কাশ্মির সত্যিই ভূস্বর্গ, কিন্তু আড়ালে গহন অন্ধকার by জয়ন্ত ঘোষাল

অনেক দিন পর শ্রীনগর এলাম। ভূস্বর্গ কাশ্মির, পূর্বের ভেনিস এই শহরটিকে দেখে মন বিষণ্ণ হয়ে গেল। এক ভয়াবহ বন্যায় বিধ্বস্ত শ্রীনগর। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত বিশ বছরে এ হেন বর্ষণ কখনো হয়নি। ঝিলম নদীর জলস্রোত রুখতে এক পৃথক কৃত্রিম খাল তৈরি হয়েছিল জলনিকাশির জন্য। তা-ও ভেসে গিয়েছে কাশ্মির। কোনো কিছুই বিপর্যয়কে রুখতে পারেনি। প্রকৃতির ভয়াল তাণ্ডবে ভেদাভেদ নেই ধনী-দরিদ্রে। নিশ্চিহ্ন কত বাড়ি ও দোকান। ওমর আবদুল্লার বাড়ির মধ্যেও জল জমে ছিল সাত দিন। কিন্তু অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষই। আর এ রকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে কাশ্মির রাজনীতিও এক বড় সঙ্কটের মুখোমুখি। মুফতি মুহম্মদ সৈয়দ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন সবে তিন মাস হলো। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারছেন বিজেপি-র মতো এক জাতীয় হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার ফল কী হতে পারে। এই জোটের ফলে রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ বাড়ছে বই কমছে না। কারণ, বিজেপি-কে অন্তর থেকে শ্রীনগরের মুসলমান সমাজ কিছুতেই কখনো গ্রহণ করতে পারে না। স্থানীয় নাগরিক সমাজ, মুসলিম বিদ্বজনেদের মনে হচ্ছে যে বিজেপি ‘হিন্দুস্থানি’ সরকার চালাচ্ছে। তারা এখানে সঙ্ঘ পরিবারের কৌশলে জম্মু ও কাশ্মিরের বিভাজন বাড়াচ্ছে। নিরাপত্তার অভাববোধের এই বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে বাড়ছে জঙ্গি কার্যকলাপ। বাড়ছে প্রবীণ গিলানির জনপ্রিয়তা। ফলে কাশ্মির সরকার এখন তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছে। অল্পবয়সী ছেলেরা আবার জঙ্গি সংগঠনে নাম লেখাচ্ছে। বিশেষত দক্ষিণ কাশ্মিরে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ দিকে দারিদ্র চরমে। বেকারি। অপুষ্টি। তবু উন্নয়ন এখনও কাশ্মিরের প্রধান আলোচ্যসূচি নয়। নরেন্দ্র মোদি যদি উন্নয়নের কথা বলেন তা হলেও কাশ্মিরি জনমানস মনে করে, হিন্দুস্থানি সরকার কাশ্মিরি আজাদির চেতনাকে ভোলানোর চেষ্টা করছে। কাশ্মির মানে আজও আমাদের কাছে পর্যটনের বিষয়। অমরনাথ যাত্রা সফল হলো না কি জঙ্গি নাশকতায় তা বন্ধ করতে হলো-এটাই যেন কাশ্মির সরকারের সাফল্যের একটি বড় পরীক্ষা। বাঙালি, গুজরাটি ও দক্ষিণি পর্যটকদের প্রিয় স্থান এই শ্রীনগর। শ্রীনগরে এসে পর্যটকেরা ডাল লেকে থাকেন। শিকারায় অনেকে রাত্রিবাস করেন। মুঘল বাগানে নানান রঙিন ফুলের বাহার দেখে মুগ্ধ হন। সেই মুগ্ধতাকে বিক্রি করে শ্রীনগরের কিছু যুবক, কিছু ব্যবসায়ী দৈনন্দিন অন্নচিন্তা সামাল দেন। কিন্তু বারবার এসেও কাশ্মিরের আর্থ-সামজিক ব্যবস্থা অতীতেও যা দেখেছি আজও তাতে বিপুল কোনো পরিবর্তন দেখছি না। সাংবাদিক হিসাবে তিন দশক আগে যখন এসেছিলাম তার সঙ্গে আজ ফারাক কোথায়! এর মধ্যে প্রায় পঁচিশ বার এসেছি এই প্রান্তে। চারার-এ-শরিফে যখন আগুন লাগে, হজরতবালে জঙ্গি প্রবেশ করে, বারবার ভোট