জীবন যেভাবে বদলে যায় by হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী

[নিজের ও পরিজনের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা অপরাধীদের ধরতে সাহায্য করলেন, আইনের চোখে তারাই হয়ে গেলেন আসামি! তবে আইন চোখ বন্ধ করে রাখলেও মিডিয়া রাখেনি। তিন সাংবাদিকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো সত্য। মুক্তি পেলেন তিন বিমানকর্মী। কিন্তু তত দিনে যা ঘটে গেছে, তা রূপকথাকেও হার মানায়। তাদের জীবনটাই তখন বদলে গেছে। বিদেশী সাময়িকী অবলম্বনে লিখেছেন হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী]
অপরাধ দমনের জন্য একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যত ব্যবস্থা থাকে, তেমনটি আর কোথাও খুব বেশি দেখা যায় না। এখানে থাকে অনেক ভিডিও ক্যামেরা, নিরাপত্তাকর্মী এবং স্ক্যানার। এ ছাড়া প্রত্যেক যাত্রীর নাম তালিকাভুক্ত থাকে। প্রত্যেক পাইলটকে স্ক্যান করে তবেই বিমানবন্দরে ঢুকতে দেয়া হয়। এমনকি নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীদেরও নিরাপত্তা তল্লাশির পরই ঢুকতে দেয়া হয়। সব মিলিয়ে এমন কড়াকড়ি, কেউ যে ট্যাঁ ফো করবে, তার উপায় নেই।
এরকম অবস্থা সারা বিশ্বের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেরই। ভেনিজুয়েলার তৃতীয় বৃহত্তম শহর ভ্যালেনসিয়ার আর্তুরো সিচেলেনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও বলিভারিয়ান ন্যাশনাল গার্ডের কম্যান্ডো-২৪ এর প্রহরীরা সর্বক্ষণ টহল দিয়ে চলেছে। যখন যাকে খুশি থামাচ্ছে, তল্লাশি করছে, তল্লাশির নামে বেফজুল হয়রানিও করছে। এ নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের অন্ত নেই।
নিরাপত্তার নামে এসব কড়াকড়ি-বাড়াবাড়ি নিয়ে যার যত অভিযোগই থাকুক, একে তাচ্ছিল্য করতে পারেন একজনই; তিনি কার্ল লুকার্ট। কারণ সব কড়াকড়ির মধ্যেও এমন ঘটনা ঘটেছিল, যা তার জীবনকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। কিভাবে? জানতে হলে আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই।
২০১২ সালের আগস্ট মাসের কোনো এক দিনে একটি প্রাইভেট জেট বিমান চালিয়ে আর্তুরো মিচেলেনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসেছিলেন লুকার্ট। এ ধরনের বিমান ভাড়া করেন সাধারণত কোনো কোম্পানির সিইও, তারকা কিংবা ধনপতিরা। পাইলট লুকার্ট ভেবেছিলেন, আর্তুরো বিমানবন্দরে তার যাত্রাবিরতিটা হবে সংক্ষিপ্ত। কিন্তু মানুষ যা ভাবে, তা কি আর হয়? ‘স্বাভাবিকভাবে’ এ ক্ষেত্রেও হলো একেবারে বিপরীত। এবং বৈপরীত্যটা এমন যে, লুকার্টের সামনে তখন দু’টি বিকল্প রইল এক. মৃত্যু, দুই. মাদক বহনকারী হওয়া।
এটা ঘটল এভাবে আগস্টের সেই রাতে পাইলট লুকার্ট হঠাৎ দেখলেন তার বিমানের দিকে মেশিনগানের ব্যারেল তাক করে এগিয়ে আসছে ন্যাশনাল গার্ডের একদল সৈন্য। তিনি চেঁচিয়ে জানালেন, ‘নো! নো ব্যাগেজ!’ কিন্তু কে শোনে কার কথা! লুকার্ট দেখলেন, ওরা একে একে ৪৭টি প্লাস্টিক ব্যাগ তার জেট বিমানে ঠেসে দিলো। এসব ব্যাগভর্তি মাদক।
সুন্দরী ও গোপন কথা
