বাজেট ২০১৩-১৪ by এ এম এম শওকত আলী

প্রতিবছর বাজেট প্রণয়নের আগে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা হয়। এ বছরও অনুরূপ জল্পনা-কল্পনার সংবাদ সময় সময় দেখা গেছে। বাজেট প্রস্তাব সংসদে পেশ হওয়ার সময়ও বিভিন্ন মহল থেকে স্বাগত জানানো অথবা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়।
যেকোনো সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের সংস্কৃতি রয়েছে। সংসদের অভ্যন্তরে সব দেশেই বিরোধী দল বাজেটের বিষয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য পেশ করে পাল্টা প্রস্তাবও দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের সংসদে খুব একটা হয়নি। এর তিনটি কারণ রয়েছে। এক. বেশির ভাগ সময়ে ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাধিক্য। ফলে প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন হওয়া আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। দুই. ১৯৭৫ (আগস্ট)-১৯৮৫ পর্যন্ত সময়ে দেশে রাষ্ট্রপতি পরিচালিত শাসন কাঠামো ছিল। এ কাঠামোতেও বাজেট অনুমোদন ছিল আনুষ্ঠানিকতা বৈ কিছু নয়। তৃতীয় কারণটি আরো দুঃখজনক। প্রধান বিরোধী দলের প্রায় অবিরাম সংসদ বর্জন। এ বছরও তা হয়েছে, যদিও প্রধান বিরোধী দল স্বল্প সময়ের জন্য সংসদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছিল। তবে বাজেট প্রস্তাব দেওয়ার সময় তারা সংসদে যায়নি। এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল। ফলে সংসদে এ বিষয়ে কোনো প্রাণবন্ত আলোচনা হয়নি বা হবেও না।
এ বছরের বাজেটের আকার নিয়েই অনেক বেশি আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে। বাজেটের মোট বরাদ্দের পরিমাণ হয় দুই লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ নিয়ে একটি দৈনিকের মন্তব্য ছিল, গত পাঁচ বছরে বাজেটের আকার দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ ঘাটতিসহ অনুন্নয়ন বাজেটের আকার এক লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি ৬৫ থেকে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বর্তমান বাজেটের পরিমাণ ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি বলা হলেও এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ভিন্নমত হলো, ৭৩ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০০৮-০৯ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। গত এক দশকের মধ্যে বর্তমান বাজেটের পরিমাণ সবচেয়ে বড়।
বাজেট প্রণয়নে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের শেষ বছরের বাজেটে রাজনৈতিক প্রভাবই বেশি থাকে বলে সব সময় সমালোচনা করা হয়। তবে এ কথাও সত্য, এ প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক। সব ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলই ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম বছর থেকেই নিজ নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত নানা ধরনের অঙ্গীকার পূরণে উদ্যোগ গ্রহণ করে। কারণ তারা জানে, এ কাজটি ঠিকমতো করতে না পারলে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী না হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এর ফলে ক্ষমতার শেষ বছরের বাজেট নির্বাচনমুখী হবেই।
প্রতিষ্ঠিত রীতি অনুযায়ী বাজেটে বরাদ্দের প্রস্তাব সম্পর্কিত অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা দীর্ঘ সময়ের জন্য হয়। সংসদে যেকোনো প্রস্তাব দাঁড়িয়ে দিতে হয়। গত বছর অর্থমন্ত্রীকে বেশ কিছুটা ক্লান্ত দেখালে স্পিকার তাঁকে বসে প্রস্তাব পেশ করার অনুমতি দেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ জন্যই প্রয়োজন স্পিকারের বসে বলার অনুমতি। এবারের বাজেট বক্তৃতা ছিল ১৮৫ পৃষ্ঠার; যার মধ্যে ১১৯ পৃষ্ঠাই বক্তৃতা- ক্ষমতাসীন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাফল্য; যা অনেকেরই অজানা নয়। মূলত অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের লিখিত মতামত গ্রহণ করে। এ কারণেই সব মন্ত্রণালয় নিজস্ব সাফল্যের কথাই বলে। তবে এর সঙ্গে কিছু প্রস্তাব যে দেওয়া হয় না, তা নয়। তবে পূর্ণাঙ্গ মতামতে উন্নয়নবিষয়ক সাধারণ বক্তব্যের আধিক্য থেকে যায়। অর্থ মন্ত্রণালয় অবশ্যই এসব লিখিত প্রস্তাবের কিছু কাটছাঁট করে। কিন্তু তার পরও সার্বিক বক্তব্য দীর্ঘ হয়, যার বেশির ভাগ উন্নয়নবিষয়ক সাফল্য। ৯ জুনের একটি বাংলা দৈনিকের বিশ্লেষণধর্মী একটি লেখায় এসব প্রশ্নের অবতারণা করা হয়। এর শিরোনাম ছিল- বাজেট বক্তৃতা কে শোনে কে পড়ে আর কে বোঝে? কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। বাজেট বক্তৃতা শোনার বেশির ভাগ ব্যক্তি ব্যবসায়ী শ্রেণীর। এমনকি ছোট দোকানেও রেডিওতে বক্তৃতা শোনার সময় লোকের ভিড় দেখা যায়। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোও বাজেট বক্তৃতা শোনে, পড়ে এবং এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নিরপেক্ষ মতামত দিয়ে থাকে। প্রচারমাধ্যমে এগুলোও বলা হয়। তবে এ কথা সত্য, সাধারণ মানুষ বাজেট নিয়ে অতটা উৎসুক না হলেও কিছুটা আতঙ্কিত হয়। কারণ বাজেট ঘোষণার আগে থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এ বিষয়টি নিয়ে এ বছর মিডিয়ায় পরস্পরবিরোধী সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। ভোক্তারা টিভি মিডিয়ায় বলেছেন, কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে, যার কোনো যুক্তি নেই। পক্ষান্তরে কিছু দৈনিকে বলা হয়েছে, বাজেটের প্রভাব বাজারে পড়েনি। আশঙ্কা আসন্ন রমজান মাসে কী হবে?
