আমাদের শিক্ষার সংকট by এ. কে. এম. মহীউদ্দীন

শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে গেলে কষ্ট লাগে। তেতাল্লিশ বছর শিক্ষকতা করেছি। প্রথম পনের মাস দেশের একটা পুরানো ও বড় কলেজে। এরপর দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য পড়ানোর কাজটা ছাত্র থাকতেও করেছি ছোটবেলা থেকেই। এই এতোগুলো বছরে যা দেখেছি তা হচ্ছে আমাদের হাতে অব্যাহতভাবে শিক্ষার ক্রমান্বয়ে অধঃপতন। অনেক কিছুই ঘটেছে অজ্ঞতা ও অসাবধানতার কারনে, আবার অনেক কিছুই হয়েছে সজ্ঞানে এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও আনাড়ি পরিকল্পনার ফলে।
প্রথম যে ক্ষতিটা সবচেয়ে মারাত্মক হয়েছে তা হচ্ছে শিক্ষকতা আর দশটা চাকরির মতো হয়ে গেছে। যারা নিয়োগ দেয় আর যারা নিয়োগ পায় সবার মনের ধারণাই এমন। আসলে শিক্ষকতা সবার কাজ নয়। কাজটা মানুষের জীবন গড়ার। এটা কোন সাধারণ বা সহজ কাজ নয়। এ কাজে লেখাপড়া যেমন জানা  লাগে তেমনি বা তার চেয়ে বেশি লাগে শিক্ষকতার উপযুক্ত মানসিক গঠন। শিক্ষকতার জন্য যে মাত্রার সংবেদনশীলতা, সতর্কতা, ধৈর্য, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতা লাগে তা কোন সমাজেই খুব বেশি মানুষের মধ্যে মেলে না। শিক্ষকের কাজে সবসময় রাতারাতি সফলতা চোখেও পড়ে না। ধীরেধীরে, তিলেতিলে, ধৈর্য, মনোযোগ ও যতেœর সাথে যারা গড়ে তুলতে জানে তারাই কেবল শিক্ষক হবার উপযুক্ত। নিষ্ঠা, ত্যাগ ও ভালবাসার কাজ শিক্ষকতা। মানুষের জীবন ধ্বংস করে দেওয়া খুবই সহজ। শিক্ষক যদি সত্যিকার ভাবে উপযুক্ত না হয় এবং তার ভুমিকা না বোঝে তবে প্রতিমুহূর্তেই সে তার অজান্তে তার দায়িত্বে থাকা ছেলেমেয়েদের জীবন ধ্বংস করার কাজই করে যায়। এর অন্যথা হবার উপায় নেই। অতএব যতেœর সাথে অনেক কিছু বিবেচনা করে কাউকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিৎ। এ ক্ষেত্রে আমাদের উদাসীনতা ও অবহেলা সীমাহীন ও অমার্জনীয়।
শিক্ষকতা সম্মন্ধে আরেকটি ভুল ধারনা আমাদের সর্বনাশ ঘটাচ্ছে। আমরা ভাবি নিচের দিকের শিক্ষক হওয়া কোন ব্যপার নয়। জিনিষটি আসলে ঠিক এর উল্টো। নিচের দিকে শিক্ষকতাই সবচেয়ে জটিল ও কঠিন। এখানেই প্রয়োজন একান্ত সংবেদনশীল, ধৈর্যশীল, বিবেচক ও বিচক্ষণ মানুষ। লেখাপড়াই হোক, আর স্বভাব-চরিত্র ও অভ্যাস গঠনই হোক আসল শিক্ষা ঘটে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। এখানে যদি একজন ছাত্রের লেখাপড়ার ও স্বভাবের ঠিকমতো বুনিয়াদ গঠন করে দেওয়া যায় তবে উপর দিকে গিয়ে তাকে শেখানো এবং তার নিজের চেষ্টায় শেখা একেবারেই সহজ হয়ে যায়। অতএব শিক্ষাজীবনের সুচনা ও বিকাশের এই বুনিয়াদী স্তরেই প্রয়োজন হয় সবদিক দিয়ে সবচেয়ে যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের। কিন্তু আমাদের এখানে এখন যা অবস্থা হয়েছে তাতে আর কোথাও কোন কাজ জুটাতে না পারা মানুষদের একটা সহজ আস্তানা হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি।   
