বিমানবন্দরে ভিআইপিদের সঙ্গে জোর করে ঢুকলে গ্রেপ্তার: নিরাপত্তা বাড়াতে বৃটেনের তাগিদ by দীন ইসলাম

বিমানবন্দরে ভিআইপিদের সঙ্গে জোর করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা অন্য কোনো অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ঢুকতে চাইলে তাদেরকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় এ নির্দেশ দেন বলে একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এর আগে গত ২৬শে অক্টোবর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় ভিআইপি লাউঞ্জ নীতিমালা না মানার বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বিষয়টি সম্পর্কে ওই সভায় উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও বিমানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর ভিআইপি লাউঞ্জ নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে এমপিদের কাছে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু এরপরও বিষয়টি খুব একটা কাজে দিচ্ছে না। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত বিমানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে বিমানবন্দরের ভেতরে অনাকাঙ্ক্ষিত লোকজনের আনাগোনা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর পরই গতকাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন মন্ত্রিসভা বৈঠকে তোলেন। বিমানবন্দরের সামপ্রতিক কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি মন্ত্রিসভার উদ্দেশ্যে বলেন, কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (ভিআইপি) সঙ্গে বেআইনিভাবে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ঢুকে পড়েন। এসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী বিমানবন্দরের বিধি-বিধানের তোয়াক্কা করেন না। তারা অনেকে একসঙ্গে বিমানবন্দরে ঢুকে পড়েন। কখনও কখনও ভিআইপিদের সঙ্গেও অনেক মানুষ ঢুকে পড়েন। এতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশ বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফ্লাইট বাতিলের কথা বলছে। এ সময় আরও কয়েকজন মন্ত্রী বিমানমন্ত্রীর বক্তব্য সমর্থন করে অনুপ্রবেশ বন্ধের কথা বলেন। অন্য মন্ত্রীরা বলেন, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তার ফাঁক খুঁজে কোনো কোনো দেশ অন্য উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করতে পারে। এ জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। মন্ত্রীর এসব বক্তব্য শোনার পর প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জিরো টলারেন্স- এর নির্দেশ দিয়ে বলেন, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। আইনে যা আছে তাই করতে হবে। নিয়ম না মেনে যারা বিমানবন্দরে প্রবেশ করবে, সে যেই হোক প্রয়োজনে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ আলোচনার পর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু পদ্মা পাড়ে একটি মন্ত্রিসভা বৈঠক করার প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রী জবাবে বলেন, পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হোক তারপর দেখা যাবে। এরপর পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ কয়েকজন মন্ত্রী অংশ নেন। আইনমন্ত্রী বলেন, তদন্তে দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর কানাডীয় আদালত বিশ্বব্যাংককে বলেছিল কিসের ভিত্তিতে আপনারা মামলা করেছিলেন, তা দেখান। কিন্তু তারা কিছু দেখাতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাংক টাকা না দিয়ে অহেতুকই পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পদ্মা সেতু এখন আর কল্পনা নয় বাস্তব। ষড়যন্ত্রকারীদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সেতু নির্মাণের কাজটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া হয়েছিল। সভায় জানানো হয়, আগামী ১২ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং ও নদী শাসনের কাজ উদ্বোধন করবেন। এর আগে ১৭ই অক্টোবর মুন্সীগঞ্জে পদ্মা সেতু এলাকায় সচিব সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মন্ত্রিসভা বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১২ই ডিসেম্বর পদ্মার মূল সেতুর পাইলিং ও নদীশাসন কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে মন্ত্রিসভার সদস্যদের আমন্ত্রণ জানান। এদিকে