মোদির ফেডারেলবিরোধী এজেন্ডায় হুমকির মুখে ভারতের ঐক্য by সুবীর ভৌমিক

ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইউনিয়ন অব স্টেটস’ হিসেবে অভিহিত করা হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রয়েছে বিপুল ক্ষমতা। এ কারণে ভারতকে বলা হয়, ‘শক্তিশালী ইউনিটারি বায়াজ ফেডারেশন।’
অবশ্য, অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভাষার ভিত্তিতে গঠিত রাজ্যগুলোকে নিয়েই ভারত একটি ফেডারেশন। সুপ্রিম কোর্টের অনেক রায়ে ভারতীয় সংবিধানের অপরিবর্তনযোগ্য ‘মৌলিক কাঠামো’ নিয়ে গঠিত ‘ফেডারেল নীতিমালা’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে বিজেপি এই মৌলিক কাঠামোটাই ধীরে ধীরে ওই পর্যায় পর্যন্ত ক্ষয় করার চেষ্টা করছে যাতে ‘হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্তান’ নিয়ে আরএসএসের ভিশনের পথ তৈরি হয়ে যায়।
মোদির ‘সহযোগিতামূলক ফেডারেলবাদ’ এমন প্রত্যাশার ওপর ভিত্তি করে প্রণীত যেখানে রাজ্যগুলো নিঃশর্তভাবে কেন্দ্রকে সমর্থন করবে, কোনো আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই এর নির্দেশনা অনুসরণ করবে।
নোট বাতিলকরণসহ কেন্দ্রের নেয়া অন্য সব সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ছাড়া রাজ্যগুলোর আর কোনো উপায় ছিল না। এটা পরিণত হয়েছে একমুখী রাস্তা।
বিজেপির পরিচালিত রাজ্যগুলো সর্বোচ্চ নেতার সাথে কোনো ধরনের মতবিরোধে যাবে না বলেই প্রত্যাশা করা হয়ে থাকে এবং আঞ্চলিক দলগুলো শাসিত যেসব রাজ্য বহন-অসাধ্য মনোভাবের বিরোধিতা করবে, তাদেরকে দেশ ভাঙ্গার চক্র হিসেবে গালিগালাজ করা হবে কিংবা ‘মহামিলাওয়াতের’ অংশ হবে।
মোদি ও অন্যান্য বিজেপি নেতা ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময় বিরোধী জোট গড়ার চেষ্টাকারীদের ‘মহামিলাওয়াত’ হিসেবে আক্রমণ করে।
আঞ্চলিক দলগুলো অপরিহার্য
কিন্তু ভারতীয় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আঞ্চলিক দলগুলো অপরিহার্য ও অবিভাজ্য। তামিল নাড়ুর দ্রাভিদা মুনেত্রা কাজগাম (ডিএমকে) স্থানীয় শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনগুলো থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। কাশ্মিরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের মতো কিছু দল এমনকি ভারত বিভক্তিরও আগে আত্মপ্রকাশ করেছিল। আবার তেলুগু দেশমের মতো অনেক দল দিল্লির বাড়াবাড়ি রকমের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করার সময় আবির্ভূত হয়।
ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকে কংগ্রেসের ব্যক্তি পূজার ফলেও দলে ভাঙনের সৃষ্টি হয়ে মহারাষ্ট্রে শরদ পাওয়ারের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) ও পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়। কংগ্রেস থেকে বের হয়ে যাওয়া এসব গ্রুপের একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক পরিচিতি রয়েছে।
আঞ্চলিক দলগুলো মুছে ফেলা যায় না, কারণ এগুলো ভারতের বহুজাতিক পরিচিতির প্রতিফলন ঘটায়। এগুলোর মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অনিবার্য প্রকাশ ঘটেছে।
যারা বিশ্বাস করে যে ভারতকে কেন্দ্রীয়ভাবে শাসন করা যাবে, তারা মোগল বা দিল্লি সালতানাতের সময়ে যেসব ভুল করেছিল, সেই একই ভুল করছে। যারা প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করে, দিল্লি আসলেই অনেক দূরে।