কার্ল লুকার্ট যে বাণিজ্যিক বিমানটি চালান, তুষারধবল সেই বিমানটি ১৯ জন আরোহী বহন করতে পারে, আর কোথাও না থেমে একনাগাড়ে উড়তে পারে সাত হাজার মাইল। পাইলট লুকার্ট মজা করে বলেন, ‘আরে আমি তো ট্যাক্সিক্যাব চালাই। ট্যাক্সিক্যাব রাস্তায় চলে, আর আমারটা আকাশেএই যা তফাৎ।’
কথাটা পুরোপুরি অসত্য যে, তাও নয়। আগেই বলেছি, সিইও, তারকা বা ধনাঢ্য মানুষেরাই নিজেদের প্রয়োজনে এ ধরনের বিমান ভাড়া করেন। সেদিনও একটি চার্টার কোম্পানির কাছ থেকে বিমানটি ভাড়া নিয়েছিল বৈরুতের প্রিন্সেস অ্যাভিয়েশন। কথা ছিল মরক্কো থেকে ছেড়ে বিমানটি ত্রিনিদাদ-টোব্যাগো হয়ে ভেনেজুয়েলা যাবে। সেখানে যাত্রাবিরতি শেষে আফ্রিকার বেনিনে।
সেদিন বিমানটিতে যাত্রী ছিলেন একজন রাইমা তাউক। ৩৭ বছর বয়সী এই নারী খুবই আকর্ষণীয়া, খোলামেলা, বন্ধুভাবাপন্ন ও চমৎকার পোশাক পরিহিতা। বিমানে ওঠার আগে পাইলট লুকার্টের সাথে তার নিয়মমাফিক কিছু কথাবার্তা হয়। লুকার্ট জানলেন, মহিলা একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। এ কাজে অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। বৈরুত, দুবাই ও সিডনিতে তার অফিস আছে।
বিমানে উঠেও পাইলটের সাথে অনেক কথা বললেন রাইমা। বৈরুতের জীবন, ভেনেজুয়েলায় তার বন্ধুর অপেক্ষা ইত্যাদি। বিমানের তরুণ স্টুয়ার্ডসদেরও অনেক সময় দিলেন তিনি।
নিরাপদ অবতরণ
প্রথম গোলটি বাধল বিমানটি টোবাগোর একটি দ্বীপে ল্যান্ড করার পর। রাইমা চান তিনি ওই রাতটা হিলটন হোটেলে কাটাবেন। কিন্তু হিলটন হোটেল তো পাশের ত্রিনিদাদে। ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোর মাঝখানে যে সাগরের বিপুল জলরাশি! বিষয়টা জানা ছিল না রাইমার। তা ছাড়া ওই দেশে ঢোকার এন্ট্রি ভিসাও ছিল না তার। কিন্তু এসব তো আইনের অসুবিধা, পকেটে মালকড়ি থাকলে দুনিয়ার সব অসুবিধারই ‘সুবিধা’ হয়ে যেতে সময় লাগে না। কাজে কাজেই পাইলট লুকার্ট কোরাল রিফ হোটেলে রাইমার থাকার ব্যবস্থা করে ফেললেন। হোটেল থেকে রোলস রয়েস গাড়ি এসে তাকে নিয়ে গেল।
পরদিন সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের সময় ভেনিজুয়েলার উদ্দেশে উড়াল দিলো লুকার্টের বিমান। ওখান থেকে ৯০ মিনিট লাগবে ভেনিজুয়েলা যেতে। বিমান চলাকালে ককপিটে এলেন রাইমা। স্যাটেলাইট ফোনে কার সাথে যেন কথা বললেন। তবে কী বললেন কিছুই বুঝলেন না পাইলট। কারণ কথা হলো আরবিতে। তবে রাইমাকে বেশ খুশি খুশি মনে হলো।
ভেনিজুয়েলা এসে বিমান নিরাপদে অবতরণ করল। রাইমা নেমে হোটেলের উদ্দেশে চলে গেলেন। জ্বালানি তেল ভরতে হবে বলে বিমানে রয়ে গেলেন লুকার্ট। বিমানে তেল ভরা হচ্ছে, এ সময় তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, ইউনিফর্ম পরা বেশ কিছু লোক বিমানটি ঘিরে রেখেছে। তেল ভরা শেষ হলে বিমানটিকে ওই রাতের জন্য পার্কিং স্পটে নিয়ে গেলেন লুকার্ট। সেখানকার কর্মীরা তাকে বললেন বিমানটিকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে রাখতে। লুকার্ট অবাক, ব্যাপারটা কী! এরকম অনুরোধ তো করার কথা নয় (অনেক পরে অবশ্য তিনি এর কারণ ধরতে সমর্থ হন। এর অর্থ হলো, বিমানের কার্গো দরজাটিকে বিমানবন্দরের বাতি ও নজরদারি ক্যামেরার আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া)!