গত ৩রা ডিসেম্বর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সকল প্রকার কাঁচাপাট রপ্তানি বন্ধ থাকবে। এর আগে ৩রা নভেম্বর থেকে এক মাস কাঁচাপাট রপ্তানি বন্ধ ছিল। বৈঠকে উপস্থিত একজন মন্ত্রী জানান, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে পাট রপ্তানির আলোচনার সূত্রপাত করেন। তিনি জানান, অনেকে পাট রপ্তানির জন্য এলসি খুলেছেন। যারা এলসি খুলেছেন তাদের রপ্তানির সুযোগ বহাল রাখা উচিত। এ ছাড়া রপ্তানি বন্ধ রাখার সুযোগ নিয়ে অনেকে দেশের বাজার অস্থির করে তুলতে পারেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে আরেকজন মন্ত্রী বলেন, দেশে তো পাটের সংকট নেই। দীর্ঘ সময় বন্ধ রাখার পর রপ্তানি খুললে বিভিন্ন দেশে আমাদের পাটের বাজারও নষ্ট হবে। আলোচনা শোনার পর প্রধানমন্ত্রী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজউদ্দিন প্রামাণিককে ব্যবসায়ীদের এলসি খোলাসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সীমিত আকারে কাঁচাপাট রপ্তানির ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
নিরাপত্তা বাড়াতে বৃটেনের তাগাদা
ওদিকে বিবিসি জানিয়েছে, বাংলাদেশের বিমান বন্দরগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করতে বাংলাদেশ সরকারকে তাগাদা দিয়েছে বৃটেন। মিশরের শার্ম আল শেখ থেকে উড়ে যাওয়া একটি রুশ বিমান সিনাইয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পর বৃটেনের পরিবহন দপ্তর বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবকটি দেশের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে এই তাগাদা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, বিমানের ভেতরে রাখা একটি বোমার বিস্ফোরণে ওই রুশ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, যাতে ২২৪ জন নিহত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে বৃটিশ কর্মকর্তাদের একটি দল ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পরিদর্শন করেছেন। এবিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও। এয়ারপোর্টের নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা বাংলাদেশকে কিছু সুপারিশও করেছেন। বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বিবিসিকে বলেছেন, এয়ারপোর্টগুলোতে নিরাপত্তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কীনা সেটাই তারা খতিয়ে দেখছেন। তারা যাত্রী ও মালবাহী বিমানগুলোর ফ্লাইটের নিরাপত্তার ব্যাপারেও জানতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, বিমানটি যে এয়ারপোর্ট থেকে উড়ে যায় ওই বিমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সে দেশের। বৃটিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানবন্দরে লোকজনের যাওয়া-আসা, বিস্ফোরক চিহ্নিত করার ব্যবস্থা ও বিমানে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় নিরাপত্তার প্রক্রিয়ার মতো বিষয়ে তারা পরামর্শ দিয়েছেন।  মেনন বলেন, নিরাপত্তার সব ব্যবস্থাই বাংলাদেশের বিমান বন্দরগুলোতে নেয়া হয়েছে। তারপরেও সেটা আরও জোরদার করা হয়েছে। তিনি জানান, যাত্রীদের চেকইনের সময়েও এই নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। আগে তাদেরকে বেল্ট, ঘড়ি বা জুতো খুলতে হতো না। কিন্তু এখন সেটা চালু করা হয়েছে। পরিবহন পরীক্ষা করে দেখার জন্য স্ক্যানিং যন্ত্রসহ বিস্ফোরকের সন্ধানে মোতায়েন করা হয়েছে ডগ স্কোয়াড। ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং-এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ব্যাপারে গোয়েন্দা ও পুলিশের ক্লিয়ারেন্সও নেয়া হচ্ছে। মেনন বলেছেন, সাধারণ যাত্রীদের জন্য যতোটা অসুবিধা হয় তার চেয়েও বেশি অসুবিধা হয় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা ভিভিআইপিদের জন্য। দেখা গেছে, তাদেরকে বিদায় ও স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে প্রচুর লোকজন ঢুকে পড়ে। তিনি বলেন, তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে অনেক সময় একশো দেড়শো লোকও হাজির হয়। বৃটেনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার এই তাগাদা দেয়া হলেও আরও যেসব দেশের এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে যাতায়াত করে সেসব দেশের পক্ষ থেকে ঢাকাকে কিছু বলা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.