গাজার ধ্বংসস্তূপে স্বজনদের খুঁজতে গিয়ে লাশ হলো যুবক

স্বজনদের খুঁজতে গিয়ে নিজেই লাশ হলো ফিলিস্তিনি এক যুবক। ইসরাইলের হামলায় তার পরিবারের সদস্যরা কোথায়, তারা নিহত হয়েছেন কিনা তা খুঁজতে গিয়েছিল ওই যুবক। কিন্তু ইসরাইলের সেনারা তার দিকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করেছে। গুলিবিদ্ধ যুবক উঠে পালানোর চেষ্টা করলে ইসরাইলি সেনারা তাকে ফের গুলি করে। এতে নিরস্ত্র, বেসামরিক ওই যুবক গাজার ধ্বংসস্তূপের ওপর নিথর হয়ে পড়ে। রক্তে ভেসে যায় ইটপাথর। এ দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করেছে প্যালেস্টাইনিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সলিডারিটি মুভমেন্ট (আইএসএম)। তারা ওই যুবকের ওপর ক্যামেরা তাক করে রেখেছিল। ফলে ইসরাইলের ওই বর্বরতা তাদের ক্যামেরায় বন্দি হয়। মর্মান্তিক ওই ভিডিওটি তারা পরে প্রকাশ করেছে। ইসরাইল এভাবেই শুধু বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছে না। তারা সোমবার দিবাগত রাতে গাজায় ৫টি মসজিদে বোমা হামলা করেছে। বোমা হামলা করেছে আল আকসা হাসপাতালে। একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্সে। হামাসের সাবেক এক সামরিক প্রধানের বাড়িতে। এ নিয়ে ইসরাইলের এই নৃশংস হামলায় এ পর্যন্ত গাজায় নিহত হলেন ৬ শতাধিক মানুষ। পক্ষান্তরে ইসরাইলের সেনা নিহত হয়েছে ২৭ জন। গত ৮ই জুলাই থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। গত দু’তিন দিন ধরে তারা আকাশ, স্থল ও জলপথে একযোগে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে নিহত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। জাতিসংঘ বলেছে, ফিলিস্তিনে নিহতদের বেশির ভাগই শিশু। নিরপরাধ এসব শিশুর লাশ স্তূপ করে রাখা হচ্ছে হাসপাতালের মর্গে। বোমার আঘাতে তাদের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। অনলাইনে পোস্ট করা ফিলিস্তিনি এক সাংবাদিকের এক ছবিতে দেখা যায়, একটি শিশুর মাথার খুলি উড়ে গেছে। তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার মগজ বেরিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আরেকটি শিশুর পেট থেকে বেরিয়ে পড়েছে নাড়িভুঁড়ি। মুহাম্মদ আবদেল্লাহ ও আইএসএমের স্বেচ্ছাসেবকরা বলেছেন, রোববার তারা শিজাইয়াহ এলাকায় যাচ্ছিলেন। এই এলাকায় ইসরাইল সবচেয়ে বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী হামলা চালিয়েছে। তখনই ওই এলাকায় তারা ওই যুবককে দেখতে পায়। সে ধ্বংসস্তূপের মাঝে কাউকে খুঁজছিলেন। এ কথা জানতে পেরে তারা ক্যামেরা তাক করে তার দিকে। কিন্তু ইসরাইলের সেনারা তার দিকে প্রথম গুলি করে। হামাগুড়ি দিয়ে সে রক্ষা পায় সে যাত্রায়। ওই গুলিটি কারও গায়ে লাগেনি। কিন্তু দ্বিতীয় গুলিটি তার শরীর ভেদ করে। সে আর্তনাদ করে ধ্বংসস্তূপের ওপর পড়ে যায়। তারপর ছটফট করতে করতে  মারা যায়। এ অবস্থা দেখে আবদেল্লাহ ও অন্যরা আত্মরক্ষার জন্য দূরে সরে যায়।  নাহলে তারাও ইসরাইলি সেনাদের নৃশংসতার শিকার হতে পারতো। তাদের ধারণা যে গুলিতে যুবকটি মারা গিয়েছে তা তার হৃৎপি-কে ভেদ করেছে। গুলি লাগার পর  সে দৌড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তাদের সামনে পড়ে যায়। এরপর ইসরাইলি সেনারা পিছন থেকে তার নিতম্বে গুলি করে। এ সময় তাদের একজন কাছে গিয়ে ওই যুবককে জিজ্ঞাসা করে সে নড়াচড়া করতে পারবে কিনা। পারলে তাকে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তাদের প্রস্তাবে সে নেতিবাচক জবাব দেয়। বলে, না। আমি আর নড়াচড়া করতে পারছি না। আমার সারা শরীর রক্তে ভিজে গেছে। এ অবস্থায় জীবনের ভয়ে তাকে ফেলে আইএসএমের স্বেচ্ছাসেবকরা সরে যান। তারপর ইসরাইলি সেনারা তার ওপর আবার গুলি করে। জীবনপ্রদীপ একেবারে নিভে যায় তার। ওদিকে ইসরাইলের তীব্র হামলায় গাজা এখন এক মৃত্যুপুরী। হাসপাতালে লাশ। রাস্তায় লাশ। বিধ্বস্ত ভবনের ভিতর পড়ে আছে লাশ। হাসপাতালগুলো ভরে গেছে আহত নারী, শিশু ও পুরুষে। এর মধ্যে শিশুদের অবস্থা ভয়াবহ। স্থান সংকুলান হচ্ছে না হাসপাতালে। একই সিটে অবস্থান করছে তিন-চারটি শিশু। তাদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত। এরই মধ্যে তাদের এক শিশু এক চিকিৎসককে আঁকড়ে ধরে তার পিতাকে এনে দেয়ার যে আকুতি জানিয়েছে তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ হয়েছে। মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ৭০টি স্থাপনার ওপর বোমা ফেলা হয়েছে। গাজার বেসামরিক এ অবস্থাকে বিপর্যয়কর বলে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘের ত্রাণ দফতর। জাতিসংঘ মানবিক বিষয়ক দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গাজায় জনবসতি এতটাই ঘন যে গোলার হাত থেকে পালানোর কোন জায়গা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ইসরাইলি গোলার আঘাতে গাজায় ১৮টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাজায় অভিযান চালানোর সময় নিখোঁজ হয়েছে এক ইসরাইলি সেনা। তাকে হামাস ধরে নিয়ে গেছে কিনা তা পরিষ্কার নয়। ওদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য নতুন কূটনৈতিক উদ্যোগ শুরু হয়েছে। একদিকে কূটনৈতিক উদ্যোগ চলছে, অন্যদিকে তার চেয়ে বেশি গতিতে ইসরাইল গাজায় রক্তস্রোত বইয়ে দিচ্ছে। এ নিয়ে মিশরে আলোচনা করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। এরপরই জন কেরি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজায় হতাহতের ঘটনায় উদ্বিগ্ন। তবে তিনি ইসরাইলের সামরিক অভিযানকে যথার্থ ও ন্যায়সঙ্গত বলে সমর্থন দেন। এ সময় তিনি বলেন, তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার পাঠাচ্ছে গাজায়। যৌথ এক বিবৃতিতে পরে মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরি ও জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন বলেন, তাদের আলোচনা গঠনমূলক হয়েছে। তিনি আবারও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.