‘মা-বাবা কই’

মা-বাবা কই, বাবা আসেনি। গতকাল সকালে ঘুম থেকে উঠে দ্বিতীয় দিনের মতো বাবাকে খুঁজলো কৃষ্ণপদ দাসের ৫ বছরের শিশু শক্তিপদ। বাবা আসবে বলে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েন মা সারথি দাশও। তার বিলাপে ঘুম ভাঙে চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর কাট্টলীর জেলেপাড়ার লোকজনের। প্রতিবেশীরা ছুটে এসে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে উল্টো দু’চোখের জলধারা ফেলতে শুরু করেন। মা সারথি দাসের কান্নায় কাঁদছিলেন শক্তিপদও।
তার সঙ্গে তার দেড় বছরের ছোট বোন নিহারীকাও। কিন্তু কেন এই কান্না? অবুঝ শিশু দুটি কি বুঝছে? তারা কি জানে যে, তাদের বাবা আর ফিরে আসবে না। যদি বুঝত তাহলে দাহ করার সময় কি তারা খেলত। এমন কথা বলেছেন চট্টগ্রামের বর্ষীয়ান নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানির মেজবান খেতে গিয়ে পদপিষ্টে নিহত কৃষ্ণপদ দাসের ছোট  ভাই সুধীর দাস।
সুধীর দাস বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ভাইয়ের লাশ আনার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সৎকার করা হয়েছে। ভাইকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। এই বড় ভাই ছিল আমার একমাত্র অবলম্বন।
সুধীর বলেন, তারা দুই ভাই সাগরে মাছ ধরেন একসঙ্গে। ভাই তো এখন নেই। কার সঙ্গে আমি মাছ ধরতে যাব। খাব কি? সংসার চলবে কিভাবে। ভাইয়ের ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ কি? এসব প্রশ্ন করে অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন সুধীর দাস।  
বুধবার সকালে সরজমিনে কৃষ্ণপদ দাসের পরিবারে গিয়ে দেখা যায় স্বজনদের শোকের মাতম। শোনা যায়, স্বজন হারানোর বিলাপ। উঠে আসে পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বজনদের হতাশার বুকভরা ব্যথা আর দীর্ঘশ্বাস।
একইভাবে শোকের মাতম দেখা যায় নগরীর ফতেয়াবাদ এলাকার প্রদীপ তালুকদারের পরিবারেও। বাবাকে হারিয়ে দু’দিন ধরে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে চোখের জল ফেলছেন তার দুই কন্যা রিফা তালুকদার ও হীরা তালুকদার।
তাদের প্রতিবেশী অঞ্জন তালুকদার জানান, মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে পদপিষ্ট হয়ে প্রদীপ তালুকদারের (৫৪) মৃত্যুর খবর পেয়ে কয়েকবার মূর্ছা যান মা ও মেয়েরা। প্রদীপ একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবাকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল দুই মেয়ে ও তাদের মা।
তিনি জানান, বড় মেয়ে রিফা এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর ছোটজন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। এই দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত এখন তাদের মা সাথী তালুকদার ও স্বজনরা। 
মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে মেজবান খেতে গিয়ে পদদলিত হয়ে হতাহতদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় দুই শিক্ষার্থীও। এদের মধ্যে নিহতের নাম রাহুল দাস (২৬) ও আহত অপরজনের নাম অর্পণ। তারা দুইজনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
রাহুলের বাড়ি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বড়ইতলী গ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী। রাহুলের মৃত্যুর খবর পেয়ে তার বাবা অমিয় দাশ গত মঙ্গলবার বিকেলে চকরিয়া থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন। ছেলের মরদেহ চিহ্নিত করে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এ সময় ছুটে আসেন তার সহপাঠীরাও। রাহুলের বাবার বুকফাটা আর্তনাদে কাঁদেন সবাই। তাদের অনেকে এ সময় রাহুলের উদ্দেশ্যে বলেন, এমনতো কথা ছিল না বন্ধু’ এভাবে ছেড়ে চলে যাবি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রাহুলের একই বিভাগের সহপাঠী তন্ময় রায় তনু তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, এ কিভাবে সম্ভব!!! এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মেজবানে পদপিষ্টে তুইও! নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছি না, তুই নেই।