দ্বিতীয় যে ক্ষতিটা হয়েছে তা হচ্ছে অনেক বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বাচ্চাদের উপর। ছোট ছোট বাচ্চা বই ও খাতার ভারে ভেঙ্গে পড়ছে একেবারে। যারা এই কাণ্ডটা করেছে তারাও বলতে পারবে না হরেক রকম এতো বইখাতা চাপিয়ে দিয়ে তারা কি অর্জন করতে চায়। প্রথম জীবনে কি এতো কিছু শেখা প্রয়োজন বা তা সম্ভব? শিক্ষা জীবনের প্রথম চার বা পাচ বছরে যদি কেউ শুদ্ধ করে পড়তে পারে, তার একান্ত পরিচিত জিনিষ সম্মন্ধে দুচার কথা সহজ ভাষায় গুছিয়ে লিখতে পারে, যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ ঠিকমতো করতে শেখে, কিছু ভূগোলের জ্ঞান পায়, নিয়ম ও শৃঙ্খলা মানতে ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ও শিষ্টাচার শেখে সেটাই কি যথেষ্ট নয়? শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক গঠনে মুল জিনিষ অনেক কিছু মুখস্ত করা নয়। মুল জিনিষ হচ্ছে পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠা, পড়ে বুঝতে শেখা, যা পড়া হয় তা নিজের ভাষায় প্রকাশ করতে শেখা এবং ক্রমান্বয়ে সহজ থেকে জটিল চিন্তা ও বিশ্লেষণ করার শক্তি ও অভ্যাস তৈরি হওয়া। বই সামনে নিয়ে পড়ে যাওয়া আর পড়ে বুঝতে শেখা এক জিনিষ নয়। বুঝতে শেখা ও গুছিয়ে গাছিয়ে পরিচ্ছন্ন ভাবে প্রাসঙ্গিক কথা লিখতে শেখা মোটেই সহজ কাজ নয়। পড়া মানে শুধু বানান দেখে পড়ে যাওয়াই নয়, লেখা মানে সাদা কাগজের উপর কালির কিছু আঁচড়ই নয়। আরো অনেক কিছু। সত্যিকার পড়া ও লেখার জন্য একটা সক্ষম ও সজাগ মন লাগে। শিক্ষার কাজ এই মনটাকে গড়ে তোলা। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে শেখাও একটা মুল্যবান শিক্ষা।
আরো একটি অত্যন্ত মুল্যবান জিনিষ একেবারেই অনুপস্থিত আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মধ্যে। ছেলেমেয়েদের কখনো শেখানো হয় না কি ভাবে কিছু পড়ে ও শুনে তা থেকে নোট নিতে হয় এবং লেখার মধ্যে দলিল ও প্রমাণ সংযোজিত করতে হয় এবং সেসবের উৎস উল্লেখ করতে হয়। পড়ে বা শুনে তা কাজে লাগাবার জন্য নোট নেবার কোন বিকল্প নেই। কারন কারো পক্ষেই সব জিনিষ মনে রাখা সম্ভব নয়। দলিল ও প্রমাণ এবং তাদের উৎস উল্লেখ ছাড়া লেখা দুর্বল থেকে যায়। শিক্ষার জগতে এসব দুর্বল লেখা মুল্যহীন। ভালভাবে নোট নিতে পারা এবং দলিল ও প্রমাণ সম্বলিত করে লিখতে পারা মানসম্পন্ন লেখাপড়ার জন্য একেবারেই অপরিহার্য। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা করতে গিয়ে এক্ষেত্রে বিষম বিপদে পড়ে যায়। পাশাপাশি দেখতে পায় স্থানীয় অনেক কচি ছেলেমেয়েও খুব স্বচ্ছন্দে নোট নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের লেখায় চমৎকার ভাবে দলিল ও প্রমাণ সম্বলিত করছে। ভালভাবে নোট নেয়ার এবং লেখার মধ্যে দলিল ও প্রমান সম্বলিত করার কিছু কায়দাকানুন আছে। এগুলি অল্প বয়সেই শিখতে হয় এবং ক্রমাগত অভ্যাস করতে হয়।
আমাদের দেশের লেখাপড়ায় এই চারটি জিনিষের দিকে কখনো মনোযোগ দেওয়া হয়নি। এসব লক্ষ্য অর্জন করার জন্য গাদাগাদা বইখাতার কোন প্রয়োজন হয় না। বরং তাতে আসল উদ্দেশ্যই ব্যহত হয়।
এরপর আসে পরীক্ষার প্রসঙ্গ। লেখাপড়াকে আমরা করে ফেলেছি সম্পূর্ণ পরীক্ষা কেন্দ্রীক একেবারে  ছোটবেলা থেকেই। সবার মনে একটাই কথা। তা হচ্ছে পরীক্ষার ফলাফল। অতএব চলছে পরীক্ষাকে সামনে রেখেই যতো আয়োজন ও প্রস্তুতি। আর তা হচ্ছে সীমিত কিছু জিনিষ পড়ানো ও পড়া। মুখস্ত করাই হচ্ছে লেখাপড়া শেখার একমাত্র উপায়। ফলে শিক্ষার বুনিয়াদ ভয়ানক দুর্বল থেকে যাচ্ছে। শেখানো ও শেখার চিন্তা একেবারেই বাদ পড়েছে। খুবই অদ্ভুত ব্যপার হচ্ছে প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত হুবুহু একই ধরনের প্রশ্ন এবং একই ধরনের উত্তর। তাহলে শিক্ষার মাধ্যমে মানসিক শক্তির ক্রমান্বয়ে বিকাশ হোল কি ভাবে? এভাবে শিক্ষিত মানুষ পড়া জিনিষও বোঝে না। আর পড়া জিনিষের বাইরে সাধারন সহজ জিনিষের সামনেও নিতান্তই অসহায়। অথচ শিক্ষার একটা বড়ো উদ্দেশ্যই হোল শেখা জিনিষের উপর ভিত্তি করে না শেখা জিনিষকে আয়ত্বে আনার যোগ্যতা অর্জন করা।    
