তথ্যপ্রযুক্তি দেশে কতটা অবদান রাখছে by লোকমান হাকিম

বাংলাদেশে বিশ্বায়ন যে কীভাবে ঢুকে পড়েছে, তা বোঝা যায় মোবাইল ফোনের ব্যবহার দেখে। শহরের প্রতিটি বাড়িতে প্রত্যেক সদস্যের হাতে মোবাইল ফোন। গ্রামও পিছিয়ে নেই। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই মোবাইল ফোন আছে। এক বাড়িতে একাধিক ফোন আছে এমন বাড়ির সংখ্যাও এখন কম নয়। দূরে থাকা স্বজন, প্রবাসী সন্তান বা ভাই-ভগ্নির সঙ্গে এখন নিত্যদিন যোগাযোগ হচ্ছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। এই ফোন যে শুধু আত্মীয়স্বজনের খবরাখবর নেয়ার মাধ্যম হয়েছে তাই নয়; কৃষক তার ফসল উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিষয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগ করতে পারছেন। দোকানি তার ব্যবসার কাজে ফোনের ব্যবহার করছেন। মাছের ব্যাপারী থেকে কাঁচাবাজারের দোকানদার সবাই এই ফোন ব্যবহার করে লাভবান হচ্ছেন। ছাত্রছাত্রীরা তাদের লেখাপড়ার কাজে ইন্টারনেট সার্চ করছে। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি-বেসরকারি আমলা- সবাই এখন ব্যাপকভাবে ইন্টারনেটের সহায়তা নিচ্ছেন। এছাড়া ফেসবুক, সাইবার ক্যাফের মাধ্যমে তথ্য বিনিময় ও গসিপ হচ্ছে প্রচুর। শিশুরাও পিছিয়ে নেই, তারাও কম্পিউটারে খেলছে বিভিন্ন ধরনের খেলা। মোটামুটিভাবে শিশু থেকে প্রবীণ সবাই বিভিন্নভাবে জড়িয়ে গেছি তথ্যপ্রযুক্তির জগতে। আর তথ্যপ্রযুক্তির কারণেই একধরনের আন্তর্জাতিক রুচিবোধ ও মানসিকতা আমাদের বাঙালিয়ানাকে স্পর্শ করছে, প্রভাবিত করছে।
এখন দেখব আমাদের বেকার তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি কতটা সহায়ক। মোটামুটিভাবে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর ২৭ লাখ মানুষ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের জগতে। এর মধ্যে ৫ লাখ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ যাচ্ছে। এতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে বটে, তবে তথ্যপ্রযুক্তি নিজেই যে একটা বিশাল কর্মকাণ্ডের বাজার, সেখানে আমরা এখনও আশানুরূপভাবে স্থান করে নিতে পারিনি। বর্তমানে দেশে আইটি বাজারের পরিমাণ আনুমানিক ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং এ খাতে ৭০ হাজার শিক্ষিত জনবল কাজ করছে। অথচ সারাবিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির বাজারের পরিমাণ ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশাল এ বাজারে অন্যান্য দেশ যেভাবে ঢুকে পড়েছে, সে তুলনায় বাংলাদেশের গতি অনেকটাই শ্লথ।
সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াবিকহাল। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে বাড়ানোর জন্য এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরির লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পৃথক তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। এর অধীনে আছে কম্পিউটার কাউন্সিল, আছে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রাইভেট সেক্টরে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, তার অধিকাংশেই তথ্যপ্রযুক্তিতে উচ্চ ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সরকার ভারতের সিলিকন ভ্যালির আদলে গাজীপুরে আইটি ভিলেজ গড়ে তোলার প্রকল্প নিয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইটি প্রফেশনাল গড়ে তোলার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে।
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল সারা বছর ধরে বিভিন্ন কোর্স পরিচালনা করে। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই সরকারি-বেসরকারি কাজে ঢুকে যায়। আর কেউবা কাজ করে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। দেশে সংবাদপত্র ও টিভি রিপোর্টিংয়ে বহু ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন। এছাড়া প্রাইভেট সেক্টরে অনেক কলসেন্টার গড়ে উঠেছে। কলসেন্টারগুলো রির্সোসপার্সন নিয়োগ করছে। তাদের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছে। আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণের জন্য একটি সুসংবাদ রয়েছে। দেশে ৩০ হাজার শিক্ষার্থীকে আউটসোর্সিংয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য সরকার একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দেশের ভেতরে ছাড়াও বাইরে প্রশিক্ষিত জনবল সরবরাহ করার ব্যাপারে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এ লক্ষ্য পূরণে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ২০ হাজার আইসিটি গ্র্যাজুয়েট এবং ১০ হাজার সায়েন্স গ্র্যাজুয়েটকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে এ প্রকল্পের আওতায়। যেসব জেলায় সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ রয়েছে, সেখান থেকে উপযুক্ত আইসিটি বা সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট সংগ্রহ করার জন্য সরকার ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে।