রাহুলের বাবা অমিয় দাশ এ সময় শুনালেন একটি স্বপ্নের অপমৃত্যুর কথা। তিনি বলেন, পরিবারের বড় ছেলে রাহুল। স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষে সে বিসিএস দিয়ে প্রশাসনিক ক্যাডারে যুক্ত হবে। সংসারের হাল ধরবে। এখন সংসারের বোঝার সঙ্গে রাহুলের লাশের ভার আমি সইব কেমন করে। বলুন না, একথা বলে দু’চোখের জলধারা ফেলেন তিনি।  
রাহুল, কৃষ্ণপদ ও প্রদীপ তালুকদারের মতো গত সোমবার চট্টগ্রাম মহানগরীর রীমা কমিউনিটি সেন্টারের প্রবেশ পথের ঢালু স্থানে হুড়াহুড়িতে পদদলিত হয়ে মেজবান খেতে আসা ১১ জনের মৃত্যু ঘটে। আহত হয় প্রায় শতাধিক ব্যক্তি। এর মধ্যে অর্ধশত লোককে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাপসাপাতালে ভর্তি করা হলেও চিকিৎসা নিয়ে ফিরে যান অনেকে। বর্তমানে গুরুতর আহত ১১ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম।
তিনি জানান, হাসপাতালে ওইদিন প্রথমে ৯জন, পরে আনা হয় একজনের লাশ। তিন ঘণ্টা চিকিৎসার পর নিহত হন আহতদের আরো একজন। তার নাম পরিমল দাশ (৪৭) পিতা : মনমোহন দাশ, পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম। এর আগে নিহতরা হচ্ছেন- সুবীর দাশ (৫০) পিতা লাল মোহন দাশ, পাথরঘাটা, কোতোয়ালি, ঝন্টু দাশ (৪৬) পিতা বিনোদ বিহারী, ফতেয়াবাদ, ধনাশীল (৪৫) পিতা অজ্ঞাত, বাঁশখালী, অলক ভৌমিক (৩৬) পিতা ননী গোপাল ভৌমিক, ছোট কুমিরা, সীতাকুণ্ড, লিটন দেব (৫০) পিতা প্রকৃতি রঞ্জন দেব, মোহসেন আউলিয়া, আনোয়ারা। ঝন্টু দাশের গ্রামের বাড়ি রংপুরে। আর টিটুর পরিচয় এখনো মেলেনি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছিল এদের লাশ। এর মধ্যে ঝন্টু দাশ গার্মেন্টে চাকরি করেন। নিহতদের ৭ জনের লাশ তাদের স্বজনরা নিয়ে গেছেন। একজনের মরদেহ গ্রামের বাড়ি রংপুরে পাঠানো হয়েছে। তিনজনের লাশ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে সৎকার করা হয়েছে বলে জানান জহিরুল ইসলাম।
মরদেহ সৎকারের তত্ত্বাবধানে থাকা চসিকের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী জানান, ঘটনায় নিহতদের ১০ জনই সনাতন ধর্মাবলম্বী। একজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে নয়জনের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাহ করা হয়েছে। আর সোমবার গভীর রাত থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত তিনজনকে নগরীর বলুয়াদিঘী মহাশ্মশানে সৎকার করা হয়।
কৃষ্ণপদের কাকাতো ভাই মিন্টু দাশ বলেছেন, মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্য কৃষ্ণপদ পাগল ছিল। তাই সে কুলখানিতে গেছে। একই কথা বলেছেন রাহুলের বন্ধু তনু, প্রদীপ তালুকদারের স্ত্রী সাথী তালুকদারও। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই মর্মান্তিক ঘটনা কিভাবে ঘটল তা বুঝে উঠতে পারছেন না তারা। একসঙ্গে এত লোকের মৃত্যু নিয়ে আয়োজকদের সমালোচনাও চলছে।
সচেতন মহলের মতে, প্রয়াত এ নেতার কুলখানি আরো  কয়েকটি কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করলে চাপ কম হতো। এমন দুর্ঘটনা দেখতে হতো না চট্টগ্রামবাসীকে।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার নগরীর ষোল শহরের চশমা হিলের বাসভবন ও ১৩টি কমিউনিটি সেন্টারে চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানির মেজবান আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ অমুসলিমদের জন্য নগরীর আসকার দিঘীর পাড়ে অবস্থিত রীমা কমিউনিটি সেন্টারে মেজবানের আয়োজন করা হয়। আর সেখানে দুপুর দেড়টার দিকে হুড়াহুড়িতে পদদলিত হয়ে ১১ জনের মৃত্যু ও শতাধিক লোক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রীমা কমিউনিটি সেন্টারে ছুটে যান মহিউদ্দিন চৌধুরীর বড় ছেলে ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। সেখান থেকে চমেক হাসপাতালে গিয়ে লাশ দেখে তিনি কেঁদে ফেলেন। পরে তিনি নিহতদের পরিবারের জন্য একলাখ এবং    আহতদের চিকিৎসা ব্যয়ের ঘোষণা দেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেককে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে বলে জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মাসুদুর রহমান সিকদার।
গত ১৪ই ডিসেম্বর দিনগত রাত তিনটার দিকে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। দীর্ঘ ১৬ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করা এই রাজনীতিক ছিলেন চট্টগ্রামের জনমানুষের প্রিয় নেতা।

No comments

Powered by Blogger.