প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা থাকবেই এটা ঠিক। কিন্তু আমরা এর সীমাবদ্ধতার কথাটা একেবারে ভুলে বসে আছি। মানুষের মেধা ও যোগ্যতা একরকম নয়। আনুষ্ঠানিক পরীক্ষায় সব ধরনের মেধা ও যোগ্যতার যাচাই করা সম্ভব হয় না। যতেœর সাথে মানুষের মেধা ও মননশীলতা যাচাই করার কোন ব্যবস্থা আমরা অবলম্বন করতে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছি। ছোটবেলা থেকে এতো পরীক্ষা উপকার তো করেই না, বরং মারাত্মক ক্ষতি করে। প্রথাগত পরীক্ষায় ভাল করতে মনটাকে একটি বিশেষ ছকের মধ্যে আটকে দিতে হয়। মনটা ও চিন্তা একেবারে ছোটবেলায় এভাবে বন্দি হয়ে গেলে সেই মনের স্বাভাবিক ও বহুমুখী বিকাশ হতে পারে না। এই মনের তখন একমাত্র কাজ হয় কিছু নির্দিষ্ট জিনিষ না বুঝে মুখস্ত করা। এধরনের শিক্ষায় চিন্তা ও বিশ্লেষণ করার, তথ্যকে ব্যবহার করে তত্বে উপনীত হবার, তত্বের পিছনের তথ্যগুলিকেও দেখতে পাবার এবং পুরাতন জ্ঞান দিয়ে নতুন সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা অর্জন হয় না। অনেক কিছু মুখস্ত করা ও এটা সেটা অনেক তথ্য জানার নাম লেখা পড়া নয়। এর চেয়ে অনেক মুল্যবান লেখাপড়ার কলাকৌশল জানা, তা ব্যবহার করতে শেখা ও ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলা। মানুষ আর সব ভুলে গেলেও এগুলি সারা জীবন স্থায়ী হয়ে যায়। শিক্ষার্থীর মেধা ও মননশীলতার নির্ণয় ও উদঘাটন ঠিকমতো হয় না এবং শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য অর্জন হয় না বলেই দেখা যায় পরীক্ষায় প্রথম দশ, পনেরো বা বিশজনের অনেকেই পরবর্তীতে একেবারে হারিয়ে যায়। নিজেকে নিজে ধার দিয়ে শাণিত রাখবার ক্ষমতা নিজের ভিতরে অর্জিত হয়নি বলে পরবর্তী জীবনে তারা দিনদিন কেবল ভোতাই হতে থাকে এবং তাদের চিন্তা ও মননে শুধু মরিচাই জমতে থাকে।
শিক্ষায় এতোসব দুর্বলতার কারনেই দেখা যায় আমাদের অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষও একটা কথা জানতে চাইলে আসল কথা ফেলে রেখে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা বলতে থাকে। প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকও কোন সাক্ষাতকার গ্রহন করার সময় কাজের প্রশ্ন করতে পারে না এবং সংক্ষেপে সুশৃঙ্খল ভাবে আসল কথা বলতে পারে না এবং তাদের অনেক লম্বা প্রতিবেদনেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথা বাদ থেকে যায়। আমাদের দেশের লেখাপড়ার দুর্বলতার কারনেই এদেশে কাজ করা অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান লোক নেবার সময় সনদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় প্রার্থীর প্রকৃত যোগ্যতার উপর। কারন তারা দেখতে পেয়েছে আমাদের এখানকার সনদ আর প্রকৃত যোগ্যতার মধ্যে পার্থক্য অনেক।
