টাঙ্গাইলে হত্যাকান্ড: সাত পুলিশকে প্রত্যাহার, দুটি তদন্ত কমিটি

টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় গতকাল শনিবার পুলিশের সাত সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
গত শুক্রবারের ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা দেওয়ায় এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। গতকাল কালিহাতী থানায় মামলা করেছেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোশারফ হোসেন। এতে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ২০০-৩০০ লোককে। আর ঘাটাইল থানায় অজ্ঞাত ৫০০-৬০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন এসআই মোনসেফ আলী।
টাঙ্গাইলের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার সঞ্জয় সরকার গত সন্ধ্যায় জানান, বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ার অভিযোগে পুলিশের সাত সদস্যকে জেলা পুলিশ লাইনসে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এঁরা হলেন কালিহাতী থানার এসআই আবুল বাশার ও সলিমউদ্দিন, কনস্টেবল জিয়াউল হক ও আমিরুল ইসলাম এবং ঘাটাইল থানার এসআই মোনসেফ আলী, কনস্টেবল হারুন অর রশিদ ও লিয়াকত আলী।
গতকাল কালিহাতীতে গিয়ে সকালের দিকে দোকানপাট কিছু বন্ধ থাকতে দেখা গেলেও দুপুরের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচলও ছিল স্বাভাবিক। উপজেলা সদরের উপজেলা পরিষদ, হামিদপুর সেতু, বাসস্ট্যান্ড, সাতুটিয়া মোড়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ মোতায়েন ছিল। র্যাবের টহলও চোখে পড়ে।
টাঙ্গাইলে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল দুপুরে ফারুক হোসেন, শামীম হোসেন ও শ্যামলচন্দ্র দাসের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ময়নাতদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণেই তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। লাশগুলো বিকেলে তাঁদের নিজ নিজ গ্রামে পৌঁছালে স্বজনদের আহাজারি শুরু হয়। উত্তর সালেঙ্কা গ্রামে নিহত শামীমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের লাশ দেখে বৃদ্ধ মা মূর্ছা যাচ্ছেন। শামীমের শিশুছেলে বাঁধনের কান্না দেখে এলাকার মানুষও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। শামীমের মামা বেলাল হোসেন বলেন, ‘পুলিশ পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই।’
গতকাল বিকেলে পুলিশের ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার জিল্লার রহমান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আলী, টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার সঞ্জয় সরকার কালিহাতীতে যান। তাঁরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠক শেষে জিল্লার রহমান সাংবাদিকদের বলেন, গুলি চালানো কতটা যৌক্তিক ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিআইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বলেন, কালিহাতীর এ ঘটনা কেন ঘটল, কারা ঘটিয়েছে, পুলিশের ওপর আক্রমণ হয়েছিল কি না, পুলিশ কেন গুলি চালিয়েছে ইত্যাদি বিষয় তদন্তের জন্য ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজিকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন জানান, ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার হোসেনকে। নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার প্রতিবাদে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পক্ষ থেকে গতকাল বিকেলে কালিহাতীর বেতডোবা স্কুল মাঠে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘যেভাবে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তাতে পুলিশের নয়, সরকারের অপসারণ চাই। সরকার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে।’
কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ওরফে রোমার স্ত্রীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ঘাটাইল উপজেলার আঠারদানা গ্রামের এক তরুণের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কয়েক মাস আগে ওই তরুণের সঙ্গে চলে যান রফিকুলের স্ত্রী। পরে পারিবারিক বৈঠকের মাধ্যমে স্ত্রীকে রফিকুলের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। গত সপ্তাহে রফিকুলের স্ত্রী আবারও ওই তরুণের কাছে চলে যান। পরে গত মঙ্গলবার রফিকুল ওই ছেলে ও তাঁর মাকে সাতুটিয়ায় ডেকে আনেন এবং বিবস্ত্র করে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। এ ঘটনার পর ছেলেটির মা কালিহাতী থানায় মামলা করেন। পুলিশ রফিকুল ও তাঁর ভগ্নিপতি হাফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। মা-ছেলেকে নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে কালিহাতী ও ঘাটাইলের মানুষ গত শুক্রবার কালিহাতী উপজেলা সদরে বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে তিনজন নিহত হন।

No comments

Powered by Blogger.