আলোর পথযাত্রী জাহানারা ইমাম

সকাল আটটা-সাড়ে আটটায় এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি কণিকায় গিয়ে দেখতাম, ইংরেজি-বাংলা প্রায় সব দৈনিক পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে বেরোনো একাত্তরের ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলনের বিশেষ সংবাদ, নিবন্ধ, প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়তে তিনি ভোরেই টিক দিয়ে রেখেছেন। খাওয়ার টেবিল দখল করেছে কাগজের স্তূপ। তাঁর বাড়ি পাহারা দেওয়ার সময় আমাদের অনেক কাজের একটি ছিল, কাঁচি দিয়ে পত্রিকার সেই চিহ্নিত অংশগুলো কেটে তাতে আঠা লাগিয়ে সাদা কাগজে লাগানো এবং পরে পরিষ্কার করে দৈনিক পত্রিকার নাম ও তারিখ লিখে ফাইলবদ্ধ করা। আমরা কাজ করি আর তিনি পাশে বসে, কখনো বা পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ জোগান আমাদের। বলেন, ‘এই তো ওদের দিন ঘনিয়ে এল। দেখো, সারা দেশে কী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই আন্দোলন। দেশ জেগে উঠছে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম সোচ্চার। আর কত দিন আমাদের সন্তানদের চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখবে? ওই পাষণ্ডেরা একাত্তরে যে রক্তগঙ্গা বইয়েছে এ দেশে—তা আড়াল করার যত চেষ্টাই করুক না কেন সরকার, তা বৃথা যেতে বাধ্য।’
ফাইলিংয়ের এই কাজ করার সময় এক দিন আপ্লুত কণ্ঠে বললেন, ‘শোনো, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সাথে কথা বলেছি। তিনি এসব ডকুমেন্ট মাইক্রোফিল্ম করতে যাবতীয় সহায়তা দেবেন। তখন সহজেই সারা বিশ্বে আমাদের এ আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে দিতে পারব। দেশে-বিদেশে আমাদের আন্দোলনের তীব্রতায় সরকার বাধ্য হবে নতজানু হতে।’ আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে ই-মেইল, মোবাইল ফোন, ফেসবুক, টুইটারবিহীন বাংলাদেশে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের প্রতিরোধ করার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করার আন্দোলন সর্বব্যাপী করতে এভাবেই সক্রিয় ছিলেন জাহানারা ইমাম।
সে এক অন্য রকম সময়। একানব্বইয়ের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি নাগরিক, যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমণি গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ঘোষণা করা মাত্রই প্রতিবাদ করে এ দেশের বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী সম্প্রদায়। মুক্তিযুদ্ধপক্ষের সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন, শহীদ সন্তানদের সংগঠনসহ (প্রজন্ম ’৭১) আপামর ছাত্র-জনতা তখন শামিল হয়েছিল এক মঞ্চে—সে মঞ্চের নেতা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীকৃত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের হোতাদের জন্য বার্ট্রান্ড রাসেলের নেতৃত্বে করা হয়েছিল ‘পাবলিক ট্রায়াল’। এর আদলে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের জন্য জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ আয়োজন করা হলো ‘গণ-আদালত’-এর। দেশবাসী যেন এমনই এক ডাকের প্রতীক্ষায় ছিল দীর্ঘকাল। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো সর্বব্যাপী হলো এ আন্দোলন, জাহানারা ইমামের মতো এক যোগ্য কান্ডারির কারণে। তাঁর তেজোদীপ্ত কণ্ঠের চাবুকে উন্মাতাল দেশবাসী তখন এককাট্টা নিজ বাসভূমে নির্বাসিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষায়। মঞ্চ থেকে প্রেরণাদায়ী, সাহস-সঞ্চারী, স্বপ্ন-জাগানিয়া ভাষণই তিনি শুধু দিতেন না, আন্দোলন বেগবান করতে ও সঠিক পথে জারি রাখতে তিনি ছিলেন ‘ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীন, সংকটে অটল’। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে কিংবা গুলিস্তানের মোড়ে যে সভা হবে বিকেলে, তার মঞ্চ ঠিকভাবে হলো কি না, মাইক ঠিকমতো আসছে কি না বা অন্য কোনো বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে কি না তা জানতে তিনি সরেজমিনে সকালেই হাজির হতেন সভাস্থলে। কমলা রঙের ভক্সওয়াগন গাড়িতে চড়ে তাঁর সঙ্গে অনেকের মতো আমারও এসব জায়গায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।
আরেকবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত জাতীয় কনভেনশনে প্রজন্ম ’৭১-এর সদস্যরা দায়িত্ব পেলাম প্রতিনিধিদের নিবন্ধন করার। আমরা কড়া রোদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অতিথিদের নিবন্ধনে যখন ব্যস্ত, তখন মিলনায়তনের মঞ্চে বসা জাহানারা ইমাম মূল অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক আগে আমাকে একটা চিরকুট পাঠালেন। সেখানে লেখা—‘আর আধঘণ্টা কাজ করে তুমি সবাইকে নিয়ে ভেতরে চলে এসো।’ তীব্র দাবদাহ থেকে আমাদের শুধু রক্ষা করার জন্য নয়, জাতীয় এই কনভেনশনে আমাদের শহীদ পরিবারের সন্তানদের উপস্থিতিকে গুরুত্ব দিতে এই চিরকুটখানা শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আমাকে দিতে ভোলেননি। এ রকম অভিজ্ঞতা শুধু আমার নয়, যাঁরাই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদেরই হয়েছে।
নানা ঘাত-প্রতিঘাত সামাল দিয়ে জাহানারা ইমাম যখন এগিয়ে নিয়ে গেছেন এই আন্দোলন, তখন অন্যদিকে তদানীন্তন খালেদা জিয়ার সরকার নির্লজ্জভাবে সমর্থন দিয়ে চলেছিল যুদ্ধাপরাধীদের। জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় সাংসদেরা যখন বিচারের দাবিতে সোচ্চার, তখন কঠোর হাতে এ আন্দোলন দমন করতে সরকার সচেষ্ট ছিল শুরু থেকেই। পুলিশ বাহিনী দিয়ে প্রকাশ্যে জাহানারা ইমামের ওপর লাঠিচার্জ করেই ক্ষান্ত হয়নি সরকার, একাত্তরের হত্যাকারীদের বিচার চাওয়ার অপরাধে তাঁকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে মামলা করেছে। সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
১৯৯৪ সালের এই দিনে আমরা হারালাম শহীদ জননীকে। সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাঠের বারকোশে ‘নিষ্প্রাণ রাষ্ট্রদ্রোহী’র স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘটল যেদিন, সেদিন শিকড়হীন অনেকেই স্বস্তির ঢেঁকুর তুলেছে। আর আমরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে আরও অনেকের সঙ্গে কাতরচিত্তে অপেক্ষা করেছি আমাদের শহীদ জননীর জন্য। ক্যানসারের কাছে তিনি পরাজিত হলেন সত্য, কিন্তু তাঁর আরাধ্য দাবি, যা কিনা আমাদের সবার মনের কথা, তা ‘ছড়িয়ে গেল সবখানে’। শেখ হাসিনার সরকার আমাদের সে দাবি পূরণ করার অঙ্গীকার করেছে। কাজও শুরু হয়েছে। আজকের তারুণ্যও সে কাজের অংশভাক। নবপ্রজন্মের হাতে এখন জাহানারা ইমামের সূচিত আন্দোলনের মশাল। সে মশাল যেন নিভে না যায়।
তৌহীদ রেজা নূর

No comments

Powered by Blogger.