‘মন্ত্রী সচল থাকলেও সড়কগুলো অচলপ্রায়’ by আলী ইমাম মজুমদার

ঈদ সামনে। এ সময় স্বজনদের সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় স্থান থেকে স্থানান্তরে আসা-যাওয়া করবে লাখ লাখ লোক। এ দেশের এককালীন নৌ ও রেল যোগাযোগনির্ভর মানুষ গত অর্ধশতাব্দী যাবৎ ক্রমান্বয়ে অধিকতর হারে সড়ক-মহাসড়কের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। নৌ আর রেলপথকে ক্রমান্বয়ে উপেক্ষা করে বিশাল সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কও গড়ে উঠেছে। জনসংখ্যা আর মানুষের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি ঈদে বেড়াতে যাওয়ার সংস্কৃতিও ক্রমান্বয়ে জোরদার হচ্ছে। জানা যায়, শুধু কক্সবাজারেই আসন্ন ঈদে যাওয়ার কথা দেড় লাখ লোকের। তাদের মধ্যে গুটি কয়েক ভাগ্যবান বিমানযাত্রী ছাড়া সবারই ভরসা সড়কপথ। অথচ ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যেতেই এখন লাগছে ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা। স্বাভাবিক অবস্থায় তা হওয়ার কথা সাত থেকে আট ঘণ্টা। ছুটি কাটাতে যাওয়ার ব্যাপার
বাদ রাখলেও প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ঈদ করতে কত লাখ লোক ছোটে, তার সঠিক হিসাব কোথাও নেই। কিছু যায় নৌ আর রেলপথে। তাদেরও যথেষ্ট ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। কিন্তু সিংহভাগ সড়কপথে যাত্রীর ভোগান্তি অন্য সবকিছুকে পেছনে ফেলছে আজ বেশ কয়েক বছর। অথচ ঠিক এমনটা ছিল না বছর দশেক আগেও।
এ সময়ে যাত্রীসংখ্যার তুলনায় যানবাহনের অপ্রতুলতা ভোগান্তির একটি কারণ। কিন্তু মূল সমস্যা হলো সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের বেহাল অবস্থা। গত কয়েক দশক এ নেটওয়ার্কটির বিশাল অংশ চলাচলের প্রায় অযোগ্য হয়ে যায় বর্ষায়। তার পরও অধিকতর যানবাহনের চাপে এসব সড়ক-মহাসড়ক এ সময়ে পাড়ি দিতে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থার। আর সে অবস্থা দূরীকরণে নেওয়া হয় সাময়িক কিছু কার্যক্রম। এতে ভোগান্তি কিছুটা হ্রাস পায়। শেষ হয় ঈদ উৎসব। কিন্তু ব্যাপারটি পূর্ববর্তীই থেকে যায়।