এর একটু পরই বিমানবন্দরের এক কর্মী এসে লুকার্টের হাতে একটি মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিলো। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে একজনের গলা, যার সারমর্ম হলো, বিমানের দরজা খোলা রেখে লুকার্ট ও তার কর্মীদের ওই রাতে এক হোটেলে চলে যেতে হবে। হোটেলে পৌঁছে দেয়ার জন্য গাড়ি বাইরে অপেক্ষা করছে।
লুকার্ট রাজি হন না। এটা কি সম্ভব? তা ছাড়া বিমানের ক্রুরাও হোটেলে যেতে নারাজ। কেননা বিমান ছাড়ার শিডিউল খুব ভোরে। হোটেলে গেলে সেখান থেকে আসতেই সময় পেরিয়ে যাবে। বিমানে থাকলে সেই সময়টা তো ঘুমানো যাবে। তার চেয়েও বড় কথা, বিমানে তালা না লাগিয়ে রেখে যাওয়া সিকিউরিটি প্রটোকলের লঙ্ঘন। এমন বেআইনি কাজ লুকার্ট করতেই পারেন না। টেলিফোনকারীকে এসব যুক্তি দেখিয়ে লাইন কেটে দেয়ার একটু পর এলো রাইমার ফোন। তারও একই কথা, ‘রাতটা হোটেলে কাটাও। ভালো হবে।’ মহাবিরক্ত হলেন লুকার্ট।
‘আমরা একেবারে অসহায়’
এরপর সবাই বিছানায় চলে গেলেন, কিন্তু নানা চিন্তা ও দুশ্চিন্তায় ঘুম আর আসে না। এলেও একটু পর ভেঙে যায়। রাত ২টার দিকে দরজায় ঠক ঠক শব্দ শোনা গেল; বেশ ক’বার। উঁকি দিতেই দেখা গেল মোবাইল ফোন হাতে দাঁড়িয়ে এক লোক। কাকে যেন বলছে, ‘সব কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বিমানে তুলতে হবে।’
লুকার্ট কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিনেমার দৃশ্যের মতো ঘটনাগুলো ঘটে যেতে লাগল। ঘোর কালো রঙের দুটো গাড়ি চলে এলো। সেখান থেকে নেমে একদল অস্ত্রধারী খুলে ফেলল বিমানের কার্গো দরজা। ‘এসব কী হচ্ছে, বন্ধ করো এসব!’ চেঁচালেন লুকার্ট। জবাবে তার দিকে উদ্যত হলো অস্ত্র। এরপর প্লাস্টিকের সাদা প্যাকেটে ভরে যেতে লাগল বিমান। প্রত্যেক প্যাকেটের গায়ে লেখা ‘রেড ক্রস’। সাদা প্যাকেটগুলো দেখে লুকার্টের মনে হলো যেন ‘তুষারধস হয়েছে। কিন্তু আমরা ছিলাম একেবারেই অসহায়’।
পুরো ‘কাজ’টি সারতে লাগল ২০ মিনিটের মতো। মোট ৪৭টি প্যাকেট উঠল বিমানে। কার্গো বে, যাত্রীদের আসন এবং মাঝখানের চলার পথ সবখানেই ছড়িয়ে আছে এসব প্যাকেট। পুরো সময়টায় সাত-আটজন অস্ত্রধারী দাঁড়িয়েছিল বিমানের সামনে। চোখের সামনে এসব দেখতে দেখতে লুকার্ট ও তার সহকর্মীরা বুঝে গেলেন, তাদের ডাকে কেউ আসবে না। পুরো বিমানবন্দরই এতে জড়িত। আর পুলিশকে খবর দেয়ারও উপায় ছিল না।
‘কাজ’ সেরে অন্ধকারের প্রাণীরা ফের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। লুকার্ট ফোন করলেন সুইজারল্যান্ডে; বিমানটি চার্টার করেছে যে কোম্পানি তার সিইও এরিক ওয়েইজকফকে। সব জানিয়ে তাকে বললেন, ‘আমাদের আসলে কিছুই করার ছিল না।’ লুকার্ট যখন কথা বলছিলেন, তখন দরজায় আবার টোকা। লুকার্ট তার কো-পাইলটকে পাঠালেন কী ব্যাপার দেখতে। কো-পাইলট ফিরে এলে দেখা গেল, আতঙ্কে তার মুখ রক্তশূন্য। তিনি জানালেন ‘লোকটি বলে গেছে, আমরা যদি এখনই বিমানটি ওড়াই, তাহলে আমাদের ওরা খুন করবে।’ রিয়ার উইন্ডো দিয়ে লুকার্ট দেখলেন, হাল্কা মেশিনগান নিয়ে বিমানের পাখার নিচে দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্রধারীরা।
