বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধন দৃঢ় করছে ভারত by মীরা শঙ্কর

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর প্রতি মনোযোগী হলো ভারত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভূ-যুক্ততার পথে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হলেও ভারতের জনদৃষ্টিতে কিংবা দিল্লির পররাষ্ট্রনৈতিক ধ্যানধারণায় বাংলাদেশ যথাযথ ওজন অর্জন করেনি। খালেদা জিয়ার বিগত আমলে দুই দেশের সম্পর্ক ছিল শীতল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার আগের সেই পথ থেকে সরে আসায় দৃঢ় ও সাহসী প্রচেষ্টা নিয়েছে। এই সরকার বেশ কটি সহিংস মনোভাবাপন্ন ইসলামি দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। নিজেদের অস্তিত্বের ঝুঁকি নিয়েও এই সরকার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা চালানোর হোতাদের বেশ কয়েকজনকে বিচারের মুখোমুখি করেছে। কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি হয়েছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক সহিংসতা ও অস্থিতিশীল কর্মকাণ্ডও করেছে জামায়াত ও তার সমর্থকেরা। সম্প্রতি চারজন ‘নাস্তিক’ ব্লগারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। আরও অনেককে সম্ভাব্য শিকার হিসেবে চিহ্নিত করাও হয়েছে। মূল ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ এখন দুটি পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনায় কম্পিত। এক পক্ষ মনে করে যে বাঙালি পরিচয় ও সংস্কৃতিই বাংলাদেশের পরিচয়ের ভিত্তি, অন্য পক্ষ বিশ্বাস করে যে প্রাথমিকভাবে এর ভিত্তি ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই মৌলিক অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিণতিই ঠিক করে দেবে কোন ধরনের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য নির্ভর করছে। এটা মধ্যপন্থী উদার গণতন্ত্র হবে কি না, এর ওপরই তা নির্ভর করছে। তবে এটা বাংলাদেশের জনগণকেই বেছে নিতে হলেও ভারত কেবল পারে সে দেশের উদার ও মধ্যপন্থী অংশকে সাহায্য করে যেতে।
মোদির এই সফরের কেন্দ্রীয় মনোযোগে ছিল অর্থনৈতিক সহযোগিতা, আরও জোরদার সংযুক্তি ও নিরাপত্তার ওপর। এ ব্যাপারে গত কয়েক মাসে দুটি লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সমুদ্র ও স্থলসীমান্ত চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে ইতিবাচক অগ্রগতির মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে। গত বছর ভারত-বাংলাদেশ উভয়েই হেগে অবস্থিত সমুদ্রসীমাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সালিস আদালতের রায় মেনে নিয়ে সমুদ্র নিয়ে বিরোধের মীমাংসা করে। বাংলাদেশের জন্য এটা ছিল বিরাট প্রাপ্তি। কারণ তারা বিবদমান এলাকার পাঁচ ভাগের চার ভাগই পেয়েছে নিজেদের বলে। অন্যদিকে বিবদমান নিউমুরিং এলাকার ওপর ভারতের সার্বভৌমত্বও স্বীকৃত হয়। সমুদ্রসীমার ওপর অধিকার আসায় বাংলাদেশের পক্ষে বঙ্গোপসাগরের সম্ভাব্য বিপুল জ্বালানি উত্তোলনের দরজা খুলে গেল। এ ঘটনার অর্থনৈতিক অবদান বাংলাদেশের জন্য বিপুল।
মোদির এই সফরের কেন্দ্রীয় মনোযোগে ছিল অর্থনৈতিক সহযোগিতা, আরও জোরদার সংযুক্তি ও নিরাপত্তার ওপর। এ ব্যাপারে গত কয়েক মাসে দুটি লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সমুদ্র ও স্থলসীমান্ত চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে ইতিবাচক অগ্রগতির মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৭৪ সালের ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তির পূর্ণ অনুমোদনই হলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের মুখ্য আলোকপাতের বিষয়। ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি ভারতের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের ১৪টি সেক্টরে বিরাজমান বিবাদের সমাধান করেছিল। বাংলাদেশ সঙ্গে সঙ্গেই চুক্তিটি অনুসমর্থন করলেও ভারত এই আইনি অজুহাতে বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছিল যে আগে সীমান্ত চিহ্নিত হতে হবে। ২০১৫ সালের মে মাসে সংবিধান সংশোধন বিলের সর্বসম্মত অনুচ্ছেদ প্রমাণ করে যে আমাদের সব রাজনৈতিক দল দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারে। বিজেপি বিলটি এগিয়ে নিলেও বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তারা এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু এবার কংগ্রেস প্ররোচনায় পা না দিয়ে বিদ্যমান রাজনীতির সীমার চাইতেও দূর পর্যন্ত দেখে বিলটি পাস করায় সমর্থন দেয়।