আমাদের লেখাপড়ার কি নিদারুন দৈন্য তা বুঝবার জন্য কেবলমাত্র দু’টি জিনিষই যথেষ্ট। এক, প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বারো বছরেও আমাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভাষাটা কোনরকম চলনসই ভাবেও রপ্ত করতে পারে না। অথচ দুনিয়ার কোন ভাষা আয়ত্ব করতেই এতোগুলি বছর লাগার কথা নয়। শেখানোটা ঠিকমতো হলে পাচ বা ছয় বছরের বেশি লাগার কথা নয় কোন ভাষা শেখার জন্য। তার মধ্যে আবার ইংরেজি ভাষাটা একটা খুবই সহজ ভাষা। এর তুলনায় আরবি বা ফরাসি অনেক, অনেক কঠিন। কিন্তু আমাদের এখানে যা ঘটে তা হচ্ছে বছর খানেকের মধ্যেই ছাত্রের মনে ধারনা জন্মে যে ইংরেজি খুবই কঠিন। আর এক বছরের মধ্যে সে ভাবতে শুরু করে ইংরেজি শেখা একটা অসম্ভব ব্যপার। তৃতীয় বছর আসার আগেই ইংরেজি একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠে তার কাছে এবং বাকি বছরগুলি সে এই দুঃস্বপ্নের বোঝা বয়ে চলে। শিক্ষা জীবনের প্রথম বারোটা বছরের এ এক অবর্ণনীয় অপচয়। 
দুই, আমাদের এম এ, এম এসসি বা এম কম পাশ করা মানুষগুলির দিকে একটু তাকালে কি দেখতে পাই? একবার পরীক্ষায় পাশ হয়ে যাবার পর তাদের ক’জন সারা জীবনেও একটি বই পড়ে? অনেকে তো খবরের কাগজটাও পড়ে না। আমি নিজে বহু এমন মানুষ দেখেছি। আমার নিজের একান্ত আপনজনদের মধ্যেই দেখেছি। বহু বছর শিক্ষক ছিলাম বলে আমাকে অনেক দেখতে হয়েছে হতভাগা এসব শিক্ষিত মানুষদের। আমি দেখেছি এম এ পাশ করা এবং পেশায় শিক্ষক এমন মানুষেরাও একশটি বই একটা নিয়ম মতো সুশৃঙ্খল ভাবে গুছিয়ে রাখতে পারছে না। এমন হয় কেন আমরা কি কেউ কখনো ভেবে দেখেছি? মাস্টার্স পাশ তো চাট্টিখানি কথা নয়। মাস্টার্স পর্যন্ত লেখাপড়া করবে অথচ তাদের মধ্যে লেখাপড়ার প্রতি আর কোন আগ্রহ থাকবে না এটা কেমন করে হতে পারল? মাস্টার্স পাশ করবে আর কোন বইটার কোথায় জায়গা হওয়া উচিৎ তা বুঝতে পারবে না এ কি কথা? ব্যর্থতা কোথায়? সমস্যা কি এই সব মানুষদের মধ্যে, না শিক্ষা সম্মন্ধে আমাদের ধারনায় এবং আমাদের আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রমে? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা আমাদের এসব লোকজনদের মন ও মগজের মধ্যে কেবল একটি জিনিষই প্রবল ভাবে সক্রিয় মনে হয়। তা হচ্ছে কে কার ‘সিনিয়র’ আর কে কার ‘জুনিয়র’ সেই হিসাব বের করা।      
শিক্ষা যদি মানসম্মত হয় তবে কেবলমাত্র উচ্চতর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ তৈরি ছাড়া অন্য কোন কিছুর জন্য মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়াই একজনের জন্য যথেষ্ট। মানসম্মত শিক্ষায় মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে মজবুত বুনিয়াদ তৈরি করা হয় তার উপর দাঁড়িয়ে যেকেউ ইচ্ছা করলে তার নিজের চেষ্টায় সামনে এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন শিক্ষা সম্মন্ধে স্পষ্ট ধারনা, উপযুক্ত শিক্ষা কাঠামো, শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ এবং সর্বোপরি শিক্ষায় ও স্বভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক। দুর্ভাগ্য যে এমন শিক্ষকেরই আমাদের নিদারুন অভাব।
আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রকৌশল কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মেডিক্যাল কলেজে পড়তে আসে তাদের অধিকাংশই এই পর্যায়ে লেখাপড়া করবার জন্য উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠে না। অনেক বেছেবুছে যাদের ভর্তি করা হয় তাদেরও কম করে হলে অর্ধেকও চিন্তাভাবনায়, বিশ্লেষণ ও প্রকাশ ক্ষমতায় একেবারে পঙ্গু। জীবনের প্রথম বারো বা চৌদ্দ বছরের শিক্ষা তাদের বস্তুত তেমন কিছু দান করতে পারেনি। বরং মহা ক্ষতি করেছে তাদের। এদের শেখানো প্রায় অসম্ভবই বলতে হবে। শিক্ষা গ্রহণ করবার সব ক্ষমতা এদের দুমড়ে মুচড়ে এমনভাবে বিকৃত হয়ে গেছে যে তা আর সোজা করা সম্ভব নয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি এভাবে নামেমাত্র লেখাপড়া করে আসা সনদপত্র সর্বস্ব মানুষদের চেয়ে যারা একেবারে কোন লেখাপড়াই করেনি তাদের শেখানো অনেক সহজ। (বিশেষ করে আলজিরিয়াতে দুবছর একদম কোন ইংরেজি না জানা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের ইংরেজি শেখাতে গিয়ে হাড়েহাড়ে এই উপলদ্ধি হয়েছে আমার।)
আরো একটা ভয়ংকর জিনিষ অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার। উচু থেকে নিচু সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেভাবে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে তাতে সবচেয়ে সর্বোত্তম কোন শিক্ষাব্যবস্থাও আমাদের এখানে ব্যর্থ হয়ে যেতে বাধ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি শিক্ষাকে একেবারে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক বা কর্মচারী নিয়োগ এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন সিধান্ত গ্রহন এর চেয়ে ধংসাত্বক আর কিছু নেই শিক্ষার জন্য।
আমরা যদি শিক্ষা ব্যবস্থার কোন মৌলিক সংশোধন করতে চাই ও এর সত্যিকার উন্নতি ঘটাতে চাই তবে আমাদের প্রথমেই মন দিতে হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার দিকে। আমাদের  কারন মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাই আসল বুনিয়াদ। এই বুনিয়াদ মজবুত না হলে সবই ব্যর্থ হতে বাধ্য। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরকে ঠিক না করেই নতুন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান করে আমাদের শিক্ষার সংকট বাড়বে ছাড়া কমবে না। বুনিয়াদি শিক্ষা যদি উপরে না উঠে আসে উচ্চশিক্ষাকেই সেক্ষেত্রে নিচে নেমে আসতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বুনিয়াদি শিক্ষাকে মজবুত করতে হলে আমাদের বুঝতে হবে কি মুল্যবান, আর কি তা নয়, শিক্ষা সম্মন্ধে আমাদের অনেক অলীক ধারনা ঝেড়ে ফেলতে হবে।  আমাদের বাস্তবাদী হতে হবে। অনেক কিছু যেনতেন করে না শিখিয়ে বুনিয়াদী কিছু জিনিষ ভাল করে শেখাতে হবে। শিক্ষার মধ্যে শৃঙ্খলা ও সদাচার আনতে হবে। সব রকম রাজনৈতিক প্রভাব থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে মুক্ত রাখতে হবে। অন্যথায় সবই বৃথা যেতে বাধ্য। আর বিশেষ ভাবে শিক্ষক নির্বাচনে সতর্ক হতে হবে। তা না হলে অন্য সব আয়োজনই ব্যর্থ হয়ে যেতে বাধ্য।
তবে সবচেয়ে বড়ো হতাশার কথা হোল চারিদিকে সর্বক্ষেত্রে আমাদের যে অকল্পনীয় অনাচার ও নৈরাজ্য তার মধ্যে ঠাণ্ডা মাথায় ও স্থির মনোযোগে কোন শিক্ষাই হতে পারে না। ঠাণ্ডা মাথায় ও স্থির মনোযোগে আমাদের এখানে এখন কেবল খুনখারাবি এবং যতো রকম অন্যায় ও অপকর্ম আছে সেসবই করা সম্ভব। শিক্ষার উপযোগী কোন পরিবেশই আজ আর অবশিষ্ট নেই আমাদের এই হতচ্ছাড়া রাষ্ট্রে ও সমাজে।

No comments

Powered by Blogger.