লুকার্ট ভাবতে বসলেন কী করা যায়। এই বিমানবন্দরটি রাতে বন্ধ থাকে। মধ্যরাতের পর থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত এখানে কোনো বিমান ওঠানামা করে না। লুকার্ট চেষ্টা করলেন টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু কেউ ফোন ধরে না। লুকার্ট এবার ভাবলেন, এত বস্তা যে ভরা হয়েছে, বিমান কি এর ভার বইতে পারবে? তিনি ছোট একটা পরীক্ষা করলেন। দেখা গেল, ঠিক আছে। ওরা ঠিকই জানে, এই বিমান কতটা ভার বহনে সক্ষম।
শত্রু যখন অন্দরে
পরদিন সকালে বিমানটি আকাশে ডানা মেলল। মিনিট দশেক উড়তে-না-উড়তেই স্যাট-ফোনে কল এলো। এক ব্যক্তি ইংরেজিতে বলল, ‘যেখানে যেতে বলা হয়েছে বিমান যেন ঠিক ঠিক সেখানে যায়। তাহলেই তোমরা জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে। কথাটা মনে থাকে যেন।’ দেখা গেল, ওরা শুধু পাইলট ও ক্রুদের স্যাট ফোন নাম্বার জানে তা নয়, তাদের দেশ কোনটি, তাদের ঠিকানা এবং আরো অনেক কিছু জানে।
এ দিকে সুইজারল্যান্ডে বিমানটির চার্টার কোম্পানির সদর দফতরে ততক্ষণে তুলকালাম শুরু হয়ে গেছে। নানা মুনি নানা মত দিচ্ছে। এর কারণও অবশ্য আছে। ২০০৪ সালে কারাকাসে এয়ার লুক্সরের একটি ফ্লাইট থেকে বিপুল মাদক উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় বিমানটি বাজেয়াপ্ত করা হয়, পাইলট ও কো-পাইলট দু’জনকেই দীর্ঘ কারাবাস করতে হয়। ঘটনাটি মনে করে আঁৎকে ওঠেন কোম্পানির সিইও এরিক। বিমানটি বাজেয়াপ্ত হলে কী হবে, ওটি তো তার কোম্পানির নয়, এক জার্মান ব্যবসায়ীর।
তবে বিমানের পাইলট লুকার্টের প্রতি কোম্পানির ‘৯৯ ভাগ’ আস্থা রয়েছে। বাকি এক ভাগ হলো সন্দেহ যে, আসলেই তো লুকার্ট এই অপকর্মে জড়িত থাকতেও পারে!
শনিবার পেরিয়ে রোববার এলো। কিন্তু এরিক এমন কাউকে পেলেন না যে, এই বিপদে তাকে একটুখানি সাহায্য করতে পারে। গুগল ঘেঁটে তিনি এবার ইন্টারপোলের নাম্বার জোগাড় করলেন। কথাও হলো এক অফিসারের সাথে। মাদক পাচারের তথ্য জানানোর জন্য অফিসার তাকে ধন্যবাদও দিলেন। ব্যস, ওই পর্যন্তই। তারপর তার আর কোনো খোঁজ নেই।
অন্য দিকে লুকার্টের বিমানের স্যাট-ফোনটি ক্রমাগত বেজেই চলেছে। ধরতেই এক ব্যক্তি জানতে চাইল, বিমানটি এখন ঠিক কোথায় আছে। প্রশ্ন শুনে ক্রুরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাদের ধারণা ছিল, গ্রাউন্ড থেকেই বুঝি তাদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। সর্বশেষ ফোনকলে নিশ্চিত হওয়া গেল, তা নয়।
তবে ক্রুরা তখনো নিশ্চিত ছিল না, আসলে প্লাস্টিকের ভেতরে কী রয়েছে। তারা খুলে দেখতেও ভয় পাচ্ছিল, যদি ওতে বোমা থাকে! আর যদি বিস্ফোরক থাকে এবং জিপিএস ট্র্যাকারের সাহায্যে ওরা দেখতে পায় যে, আমরা ওদের দেখানো পথে চলছি না, তাহলে বিমানটি যদি উড়িয়ে দেয়!