স্থল ও সমুদ্রসীমা বন্দোবস্তে দুই দেশের মধ্যে বৃহত্তর স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা আনা উচিত। বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে শেখ হাসিনার সরকার গঠনমূলক সাড়া দিয়েছে। ওই গোষ্ঠীগুলোর কয়েকজন মূল নেতাকে তারা ভারতের কাছে হস্তান্তরও করেছে। দুই দেশই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন করায় সহযোগিতার হাত শক্তিশালী করেছে। সময়মতো তথ্য ও গোয়েন্দা সহযোগিতা দেওয়ার মাধ্যমে আরও নিবিড় সমন্বয় এবং কার্যকর সীমান্ত ব্যবস্থাপনা থেকে দুই দেশই তাদের নিরাপত্তা হুমকিগুলো মোকাবিলায় সক্ষম হবে। এ ব্যাপারে উভয়েরই বড় স্বার্থ রয়েছে।
কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা এবং শিলং হয়ে ঢাকা থেকে গুয়াহাটি বাস চলাচল চালুর মাধ্যমে কানেকটিভিটি বা সংযুক্তিও এক লাফে এগিয়ে গেল। তাহলেও দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে মানুষ, পণ্য ও সেবার বাধাহীন চলাচলের স্বপ্ন অর্জনের জন্য আমাদের আরও দূরে যেতে হবে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর রাজনৈতিকভাবে যে যোগাযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল, তা আবার বহাল করতে হবে। বস্তুগত অবকাঠামোর তুমুল উন্নতি—সড়ক, রেল ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে—এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে বেগবান করা এই লক্ষ্য হাসিলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও ভারতের মধ্যে মোটরগাড়ি চলাচলের যে সার্ক চুক্তি পাকিস্তানের কারণে আটকে আছে, তা সম্পন্ন করা উচিত।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো উন্নতি করছে, বছরে গড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে বড় আকারে আবির্ভূত হয়েছে এবং সৃষ্টি করেছে কাজ ও সমৃদ্ধি। সামাজিক উন্নয়নের বেলায়ও বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অগ্রগতি ঘটিয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক সূচকে দেশটি ভারতের চেয়েও এগিয়ে। বলতেই হবে, বাংলাদেশ আমাদের পশ্চিম সীমান্তের প্রতিবেশীর চেয়ে সুখকর ব্যতিক্রম এ কারণে যে তারা নিরাপত্তা-সামর্থ্যের জন্য অর্থনীতিকে ভুগিয়েছে। ভারত, বাংলাদেশসহ বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সহযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ ঘটাবে এবং সমগ্র অঞ্চলের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। উভয় দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়ে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ভারত একতরফাভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ উভয়ের মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা বা বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ দেখালেও ভারত থেকে বেশির ভাগ আমদানি তাদের বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানি খাতে অবদান রেখে যাচ্ছে। বর্তমানে আড়াই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারত এককভাবে এই উদ্বেগে সাড়া দিয়েছে। গত বছর থেকে দৈনিক ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহকেও শুভসূচনা বলা চলে। জ্বালানি খাতে সহযোগিতা আরও বাড়ানো উভয় দেশের স্বার্থেই মঙ্গলজনক।
মোদির এবারের সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টি ছিল না। তাহলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সফরকারী দলে নিয়ে নরেন্দ্র মোদি ভবিষ্যতের আশা জিইয়ে রেখেছেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের গড়ন ঠিক করায় ভারতের সীমান্ত রাজ্যগুলোর ভূমিকা ব্যাপক, এ জন্যই তাদের উপস্থিতি থাকা ভালো।
ভারতের দ্য ট্রিবিউন পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ থেকে নেওয়া এবং ইংরেজি থেকে অনূদিত।
মীরা শঙ্কর: যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত।

No comments

Powered by Blogger.