এসব সড়ক-মহাসড়ক তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক ও জনপথ বিভাগের। এ সংস্থাটি নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে ১৯৬২ সালে। এর আগে এটা ছিল কমিউনিকেশন ও বিল্ডিং (সিঅ্যান্ডবি) বিভাগের একটি অংশ। তখন এর আওতায় ছিল আড়াই হাজার কিলোমিটার সড়ক। আর এখন তার পরিমাণ ২১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক হাইওয়ে আর জেলা সড়ক রয়েছে। এ ছাড়া তাদের আওতায় আছে ২২ হাজার ব্রিজ ও কালভার্ট। অবশ্য এক হাজার ৫০০ মিটারের ঊর্ধ্বে সেতু, ফ্লাইওভার, ওভারপাসের দায়িত্বে রয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ নামে আরেকটি সংস্থা। সড়ক ও জনপথ বিভাগের এ বিশাল কাঠামো ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন নয় হাজার ৩০০ স্থায়ী আর আট হাজার ৭০০ অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী। সুতরাং, অবকাঠামোর ব্যাপকতার সঙ্গে তাদের জনবলকাঠামোও সংগতিপূর্ণ বলেই বিবেচনা করা যায়। তাদের কাজের রূপকল্প দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অনুকূল, টেকসই, নিরাপদ ও মানসম্মত সড়ক অবকাঠামো তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ। এ সংস্থার কাজ তদারকি, এ বিষয়ে প্রকল্প প্রস্তাবের অগ্রাধিকার নির্ধারণ, বাজেট নিয়ন্ত্রণসহ সামগ্রিক নীতিনির্ধারণের দায়িত্বে রয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগ।
প্রায় এক দশক যাবৎ সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাজকর্মে একটি বিস্ময়কর জড়তা লক্ষণীয় হচ্ছে। এটা সত্যি, তারা তাদের এ বিশাল সড়ক নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সময়মতো পর্যাপ্ত বরাদ্দ পায় না। সীমিত সম্পদের দেশে এটা অস্বাভাবিক নয়। অতীতেও কখনো চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তবে যতটুকু পাওয়া যায়, তা অগ্রাধিকার নির্ণয় করে সময়োচিত ব্যবহার করলে অবস্থা এ পর্যায়ে আসতে পারে না। এটাও ঠিক, রাজনৈতিক চাপে সঠিক ঠিকাদার নিয়োগ ও তাদের থেকে কাজ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি এটাও জানা যায় যে সেই ঠিকাদার চক্রের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছেন এ বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। এই বেহাল অবস্থায়ও তাঁদের মধ্যে প্রয়োজনীয় তৎপরতা অদৌ লক্ষণীয় হয় না।
সংস্থাটি যেহেতু যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন, তাই স্বাভাবিকভাবে এর নৈতিক দায় তাদের ওপর বর্তায়। সংসদ ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে। তিনি আজ প্রায় আড়াই বছর এ পদে বহাল আছেন। মন্ত্রণালয়টির আগের নেতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও দূর করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এ–জাতীয় ঈদ উৎসবের আগে সড়ক নেটওয়ার্ক কার্যকর রাখার জন্য অবিরাম ছোটাছুটি করেন মাস খানেক আগে থেকেই। পাশাপাশি তাঁর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ২৪টি কমিটিও তদারক করে যাচ্ছে বলে খবরে জানা যায়। পাশাপাশি এটাও বলার থাকে যে যাদের এ কাজগুলো করার কথা, তাদের দিয়ে তারা তা করাতে পারছে না। জনবল, যন্ত্রপাতি ও অতীত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সড়ক ও জনপথ বিভাগ নামের প্রতিষ্ঠানটিতে কার্যত গতি আনতে সক্ষম হয়নি এ মন্ত্রণালয়। এটা কার ব্যর্থতা, সেটা তলিয়ে দেখার আবশ্যকতা রয়েছে।
রাজনৈতিক চাপ আর বিভাগীয় কর্মকর্তাদের এর সঙ্গে একাত্মতায় নিম্নমানের কাজের অভিযোগ শুধু এ সংস্থার ওপরই আসে না। এ দায় দেশের প্রায় সব বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণকাজের জন্যই প্রযোজ্য। তাই বলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে এতটা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, এমনটা বলা যাবে না। কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কিংবা এর কর্মকর্তাদের পরিদর্শন টিম এভাবে আর কোথাও ছুটছে না। হতে পারে ঈদের সময় সড়ক অবকাঠামোর ওপর ব্যাপক চাপ মোকাবিলার মতো চ্যালেঞ্জ অন্যদের নেই। এ ক্ষেত্রে বলতে হবে, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সামর্থ্য বিবেচনা করেই এ বিশাল সংস্থাটির সৃষ্টি ও বিকাশ হয়েছে। অনেক বড় সড়ক, মহাসড়ক, সেতু তৈরি আর রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। তাহলে গত কয়েক বছর সড়ক-মহাসড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে এ রকম উদাসীনতা থাকবে কেন? আর কেনই বা মন্ত্রণালয় তার অধীন সংস্থাটিকে দায়িত্ব পালনে তৎপর করতে পারছে না? এভাবে মন্ত্রী ও তদারক কমিটিগুলোর নিরন্তর দৌড়–ঝাঁপ এ সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে।
মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিবসহ অন্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব মূলত নীতি প্রণয়ন, লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তহবিল সংগ্রহ। পাশাপাশি অধীনস্থ সংস্থার কাজ তদারক, নির্দেশনা আর ক্ষেত্রবিশেষে আন্তমন্ত্রণালয় সম্পর্কবিষয়ক জটিলতা নিরসন। এভাবেই চলছে দেশের অন্য সব প্রতিষ্ঠান আর মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে এমন দাবি কেউ করে না। তা সত্ত্বেও একটি সংস্থার কাজ নিয়ে মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষভাবে এ রকম সংশ্লিষ্ট হওয়ার নজির সম্ভবত সাম্প্রতিককালে নেই। পত্রিকান্তরের খবর থেকে জানা যায়, বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী গত আড়াই বছরে ৬৪ জেলার ২০৪টি উপজেলায় ৩৮১ দিন সড়ক-মহাসড়ক পরিদর্শন করেছেন। তাঁর অধীন তদারক টিমগুলোও একইভাবে সক্রিয়। তবে গণমাধ্যম ফোড়ন কাটছে ‘মন্ত্রী সচল থাকলেও মহাসড়কগুলো এখনো অচলপ্রায়’। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সময়মতো মানসম্মত কাজ না করার কারণে এ অবস্থা হয়েছে।

ঈদ অত্যাসন্ন। সক্রিয় ও আন্তরিক যোগাযোগমন্ত্রীর সদিচ্ছায় এবারও হয়তো বা অচলাবস্থা কিছুটা কেটে যাবে। তবে এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা স্থায়ীভাবে চলতে পারে না। সড়ক ও জনপথ বিভাগের এ নিষ্ক্রিয়তার অবসান ঘটাতে মন্ত্রণালয়কেই উদ্যোগী হতে হবে। তদারক টিম হয়তো থাকবে, কিন্তু মূল কাজ করাতে হবে সংস্থাকে দিয়েই। তাদের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ অনীহা দেখালে শাস্তি অবশ্যই দেওয়া যাবে। তবে প্রয়োজন রয়েছে সংস্থাটির ভেঙে পড়া কর্মসংস্কৃতি নতুনভাবে গড়ে তোলার। এটা অসাধ্য কোনো বিষয় হওয়ার কথা নয়। যার কাজ তাকেই করতে হবে। বিভিন্ন স্তর থেকে অবিরাম তদারকি ক্ষেত্রবিশেষে মাঠ কর্মকর্তাদের উদ্দীপনা শিথিল করে দেয়। তাঁরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েন নির্দেশনার জন্য। পর্যাপ্ত ক্ষমতা অর্পণ আর যথোপযুক্ত তদারকিই আদর্শ কর্মসংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে। আর এ তদারকির সিংহভাগই করার কথা সেই বিভাগের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলীদের। এ রকম না করলে মন্ত্রণালয়ের বর্তমান তদারকব্যবস্থা সাময়িক কিছু সুফল দেবে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়াবে না ঐতিহ্যবাহী এ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানটি। তাই সময়ের দাবির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হোক। তাদেরও বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেদিকে অনুপ্রাণিত করতে পারে মন্ত্রণালয়। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য টেকসই যোগাযোগব্যবস্থা অপরিহার্য। আর সেই ব্যবস্থা যারা করবে, তাদের সক্ষমতার ক্রমহ্রাসমান অবস্থার অবসান অতি প্রয়োজনীয়।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.