হয়- যখনই এসেছি, কখনো ফারুক, কখনো মুফতি, কখনো গুলাম নবি। এখানেও রাজার পোশাক বদলায়, রাজতন্ত্র বদলায় না। ৩৭০-এর অধিকারে কোটি কোটি রুপি আসে। সে রুপি প্রত্যন্ত কাশ্মিরের গরিব মানুষ পর্যন্ত পৌঁছায় না। এবার এসেছিলাম সংবাদমাধ্যম সম্পর্কিত এক আলোচনায় যোগ দিতে। এক দিকে দিল্লি থেকে আসা নানা ধরনের সাংবাদিক। সেখানে সর্বভারতীয় বৈদ্যুতিন সাংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক যেমন আছেন, তেমনই আছেন দূরদর্শনের উপদেষ্টা। আবার আমার মতো বাংলা সংবাদপত্রে কর্মরত গদ্য-কর্মীও ছিল। অন্য দিকে নানা ধরনের কাশ্মিরি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। দু’দিন ধরে আলোচনার মাধ্যমে এক সেতু রচনার চেষ্টা। কিন্তু দু’দিনে এটা বোঝা গেল যে কাশ্মিরি সংবাদমাধ্যম এক তীব্র বিচ্ছিন্নতাবোধের শিকার। কাশ্মিরি সাংবাদিকরা বার বার আমাদের সম্বোধন করছিলেন হিন্দুস্থানি মিডিয়া হিসাবে। আর ওরা হলেন কাশ্মিরি মিডিয়া। আমি বললাম, আমি তো জানতাম আপনারাও ভারতীয় সাংবাদমাধ্যম। আপনারা কি নিজেদের হিন্দুস্থানি বিরোধী মিডিয়া বলে মনে করেন? আমি তো বাঙালি। বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতা করি। কিন্তু আমি তো ভারতীয় সাংবাদিক। নিজেকে পশ্চিমবঙ্গীয় সাংবাদিক তো বলি না। কাশ্মিরি হয়েও ভারতীয় হতে না পারার মধ্যে কাশ্মিরি বিচ্ছিন্নতাবোধ আছে। কিন্তু সেই বিচ্ছিন্নতাবোধকে ৭০ বছর ধরে প্রশ্রয় দিয়ে কাশ্মিরের কোন উপকারটা হয়েছে! বিহারে গেলে রাস্তার যে অবস্থা দেখি এখানেও তো সেটাই দেখছি। দু’টোই তো ভারতের রাস্তা। বঞ্চনা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন তুললেও বলব, এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বাঙালিরও অনেক বঞ্চনার অভিযোগ রয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবোধের শিকার কেরলের এক জন মালয়ালি, তামিলনাড়ুর এক তামিল, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক মণিপুরিও। মানছি, কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রেক্ষাপট পৃথক। মানছি অতীতের পৃষ্ঠায় থাকা শেখ আবদুল্লাহ ও হরি সিংহ, মাউন্টব্যাটেন-গান্ধী, নেহরু-জিন্নার ভূমিকা নিয়ে আজও এ প্রান্তে বিতর্ক সজীব। স্থানীয় প্রকাশক ও বইয়ের দোকানে গেলে তা বোঝা যায়। এ ব্যাপারে নতুন নতুন বই প্রকশিত হয়েই চলেছে। বহু হরিয়ত নেতা দুর্নীতিগ্রস্ত। তারাও ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্যস্ত। কেউ স্থানীয় বাজারের ইজারা নিয়েছেন। কারও আমদানি-রফতানির ব্যবসা। কাশ্মিরি বিচ্ছিন্নতাই তাদের রাজনীতির মূলধন। স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রকাশিত কার্টুন, এক রোবট কাশ্মিরের সাংবাদমাধ্যমের মঞ্চে সেমিনার করতে এসেছে। পিছন থেকে হাতে রিমোট নিয়ে দিল্লি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। দু’দিনের আলোচনা সভায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তীব্র সমালোচনা করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক এবং সমাজকর্মীরা ভারতীয় রাষ্ট্রের সমালোচনা করতে