হঠাৎ উত্তপ্ত আন্ডার ওয়ার্ল্ড

ঝিমিয়ে পড়া আন্ডারওয়ার্ল্ড হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এক সময়ের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। এসব সন্ত্রাসীর অনেকেই বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে বিদেশে পলাতক আছে। আবার অনেকে আছে কারাগারে। কিন্তু আড়ালে-আবডালে থেকেই তারা আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি
বেশ কিছু ঘটনা তার জানান দিচ্ছে। বিশেষ করে ঈদ ও পশুরহাটকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের চাঁদাবাজির টার্গেট নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এছাড়া টেন্ডারবাজি, দখল, এলাকা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে তারা।
এজন্য সরবরাহ করছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। ১৬ই জুলাই শীর্ষ সন্ত্রাসী পরিচয় দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদকে একটি বিদেশী নম্বর থেকে ফোন দিয়ে টাকা চাওয়া হয়। টাকা না দিলে পরিবারের সদস্যদের গুম করার হুমকিও দেয়া হয়। ঘটনার দিন আনু মুহাম্মদ তার ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, + ৯১৮০১৭৮২২৭২৫ থেকে সকাল ১০টার দিকে একটা ফোন এলো। নিজের পরিচয় দিলেন সুব্রত বাইন, কলকাতায় থাকেন, তিনি নাকি শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। কলকাতায় তার ছোট ভাইদের চিকিৎসার জন্য টাকা দাবি করলেন। না দিলে পরিবারের সদস্য গুমসহ কীভাবে টাকা আদায় করবেন তা দেখতে বললেন।

এবিষয়ে যোগাযোগ করলে আনু মুহাম্মদ মানবজমিনকে বলেন, ঘটনার পরে আমি খিলগাঁও থানায় একটি জিডি করেছি। তবে এরপর থেকে আর কেউ ফোন দেয়নি। জিডি করার পরে থানা পুলিশও যোগাযোগ করেনি। জিডির বিষয়ে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, আমরা জিডির তদন্ত করছি। একটি কপি ডিএমপির সাইবার টিমের কাছে পাঠিয়েছি। তিনি বলেন, এরকম মোবাইল নম্বর থেকে প্রায়ই বিভিন্ন লোকের কাছে ফোন আসে। অনেকে এসে থানায় জিডি করে রাখে। যে নম্বর থেকে ফোন আসে এসব নম্বর দেশের বাইরের।

শনিবার বিকালে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার একটি টিম সন্ত্রাসীকর্তৃক যুবলীগ দক্ষিণের এক শীর্ষ নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়ার তথ্য জানিয়েছে। এর নেপথ্য রয়েছে, খিলগাঁও এলাকার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী। মধ্যপ্রাচ্যে বসে সে তার ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের দিয়ে হত্যা পরিকল্পনা করেছিল। গোয়েন্দা পুলিশ একে-২২ রাইফেল ও বিদেশী পিস্তলসহ খিলগাঁর সিপাহীবাগ এলাকা থেকে তার ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করেছে।

গোয়েন্দাসূত্র বলছে, ওই শীর্ষ সন্ত্রাসী মধ্যপ্রাচ্য বসেই টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল, খুন-খারাবির নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব কাজের জন্য তার বড় ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। তার বিভিন্ন কর্মকান্ডে যুবলীগ দক্ষিণের এক নেতা বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। রাজধানীর খিলগাঁও, মতিঝিল, পল্টনসহ আশে পাশের অন্যান্য এলাকায় তার অনুসারিরা রয়েছে। মূলত তাদেরকে দিয়েই সব কাজ হাসিল করে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একে-২২ রাইফেল, চারটি বিদেশী পিস্তল, একটি রিভলবার ও ৪৭ রাউন্ড গুলি সরবরাহ করেছে বলেও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

ডিবি এ ঘটনায় খান মো. ফয়সাল, জিয়াউল আবেদীন জুয়েল ও জায়েদ আল আবেদীন রুবেলকে আটক করেছে। এদের মধ্য জুয়েল ও রুবেল সম্পর্কে আপন ভাই। তারা ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে দুবাইতে একসঙ্গে ছিল। তাদের আরেক ছোট ভাই সন্ত্রাসী লিয়ন পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে। গোয়েন্দাসূত্র মতে, ওই সন্ত্রাসী মোবাইলে বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে বাংলাদেশের আরও দুই সন্ত্রাসীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। তাদের মধ্য একজন হলো আনিসুর রহমান। সে দীর্ঘ দিন জেল খেটে বের হয়েছে। আরেকজন হচ্ছে ওমর ফারুক। সে বোমা তৈরিতে খুব পারদর্শী এবং একে-২২ রাইফেল চালাতে পারদর্শী। এই দুই সন্ত্রাসীর সঙ্গে জুয়েল ও রুবেলের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। হত্যা পরিকল্পনায় তাদেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। এই অস্ত্রগুলো তারা আনিস ও ফারুকের কাছ থেকে পেয়েছে।

এর কয়েকমাস আগে কাফরুলের হাইটেক মাল্টিকেয়ার হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসককে হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করেছে আরেক সন্ত্রাসী। ভয়ে তারা কেউই এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। তবে সর্বশেষ আরেক চিকিৎসকের কাছে চাঁদা দাবি করলে তিনি কাফরুল থানায় গিয়ে জিডি করেন। থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশও ঘটনাটি জানত। পুলিশ ওই চিকিৎসকের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু ক্রমাগত হুমকিতে ওই চিকিৎসক পুলিশকে কিছু না জানিয়ে ওই সন্ত্রাসীর লোকজনকে চাঁদা দেন।

একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ঈদ ও পশুরহাটকে কেন্দ্র করে পলাতক সন্ত্রাসীরা নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করছে। মোবাইল, ইমো, ভাইভার, হোয়াটসঅ্যাপস, ম্যাসেঞ্জারে সন্ত্রাসীরা তাদের বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে। ছোট-বড় ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও বাড়ির মালিকদের অচেনা নম্বর থেকে হুমকি-দামকি দিচ্ছে। প্রাণের ভয় দেখিয়ে আদায় করে নিচ্ছে বড় অংকের টাকা। এছাড়া জমি ক্রয়-বিক্রয়, নতুন ভবন নির্মান, টেন্ডার, হাট-বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চাঁদাবাজির টেষ্টা করছে আন্ডারওয়াল্ডের সন্ত্রাসীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোরবানি ঈদকে সামনে রেখেই সন্ত্রাসীরা তাদের তৎপরতা বাড়াচ্ছে। এসময়টা দেশে টাকার প্রবাহ বেশি থাকে। তাই এ সুযোগেই তারা ফায়দা লুটে নেয়। আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সুনির্দিষ্টভাবে কোন অভিযোগ তাদের কাছে আসছে না। ভুক্তভোগীরা তাদের কাছে এসব বিষয় গোপন রাখে, তাই কোন ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গোয়েন্দাসূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডে বসে কিছু সন্ত্রাসী আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তারা প্রত্যেকের মাথার ওপর একাধিক মামলা আছে। কিন্তু প্রতিবেশী একটি দেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে তারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে ব্যবসা বাণিজ্য করছে। দেশে তাদের রয়েছে অনুসারি বাহিনী। তারা অনেক সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করে।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছেন। মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা হয়তো আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরাও তৎপর রয়েছি। তাদের গতিবিধি আমরা মনিটরিংয়ে রেখেছি। এছাড়া পশুরহাট কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি নিয়েও আমরা তৎপরতা চালাচ্ছি। সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধে গোয়েন্দা পুলিশ নজর রাখছে।

No comments

Powered by Blogger.