টাকা ভল্টে তাই সংকট... by শামীমুল হক

ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রেখে ফরহাদ জামান ভীষণ চিন্তিত। গত মাসে মাত্র পাঁচ লাখ টাকা তুলতে গিয়েছিলেন একটি ব্যাংকে। ক্যাশ কাউন্টারে চেক জমা দিতেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন তিনি। এত টাকা তুলবেন আগে কেন জানালেন না? কাল আসুন। শেষ পর্যন্ত ফরহাদ জামান পরদিন গিয়ে টাকা তুলেন। ব্যাংকার নীলা। একটি  বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। তিনি জানালেন, তাদের উপর এখন ভীষণ চাপ।
কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক স্টাফকে টার্গেট দিয়েছেন গ্রাহক বাড়াতে। আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকে বকেয়া টেলিফোন বিল দিতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েন গৃহবধূ নুরুন্নাহার। কাউন্টারে বিলগুলো দিতেই ওপাশ থেকে বলা হয়- টেলিফোন বিল আজ জমা নেয়া হবে না। পরে আসুন। অনেক অনুরোধ করেও তিনি রাজি করাতে পারেননি ব্যাংক কর্মকর্তাকে। ফিরে আসার মুহূর্তে ওই ব্যাংক কর্মকর্তা শর্ত দেন যদি ওই ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেন তাহলে তিনি বিল নেবেন। এই শর্তেই রাজি হন নুরুন্নাহার। সেদিনই ব্যাংক কর্মকর্তা গ্রাহক ফরম দিয়ে দেন নুরুন্নাহারকে। এমন নানা ঘটনা এখন ব্যাংক পাড়ায়। এর পেছনে কারণ একটাই ব্যাংকগুলোতে চলছে টাকার তীব্র সংকট। টাকার জন্য ধুঁকছে ব্যাংকগুলো। পরিস্থিতি এমন যে রীতি ভেঙে ৭ ব্যাংক ও দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংকের তহবিল থেকে ধারে টাকা নিয়েছেন। যার পরিমাণ সাড়ে ৬ হাজার টাকারও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়ে সতর্ক করেছে ব্যাংকগুলোকে। কিন্তু কেন এই টাকার সংকট? তাহলে কি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে তা চলে যাচ্ছে অন্য পথে? সাদা টাকা হয়েও তা কি কালো টাকায় রূপ নিচ্ছে? অবস্থাদৃষ্টে তা-ই দেখা যাচ্ছে। নানাভাবে, নানা পথে অর্থ উপার্জন করে তা ব্যাংকে না রেখে ব্যাংকের মতো ভল্ট বানিয়ে নিজ বাড়িতে রাখার চিত্রও উঠে এসেছে সাম্প্রতিক ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে। সূত্রাপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনুর কব্জা থেকে এমন পাঁচটি ভল্ট উদ্ধার করা হয়েছে। যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা। অবাক করা বিষয় ভল্টে টাকার সংকুলান না হওয়ায় স্বর্ণালঙ্কার কিনে রাখা হয়। যার পরিমাণ ৭২০ ভরি। এর আগে টেন্ডার মুঘল জি কে শামীমের অফিস থেকে উদ্ধার করা হয় নগদ পৌনে দুই কোটি টাকা ও ২০০ কোটি টাকার এফডিআর।
টেন্ডার মুঘল জি কে শামীম টেন্ডার ভাগিয়ে নিতে ঘুষই দিয়েছেন ১৫০০ কোটি টাকা। ওদিকে ক্যাসিনো লোকমান শুধু অস্ট্রেলিয়ার ব্যাংকে রেখেছেন ৪১ কোটি টাকা। মতিঝিলের টাকার খনি কমিশনার মমিনুল হক সাঈদ এখন আছেন দেশের বাইরে। তারও অবৈধ পথে আদায় করা অর্থ দেশের কোনো ব্যাংকে রাখা হয়নি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ক্যাসিনো চালানো থেকে যত টাকাই কামাই করেছে রাঘববোয়ালরা তা এসেছে ব্যাংক থেকে। কিন্তু সেসব টাকা আর ব্যংকে ফেরত যায়নি। ফলে ব্যাংকগুলো হয়ে পড়েছে অর্থশূন্য। কোনো কোনো ব্যাংক গ্রাহকের টাকা দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে চলতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো অর্থ সংকটে থাকলেও বাংলাদেশিদের পাঠানো টাকায় সুইস ব্যাংক সমৃদ্ধ হচ্ছে। গত জুনে ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৮’ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৬৫৫৯ কোটি টাকা। যা আগের বছরের চেয়ে ২৯ শতাংশ বা ১২০০ কোটি টাকা। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আগের বছর দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫৩৫৯ কোটি টাকা।
এছাড়া দেশের বিপুল অর্থ দিয়ে মালয়েশিয়ায় তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোম। মোদ্দা কথা- দেশের অর্থ ব্যাপকহারে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আর দেশেও যারা অবৈধ পথে উপার্জন করছে তারা টাকা ব্যাংকে না রেখে রাখছে নিজ ঘরে। ফলে অর্থ সংকটে পড়তে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে এ টাকার সংকট দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। সাতটি ব্যাংক ও দুইটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধার করে চলা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর টাকার লেনদেনে সংকট দেখা দিলে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার অর্থাৎ কলমানি মার্কেট থেকে তারা স্বল্পসময়ের জন্য ধার করে থাকে। কিন্তু এটা নিয়মের মধ্যে থেকে করতে হয়। টাকার সংকটে থাকায় ওই ব্যাংকগুলো এখন ধার করে চলছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআরআর (নগদ জমা) ও এসএলআর (বিধিবদ্ধ সঞ্চিতির হার) জমা রাখতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ২ বারে ঋণ নিয়েছে ১৫৭৫ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড ৩ বারে ঋণ নিয়েছে ২২১০ কোটি টাকা। এই ব্যাংকটির ঋণ নিতে পারতো সর্বোচ্চ (লিমিট ছিল) ১৬৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ অতিরিক্ত ৬৫০ কোটি টাকা বেশি নিয়েছে।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ঋণ নিয়েছে ১১৫০ কোটি টাকা। এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড নিয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংক লি. নিয়েছে ১৮০ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংক লি. নিয়েছে ২০০ কোটি টাকা ও এবি ব্যাংক লি. ধার নিয়েছে ২০ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকে পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ঋণ নিয়েছে ৮৪ কোটি ৫ লাখ টাকা। হজ ফাইন্যান্স কোম্পানি ধার নিয়েছে ৫০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ৭ই ফেব্রুয়ারি মাসে ইসলামী ব্যাংকের ২৭২তম বোর্ড সভায় অন্য ব্যাংককে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার জন্য অনুমোদন পাস করা হয়। তবে বলা হয়, কোনোভাবেই ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি অতিক্রম করবে না। কিন্তু ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত ৪২৯ কোটি ৫ লাখ টাকা বেশি ঋণ দেয়া হয় ওই ৯টি প্রতিষ্ঠানকে। আর এই অতিরিক্ত টাকাও দেয়া হয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে। যা নিয়ম-রীতির ভঙ্গ বলে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সার্বিক বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, অনেকেই আগ্রাসী ব্যাংকিং করছে। সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ঋণ দিয়ে ফেলেছে। হাতে নগদ কোনো ক্যাশ রাখেনি। অনেক ব্যাংকে ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার ওপরে চলে গেছে। ফলে টাকার সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মানলে এই সমস্যায় পড়তে হতো না বলে মনে করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.