সেনা অভিযান সমাপ্তির পথে

সিলেটে টানা চার দিনের জঙ্গিবিরোধী অভিযান ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ সমাপ্তির পথে। ৮৭ ঘণ্টার অভিযানে সিলেটের শিববাড়ীর আতিয়া মহলে এক নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হয়েছে। ভেতরে আর কোনো জীবিত জঙ্গি নেই বলে ধারণা করা হচ্ছে। আস্তানাটির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল। সোমবার সন্ধ্যায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য দেন। তিনি বলেন, আমাদের অভিযান এখনও চলমান। শেষ করতে আরও হয়তো কিছু সময় লাগতে পারে। এজন্য অপারেশন টোয়াইলাইট সমাপ্ত ঘোষণা করা যাচ্ছে না। অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণার পর স্থানটি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী আমরা বাকি কাজটুকু এগিয়ে যাব। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, দু’জনের লাশ বের করা হয়েছে। এদের একজন পুরুষ এবং একজন নারী জঙ্গি। বাকি লাশ দুটি বের করা হয়নি। প্রতিটি লাশের শরীরে সুইসাইড ভেস্ট লাগানো ছিল। আতিয়া মহলের ভেতরে থাকা লাশের আশপাশে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে ওই লাশ দুটি বের করা হয়নি।
ওই ভবনে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক এবং আইইডি বোমা রয়েছে। এই আস্তানায় জঙ্গিদের শীর্ষ কোনো নেতা থাকতে পারেন বলে ধারণার কথা জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল। নিহতদের মধ্যে তেমন কেউ রয়েছে কিনা- সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে সেনা কর্মকর্তা ফখরুল বলেন, তা পুলিশ ও র‌্যাব দেখে নিশ্চিত করতে পারবে। তবে যে চারজন এখানে ছিল, তারা ওয়েল ট্রেইন্ড। তাদের খুঁজে বের করে যে নিষ্ক্রিয় করা হল বা হত্যা করা হল, তা সেনাবাহিনীর জন্য বিশাল বড় সফলতা। ফখরুল আহসান আরও বলেন, ভেতর থেকে জঙ্গিরা এক্সপ্লোসিভ ফুটিয়েছে, গ্রেনেড চার্জ করেছে, গুলি করেছে। জঙ্গিরা সুইসাইডাল ভেস্ট পরা ছিল। পুরো বাড়ি কমান্ডোরা তল্লাশি করে দেখেছেন। প্রয়োজনে আরও তল্লাশি করা হবে। ভেতর থেকে যাদের লাশ বের করা হয়েছে তারা কখন মারা গেছেন এর সঠিক সময় সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি তিনি। তবে তিনি বলেন, চারজনের মধ্যে রোববার সেনা অভিযানে দু’জন এবং সোমবার দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। পুরো ভবন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে ফখরুল আহসান বলেন, সেজন্য সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হচ্ছে। ভেতরে অবস্থানরত সব জঙ্গি নিহত হলেও তারা বাড়িটিতে ব্যাপক বিস্ফোরক মজুদ করে রেখেছিল। যে চারজন এখানে ছিল, তারা বেশ ভালো প্রশিক্ষিত। তাদের খুঁজে বের করে মারা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সার্বিক অবস্থায় দেখলাম, একটা রুমের ভেতরে একটা ডেডবডি, তার পাশেই ছড়ানো-ছিটানো আইইডি লাগানো রয়েছে। পুরো বিল্ডিংটায় যে পরিমাণ এক্সপ্লোসিভ আছে এগুলো যদি বিস্ফারিত হয় তাহলে এই বিল্ডিংয়ের অংশবিশেষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে অবস্থায় আছে, এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। সোমবার সাংবাদিকদের সামনে উপস্থিত হয়েই তিনি অভিযান প্রায় শেষ হওয়ার ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য আমরা সবাই গর্বিত। আপনারাও গর্ববোধ করতে পারেন। দেশবাসীর দোয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই সফলভাবে অভিযানটা চলেছে।
