‘ধরে দিবানে’ই তো সত্য হলো by আনিসুল হক

ইংল্যান্ডকে হারিয়ে উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা
বাংলাদেশ দলের বিজয়ে ঢাবির টিএসসি এলাকায় শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস
সামনে যে পড়বে তাকেই ধরে দিবানে—মাসিক কিশোর আলোর খুদে সাংবাদিকদের হাসতে হাসতে বলেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি, অস্ট্রেলিয়া-যাত্রার ঠিক আগে আগে। প্রশ্ন ছিল, ‘২০০৭ সালে বলেছিলেন, ভারতকে ধরে দিবানে, ২০১৫ সালে কোন কোন দলকে ধরে দেওয়ার ইচ্ছা আছে?’ সেই প্রশ্নের জবাবে এই ছিল বাংলাদেশ অধিনায়কের সহাস্য জবাব। জবাবটা যে এবার তাঁরা ব্যাট আর বলের মাধ্যমেই দিলেন। ৯ মার্চ ২০১৫ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে ইতিহাস রচিত হলো, ক্রিকেটের জন্মদাত্রী দেশটি বিশ্বকাপ থেকে ফিরে যাওয়ার টিকিট পেয়ে গেল বাংলাদেশের হাত থেকে।
১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় অরণ্যে রোদন কলামে লিখেছিলাম, ‘চলো বাংলাদেশ, বিশ্বজুড়ে, বিশ্বকাপে’ শীর্ষক লেখা। জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি, ভালোবাসি আমাদের ক্রিকেটকে, লিখেছিলাম, বাংলাদেশ চির অপরাজেয় জাতি, কত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভালো করছে মানব উন্নয়ন সূচকের কত ক্ষেত্রে! আজকে ক্রিকেটের এই বিজয় আমাদের সেই আত্মবিশ্বাসকেই নতুনভাবে শাণিত করবে। কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছার লক্ষ্য ঘোষণা করেই মাশরাফিরা পাড়ি দিয়েছিলেন প্রশান্ত মহাসাগর। লক্ষ্য অর্জন সহজ ছিল না। আফগানিস্তানও শক্ত প্রতিপক্ষ, স্কটল্যান্ডও সহজ নয়। ওই দুটো দলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ খেলেছে বড় দলের মতোই, রাজসিক ভঙ্গিতে। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে? এ যে বলে-কয়ে জয়! কাজটা কঠিন ছিল। তা আরও কঠিন করে তোলে কাল সকালে অ্যাডিলেডের বৃষ্টি, প্রথমে ব্যাট করতে নামলে দ্রুত উইকেট পতনের আশঙ্কা। আমাদের দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নিলে ঘরপোড়া আমরা মেঘে সিঁদুর দেখতে শুরু করেছিলাম। তখন মাহমুদউল্লাহ আর সৌম্য সরকার এসে হাল ধরলেন। রানরেট আর উইকেট কোনোটাই পড়তে না দিয়ে ব্যাট করে গেলেন তাঁরা। সৌম্যর পরে সাকিব আল হাসানের বিদায় একই কায়দায়। এবার বুক চিতে দাঁড়ালেন আস্থার প্রতীক মুশফিকুর রহিম। মাহমুদউল্লাহ আমাদের আনসাং হিরো, প্রায় প্রত্যেক ম্যাচেই রান পান, দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ব্যাট হাতে, কিন্তু বিজয়ের পর তাঁকে কাঁধে তুলে উল্লাস করার উপলক্ষ সব সময় আসে না। এবার তিনি তা-ই করলেন, বিশ্বকাপে লাল-সবুজের প্রথম শতকটি তাঁর, আর তা করলেন কোন ম্যাচে? বাংলাদেশ আর ইংল্যান্ডের জন্য যা ছিল অঘোষিত ফাইনাল।
২৭৫ ভালো স্কোর, কিন্তু কতটা নির্ভরযোগ্য! ইংল্যান্ডের উইকেট পড়ছে না, পেসাররা মার খাচ্ছেন, একটা মাত্র রানআউট। এই সময় আঘাত হানলেন তিনি—যাঁর পা সবচেয়ে বেশিবার চিকিৎসকের ছুরিতে কাটাছেঁড়া হওয়ার পরও খেলে যাচ্ছেন, অধিনায়ক মাশরাফি। কিশোর আলোর ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সংখ্যার সাক্ষাৎকারটিতে যিনি বলেছিলেন, ‘জীবনে সব সময় ভালো-খারাপ দুইটাই আসবে। খারাপ সময়ে হতাশ না হয়ে ওটাকে কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, তা চিন্তা করতে হবে। সেভাবে কাজ করাটাই ভালো।’ মাশরাফি সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেন, ঠিক সময়ে বোলার বদলেছেন, আর তাঁর সহখেলোয়াড়েরাও তাঁর আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন ঠিকঠাক। প্রয়োজনের সময়ে উইকেট পেয়েছেন তাসকিন। আর রুবেল? দুই জোড়া আঘাতে যিনি ভেঙে দিয়েছেন ক্রিকেট কৌলীন্যের অহংকার, যা বিশ্বকাপে কেবল কুলীনেরা খেলবে—এই আবদারকে ধরাশায়ী করেছে এবং বাংলাদেশের ক্রিকেট সামর্থ্য নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছে তাদের ‘থোঁতা মুখ ভোঁতা’ করে দিয়েছে।
আহা! অস্ট্রেলিয়ার গ্যালারিতে যে প্রবাসীরা লাল-সবুজের তরঙ্গ তুলেছিলেন, তাঁদের জন্য এটা চিরজীবনের আনন্দস্মৃতি হয়ে রইবে। শুধু কি অস্ট্রেলিয়া, পৃথিবীর যে ২১০টা দেশে বা অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশিরা, সেখানেই এই জয়ের মুহূর্তটি এসেছে বাঁধভাঙা আনন্দের উপলক্ষ হয়ে। শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু এখন কানাডায়, ফেসবুকে আমাকে লিখেছেন, আনিস ভাই, আমার কাঁদতে ইচ্ছা করছে। আমি বলেছি, কাঁদেন। এই ইংল্যান্ডকেই ২০১১ বিশ্বকাপে হারানোর পরে লিখেছিলাম, দেশের জন্য কান্নাতেও সুখ। আজ সত্যি আনন্দে আমরা একবার হাসছি, একবার চোখ মুছছি। বাংলাদেশ দল হিসেবেই এবার বেশ পরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছে। কালকের খেলাতেও তারা জিতেছে দল হিসেবেই। চাপে ভেঙে পড়ছে না, দুঃসময় থেকে দলকে টেনে তুলছে সুসময়ের দিকে! এবং বাংলাদেশ ফাস্ট বল করতে শিখেছে, খেলতেও শিখেছে। এই দলের তো এর পরেও ভালো করার কথা! চলো বাংলাদেশ, পরের ম্যাচগুলোতেও ভালো খেলে চলো, ভালো করো, ১৬ কোটি হৃদয়ের এই শুভকামনা তোমাদের জানিয়ে রাখি। অভিনন্দন, টিম বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.