রাসায়নিক ছাড়া ফল নেই বাজারে by উৎপল রায়

চলছে দেশী ফলের মওসুম। বাজার ভরপুর হরেক রকমের ফলে। আম, জাম, লিচু, আনারস, জামরুলসহ দেশী সব ফলেই কোন না কোন রাসায়নিক  মেশানো হচ্ছে।
ফলকে তাজা রাখতে, পাকাতে বা রঙ কড়া করতে এসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। কলা, কমলা, আঙুর, আপেল, মাল্টা, তরমুজেও মেশানো হচ্ছে ফরমালিনসহ নানা ধরনের রাসায়নিক। তাজা শাকসবজিতেও ব্যবহার হচ্ছে এসব। বলতে গেলে বাজারে এখন রাসায়নিক ছাড়া কোন ফলই নেই। বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর আলাদাভাবে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। এ পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ দলের অভিযানের যে ফল পাওয়া গেছে তার চিত্র ভয়াবহ। অভিযানে প্রায় সব ধরনের ফলেই ফরমালিন বা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই হার উদ্বেগজনক। পরীক্ষায় যে সব রাসায়নিক পাওয়া যাচ্ছে এর মধ্যে আছে ফরমালিন, কার্বাইড, ইথোফেন সহ বিষাক্ত সব রাসায়নিক।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)’র সাবেক পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গোলাম মওলা মানবজমিনকে বলেন, রাসায়নিক মেশানো ফল খেয়ে মানবদেহে জটিল ১২টি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, পাকস্থলীতে প্রদাহ, ফুসফুসের সংক্রমণ, কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সহ সংক্রামক ব্যাধি ও ব্যয়বহুল সব রোগ হচ্ছে। বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো ফল খেয়ে শিশুরা মানসিক ও শারীরিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি মহিলাদের সন্তান ধারণেও মারাত্মক ঝুঁকির প্রভাব ফেলছে। অধ্যাপক মওলা জানান, অনেকেই হয়তো মানতে চাইবেন না- কিন্তু এটাই সত্য যে, শুধুমাত্র বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো খাদ্য খেয়ে দেশে মৃত্যুর হার শতকরা ৩০ ভাগ বেড়ে গেছে।
বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর মওসুমি ফল নিয়ে সামপ্রতিক একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে ভয়াবহ তথ্য। রাজধানীর ২৬টি এলাকার বিভিন্ন ফলের দোকান থেকে ৯৬টি আম, ৬টি লিচু ও জামের ৩টি নমুনা সংগ্রহ করেন তারা। গবেষণায় জানা যায়, বিভিন্ন জাতের আমের ৯৬টি নমুনার মধ্যে ৯০টি নমুনায় ফরমালিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যা মোট নমুনার ৯৩.৭৫ শতাংশ। লিচুর ৬টি নমুনায় ফরমালিনের মিশ্রণ পাওয়া গেছে ৫.৯২ থেকে ১৭.০৪ শতাংশ। যা মোট নমুনার একশ’ ভাগ। এছাড়া, জামের ২টি নমুনায় ফরমালিন পাওয়া গেছে ১৮.০৪ থেকে ২৮.৫০ শতাংশ। যা মোট নমুনার শতভাগ। এছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মালটা, আপেল, আঙুর, কমলা সহ বিভিন্ন ফলে ফরমালিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মালটায় ফরমালিন পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, যে তথ্য পাওয়া গেছে তা এক কথায় আতঙ্কজনক। এতে মানবদেহ চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাড়ছে জটিল রোগবালাই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে ফলে ভেজালবিরোধী অভিযান সত্ত্বেও থামছে না অসাধু ফল ব্যবসায়ীদের এই অপতৎপরতা। আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি কেমিক্যালের সহজলভ্যতা রোধ, জনসচেতনতা, সরকারের নজরদারি সহ সামাজিক আন্দোলনের কথা বলছেন বিশিষ্টজনরা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান মানবজমিনকে বলেন, নতুন ও আগামী প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সমাজের এই অন্যায়কে রুখতে হবে। সমাজের কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যাহত হবে- এটা হতে দেয়া যায় না। অপরাধের ধরন বুঝে আইনকে এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে যেন প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি হয়।