এর মধ্যে লুকার্টের ফোনে রাইমার কল এলো। সে খুব দুঃখ প্রকাশ করল। বারবার ‘সরি!’ বলে জানাল যে, যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কাজ কিন্তু সেভাবে এগোচ্ছে না। এ দিকে লুকার্ট তো রেগে আগুন। সে ফোনে যা-তা বলল রাইমাকে। বলল, তুমি আমাদের সবাইকে মারতে বসেছ। রাইমা সব শুনেও শান্ত গলায় বলল, তোমাদের যেভাবে বলা হয়েছে, তা-ই করো। বেনিন যাও। সেখানে আমি তোমাদের জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা করব। মাল খালাস করেই তোমরা নিরাপদে ইউরোপের দিকে চলে যেতে পারবে।
ওরা রাইমার সব কথা শুনল, তবে এক বর্ণও বিশ্বাস করল না। বরং লুকার্ট ও তার কো-পাইলট ঠিক করল, বিমানটিকে তারা কিছুতেই আফ্রিকা (বেনিন) নিয়ে যাবে না। তবে হ্যাঁ, তার আগে নিজ নিজ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। দু’জনই পরিবারে ফোন করে নিরাপদ কোনো জায়গায় সরে যেতে বলল।
বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট
এ দিকে চার্টার কোম্পানির সুইজারল্যান্ড সদর দফতরে ফোন এলো ইন্টারপোলের। তাদের তদন্তকারীরা ভেনিজুয়েলায় খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে, একটি বিমান চুরি হয়েছে। ইন্টারপোল আরো বলল, বিমানটি বেনিনে ল্যান্ড করলে অসুবিধা হবে। বিমান বা ক্রু কাউকেই ওই দেশের বাইরে আনা সম্ভব হবে না। তবে ক্রুদের পরিবারের নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ পাঠাল ইন্টারপোল।
কোম্পানির সদর দফতরে তখন আরো কাজ চলছে। বিশেষজ্ঞরা বসে গেছেন হিসাব কষতে যে, ট্যাঙ্কে যে পরিমাণ তেল আছে তা দিয়ে কদ্দুর যাওয়া যাবে। ইউরোপের সব গন্তব্যের মধ্যে নিকটতম হচ্ছে গ্র্যান ক্যানারিয়া দ্বীপ। সেখানে বিমানটিকে অবতরণ করানোর বিষয়ে ইন্টারপোলও একমত হলো। বলল, ক্রুদের নিরাপত্তায় সব রকম ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ দিকে বিমানের ট্রান্সমিটিং লোকেশান ইনফরমেশন বন্ধ করে দিলেন লুকার্ট। এর ফলে বিমানটি তখন কার্যত অদৃশ্য হয়ে গেল। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠে বসে কোনোভাবেই জানা সম্ভব হবে না যে, বিমানটি কোথায়। এরপর পাইলট বিমানটি নিয়ে গেলেন ৪৬ হাজার ফুট উঁচুতে (সাধারণত, যাত্রীবাহী জেট বিমানগুলোই এরকম উচ্চতায় চলাচল করে)। এ অবস্থায় মাদক ব্যবসায়ীরা যখন ফোন করে বিমানের অবস্থান জানতে চাইল, বিমান থেকে জানানো হলো যে, বিমান আফ্রিকার দিকে এগিয়ে চলছে।
এবার ফোনে বলা হলো বারকিনা ফাসো যেতে। আফ্রিকার এই দেশটির বেশ কয়েকটা বিমানবন্দরের নাম বলে জানানো হলো যে, এর যেকোনো একটিতে লুকার্ট যেন তার বিমানটি নামান। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যেসব বিমানবন্দরের নাম বলা হয়েছে, তার বেশির ভাগের মালিকই সেনাবাহিনী। কিন্তু লুকার্টের গ্লোবাল এক্সপ্রেস বিমানটি তো সবখানে নামতে পারে না। এর পাখার দৈর্ঘ্য ৩০ মিটার এবং এটি নিরাপদ অবতরণের জন্য আট শ’ মিটার দীর্ঘ রানওয়ে লাগবে। আর রানওয়ের ভার বহন ক্ষমতা হতে হবে ৪৫ টন।