মোদির ‘এক জাতি, এক নির্বাচন’ ফেডারেল ভারতের ধারণাকেই আঘাত করছে। বিজেপির এই উদ্যোগ গ্রহণ করার কারণ হলো, তারা মনে করছে, যুগপৎভাবে সব রাজ্য ও কেন্দ্রে নির্বাচন হলে শক্তিশালী মোদি ব্র্যান্ডের ফলে তাদের ক্ষমতা দখল সহজ হবে।
২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনের সাথে যে রাজ্যটির নির্বাচন হয়েছে, তার ফলাফলে দেখা যায়, উড়িষ্যায় বিজু জনতা দলের (বিজেডি) মতো শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলো কিভাবে ভোট দেয়।
মোদির ‘এক দেশ, এক ভোট’ নির্বাচনী খরচ হিসেবে ৫৫ হাজার মিলিয়ন রুপি বাঁচাবে বা বারবার নির্বাচন আয়োজনে ঝামেলা থেকে রক্ষা করবে বলে বিজেপি যে কথা বলছে, তা একেবারে আনাড়ি বক্তব্য।
তাহলে বিজেপি কেন গুজরাটের রাজ্য সভার দুটি আসনে একই তারিখে ভোট আয়োজনের বিরোধিতা করেছিল? বাস্তবতা হলো, বিজেপি-আরএসএস জুটি পেশীশক্তির জাতীয়তাবাদীর মোদি ব্র্যান্ডকে জাতীয় শক্তি কাঠামোতে (কেন্দ্র ও রাজ্য) অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করতে চায়।
সম্প্রতি একজন ভাষ্যকার দেখিয়ে দিয়েছেন, অর্থনীতিতে অন্তত ১০টি ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে ৫০ হাজার মিলিয়ন রুপি বা তার চেয়ে বেশি সাশ্রয় করা সম্ভব। এসবের মধ্যে বড় ধরনের একটি ব্যয় হ্রাস হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত প্রচারণা বাজেটে। আরেকজন বিশ্লেষক বলেছেন, এক জাতি, এক ভোট ধারণাটি আসলে সেতুর কিছু কাঠামোগত সমস্যার কারণে নদীর ধারা বদলে দেয়ার মতো।
হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান
বিজেপির ফেডারেলবাদের ওপর আক্রমণের উৎস হলো আরএসএসের ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তানের’ ওপর ভিত্তি করে প্রণীত ‘এক ভারত’ দর্শন।
জাতীয় শিক্ষানীতিতে তৃতীয় ভাষার মাধ্যমে হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা ওই মতাদর্শ প্রচারই প্রতিফলিত করে। তামিল নাড়ু ও আরো কয়েকটি রাজ্যে কঠোর প্রতিবাদের ফলে হিন্দিতে শিক্ষার প্রয়াস বাতিল করা হয়েছে। তবে আরএসএস জানিয়েছে, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
হিন্দির পরিচিতি জোরদার করা ও সুসংহত করার অনেক চেষ্টা চলছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানে জোর দেয়া, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা, সন্ত্রাসে অভিযুক্ত প্রজ্ঞা ঠাকুরের মতো হিন্দু কট্টরপন্থীদের জন্য পার্লামেন্টে আসনের ব্যবস্থা করা, রাম মোহন রায়ের মতো বাংলার রেনেসাঁস ব্যক্তিত্বদের সুনাম হানি করা।
হিন্দি ও হিন্দুর বেলাও প্রায় একই কথা। তারপর আসে ‘এক হিন্দুস্তান।‘ আর তা প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হচ্ছে ‘এক জাতি, এক নির্বাচনের’ মাধ্যমে।
কলামিস্ট স্বামিনাথান আয়ার ‘এক জাতি, দুই নির্বাচনের’ পরামর্শ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের দুই বা তিন বছর পর সব রাজ্যের নির্বাচন হতে পারে। তার মডেলটি মার্কিন মডেলের মতো। সেখানে প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচন হয় সাধারণত প্রেসিডেন্ট ও সিনেট নির্বাচনের অনেক পর।
কোনো রাজ্যে সরকার যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়, তখন কী হবে? যেসব রাজ্য কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় আসবে, সেগুলো কি অন্য রাজ্যগুলোর জন্য অপেক্ষা করবে? কেন্দ্রে সরকারের পতন হলে কী হবে? এটা কি ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে? এসব প্রশ্নের সমাধান দিতে হবে।
