লন্ডনে হাসিনা ক্যামেরন বৈঠক

বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গার্ল সামিট ২০১৪-এ যোগ দিতে বর্তমানে তিনি লন্ডনে রয়েছেন। প্রধান বিরোধী জোট ও দলগুলোর বর্জনের মুখে অনুষ্ঠিত ৫ই জানুয়ারির ‘ত্রুটিপূর্ণ’ নির্বাচনের পর যুক্তরাজ্য তথা পশ্চিমা কোন দেশে এটিই তার প্রথম সফর। ওই নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়ায় বৃটেনসহ ২৮ রাষ্ট্রের ইইউ জোট নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। নির্বাচনের পরও ইইউসহ পশ্চিমা দেশগুলো নতুন নির্বাচনের জন্য সংসদের বাইরে থাকা দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচনের জন্যও সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে। অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বরাবরই বলেন, নতুন নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর কোন চাপ নেই। পশ্চিমাদের সুর নরম হয়ে আসছেন বলেও দাবি তার। পশ্চিম তথা বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৃটিশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কি কথা হয়েছে তা ওই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্পষ্ট হয়নি। শেখ হাসিনার সফরসঙ্গীদের বরাত দিয়ে কিছু কথাবার্তা দেশীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।  বৈঠকটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক। কিন্তু বৃটিশ গণমাধ্যম বা বিশ্ব মিডিয়ায় বৈঠকের কিছুই প্রকাশ পায়নি। তাৎপর্যপূর্ণ ওই বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী গার্ল সামিটে অংশ নিয়েছেন। সেখানে উপস্থাপক শেখ হাসিনাকে ‘দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী’ বলে পরিচয় করিয়ে দেন। উপস্থিত মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী তখন উপস্থাপকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং নিজেকে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী বলে জানান। ৫২ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত ওই গার্ল সামিটে দেশের নারী সমাজ বিশেষ করে কন্যা শিশুদের উন্নয়নে তার সরকারের অবদান বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তানের কিশোরী মানবাধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাই নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার প্রশংসা করেছেন।
লন্ডন প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর আস্থার প্রকাশ ঘটেছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক। তিনি বলেন, অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে দুই প্রধানমন্ত্রীর ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। বাংলাদেশের মৌলবাদ মোকাবিলা ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের প্রশংসা করেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। বাংলাদেশ সফর করে এ অর্জনের কৌশল নিজ চোখে দেখতে ও জানতে চান তিনি। গতকাল স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ৯টায় শুরু হওয়া হাসিনা-ক্যামেরন বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এসব কথা কথা বলেন পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক।
স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টায় ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছলে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান। এরপর তারা ভেতরে প্রবেশ করেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন শেখ রেহানা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কে এম মাহমুদ আলী এবং নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ ও লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মিজারুল কায়েস। বৈঠক শুরুর আগেই শেখ হাসিনার হাতে ওয়ার্ল্ড গার্ল সামিট চার্টার তুলে দেন ডেভিড ক্যামেরন। এরপর তারা বৈঠকে বসেন। প্রায় ৩০ মিনিটের বৈঠক শেষে বের হয়ে গার্ল সামিট ভেন্যুর উদ্দেশে রওনা হন শেখ হাসিনা। বৈঠকে শেখ হাসিনা গত নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী বিষয় ছাড়াও দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। ক্যামেরনের সঙ্গে বৈঠকটিই এখন প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই দেখছেন প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর বৃটিশ সরকার যে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিল তা থেকে সরে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতি ইতিবাচক হয়ে উঠেছে- সেটাই এ বৈঠক প্রমাণ করেছে। দুই সরকারপ্রধান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়েই কথা বলেন। এরপর শেখ হাসিনা ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বের হয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বেশ উৎফুল্ল হয়ে হাত নাড়েন।
পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী সাংবাদিকদের কাছে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় বাংলাদেশ সফরের জন্য আন্তরিক আমন্ত্রণ জানান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীকে। প্রেস ব্রিফিংকালে জানানো হয়, বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, নারীর অধিকার ও নারী স্বাধীনতায় অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগী দেশ হিসেবে বৃটেন বাংলাদেশে শান্তি ও সম্প্রীতি কামনা করে। বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার কথা উল্লেখ করেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নে যে সাফল্য দেখিয়েছে তার কৌশল নিজ চোখে দেখতে বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ প্রকাশ করেন ডেভিড ক্যামেরন। বাংলাদেশে বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল সফরের আগ্রহ দেখান তিনি।
ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন মন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়াইন ও ব্যারোনেস সাইদা ওয়ার্সি।
সামিট ভেন্যু ওয়ালওয়ার্থ একাডেমিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক বৈঠক করেন। স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় এ বৈঠক ৩০ মিনিট স্থায়ী হয়। এ বৈঠকে শেখ হাসিনা শিশু শিক্ষা উন্নয়নে বাংলাদেশে তার সরকারের বিভিন্ন সাফল্য তুলে ধরেন। এর পরপরই একই ভেন্যুতে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়াইন টিডির সঙ্গে। প্রায় ২০ মিনিটের বৈঠকে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় তাদের মধ্যে। এরপর দুপুর ১২টায় তিনি যোগ দেন গার্ল সামিটে। সামিটের উচ্চপর্যায়ের সেশনে অংশ নিয়ে নারীর ক্ষমতায়নে ও উন্নয়নে বিশেষ করে বাল্যবিয়ে রোধে তার সরকারের উদ্যোগ ও অঙ্গীকারগুলো তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দারিদ্র্য নিরসন, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ নিশ্চিত হলে মেয়েদের বাল্যবিয়ে কমে যাবে। আর তার সরকার সে লক্ষ্যেই কাজ করছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে মাস্টার্স পর্যন্ত তা অবৈতনিক করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। এ ছাড়া গতকাল বিকাল ৪টায় শেখ হাসিনার সঙ্গে তার হোটেলকক্ষে বৈঠক করেন যুক্তরাজ্যের শ্যাডো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডগলাস আলেকজান্ডার এবং বিকাল ৫টায় রয়েছে অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের একটি প্রতিনিধি দল। রাতে হোটেল হিলটনে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক ইফতার মাহফিলে যোগ দেন শেখ হাসিনা।
বিক্ষোভ: গার্ল সামিট চলাকালে সেন্ট্রাল লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার কুইন এলিজাবেথ কনফারেন্স সেন্টারের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও কালো পতাকা প্রদর্শন করেছে যুক্তরাজ্য বিএনপি। এ ছাড়া সিটিজেন মুভমেন্ট আহ্বায়ক এম এ মালেকের নেতৃত্বে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা খসরুজ্জামান খসরু, আমিরুল ইসলাম, আবদুর রহিমসহ বেশ কয়েক নেতাকর্মী হাসিনার গাড়িবহর লক্ষ্য করে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। নেতাকর্মীরা গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করলে তারা দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। এ সময় তারা ‘কিলার হাসিনা, গো ব্যাক গো ব্যাক’ বলে স্লোগান দেন। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড ও কালো পতাকা ছিল। হাসিনার নিরাপত্তাকর্মী তাদের ছবি তোলার চেষ্টা করলে তাদের মধ্যে বাকবিত-া হয়।

No comments

Powered by Blogger.