পাঁচ তলা ওই ভবনের নিচ তলায় চারটি লাশ পাওয়ার কথা জানিয়ে এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের যে গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলাম সেখানে মোটামুটি চার জঙ্গি থাকার তথ্য ছিল। এমন তথ্যও ছিল যে তিনজন পুরুষ ও একজন মহিলা। যে ডেডবডি আমরা পেয়েছি তার মধ্যে তিনজন পুরুষ, একজন মহিলা। দুটি লাশ পুলিশের কাছে তুলে দেয়া হলেও বাকি দুটি এখনও ওই বাড়ীর ভেতরেই রয়েছে। ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, বাকি দুটো ডেডবডির মধ্যে সুইসাইডাল ভেস্ট লাগানো আছে। যে অবস্থায় আছে, তাদের ওইখান থেকে বের করাটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এ ডেডবডিগুলো কিভাবে বের করব, সেজন্য আমরা পরিকল্পনা করছি। আগুন লাগার বিষয়ে তিনি বলেন- এখানে যে পরিমাণ ফায়ারিং হয়েছে, যে পরিমাণ গ্রেনেড লাঞ্চ করা হয়েছে, টিয়ার শেল ফায়ার করা হয়েছে তাতে আগুন লাগতেই পারে। তবে আগুন দ্রুত নেভানো হয়েছে। জঙ্গিদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে তিনি বলেন, অভিযানের প্রথম দিন কলাপসিবল গেটের সামনে একটি বালতি ছিল। ওই বালতিতে বিস্ফোরক ছিল। সেটিতে যখন বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, ওই গেট উড়ে এসে পাশের ভবনে পড়েছে। সেখানে আমাদের তিন-চারজন সদস্য ছিলেন, তারা ছিটকে গেছেন। এ ধরনের বিস্ফোরক আরও থাকতে পারে। আগের দিনই (রোববার) দুই জঙ্গির নিহত হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, দু’জনকে দৌড়ানো অবস্থায় দেখে আমাদের কমান্ডোরা ফায়ার করে। তারা পড়ে যাওয়ার পর একজন সুইসাইডাল ভেস্ট বিস্ফোরণ ঘটায়। চারজনের বাইরে আর কারও থাকার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, চারজনের বিষয়ে আমরা জানতাম, চারটা ডেডবডি আমরা পেয়েছি। যতটুকু ধারণা হচ্ছে, এখানে জীবিত আর কেউ নেই। তবে কেউ হঠাৎ করে থেকেও যেতে পারে।
সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আতিয়া মহলের ভেতরে সেনা কমান্ডোরা প্রবেশ করেছেন। এর এক ঘণ্টা পরে ওই বাড়ীতে যান সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার (এসএমপি) গোলাম কিবরিয়া। তারা ভেতর থেকে ঘুরে আসার পরও তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান সমাপ্তির কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। সোমবার সকাল থেকে ভবনে অন্তত চারটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে বেলা সোয়া ৩টার পর আর কোনো বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়নি। সকাল থেকে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা জঙ্গিদের লক্ষ্য করে একাধিকবার গুলি করলেও বেলা সোয়া ৩টার পর আর কোনো গুলির শব্দ পাওয়া যায়নি। সোমবার বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা গুলি শুরু করেন। ভেতর থেকে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। এ সময় গোলাগুলির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দুপুর ২টার দিকে বিকট শব্দে আবারও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এর কিছুক্ষণ পর থেকে আবারও শুরু হয় গুলি। আধা ঘণ্টা গুলি চলে। পরে বেলা আড়াইটার দিকে গোলাগুলি বন্ধ হয়। বেলা ৩টা সোয়া ৩টার দিকে আবারও বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এর ১০ মিনিট পর আতিয়া মহল থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। প্রথমে স্থানীয়রা ধারণা করেছিলেন, ভবনে আগুন লেগেছে। এ ধোঁয়া ক্রমেই বাড়ছিল। এর ২০ মিনিট পর বেলা পৌনে ৪টার দিকে আস্তে আস্তে ধোঁয়ার পরিমাণ কমে আসে। এর ৫ মিনিট পর ধোঁয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আশপাশের এলাকায় কাঁদানে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।  এ থেকে ধারণা করা হয়, ওই ভবনে কমান্ডোরা কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছিলেন।
