বিদেশে চাকরি দেয়ার নামে ভয়ঙ্কর প্রতারণা by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

বিদেশে চাকরি দেয়ার নামে রাজধানীতে চলছে ভয়ঙ্কর প্রতারণা। নিজেদের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্রটি। বাংলাদেশ থেকে কানাডাসহ ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসনের নামে তারা এসব প্রতারাণা করছে। মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে তারা সহজ সরল সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলছে। বিভিন্ন কৌশলে তারা রাজধানীর বিভিন্ন অলি-গলিতে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন নিরীহ জনগণ। এসব প্রতিষ্ঠানের রিক্রুটিং লাইসেন্সও নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা বেআইনি। সরকারকে এখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
চক্রটি টার্গেট গ্রুপ হিসেবে বেছে নিয়েছে দেশের পেশাজীবীদের। বিশেষ করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং বিবিএ, এমবিএ করা ব্যক্তি তাদের মূল লক্ষ্য। বিভিন্ন কৌশলে প্রতারক চক্রটি পেশাজীবীদেরকে তাদের নেটওয়ার্কে নিচ্ছে। এসব পেশাজীবীদের কানাডায় বসবাসে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দিচ্ছে প্রতারকরা। প্রতারক গ্রুপ ৭ থেকে ৮ লাখ টাকায় কানাডাতে গোটা পরিবারকে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। বলছে, টাকা থাকলে ইংরেজিতে কথা বলার অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টেস্টি সিস্টেম (আইইএলটিএস) প্রয়োজন নেই। শুধু কাগজপত্র দিলেই চলবে। পরিচিত হওয়ার পর পরই চক্রটি দ্রুত টাকা হাত করার ধান্ধায় নেমে পড়ে। ফোনের পর ফোন দিতে থাকে টার্গেট ব্যক্তিকে। কাজ উদ্ধার হলেই আস্তে করে ছিটকে পড়ে। একপর্যায়ে প্রতারণার শিকার ব্যক্তির ফোনও রিসিভ করে না তারা। গ্রুপটি একেক সময় একেক ধরনের ফোন নম্বর ব্যবহার করে। এ চক্রটি কানাডার নাম ব্যবহার করে কিছু ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কথা তাদের কাগজপত্রে উল্লেখ করে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করছে অদৌ ওই সব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই নেই সেদেশে- বললেন, প্রতারণার শিকার পেশাজীবীরা। দ্রুত পাঠানোর নাম কর সুকৌশলে টাকা আদায় করছে প্রতারকরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এসব পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রায়ই বন্ধ থাকে। ফোনে ফোনে মক্কেল ধরে নিয়ে আসে অফিসে। পাশের অফিসের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর পান্থপথস্থ ৬৯/সি অফিসটি এক বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। আর এই অফিস থেকে এরকম প্রতারণা করা হতো বলে প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
কেইস স্টাডি: ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রতারণার শিকার হন ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. রফিক আহম্মেদ। রাজধানীর পান্থপথস্থ ৬৯/সি (চতুর্থ তলায়) কালকুলাস গ্রুপ নামের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্বারা তিনি প্রতারিত হন। এই চিকিৎসক তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেন বলে ডা. রফিক উল্লেখ করেন। তিনি জানান, প্রতারকরা তাকে কানাডার একটি হাসপাতালে গবেষণা পদে লোভনীয় চাকরিসহ তার পরিবারকে অভিবাসনের নামে ৮ লাখ টাকা দাবি করে। তাদের কথায় সরল মনে বিশ্বাস করে তিনি ও তার স্ত্রী এই টাকা দিতে রাজিও হন। ওই বছরের ৪ এপ্রিলে ওই গ্রুপের ব্যাংক হিসাব নম্বরে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে প্রথম কিস্তির ৭৫ হাজার ৯৩০ টাকা পরিশোধও করেন। এরপর বাকি টাকা দ্রুত পরিশোধ করার তাগাদাও দিতে থাকে। গ্রুপের প্রতিনিধিরা মুঠোফোনে বলেন, আপনার কাগজপত্র চলে এসেছে। টাকা পরিশোধ করে কাগজপত্র নিয়ে যান। এতো দ্রুত কাগজপত্র চলে আসার কথা বলায় চিকিৎসকের সন্দেহ তৈরি হয়। ওই মাসের ১৬ তারিখে চিকিৎসক তার স্ত্রীসহ গ্রুপটির প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করেন এবং কাগজপত্র হাতে নেন। তা পান্থপথের অফিসে নয়। কাওরান বাজারের একটি ভবনে। কোম্পানির দেয়া কাগজপত্রের একটি ফটোকপি চিকিৎসক কানাডায় বসবাসরত দুই বন্ধুর কাছে পাঠান। তারাও পেশায় চিকিৎসক। ২০ বছরের অধিক সময় ধরে সেখানে আছেন। পরে তার বন্ধুরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন কাগজে উল্লিখিত হাসপাতালের অস্তিত্ব কানাডায় নেই। অর্থাৎ কাগজপত্র ভুয়া বলে রফিক আহম্মেদ জানতে পারেন। এরপর বিষয়টি কালকুলাস গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন (বিনিআমিন) কে জানান এই চিকিৎসক।  তার দেয়া ৭৫ হাজার ৯৩০ টাকা ফেরত চান। এরপর থেকে চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন ওই চিকিৎসকের ফোন রিসিভ করছেন না বলে অভিযোগ করেন রফিক আহম্মেদ।
একইভাবে প্রতিষ্ঠানটির দ্বারা প্রতারণার শিকার হন আজাদ নামে আরেক ব্যক্তি। তাকেও কানাডায় প্যাকেজিং সেক্টরে ভাল চাকরি দেয়ার প্রলোভন দিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেন। পরে তার ৫০ হাজার টাকা ফেরত দেন। আজাদ জানান, তার কাছে প্রাতারকের একাধিক নম্বর রয়েছে। কিন্তু কখনও বন্ধ থাকে বা খোলা থাকলে ফোন রিসিভ করে না।
এ বিষয়ে চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার ০১৭১-৫৯৩০৪৭০, ০১৮৩-৯৬০৪৫৮৯, ০১৬৭-৩৬৬৮৭০৭, ০১৮৩-৯৬০৪৫৮৫ মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে সব ফোনই বন্ধ পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন: বিদেশে চাকরির কথা বলে এভাবে প্রতারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র (বিএমইটি) মহাপরিচালক বেগম শামছুন নাহার বলেন, এরকম অভিযোগ তাদের কাছেও আসে। কিন্তু তাদের কিছু করার থাকে না। কারণ, যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তারা একটিও রিক্রুটিং এজেন্সি হিসেবে লাইসেইন্সধারী নয়। আর দেশে আইন অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া এ ধরনের কাজ করা বেআইনি।

No comments

Powered by Blogger.