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) সূত্রে জানা গেছে, গত ২০শে মে থেকে ৬ই জুন পর্যন্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে রাজধানীতে ফলে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে তারা। যাত্রাবাড়ী, বাদামতলী, হাজারীবাগ সহ বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত এ সময় বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য (সংশোধিত) আইন ২০০৫-এর ৬ (ক) ধারায় ফলে বিষাক্ত ফরমালিন, কার্বাইড, ইথোফেন মেশানোর অভিযোগে ৫টি মামলায় ৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়। আদায় করা হয় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। এ সময় উদ্ধার করা বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত ২৭০০ কেজি আম ধ্বংস করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গত ২৭শে মে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মওসুমি ফলে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। এসময় কৃষি মার্কেটের লিয়াকত মোল্লা ও হাসান মুন্সীর ফলের দোকান, জাপান গার্ডেন সিটি ও রিং রোডের মোহাম্মদ জামালউদ্দিন, বজলুর রহমানের ফলের দোকান, শিয়া মসজিদ কাঁচা বাজারের মন্টু মিয়া ও ফয়েজ আহমেদের ফলের দোকানে বিষাক্ত ফরমালিন মিশ্রিত ৪০০ কেজি আম জব্দ করা হয়। পরে এই সব ফলের দোকান থেকে মোট ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই প্রতিষ্ঠান গত ৪ঠা জুন অধিদপ্তরের উপ-সচিব (সংযুক্ত) সৈয়দ আহাম্মদ ছফার নেতৃত্বে রাজধানীর রমনা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। ফরমালিন মিশ্রিত আম ও মালটা পাওয়ায় নাসির ফল বিতানকে ১০ হাজার টাকা ও মো. এরফান ফকিরের ফলের দোকানকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে। এসময় ফরমালিন মিশ্রিত ৮০ কেজি আম ও ৩০ কেজি মাল্টা ধ্বংস করা হয়। একই দিন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আতিয়া সুলতানার নেতৃত্বে ঢাকা মহানগরীর ধানমন্ডি এলাকায় বিভিন্ন ফলের দোকান ও সুপারশপগুলোতে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। আম, আঙুর, মাল্টা সহ বিভিন্ন ফলে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানোর অভিযোগে আমজাদ ফল বিতানকে ১৫ হাজার টাকা, পিন্টুর ফলের দোকানকে ৩ হাজার টাকা, ফরমালিন মুক্ত ঘোষণা দিয়ে আম বিক্রি করা আমের মেলা স্টোরকে ২৫ হাজার টাকা, অভিজাত সুপার শপ মিনাবাজারকে ৪৫ হাজার টাকা, স্বপ্ন সুপার শপকে ৩০ হাজার টাকা সহ মোট ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এ সময় ফলের দোকান ও সুপারশপগুলো থেকে উদ্ধার করা ফরমালিন মিশ্রিত বিভিন্ন জাতের ৫৫০ কেজি আম, ২ কেজি আঙুর ও ৩০ কেজি মাল্টা অকুস্থলেই ধ্বংস করা হয়। ৬ই জুন খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় ফরমালিন মেশানো আম ও মাল্টা বিক্রি করায় নিউ রাজধানী ফুড স্টোরকে ১৫ হাজার টাকা, মায়ের দোয়া ফলের দোকানকে ১৫ হাজার টাকা, বাসাবোর স্বপ্ন ডিপার্টমেন্টাল  স্টোরকে ৩০ হাজার টাকা, তানহা ফ্রুটসকে ৫ হাজার টাকা, ইস্কাটন এলাকার আনোয়ার হোসেনের ফলের দোকানকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মাহবুব জামান খান। এ সময় ফরমালিন মিশ্রিত ২৫০ কেজি আম ও ৪০ কেজি মাল্টা ধ্বংস করা হয়। ৯ই জুন অধিদপ্তরের একটি টিম নয়াটোলায় ফরমালিন মিশ্রিত আম পাওয়ায় আবুল কাশেমের ফলের দোকানকে ৫ হাজার টাকা, ফকিরেরপুলের মো. তারা মিয়ার ফলের দোকানকে ১৫ হাজার টাকা ও মো. রমজান মিয়ার ফলের দোকানকে ৫ হাজার টাকা সহ দু’টি অভিযানে ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. রবিউল ইসলাম। এ সময় দোকানগুলো থেকে উদ্ধার করা ১১০ কেজি আম ধ্বংস করা হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুল হোসেন মিঞা মানবজমিনকে বলেন, শুধু মওসুমি ফল নয় সব ধরনের ফলে বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। এরকম তথ্য আমরা প্রতিনিয়তই পাচ্ছি। এবিষয়ে আমাদের তৎপরতাও যথেষ্ট। কিন্তু ফলে কেমিক্যাল মেশানোর বিষয়ে মাঠ পর্যায় থেকে যে সব ভয়ঙ্কর তথ্য আসছে তা খুবই উদ্বেগজনক। তবে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ মোবাইল কোর্টের নির্বাহী পরিচালক এএইচএম আনোয়ার পাশা এ বিষয়ে বলেন, মোবাইল কোর্টের অভিযানে সব ধরনের ফলেই ফরমালিনসহ ক্ষতিকর কেমিক্যালের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের জেল জরিমানা দিলেও ফলে কেমিক্যাল মেশানো হয় বাগান বা উৎপাদনস্থলে।

No comments

Powered by Blogger.