ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ‘নিরুপায়’ শিশুরা by প্রণব বল

চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরের একটি অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় কাজ
করছে এক​ শিশু। গতকাল সকালে তোলা ছবি l প্রথম আলো
১৩ বছরের শচীন কাজ করে চট্টগ্রাম নগরের মোমিন রোডের একটি গাড়ি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানে। বাবার আয়রোজগার কম, তাই ষষ্ঠ শ্রেণির পরই পড়াশোনার পাট চুকাতে হয়েছে তাকে। একই দোকানে কাজ করে তার সমবয়সী রিপন। পরিবারের অভাবের তাড়নায় এই বয়সে কাজ করছে সে।
মোমিন রোডের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. আলমগীর বলেন, ‘শচীনকে আমার এখানে আনার পর তার অভিভাবকদের বলেছিলাম, তাকে লেখাপড়া করাতে। কিন্তু তার অভিভাবক বলল, ঠিকমতো খেতে পায় না। কাজ করা ছাড়া উপায় নেই।’
শচীন ও রিপনের মতো হাজারো শিশু শ্রমের সঙ্গে জড়িত। সরকারি হিসেবে চট্টগ্রামে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১০ হাজার। কিন্তু বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, এই সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো। শ্রম আইন অনুযায়ী, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা নিষেধ। এ ছাড়া শিশুদের দিয়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের শ্রম একেবারেই নিষিদ্ধ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনেক শিশু শ্রমিকের আয়ে চলে তাদের পরিবার। অভাবের তাড়নায় নিরুপায় হয়ে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। অন্যদিকে সস্তা শ্রমের কারণে শিশুদেরও কাজে নিয়োগের প্রবণতা আছে। এসব কারণে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না।
সরকারি হিসাবে, চট্টগ্রামে ১০ হাজার শিশু শ্রমিক আছে। এরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত।
‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন’ নামের একটি প্রকল্প ছিল শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সম্প্রতি প্রকল্পটি শেষ হয়ে গেছে। ওই প্রকল্পের প্রোগ্রাম সুপারভাইজার ছিলেন মো. ইয়াসির আরাফাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে ১০ হাজার শিশু শ্রমিক জড়িত।’
বিভিন্ন সূত্র জানায়, শিশু শ্রমিকেরা জাহাজভাঙাশিল্প, ঝালাই কারখানা, পুরান লোহালক্কড়ের দোকানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত। এসব কাজে নিয়োজিত বেশির ভাগ শিশুই দৈনিক ৭ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে।
ওয়ার্ল্ড ভিশন, অপরাজেয় বাংলাদেশ ও ব্রাইট বাংলাদেশ নামে তিনটি সংস্থার ‘শিশুশ্রম হ্রাসকরণ’ নামের একটি প্রকল্প আছে। ওই প্রকল্পের অধীনে নগরের চারটি ওয়ার্ডে শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
অপরাজেয় বাংলাদেশের প্রকল্প সমন্বয়কারী মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে শ্রমজীবী শিশুদের নিয়ে কাজ করছি। আমাদের অভিজ্ঞতায় বলে নগরে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৪০ হাজারের কম নয়। আমরা শিশুশ্রম বিষয়ে শিশুদের অভিভাবক ও মালিকপক্ষকে সচেতন করে যাচ্ছি। তবে বাস্তবতা হলো, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে নিরুপায়।’
ইউসেপ বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন প্রায় ৩৫ বছর ধরে চট্টগ্রামে শ্রমজীবী শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। তারা শিশুদের কাজের ফাঁকে লেখাপড়া ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছে।
ইউসেপ বাংলাদেশের সহকারী প্রোগ্রাম কর্মকর্তা দেবাশীষ সেন বলেন, ‘আমাদের ১০টি জেনারেল স্কুল ও দুটি টেকনিক্যাল স্কুলে ১০ হাজারের বেশি শিশু আছে। তারা কাজের ফাঁকে পালা করে এখানে পড়ছে।’ তিনি বলেন, শিশুরা অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে কাজে আসছে। দেবাশীষ সেনের মতে, চট্টগ্রামে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজার।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাহাড়তলী থানাসংলগ্ন পুরোনো জাহাজের সরঞ্জাম বিক্রির দোকানগুলোতে অন্তত ৫০টি শিশু কাজ করছে। শিশুদের প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে টানা আট-নয় ঘণ্টা কাজ করতে হয়।
রঙ্গাজীব নামের একটি শিশু বলল, ‘আমার বাবা অসুস্থ। মা বাসাবাড়িতে কাজ করে। তাতে চলে না। তাই এখানে কাজ করছি।’

No comments

Powered by Blogger.