গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন সু চি?

জায়েদ রা’দ আল হোসেন এ বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ যে, রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুরতা সংঘটনের জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। তাই, তার মতামতের মূল্য আছে। ভবিষ্যতে কোনো এক সময় মিয়ানমারের সর্বোচ্চ বেসামরিক নেতা অং সান সু চি ও দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অং মিন হøাইংকে গণহত্যার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে রাজি নন তিনি।
এ মাসের শুরুতে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদকে জায়েদ বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক হারে যে নির্যাতন চালানো হয়েছে, তার প্রকৃতিটাই এমন ছিল যে, গণহত্যা সংঘটিত হয় নি, এ কথা বলা যায় না।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সামরিক অভিযানের মাত্রা এত ব্যাপক ছিল, স্পষ্টতই সেসবের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে উচ্চপর্যায় থেকে।’
কিন্তু গণহত্যা এমন একটি শব্দ, যা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। শুনতে খুব ভয়ঙ্কর শোনালেও, খুব কম মানুষই আজ পর্যন্ত এই অপরাধের দায়ে সাজা পেয়েছে।
মূলত, হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞ বা হলোকাস্টের পর এই অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নব-প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে এমন হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যার নেপথ্যে একটি বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠীকে নির্মূল করার উদ্দেশ্য থাকে।
জাতিসংঘের সর্বোচ্চ মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে কিনা, সেটি প্রমাণের দায়িত্ব জায়েদ রা’দ আল হোসেনের নয়। শুধু একটি আদালতই তা করতে পারে। কিন্তু তিনি মিয়ানমারের রাখাইন অঙ্গরাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের জন্য দায়ীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরুর ডাক দিয়েছেন।
অবশ্য তিনি এটিও মেনে নিয়েছেন, গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, এটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করাটা বেশ দুরূহ হবে। তার ভাষ্য, ‘যদি আপনি গণহত্যা সংঘটনের পরিকল্পনা করেন, তাহলে কোনো নথিপত্র আপনি রাখবেন না, এটাই স্বাভাবিক। কোনো লিখিত নির্দেশনা আপনি দেবেন না।’ তবে তিনি বলেন, ‘আমরা আজ যা দেখছি, তার ভিত্তিতেই ভবিষ্যতে যদি কোনো আদালতে সিদ্ধান্তে আসে, তাহলে আমি অবাক হব না।’
আগস্টের শেষের দিকে শুরু হওয়া সেনা অভিযানের পর ডিসেম্বর অবধি রোহিঙ্গাদের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। শ’ শ’ গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। নৃশংসতা সংঘটনের প্রমাণ অবশ্য আছে। হত্যাযজ্ঞ, খুন ও গণধর্ষণের মতো নৃশংসতার শিকার হওয়ার দাবি করেছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
কিন্তু যে জিনিসটি জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় তা হলো, মিয়ানমারের নেতা সু চি’কে আগস্টেরও ছয় মাস আগে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে ২০১৬ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া পূর্ববর্তী সহিংসতায় নৃশংসতার বিবরণ নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। ওই সময় জায়েদ রা’দ আল হোসেন নিজেই অং সান সু চির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন।
ওই কথোপকথনের বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তার কাছে ওই সামরিক অভিযান বন্ধের আবেদন জানিয়েছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, যেভাবে সম্ভব এই অভিযান বন্ধ করুন। কিন্তু সেটা আদতে ঘটেনি।’
এটি সত্য, সামরিক বাহিনীর ওপর সু চির নিয়ন্ত্রণ সীমিত। কিন্তু জায়েদ রা’দ আল হোসেন মনে করেন, তার উচিত ছিল সামরিক অভিযান বন্ধে আরও ভূমিকা রাখা।
সু চির ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করারও সমালোচনা করেন আল হোসেন। তার মতে, রোহিঙ্গাদের নামহীন করে ফেলাটা তাদেরকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার শামিল। এটি এমন এক পর্যায়, যেখানে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে এদের ওপর যেকোনো কিছু করা সম্ভব। একজন শীর্ষস্থানীয় জাতিসংঘ কর্মকর্তা হিসেবে এ ধরণের শব্দচয়নকে বেশ সাহসীই বলতে হবে।
জায়েদ রা’দ আল হোসেন আরও মনে করেন, ২০১৬ সালের সহিংসতার সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তার ফলেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আরও সাহস পেয়েছে।
মিয়ানমার সরকারের দাবি, সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিল মূলত আগস্টের একটি সন্ত্রাসী হামলার জবাব দিতে। ওই হামলায় ১২ পুলিশ সদস্য নিহত হন। কিন্তু বিবিসির তদন্তে এমন সব প্রমাণ পাওয়া গেছে, যাতে বোঝা যায়, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের প্রস্তুতি অনেক আগেই নেওয়া হয়েছিল।
মিয়ানমার বহু আগ থেকেই স্থানীয় বৌদ্ধদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিচ্ছিল। গত বছরের সহিংসতার পরপরই সরকার স্থানীয় বৌদ্ধদের প্রস্তাব দেয় যে, ‘রাখাইনের যে নাগরিকরা তাদের রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে চান, তারা স্থানীয় সশস্ত্র পুলিশে যোগ দিতে পারেন’।
ফোর্টিফাই রাইটস নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথ বলেন, বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংসতা সংঘটনের সিদ্ধান্ত তখনই নেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারাও একই কথা বলেছে। স্থানীয় বৌদ্ধদের প্রসঙ্গে মোহাম্মদ রফিক নামে এক রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী বলেন, এরা যেন একেবারেই সেনাবাহিনীর মতন। তাদের কাছেও ঠিক একই অস্ত্র ছিল। এদের অনেকে ছিল স্থানীয় ছেলে, যাদেরকে আমরা চিনতাম। সেনাবাহিনী যখন আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছিল, নির্যাতন চালাচ্ছিল, এরাও সেখানে ছিল।
গ্রীষ্ম নাগাদ বন্যার কারণে উত্তর রাখাইনে খাদ্য সঙ্কট ছিল চরমে। তখনই সরকার কড়াকড়ি আরোপ করে। মধ্য আগস্ট থেকেই কর্তৃপক্ষ সব ধরণের খাদ্য ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদানের পথ বন্ধ করে দেয়। আর সেনাবাহিনী আরও সেনা নিয়ে যায় সেখানে। রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর হামলারও দুই সপ্তাহ আগে, ১০ আগস্ট এক ব্যাটলিয়ন সেনা হাজির করা হয় রাখাইনে। তখন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিনিধি এতটাই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, তিনি প্রকাশ্যে সতর্কতা ব্যক্ত করে বিবৃতি দেন। রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর ওই হামলার পরপর সামরিক বাহিনীর প্রত্যুত্তর ছিল ভয়াবহ।
জায়েদ রা’দ আল হোসেন উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরে বিভিন্ন জিহাদি গোষ্ঠী অনুপ্রবেশ করতে পারে। সেখান থেকে তারা মিয়ানমারে জঙ্গি হামলা চালাতে পারে। তারা এমনকি বৌদ্ধ মন্দিরও টার্গেট করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘এখানে ঝুঁকিটা অনেক ব্যাপক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুতর উদ্বেগের বিপরীতে মিয়ানমার যেভাবে হালকা চালে প্রতিক্রিয়া জানায়, সেটি বেশ উদ্বেগজনক।’
(বিবিসি অবলম্বনে)

No comments

Powered by Blogger.