প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক চলছেই

চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বিতর্ক চলছেই। সাবেক নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের অনেকেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনের সঙ্গে একমত নন। আবার অনেকে মনে করছেন বিবিএসের প্রাক্কলনই সঠিক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, সরকারের প্রাক্কলিত জিডিপির প্রবৃদ্ধি যৌক্তিক নয়। প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি অনুযায়ী বিনিয়োগ হয়নি।
অন্যদিকে বিনিয়োগ পরিস্থিতি, নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন সঠিকই রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন।
গতকাল রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুল আয়োজিত ‘অর্থনীতির অবস্থা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক সংলাপে তাঁরা এ রকম বিপরীতধর্মী মত দেন। বিজনেস স্কুল মিলনায়তনে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের হেড অব গ্লোবাল মার্কেটস আলমগীর মোর্শেদ। এ ছাড়া বক্তব্য দেন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সভাপতি পারভীন মাহমুদ, ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের পরিচালক মামুন রশীদ প্রমুখ। সংলাপে সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাক ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক সৈয়দ এম হাশেমী।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, গত কয়েক বছরে জিডিপিতে বিনিয়োগ অনুপাত একই রকম থাকা সত্ত্বেও গত এক বছরের মধ্যে উৎপাদনশীলতা এত বাড়ল কীভাবে? বিবিএসের উপাত্তের ওপর বেশি নির্ভর করা যায় না।
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, এ বছর সরকারি বিনিয়োগ কমেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আয়তন কমিয়ে সংশোধন করা হয়েছে। উচ্চহারে রপ্তানি হলেও তার তুলনায় আমদানি প্রবণতা বেশি। আবার প্রবাসও কমেছে যা ভোক্তা চাহিদা কমিয়েছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়?
তবে বিনায়ক সেন বিবিএসের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন সঠিক রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। আর এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সমালোচনারও সমালোচনা করেন তিনি।
বিনায়ক সেন বলেন, গত কয়েক বছর ধরে একই হারে বিনিয়োগ হচ্ছে। শুধু এ বছরই কম বিনিয়োগ হয়নি। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে কৃষিবহির্ভূত খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো এসব খাতে বিনিয়োগ করছে। আর শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। আগে মোট শ্রমমক্তির ১৫ ভাগ ছিল নারী, এখন তা ৩০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। এসব কারণে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
তবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি কতটা জরুরি—এ প্রসঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন বিনায়ক সেন। তাঁর মতে, উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। এতে শিল্প বর্জ্য বাড়ছে, পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি আয় বৈষম্য বাড়াচ্ছে।
অন্যদিকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পক্ষে মত দিয়েছেন এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলে সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্য কমে। দারিদ্র্য কমার বিষয়টি আঞ্চলিক পর্যায়ে দেখলে হবে না। সবার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে উচ্চ হারে দারিদ্র্য বিমোচন করব নাকি নিম্ন প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সম্পদের সুষম ব্যবহার করে দারিদ্র্য কমাব।’
বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এ মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ রয়েছে। উচ্চ আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আর পুঁজিবাজার বিশৃঙ্খলভাবে চলছে।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, সার, জ্বালানি খাতে বড় ধরনের ভর্তুকির জন্য সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে রয়েছে। এ ধরনের ভর্তুকি জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কতটা কাজে লাগে তা এখন বিবেচনা করার সময় এসেছে।

No comments

Powered by Blogger.