যেখানে রক্তের গ্রুপ নেই by সাজেদুল হক

ইংল্যান্ডকে হারিয়ে উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা
পূরণ হলো কোয়ার্টার ফাইনালের স্বপ্ন। রুবেল–মাহমুদউল্লাহ–মাশরাফিদের
বাঁধনহারা উদ্‌যাপন! কাল অ্যাডিলেডে ছবি: এএফপি
দু’মাসের অচলাবস্থা। হরতাল-অবরোধ। পেট্রলবোমা-গুলি। ভাল নেই মানুষ। প্রতি মুহূর্ত তাদের কাটছে অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায়। এমনই এক ঘোর অন্ধকার সময়ে এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ। পেসার রুবেল হোসেন তার বিখ্যাত ইয়র্কারে উড়িয়ে দিলেন অ্যান্ডারসনের স্ট্যাম্প। বিশ্বকাপের অ্যালবামে ঠাঁই পাওয়ার মতো এক ছবি। মাঠে আনন্দে উদ্বেল মাশরাফিরা। তাদের সঙ্গী ১৬ কোটি মানুষ। এখানে কোন ভেদ নেই, রক্তের গ্রুপ নেই, আওয়ামী লীগ নেই, বিএনপি নেই। ধর্ম-বর্ণ আর শ্রেণিরও কোন সঙ্কট নেই। সবাই এক কাতারে। সবাই ঐক্যবদ্ধ। সবাই একদল। ম্যাচের শুরু থেকেই মাইকেল আথারটন- রমিজ রাজার মতো সাবেক তারকারা বলছিলেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ এটি। ম্যাচ শেষে তা আসলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ম্যাচই হয়ে রইলো। যে ইতিহাসের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯ বছর আগে মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠে। আকরাম খান- মোহাম্মদ রফিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল স্বপ্নযাত্রার। এরপর দুনিয়াব্যাপী আমরা পরিচিতি পেয়েছি ক্রিকেটপাগল জাতি হিসেবে। মাঠে এমন ক্রিকেট উন্মাদনা পৃথিবী নামক গ্রহের আর কোথায়ই বা দেখা যায়। টিভি টক শো থেকে রাজনীতির মাঠ সবখানে বাংলাদেশ দু’ভাগে বিভক্ত থাকলেও একমাত্র ক্রিকেটের ব্যাপারেই সবাই একমত। এমনকি বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য কয়েকদিন আগে এমনটাও বলেছিলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ জিতলে অবরোধ উঠে যাবে। তারাই আমাদের সঙ্কটের সমাধান করবে।
মাঠে ক্রিকেটারদের নৈপুণ্য সবসময় এক রকম ছিল না। প্রত্যাশার বেশিরভাগই হয়তো পূরণ হয়নি। তবুও মাঝে মাঝেই ক্রিকেট আমাদের আনন্দে উদ্বেল করেছে। এ জাতির আনন্দক্ষণ যা কিছু মুহূর্ত তা ক্রিকেটই উপহার দিয়েছে। ক্রিকেট আমাদের কাঁদিয়েছেও কম নয়। গতকালের অ্যাডিলেডের কথাই ধরুন না কেন। পুরো গ্যালারিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাল সবুজ। ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠছে ‘রক্ত লাল, রক্ত লাল।’ ক্ষণে আশা, ক্ষণে হতাশা। শুরুতে দু’উইকেট নেই। পরে মাহমুদ উল্লাহ-মুশফিকের রাজসিক ব্যাটিং। ইংল্যান্ডের ব্যাটিং এগুচ্ছিলো মসৃণপথেই। কিন্তু দিনটি যে ছিল টাইগারদের। মাশরাফি-রুবেল-তাসকিনদের গর্জন। বাটলার ম্যাচটি বের করেই নিয়ে যাচ্ছিলেন। রুবেলের জোড়া আঘাত ঐতিহাসিক এক জয় এনে দিলো রক্তাক্ত মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। অভিশপ্ত এক জীবন থেকে বাঁচিয়ে দিলো তামিম ইকবালকে। না হয় শেষ মুহূর্তে ক্যাচ মিসের যন্ত্রণা সারা জীবনই তাড়িয়ে বেড়াতো তাকে। মাশরাফি এ জয় উৎসর্গ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। স্মরণ করেছেন বাংলাদেশের মানুষের কথা।
ক্রিকেট সব সময় নিছক একটি খেলা নয়। মাঠের বৃত্ত পেরিয়ে কখনও কখনও ক্রিকেট পরিণত হয় জীবনের প্রতিচ্ছবিতে। যেখানে বিজয় পথ দেখায় একটি জাতিকে। কালকের ঐতিহাসিক বিজয় যেমন একসূতোয় গেঁথেছে পুরো বাংলাদেশকে। এখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ক্রিকেট বিজয়ের মিছিলে যে ছেলেটি শরিক হয়েছে তার কোন রাজনীতি নেই। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠেই সে মিছিলে শরিক হতে পেরেছে ছেলেটি। বাংলাদেশের আকাশ আজ অন্ধকারে ঢাকা। এই অন্ধকার কাটাতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কোন আগ্রহ নেই। এমন একটি সময়ে আমাদের হৃদয়কে রাঙিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। প্রাণ খুলে হাসি আর আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছে। অভিবাদন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে।

No comments

Powered by Blogger.