মিডিয়ার বিতর্কে ইতোমধ্যেই এই আইডিয়াটির অসম্ভব প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তবে বিজেপি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত প্রস্তাবটি নিয়ে কথা বলেই যাবে। বর্তমানে লোকসভায় বিজেপির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও ২৪৫ আসনবিশিষ্ট রাজ্য সভায় রয়েছে তাদের ১০৬ জন।
ভারত আসলে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে
ভারতীয় সেনাবাহিনীর বন্দুকের মাধ্যমে নয়, বরং ঐকমত্য ও ভদ্রোচিত মিলের মাধ্যমে ভারতীয় ইউনিয়ন একত্রিত হয়েছিল। আঞ্চলিত পরিচিতিগুলোর সহিষ্ণুতা এর অংশ। এখন এর কোনো ধরনের ক্ষতি ফেডারেল ব্যবস্থার ভিত্তিকেই দুর্বল করে দিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
ধর্মভিত্তিক কেন্দ্রীয় রাজনীতি পাকিস্তানকে এক রাখতে পারেনি। ইসলাম ও একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে এক রাখতে পারেনি। এমনকি ১৯৭১ সালের পরও শক্তিশালী বিচ্ছিন্নতাবাদ ও স্বায়ত্তশাসনবাদী আন্দোলন পাঞ্জাবের বাইরের সব প্রদেশে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু আমাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো শিক্ষা গ্রহণ করার বদলে মোদির বিজেপি ধর্ম চালিত জাতি-রাষ্ট্রের ব্যর্থ পাকিস্তানি মডেলকে ভারতে নিয়ে আসছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার লোকজন জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব সমাহিত করে দিয়েছে। এখন হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় উন্মাদনা জিন্নাহর দ্বিজাতীয় তত্ত্বকে নতুন করে বৈধতা দিতে যাচ্ছে।
প্রতিবেশীদের ওপর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি প্রদানের মাধ্যমে বিজেপি একটি প্যান্ডোরা বাক্স খুলছে। এর মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের পুরো পূর্বাঞ্চলে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হতে পারে। উল্লেখ্য আসামের এনআরসির ফলে প্রায় ৩০ লাখ বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম বহিস্কৃত যদি নাও হয়, তবুও অন্তত ভোটাধিকার হারাতে চলেছে।
এনআরসির কোনো বিরূপ প্রভাব যদি বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে পড়ে, তবে মোদির ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ আকাঙ্ক্ষার ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে, উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আর স্রেফ সরকার পরিবর্তনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গকে ‘কাশ্মিরের চেয়েও খারাপ’ হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে মোদি-শাহ জুটি আসলে ইন্দিরা গান্ধীর ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করছে। উল্লেখ্য, ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮৪ সালে নির্বাচিত ফারুক আবদুল্লাহ সরকারকে হঠিয়ে দিয়ে জঙ্গিবাদের ভিত্তি প্রস্তুত করেছিলেন। ভারত এখনো এই সমস্যায় রয়েছে।
মোদি দৃশ্যত বুঝতে পারছেন না যে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ প্রজেক্টের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

No comments

Powered by Blogger.