শুরু করেন। দু’দিন আলোচনা শুনতে শুনতে মনে হলো, আমিই কি তবে ভারতীয় রাষ্ট্র! ওনাদের বললাম, ভারতীয় সেনাবাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে আমরাও তার তীব্র সমালোচনা করি। আমরা ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছি না। আমরা বেসরকারি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি। সংবাদমাধ্যমের যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, তা যেমন দিল্লিতে আছে তেমনই কাশ্মিরেও আছে। হাইপার জাতীয়তাবাদ যেন ভারতীয় চ্যানেল বা সংবাদমাধ্যমে কাঙ্খিত নয়, তেমনই কাশ্মিরি সংবাদমাধ্যমের বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বার অতিপ্রচারও ভাল নয়। মডারেট বা মাঝামাঝি পথে চলা মানুষেরা এ সমাজে ক্রমশ বেশি বেশি করে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়িও ভালো নয়, আবার তা বলে জঙ্গি তৎপরতাও ভালো নয়। শ্রীনগর থেকে দিল্লি ফেরার পথে সহযাত্রী ছিলেন এক অবসরপ্রাপ্ত কাশ্মিরি বিচারক। এই প্রবীণ মানুষটিকে প্রশ্ন করেছিলাম, জঙ্গি তৎপরতা আবার বাড়ছে এ কথা সবার মুখে শুনে এলাম। জবাবে ওই প্রবীণ কাশ্মিরি বললেন, ও তো এখানে কখনো বাড়ে, আবার কখনো কমে। যখন কমে তখনও আসলে কমে না। আবার যখন বাড়ে তখনও এতটা বাড়ে না যে ওটা আর কমবে না। আসলে যে সরকারই আসুক তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ে। কারণ কাশ্মিরের মানুষের সমস্যার সমাধান হয় না। কাশ্মির সমস্যার নাম করে রাজনীতিকেরা দারিদ্র, বেকারির মতো ইস্যুকে ভুলিয়ে রাখেন। গৃহবন্দি গিলানি ভোট বয়কট করেন তাই জনপ্রিয়। কিন্তু তাকে যদি মুখ্যমন্ত্রী করে দেওয়া হয় তা হলে তিনিও অচিরেই জনপ্রিয়তা হারাবেন। এটাই দস্তুর। আপনাদের হিন্দুস্তানে মোদি থেকে মমতা, সকলকেই এই অসন্তোষের মোকাবিলা করতে হয়। এই অসন্তোষের জন্যই মনমোহন সিংহ থেকে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম, সকলকেই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে। তা হলে কাশ্মির কি যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যাবে? এ এক বিচিত্র ত্রিভুজ। ত্রিভুজের প্রথম বিন্দু দিল্লি-শ্রীনগর সম্পর্ক। দ্বিতীয় বিন্দু, জম্মু-কাশ্মির, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক আর তৃতীয় বিন্দু, ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক। শুধু একটা প্রশ্নের সমাধান করতে গেলে অন্য বিন্দুগুলিতেও প্রত্তিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সহযাত্রী প্রবীণ বিচারকের সখেদ মন্তব্য, এখন তাই আমরা খবরের পিছনে দৌড়াই না। প্রতি দিন টিভি চ্যানেলের খবর আমাদের তাড়া করে ফেরে। আমরা খবর পড়ি। খবর শুনি। সব দেখি। সব বুঝি। কিন্তু কোনো উত্তর নেই কারও কাছে। দিল্লি বিমানবন্দরে নেমে কনভেয়ার বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে বলে এলাম, সমাধান আমরা না-ও দিতে পারি, কিন্তু আপনার হতাশার কথা, খেদের কথা আমার পাঠককে জানাতে পারি।
জয়ন্ত ঘোষাল: নয়া দিল্লি ব্যুরো চিফ, আনন্দবাজার পত্রিকা।

No comments

Powered by Blogger.