এ অবস্থায় লুকার্ট আবার তার বস এরিককে ফোন করলেন। বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে কথা বললেন তারা। যেমন, মাদকের প্যাকেটগুলো আটলান্টিকে ফেলে দিলে কেমন হয়? লুকার্ট বললেন,্ এ কাজটি করতে গেলে বিমানটিকে সাগরের যথাসম্ভব কাছাকাছি নামিয়ে ওড়াতে হবে। এতে জ্বালানি খরচ হবে বেশি। তাহলে গ্র্যান ক্যানারিয়া পৌঁছার মতো জ্বালানির ঘাটতি পড়ে যাবে। তা ছাড়া দুই পাইলটের একজনকে কার্গো দরজাটি খুলতে হবে। দরজাটি যেহেতু ইঞ্জিনের খুব কাছে, তাই দরজা খোলার সাথে সাথে প্রবল বায়ুচাপ সৃষ্টি হবে। এটা একটা বড় ঝুঁকি। এতে একজনের প্রাণহানিও ঘটতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, বিমান লাস পামাসে অবতরণের পর কী হবে? পুলিশ যদি বিমানে একটাও মাদকের ব্যাগ না পায়, তাহলে তো তারা আমাদেরই ধরবে যে, তোমরা ওগুলো অন্য কোথাও রেখে এসেছ।
এসব বলতে বলতে কাছে চলে এলো গ্র্যান কানারিয়া বিমানবন্দর। কো-পাইলট এবার স্যাটেলাইট ফোনটি বন্ধ করে দিলেন। আফ্রিকায় পৌঁছার নির্ধারিত সময়সীমার ৪৫ মিনিট আগে বিমানটি লা পামাসের মাটি স্পর্শ করল। স্পেন সরকারকে আগেই সব জানিয়ে রেখেছিল ইন্টারপোল। পুলিশের একটি বিরাট দল অপেক্ষা করছিল। একদল মুখোশধারী পুলিশ কর্মকর্তা বিপুল বিক্রমে বিমানে ঢুকে পড়ল। বিমানের ভেতরে যেন ঝড় বয়ে গেল। এরপর তারা বিমানের পাইলট, কো-পাইলট ও স্টুয়ার্ডসকে ধরে বাইরে নিয়ে এলো। প্রথমে তাদের বিমানবন্দরের সেলে নেয়া হলো। পরে সেখান থেকে পাঠিয়ে দেয়া হলো পামাসের পুলিশ সদর দফতরে।
রাবার প্যাডে শয্যা
একটা সময় এসে তারা বুঝতে পারলেন যে, স্পেনিশ পুলিশ তাদেরকেই মাদক পাচারকারী ভাবছে। এরপর তাদেরকে ভূগর্ভের নির্জন প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হলো। প্রকোষ্ঠের আয়তন ২দ্ধ৪ মিটার। এর সামনের মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত লোহার শিক। দিনের আলো দেখা যায় না। কোনো টয়লেট নেই। বেসমেন্টের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘুমানোর জন্য তারা পেল একটি করে রাবারের প্যাড।
এ দিকে ‘বড় শিকার’ ধরার কৃতিত্বে স্পেনে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগল। পত্রিকায় সেই বিমানটির ছবি ছাপা হলো, তার সামনে মাদকভর্তি প্যাকেটগুলো।
অন্য দিকে চার্টার কোম্পানির সিইও এরিক ভেবে পেলেন না কী হতে কী হয়ে গেল। ইন্টারপোল তার সাথে যেসব ওয়াদা করেছিল, একে একে সবই তারা ভেঙে ফেলল। যারা ঘটনার শিকার, তাদেরই বানানো হলো আসামি। তার ওপর তাদের পক্ষের আইনজীবী প্রথম দিকে কিছুই করতে পারছিলেন না। কেননা সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে যেসব দলিল তার দেখা প্রয়োজন, কিছুই তাকে দেয়া হলো না। বলা হলো, এসব ক্লাসিফায়েড; তাই দেয়া যাবে না। এভাবে চার সপ্তাহ কেটে গেল, কিছুই হলো না। এসব মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। আর যাকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে, তিনি কিছুই করলেন না।
এভাবে কেটে গেল আট সপ্তাহ। বিমানের ক্রুরা তখনো ভূগর্ভের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী, বিমানটিও আটক স্পেনে। কোম্পানি প্রতিদিন গচ্চা দিচ্ছে হাজার হাজার ডলার।
