দলের চেয়ে কোন্দলই বড় হলো

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন চট্টগ্রামে। এ কথা পাঠকের জানা আছে। তবে অনেকেই বিস্মৃত হতে পারেন, সেবার তিনি চট্টগ্রামে এসেছিলেন স্থানীয় বিএনপির কোন্দল মেটাতে। মৃত্যুর আগের দিন বিবদমান দুটি গ্রুপের নেতা আরিফ মঈনুদ্দিন ও সলিম উল্লাহর সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমান আজ নেই, কিন্তু নানা দল ও আদর্শ থেকে বিএনপিতে এসে জড়ো হওয়া নেতা-কর্মীদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাঁর পূরণ হয়নি কোনো দিনই। এর মধ্যে তিন-তিনবার (’৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারিসহ) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেছে দলটি, কিন্তু বিভেদ ও অনৈক্যের যে সুরটি ছিল শুরু থেকেই, তা থেকে আর কখনোই বেরিয়ে আসতে পারেনি বিএনপি।
এবার ১৬ নভেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কাউন্সিলে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়, তাতে আরও একবার প্রমাণিত হলো দলের ঐক্য ও পুনর্গঠন নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যত কথাই বলুক, দলে প্রাধান্য বিস্তারে সচেষ্ট নেতা-কর্মীদের মনে তার প্রভাব পড়েছে সামান্যই। কেন্দ্রীয় নেতা আ স ম হান্নান শাহ, বরকতউল্লা বুলু, মো. শাহজাহান ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের উপস্থিতিতেই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন দলের বিবদমান গ্রুপের কর্মীরা। অসহায় নেতাদের চোখের সামনে তাঁদের সমর্থকেরা যেভাবে মাইক ভেঙে, চেয়ার ছুড়ে কাউন্সিল পণ্ড করে দিয়েছেন, তাতে ঐক্যের ‘ললিত বাণী’কে ‘ব্যর্থ পরিহাস’ ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।
আসলে এ কাউন্সিলের অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব-মতানৈক্য চলে আসছিল। নগরের কোতোয়ালি ওয়ার্ডের সম্মেলন নিয়ে পরস্পরবিরোধী সভা-সমাবেশ হয়েছে। বোয়ালখালী, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যেখানেই সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেখানেই হাতাহাতি-মারামারির ঘটনা ঘটেছে।
পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। এত কিছুর পরও বিএনপির কেন্দ্রীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কাউন্সিল আহ্বান করা হয়েছিল। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে কমিটি গঠন নিয়ে আবদুল্লাহ আল নোমান, মোরশেদ খান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বা সাকা চৌধুরীর বিরোধের কথাটি মাথায় রেখে ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠক করেছেন তাঁদের সঙ্গে। আপাতত সংঘর্ষ এড়াতে কাউন্সিলে কমিটি ঘোষণার পরিবর্তে কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয় বিবদমান গ্রুপগুলোর নেতাদের। সাময়িক সমঝোতার ভিত্তিতে কাউন্সিল করার ব্যাপারে সম্মতি দেন নেতারা। কিন্তু অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার বোধ থেকে আগুন জ্বলছিল কর্মী-সমর্থকদের মনে, তাকে ছাইচাপা দিয়ে রাখা যায়নি কাউন্সিলের দিন। এতে ইন্ধন জুুগিয়েছেন খোদ নেতারাই।
অবাক করার ব্যাপার হলো, নোমান, মীর নাছির, মোরশেদ খান বা সাকা চৌধুরীদের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে হলেও এ কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে তাঁরা প্রায় সবাই এককাট্টা হয়েছে আমীর খসরুর বিরুদ্ধে। আমীর খসরুও আহ্বায়ক হিসেবে নিজের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেননি। তাই মীর নাছির বা সাকা চৌধুরীর সমর্থকেরা যখন নোমানের পক্ষে স্লোগান দিয়ে মঞ্চ দখল করতে এগিয়ে যান, তখন মনে হয় রাজনীতিতে তো বটেই, উপদলীয় কোন্দলেও স্থায়ী শত্রুমিত্র বলে কিছু নেই।
চট্টগ্রামের বিএনপিতে একসময় অলি-নোমানের দ্বন্দ্বের কথা ছিল বহুল আলোচিত, পরে নোমান-সাকা, নোমান-মীর নাছির বা সাকা-মোরশেদ খান দ্বন্দ্বের বিষয়গুলোও উঠে আসে প্রকাশ্যেই। এসব দ্বন্দ্ব খুন-জখম পর্যন্ত গড়িয়েছে। এবার কমিটি গঠন ও দলে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধিকে সামনে রেখে এই নেতারা যেভাবে অতীতের দ্বন্দ্ব ভুলে এককাতারে এলেন, তাতে মনে হয় নিজেদের স্বার্থের চেয়ে বড় কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত নন তাঁরা। শুধু স্বার্থচিন্তাই। এক ঘাটে পানি খাওয়াতে নিয়ে এল বাঘ ও গরুকে।
সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে দেনদরবার এবং জাতীয় স্বার্থে নানা ইস্যুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতির জন্য এ সময়টিতে বিএনপির উচিত সাংগঠনিক ভিত্তি দৃঢ় করা। অথচ প্রধান বিরোধী দল তার সমর্থকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না।
সম্মেলন ও কাউন্সিল পণ্ড হওয়ার পর কেন্দ্রীয় নেতারা সাংবাদিকদের যথারীতি বলেছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দলে এ রকম কিছু গোলযোগ থাকতেই পারে, তবে এটা দলের বৃহত্তর ঐক্যের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছে গোলযোগের সংবাদ।
কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দলগুলোই তো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যায় জনসমর্থন নিয়ে, যাঁরা কমিটি গঠনের মতো ছোটখাটো বিষয়ে নিজেদের এভাবে বিভক্ত করতে পারেন, তাঁরা দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবেন কীভাবে?
মাহবুবুল করিম, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।

No comments

Powered by Blogger.