয়। তাই কোনো ভণিতা না করে সোজাসাপ্টা বলতে চাই, ব্যাংকিং খাতের দুর্বৃত্তরা ভয়াবহ অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। বড় মাপের ঋণখেলাপি থেকে শুরু করে ঋণ জালিয়াত, দুর্নীতিবাজ, জনগণের টাকা আত্মসাৎকারী- সবাই যেন জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। অথচ আইন আছে, আছে প্রশাসনিক অনেক ক্ষমতাও। কিন্তু প্রয়োগ নেই। বরং যিনি বা যারা আইন প্রয়োগ করবেন, অনেক সময় তাদের দেখা যায় ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের পক্ষে সাফাই গাইতে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে কতগুলো বড় বড় অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু কারও তেমন কিছু হল না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো রাঘববোয়ালদের অনেকের তো টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি।
যুবকের প্রতারণা থেকে শুরু করে ডেসটিনি, হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেংকারি সবার মুখে মুখে। আর প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়, এ সেক্টরের কোনো না কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ দুর্নীতি, জালিয়াতি ও পার পেয়ে যাওয়া ঋণখেলাপির খবর। তথ্যভিত্তিক সচিত্র খবর দেখাচ্ছে কোনো কোনো বেসরকারি টিভি চ্যানেলও। সাংবাদিকদের নিজস্ব অনুসন্ধান ছাড়াও খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে একের পর এক উঠে আসছে জাল-জালিয়াতি করে নেয়া ঋণের অবিশ্বাস্য সব খবর। পরিদর্শন টিমে প্রয়োজনের তুলনায় জনবল অনেক কম থাকলেও কিছুসংখ্যক সৎ ও সাহসী কর্মকর্তার কারণে মানুষ স্বল্প পরিসরে হলেও কিছু অনিয়ম, দুর্নীতির খবর জানতে পারছে। কিন্তু খবর প্রকাশ পর্যন্তই যেন সব শেষ। অবস্থাটা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, এসব ব্যাংক ও শেয়ারবাজারখেকো দুর্বৃত্তদের সামাজিকভাবে মিডিয়া ট্রায়াল ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। এ পর্যন্ত একটি ঘটনারও দৃষ্টান্তমূলক বিচার কিংবা শাস্তি হয়নি। কয়েকজন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। এ ধরনের সংবাদে তাদের যেসব সাহসী বক্তব্য প্রকাশিত হচ্ছে সেখানেও তারা বলছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এসব অন্যায়ের শাস্তি নিশ্চিত না হবে ততদিন এই দুর্বৃত্তপনা বন্ধ হবে না। তারা এ-ও বলছেন, কেউ যদি জানেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ও দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর দেয়া লাগবে না; তাহলে তিনি ঋণ পরিশোধ কেন করবেন? অবশ্যই করবেন না। হচ্ছেও তাই।
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এ চক্র নিজেরা ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। ওদিকে ব্যাংকের কিছুসংখ্যক পরিচালক নিজের ঘরে আগুন দেয়ার মতো কর্মকাণ্ড শুরু করে দিয়েছেন। তারা একে অপরের ব্যাংক থেকে মিলেমিশে লুটপাটে মেতে উঠেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত এক খবরে দেখা গেছে, ব্যাংকের পরিচালকরা প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ খেলাপি হয়ে ঋণ অবলোপনও করছেন। কী ভয়াবহ কথা। এসব ভাবা যায়! অথচ এটিই আজ বাস্তবতা। আর এই যখন অবস্থা, তখন শুধু ব্যাংকিং খাত কেন- এর বিরূপ প্রভাবে পুরো অর্থনীতি ধ্বংস হতে বসেছে। বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। যেসব তথ্য দিয়ে বাহবা নেয়া হচ্ছে তা সবই কাগুজে। তাই দেশের একজন শিল্পপতি হিসেবে সরকারের কাছে আমার জোরালো দাবি- এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশে এসব অন্যায়-দুর্নীতি আর চলতে দেয়া উচিত হবে না। যারা ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও ভয়াবহ দুর্নীতি করে ব্যাংকিং সেক্টরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন তাদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ঋণখেলাপিদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বিশেষ করে যারা বড় বড় ঋণখেলাপি তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। প্রথমে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিলামে তুলে ব্যাংকের সমুদয় পাওনা টাকা উসুল করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সম্পদ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ না হলে দ্রুত জেলে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশেষ বিধান জারি করতে হবে; যাতে কেউ আদালতে রিট করে শাস্তি আটকাতে না পারেন। খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে প্রয়োজনে ৩ থেকে ৬ মাসের সময় বেঁধে দিয়ে কঠোর আইন করা উচিত। একই সঙ্গে তাদের পাসপোর্টও জব্দ করতে হবে। যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন।
কারণ ব্যাংকের মূলধন সাধারণ জনগণের আমানতের টাকা। তাই এসব দুর্বৃত্তকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া কিংবা ক্ষমা করার সুযোগ নেই। আমার মতে, তাদের ন্যূনতম ছাড় দেয়ার আর সুযোগ নেই। কেননা তারা ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। বিপুল অংকের টাকা পাচার করাসহ বিদেশে নানা পন্থায় বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। আর তারা তো আকাশ থেকে নাজিল হননি। আমাদের সমাজের আশপাশে দিব্বি বহালতবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দামি গাড়িতে চড়ছেন। গুলশানের মতো জায়গায় আলিশান বাড়িতে থাকছেন। ছেলেমেয়েদের বিদেশে লেখাপড়া করাচ্ছেন। নামিদামি ক্লাবে পার্টি দিচ্ছেন। কখনও ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা সেজে সমাজে ছড়ি ঘুরাচ্ছেন। যারা ঋণ আদায় করবেন তারাই উল্টো তাকে সমীহ করে চলছেন। অর্থাৎ তাদের সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। শুধু যত সমস্যা ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করার বেলায়। মোট কথা, তারা ব্যাংকের টাকা দেবেন না। ভাবখানা এমন যে, সাধারণ মানুষ ব্যাংকে রাখতে বাধ্য, আর তারা সে টাকা মেরে দিয়ে বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ে তুলবেন। অপরদিকে ঋণ অবলোপনের নামে সমানে ব্যাংকগুলো খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। এ পর্যন্ত ৪২ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এতে খেলাপিরা আরও উৎসাহিত হচ্ছেন। অর্থাৎ ঋণ নিয়ে আর দেয়া লাগবে না। একপর্যায়ে ব্যাংক বাধ্য হয়ে দায়দেনার খাতা ক্লোজ করে ফেলবে। এ অপব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। আমি মনে করি, শুধু ঋণখেলাপি নয়, ব্যাংকিং অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
জেলে পাঠানো ছাড়াও তাদের সম্পদ বিক্রি করে টাকা উসুল করতে হবে। একই সঙ্গে পরিচালকদের ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উচিত হবে ব্যাংকের পরিচালকদের সম্পদের হিসাব নেয়া। বিশেষ করে কে কত বছর আগে কত টাকা দিয়ে ব্যাংকের মালিকানা খাতায় নাম লিখিয়েছেন এবং এখন কত টাকার মালিক হয়েছেন। আমার মতে, দুদক এ হিসাবটি যথাযথভাবে নিতে পারলে অনেকের গোমর ফাঁস হবে। সবশেষে এটাই বলব, ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে আর হেলাফেলা করা ঠিক হবে না। কারণ এটি অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এরই মধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে। আর সামনে বাড়তে দিলে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। বিনিয়োগ হওয়া তো দূরের কথা, চালু শিল্পপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যাবে। কর্মসংস্থান বাড়ার পরিবর্তে লাখ লাখ বেকার তৈরি হবে। দেশ স্বনির্ভর না হয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়বে। বিপরীতে সরকার ব্যাংক ও আর্থিক সেক্টরের অনিয়ম, দুর্নীতি শক্ত হাতে দমন করতে পারলে দেশ ঘুরে দাঁড়াবে। সাহসের সঙ্গে সঠিক পলিসি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারলে এখানে রীতিমতো শিল্পবিপ্লব ঘটানো সম্ভব। আর মাথাপিছু আয় এখন যা আছে, তা ৫ বছরের মধ্যে বাড়বে বহুগুণ।

No comments

Powered by Blogger.