অবশেষে অক্টোবর মাসে লুকার্ট ও তার দুই সহকর্মীকে কারাধ্যক্ষের কাছে নেয়া হলো। লুকার্টের মা ও বাবা ৬০ হাজার ইউরো জামিনে তাদের মুক্ত করলেন। তারা মুক্তি পেলেন বটে, তবে স্পেন ছাড়ার অনুমতি পেলেন না। অবশ্য বিমানটি তার মালিককে ফিরিয়ে দেয়া হলো।
এ অবস্থায় এক দিন বৈরুতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন এক নারী। তিনি নিজের পরিচয় দিলেন রাইমা তাউক বলে। জানালেন, ৩০ হাজার ইউরো দেয়া হবে এই অঙ্গীকারে তিনি ওই বিমানের যাত্রী হতে রাজি হয়েছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, বিমানে কিছু নিষিদ্ধ জিনিস থাকবে, তবে সেটা যে কোকেন তা তিনি জানতেন না।
রাইমাকে কে ভাড়া করেছিল? করেছিল যে লোকটি, সে আন্তর্জাতিক আইনশৃঙ্খলা কর্মকর্তাদের খুবই চেনা একজন। তার নাম আলি ক্লেইলাত। বিশ্বব্যাপী মাদক ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার একজন বড় চাঁই। তার আছে কমপক্ষে ছয়টি ডাকনাম। জন্মসালেও আছে ভিন্নতা কখনো ১৯৭০, কখনো বা ১৯৬৩। তার আছে লাইবেরিয়া, দ্য নেদারল্যান্ডস, ভেনিজুয়েলা ও লেবাননের পাসপোর্ট।
২০১১ সালে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে এক টনেরও বেশি মাদকের একটি চালান আটক হয়। এর সাথে জড়িত সন্দেহে ক্লেইলাতকে ধরতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিযান শুরু হয়। একপর্যায়ে ধরা পড়ে সে। বর্তমানে বেলজিয়ামের একটি কারাগারে আটক রয়েছে। সেদেশের আদালত তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি দেবে বিচার মন্ত্রণালয়।
ক্লেইলাতের সাঙ্গপাঙ্গরাই আর্তুরো মিচেলেনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ঘটনাটিও ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে ১৮ জন, যাদের নয়জন বলিভারিয়ান ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য, দু’জন বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অসামরিক সদস্য, গোয়েন্দা সংস্থার একজন সদস্য এবং একজন বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রক। এ কাজে সহযোগিতার জন্য প্রত্যেকে পেয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থাত সর্বনিম্ন ১৯ হাজার থেকে এক লাখ ৮৮ হাজার ইউরো। ধারণা করা হয়, এফরেইন পেরেদা নামে এক দুর্বৃত্তই কলম্বিয়ান মাদকচক্র ও স্থানীয় অপরাধীদের মধ্যে যোগাযোগটি ঘটিয়ে দিয়েছে।
মামলা শেষ হয়েছে। লুকার্ট ও তার ক্রুরা স্বদেশ জার্মানিতে ফিরে গেছেন। পুলিশ লুকার্টকে একটি নতুন নাম দিয়েছে। তিনি এখন নতুন শহরে নতুন নাম-পরিচয়ে বসবাস করেন। কোনো অসুবিধা নেই, তবু মনের তিক্ততা কাটে না। লুকার্ট তিক্ত গলায় বলেন, ‘কিছুই আগের মতো নয়। ভালো লাগে না।’
নাম বদলে গেছে, তবে পেশা আগেরটাই আছে। এখনো লুকার্ট দুনিয়াজুড়ে প্রাইভেট ক্লায়েন্টদের বিমান চালান। তবে যাত্রীদের আগে যেমন বিশ্বাস করতেন, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি করেন অবিশ্বাস। আর বিমান নিয়ে কখনো ভেনিজুয়েলা বা লেবানন যান না।

No comments

Powered by Blogger.