তারপরই কমান্ডোরা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকার আতিয়া মহলে বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ইউনিট। শনিবার আতিয়া মহল থেকে নারী ও শিশুসহ ৭৮ জনকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার অভিযান শেষ হওয়ার পরই জঙ্গিদের ধ্বংস করতে মূল অপারেশন শুরু হয়। বাড়ীতে শক্তিশালী আইইডি লাগিয়ে রাখার কারণে অভিযান চালাতে সমস্যা হয়েছে। টানা ৪ দিন তারা ভেতর থেকে দফায় দফায় গ্রেনেড চার্জ করেছে। এমনকি আত্মঘাতী বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। তাছাড়া বাড়ীর অবস্থানগত কারণে সেখানে সাঁজোয়া যান নিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। বাড়ীর ছাদ এবং বাইরে থেকে কমান্ডোদের গুলি করতে হয়েছে।কড়াকড়ি আরও বেড়েছে : শিববাড়ী মোড় এবং এর আশপাশের এলাকায় সোমবার অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। শিববাড়ী থেকে প্রায় চার কিলোমিটার এলাকা কর্ডন করে রাখা হয়। এ সময় কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। শিববাড়ী থেকে উত্তর দিকে হুমায়ূন রশীদ চত্বর পর্যন্ত এবং দক্ষিণে পারাইরচক পর্যন্ত কর্ডন করে রাখা হয়। শিববাড়ী থেকে পূর্বে গোটাটিকর ও পাঠানপাড়া, পশ্চিমে চান্দাই জৈনপুর ও গালিমপুর পর্যন্ত কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এতে করে এলাকাবাসী ভোগান্তিতে পড়েছে।
আতিয়া মহল ধ্বংসের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে : টানা চতুর্থ দিনের সকালে আতিয়া ভবনের ভেতরে জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কমান্ডোদের পাল্টা জবাব দিচ্ছিল। তাছাড়া ওই বাড়িতে আইইডি লাগিয়ে রাখার কারণে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছিল। এ কারণে ভবনটি উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও হচ্ছিল। সোমবার সকালে সিলেট মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার যুগান্তরকে বলেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ভেতরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এ কারণে ভবনটি ধ্বংস করার বিষয়টিও আলোচনা হয়েছে।
যেভাবে অপারেশন টোয়াইলাইটের শুরু : সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকার উস্তার মিয়ার মালিকানাধীন আতিয়া মহলে জঙ্গি অবস্থান করছে- এমন তথ্য পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার গভীর আতিয়া মহলের মূল গেটে তালা দিয়ে বাসাটি ঘিরে রাখে পুলিশ। বিকালে ঢাকা থেকে আসে সোয়াত টিম। সন্ধ্যায় আসে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো। বৃহস্পতিবার রাতভর প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ভবনটি ঘেরাও করে রাখে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। শনিবার সকাল থেকে শুরু হয় মূল অভিযান। জঙ্গি সদস্যদের ধরতে পরিচালিত এ অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। এর আগে সোয়াত এই অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন স্প্রিং রেইন’। এদিকে অপারেশন চলাকালীন শনিবার সন্ধ্যার পর আতিয়া মহলের অদূরে দু’দফা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশত। মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে এ দুটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে প্রথম দফায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। সেখানে পুলিশের একটি চৌকি ছিল। এরপর কর্ডন করে রাখা এলাকা ক্রাইম সিন করতে গেলে রাত ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা বস্তাসদৃশ্য একটি বস্তু পরীক্ষা করার সময় দ্বিতীয় দফায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ছয়জন নিহত হন। এর মধ্যে দুজন আত্মঘাতী জঙ্গি ছিল বলে আইনশৃংখলা বাহিনী দাবি করেছে।

No comments

Powered by Blogger.