সরকার প্রাথমিক শিক্ষা থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা কারিকুলামে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি কোর্স চালু করেছে। শিশুরা শৈশব-কৈশোর থেকে যাতে তথ্যপ্রযুক্তি রপ্ত করতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরি করে দিচ্ছে। ক্লাসরুমগুলো বিদ্যুৎ সংযোগসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাপটপ ও কম্পিউটার দ্বারা সজ্জিত করা হচ্ছে। বিশেষ কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত ১৫০০টি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরি করা হয়েছে।
সচিবালয়সহ সরকারি অফিসগুলো ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হচ্ছে। এসব অফিসে থাকা কম্পিউটার, প্রিন্টারের মতো ইলেট্রনিক ডিভাইজগুলো তারের পরিবর্তে রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে সংযুক্ত হবে। ন্যাশনাল আইসিটি ইনফ্রা নেটওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট নামে ১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ সম্প্রতি অনুমোদন করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় সচিবালয়সহ সব সরকারি অফিসে ২৫ হাজার ট্যাব কম্পিউটার সরবরাহ করা হবে। বাংলাদেশ সচিবালয়, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, ৭টি বিভাগীয় সহ-দফতর এবং জেলা দফতর ও ৪৮৫টি উপজেলার সরকারি অফিসগুলোতে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এ প্রকল্পে চীন ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা দেবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, জেলা প্রশাসক ও উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের ট্রেনিং সেন্টারসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে মোট ৮০০টি ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমও স্থাপন করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পের কাজ জুন, ২০১৫ নাগাদ শুরু করার সময়সীমা নির্ধারিত করা আছে।
বেসরকারি খাতে দেশের আইটি প্রফেশনালদের সংগঠন বেসিস দেশে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি না হওয়ার জন্য চিহ্নিত করেছে তথ্যপ্রযুক্তি বিপণন-সংক্রান্ত জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবকে। জুলাইয়ে বেসিস হোটেল র‌্যাডিসনে আয়োজন করেছিল দেশের প্রথম আইটি মার্কেটিং ফোরাম। বেসিস মনে করে, তথ্যপ্রযুক্তি বিপণন কৌশলের সঠিক ব্যবহারই আগামীতে আইটি কোম্পানিগুলোর প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে পারবে। আইটি কোম্পানিগুলোতে কর্মরত প্রত্যেক ব্যক্তির আবশ্যিকভাবে কোম্পানির পণ্য ও সেবা একটি ব্র্যান্ড হিসেবে বিপণনের সম্যক ধারণা থাকতে হবে। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপনের কৌশল জানতে হবে।
নিবন্ধটি শেষ করব অত্যন্ত গৌরবজনক ও বিস্ময়কর একটি সংবাদ দিয়ে। সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লেখাতে যাচ্ছে বাংলাদেশের এক ক্ষুদে কম্পিউটার জিনিয়াস রূপকথা। এই বিস্ময় বালকের পুরো নাম ওয়াশিক ফারহান রূপকথা। মাত্র ৭ বছর বয়সী রূপকথা ইতিমধ্যে প্রোগ্রামিংয়ে সি, সি++, ভিজ্যুয়াল বেসিক, জাভা, পাইথন, উইন্ডোজ এক্সপি, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড (দ্রুত গতিতে কম্পোজ), ফটোশপ, পাওয়ার পয়েন্ট, এডবি ফ্লাস ইত্যাদিতে দক্ষতা অর্জন করেছে। রূপকথার বাবা গুলশানের অধিবাসী। তার বয়স যখন ১ বছর, তখন তাকে কিছু খাওয়াতে চাইলে কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে খাওয়াতে হতো। ১ বছর বয়সে সে মাউস নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করে। ২ বছর বয়সে সে এমএস ওয়ার্ড টাইপিং শিখে ফেলে। সে এখন প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কম্পিউটারে নিমগ্ন থাকে। ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সি রূপকথাকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রোগ্রামার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী প্রোগ্রামার হিসেবে অভিহিত করে তাকে নিয়ে বিবিসি সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করে। তাকে নিয়ে লেখালেখি হয় ক্যার্লিফোনিয়া অবজারভার, নিউইয়র্ক টাইমস, নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন, স্টেট নিউজ, চিলড্রেন পোস্ট, জিনিউজ, হিন্দুস্তান টাইমসসহ অনেক বিদেশী পত্রপত্রিকায়। বাংলাদেশে অষ্টম শ্রেণীর ইংলিশ ফর টু ডে টেক্সট বইয়ে রূপকথাকে মডেল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
২০১১ সালে ‘রিপলিস বিলিভ ইট ওর নটে’ অন্তর্ভুক্ত হয় এই বিস্ময় বালক। গিনেস বুকে নাম প্রকাশের নিয়ম অনুযায়ী গত ১৬ মে একটি ভিডিও ডকুমেন্টেশন তৈরি করা হয়েছে। ওই ভিডিওসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, কর্তৃপক্ষ রূপকথার নাম অচিরেই গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করার চূড়ান্ত ঘোষণা দেবে।
বাংলাদেশে এমন আরও অনেক রূপকথার জন্ম হবে এবং তারা গোটা বিশ্বকে বিমোহিত করবে- এই প্রত্যাশা নিয়ে রূপকথার জন্য শুভ কামনা রেখে শেষ করছি।
লোকমান হাকিম : সাবেক অতিরিক্ত সচিব, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.