মালিতে বিস্ফোরণে বাংলাদেশি চার শান্তিরক্ষী নিহত

আফ্রিকার মালিতে সন্ত্রাসীদের পুঁতে রাখা শক্তিশালী ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইজ (আইইডি)-এর ভয়াবহ বিস্ফোরণে  চার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো চারজন। ২৮শে ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় দুপুর আড়াইটায় (বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা ৩০ মিনিট) দোয়েঞ্জা নামক স্থানে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন ওয়ারেন্ট অফিসার আবুল কালাম, পিরোজপুর (৩৭ এডি রেজি. আর্টি.), ল্যান্স করপোরাল আকতার, ময়মনসিংহ (৯ ফিল্ড রেজি. আর্টি.), সৈনিক রায়হান, পাবনা (৩২ ইস্ট বেঙ্গল) সৈনিক (পাঁচক) জামাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ (৩২ ইস্ট বেঙ্গল)। আহতরা হলেন, করপোরাল রাসেল, নওগাঁ (৩২ ইস্ট বেঙ্গল), সৈনিক আকরাম, রাজবাড়ী (৩২ ইস্ট বেঙ্গল), সৈনিক নিউটন, যশোর (১৭ বীর), সৈনিক রাশেদ, কুড়িগ্রাম (৩২ ইস্ট বেঙ্গল)। গতকাল আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
এতে বলা হয়, ব্যানব্যাট-৪ এর একটি লজিস্টিক কনভয় এস্কর্ট (নিরাপত্তা দল) গাঁও হতে মপতি যাওয়ার পথে বোনি-দোয়েঞ্জা সড়কে দোয়েঞ্জা থেকে ৩৫ কিলোমিটার পূর্বে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ১৩টি এপিসি ও ২টি এমপিভি এর সমন্বয়ে কনভয় এস্কর্ট-এর ৪ নম্বর এপিসিটি দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছালে এই বিস্ফোরণ ঘটে। দ্রুততার সঙ্গে হেলিকপ্টারযোগে আহতদের উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তারা চিকিৎসাধীন আছেন। মালিতে নিয়োজিত অন্য বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা নিরাপদ আছেন বলে আইএসপিআর জানিয়েছে।
কালামের মৃত্যুর খবর এখনো জানে না স্ত্রী-সন্তান
মাহমুদুর রহমান মাসুদ, পিরোজপুর থেকে জানান, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন যাওয়া সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার আবুল কালামের স্ত্রী ও সন্তানরা এখনো জানে না তার মৃত্যুর খবর। বুধবার আফ্রিকার মালে শহরের রাস্তার পাশে পুঁতে রাখা ইমপ্রোভাইস্ট এক্সপ্লোসিভ ডিভাইজ বিস্ফোরণে নিহত চার বাংলাদেশি সৈনিকের একজন আবুল কালাম আজাদ। তিনি ১৯৯২ সালের ২২শে আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে ২০১৭ সালের ২০মে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সদস্য হিসেবে মালেতে যান।
আবুল কালাম পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার উত্তর কলারদোয়ানিয়া গ্রামের মৃত. মকবুল হোসেনের পুত্র। চার ভাই বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম পুত্রসন্তান। বাকি তিন বোনের মধ্যে দুই বোনের বিয়ে হলেও মানসিক প্রতিবন্ধী বড় বোন রয়েছেন তার পরিবারের সঙ্গে।
গতকাল দুপুরে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এখনো দেশে ফেরার দিন গুনছেন স্ত্রী খাদিজা আক্তার ও তার দুইসন্তান দশম শ্রেণির ছাত্রী আশমিকা আজাদ ইমা ও চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ফারদিল ইবনে আজাদ। তারা এখনও জানে না তাদের বাবা বেঁচে নেই। তাদের জানানো হয়েছে তিনি আহত হয়ে আফ্রিকার হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সুস্থ হলেই দেশে চলে আসবেন।
নিহত আবুল কালামের চাচাত ভাই মো. সাইফুল্লাহ্‌ জানান, আমরা বেসরকারি একটি টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রথমে জানতে পারি মালিতে নিহত সেনাদের একজন পিরোজপুরের আবুল কালাম। তখন চেষ্টাকরি আমার ভাই কালাম নিহত হয়েছেন কিনা জানতে। একপর্যায়ে নিশ্চিত হলাম তিনি মাইন বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন। ভাবীকে (সেনা অফিসারের স্ত্রী) মর্মান্তিক এ ঘটনা জানাইনি। তার মেয়ে ও ছেলেকেও জানানো হয়নি। তবে আমাদের ছুটো ছুটি দেখে ভাবি যখন কিছু আঁচ করতে পেরেছেন তখন তাকে বলা হয় ভাই এক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
কালামের আরেক চাচাত ভাই ফিরোজ কিবরিয়া জানান, ভাবী বাচ্চারা মৃত্যুর খবর জানতে পারে এই ভয়ে বাড়ির সকল সংবাদমাধ্যমের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। তবুও তাদের সামলে রাখা যাচ্ছে না। অসুস্থতার খবর পেয়ে কিছুক্ষণ পর পরই খাদিজা ভাবী কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
এ সময় নিহত কালামের স্ত্রী খাদিজা আক্তার জানান, গত ২১ ফেব্রুয়ারি মোবাইল ফোনে তাকে জানিয়েছেন আর মাত্র ৮৮ দিন পরেই দেশে ফিরবেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এ বছরই তিনি চাকরি থেকে অবসরে যাবেন। আর বিদেশে যাবেন না।
জামালের বাড়িতে শোকের মাতম
চাঁপাই নবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি’র দোয়েঞ্জা নামক স্থানে ভয়াবহ বিস্ফোরণে চার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরো চারজন। তারা সবাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য। তাদের মধ্যে সৈনিক জামাল হোসেনের বাড়ি চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার ঘোড়াপাখিয়া ইউনিয়নের ধূমিহায়াতপুর-ঘাইসাপাড়ায়। তিনি মো. মেসের আলীর ছেলে। নিহত জামাল হোসেনের চাচা রবিউল ইসলাম জানান,স্থানীয় সময় গতকাল দুপুর আনুমানিক আড়াইটায় (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৮টা) এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারা রাত সাড়ে ১১টার দিকে জামাল হোসেন নিহত হওয়ার খবর জানতে পারেন। একজন সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জামাল হোসেন নিহত হওয়ার বিষয়টি মোবাইল ফোনে পরিবারকে জানান। এর পর পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বাবা মেসের আলী। মা ফেরদৌসি বেগম ছেলের ছবি বুকে ধরে স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন। আর স্ত্রী শিল্পী বেগম একমাত্র ৫ বছরের ছেলে শিমুলকে নিয়ে বিছানায় কাতর হয়ে পড়ে আছেন। শুধু পরিবার নয়, জামালের বাড়ির আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে শোক। সকাল থেকে শত শত গ্রামবাসী তাদের বাড়িতে এসে শোকাহত পরিবারটিকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। মেসের আলীর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে নিহত জামাল হোসেন ছিল সবার বড়। জামাল হোসেনের মা ফেরদৌসি বেগম জানান, দ্রুত ছেলের মরদেহ ফিরিয়ে দেয়া হোক পরিবারের কাছে।

No comments

Powered by Blogger.