শেয়ারবাজারে বাজেটের প্রভাব সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে। ডিএসই বলছে, বাজেট হয়েছে শেয়ারবাজারবান্ধব। অন্যদিকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বলেছে, কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এ মতবিরোধের মূল কারণ যে যার দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিজ্ঞতার আলোকে এসব পরস্পরবিরোধী মত প্রকাশ করছে। শেয়ার মার্কেট পরিচালকদের পক্ষে কিছু যুক্তি উপস্থাপন করা সম্ভব। ১০ জুন কালের কণ্ঠে এ ধরনের পাল্টাপাল্টি মত প্রকাশ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে ৮ জুন শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। সূচক পড়েছে ১৪৫ পয়েন্ট। লেনদেন কমেছে ৩০০ কোটি টাকা। বড় ধরনের দর পতনের কারণে প্রতিবাদে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ওই দিন বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁদের আশা ছিল, বাজেটে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য একটা থোক বরাদ্দ থাকবে। কিন্তু তা হয়নি। একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, যেসব প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে তার প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়েনি। এ বিষয়ে একজন নারী উদ্যোক্তা টিভি মিডিয়ায় বলেছেন, অতীতেও যেসব প্রণোদনার কথা বলা হয়েছিল তা ছিল প্রতারণা মাত্র। অন্যদিকে এ বছরের প্রণোদনা হলো ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ের উৎস কর দিতে হবে না। অর্থাৎ কর মওকুফ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে বলা যায়, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বাজেট প্রস্তাবের চূড়ান্ত অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ ১ জুলাই ২০১৩। ওই দিন থেকে সাধারণ নিয়মে বাজেট কার্যকর করা হয়। এর পরও কিছু সময় লাগা স্বাভাবিক। অনুমোদনের পর এনবিআর থেকে প্রজ্ঞাপন বা এমআরও জারি করতে হবে। ওই প্রজ্ঞাপন ব্যাংকে না পৌঁছা পর্যন্ত ব্যাংক কোনো রেয়াত দেবে না।
প্রতিবছর বাজেট সম্পর্কে বিভিন্ন মহল থেকে যেসব মত প্রকাশ করা হয়, তা প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক. ইতিবাচক। দুই. নেতিবাচক বা বিতর্কিত। এবারের বাজেটেও একই ধারা লক্ষণীয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দৈনিকে এ ধরনের মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। ইতিবাচক দিকগুলো হলো- এক. ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব ব্যক্তিদের কর সুবিধা। ২.৫০ লাখ টাকা করমুক্ত। আগে ছিল বিনিয়োগকারীদের কর রেয়াত। এ সম্পর্কে অবশ্য বলা হয়েছে, বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধি, ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ। বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তিন. চাকরিজীবী ও স্বল্প আয়ের ব্যক্তিদের কর সুবিধা। করমুক্ত বাড়িভাড়ার সীমা দুই লাখ ৪০ হাজার। আগে ছিল এক লাখ ৮০ হাজার। চার. করমুক্ত যাতায়াত ভাড়ার পরিমাণ বৃদ্ধি। নতুন প্রস্তাব হলো ৩০ হাজার টাকা। আগে ছিল ২৪ হাজার টাকা। পাঁচ. মফস্বলের নাগরিকদের জন্য কর ছাড়। জেলা সদরের পৌরসভা, উপজেলা ও গ্রামগঞ্জ পর্যায়ের কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের জন্য নূ্যনতম কর দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৯ জুন একটি দৈনিকে এ সংবাদে আরো বলা হয়েছে, করজাল বিস্তৃত করার লক্ষ্যেই এ প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
নেতিবাচক বা বিতর্কিত মতামতে কিছু বিষয় উত্থাপিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক অথবা বিতর্কিত বিষয় হলো বাজেটের বিশাল আকার। সমালোচনায় বলা হয়েছে, এতে আয়ের পথ কম, ব্যয়ের পরিমাণ বেশি। অর্থমন্ত্রী এ অভিযোগ স্বীকার করেননি। শীর্ষ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি অর্থমন্ত্রীর মতকেই সমর্থন করেছেন। দ্বিতীয় সমালোচিত বিষয়টি হলো, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। এর সপক্ষে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য হলো, এ পদক্ষেপ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। প্রতিবারের মতো এবারও বেসরকারি কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। কিছু দৈনিকে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগে খুব বেশি কর আদায় হয় না, তবু কেন এই সুযোগ? প্রতিবারের মতো এবারও বলা হয়েছে, সরকারের বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষমতা নেই। এ বছরের বাজেটের বিষয়ে এটা ভবিষ্যতেই বলা যাবে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.