মৌলভীবাজারে হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী একটি সেতু

সেদিন ১৯৭১ সালের ১৩ মে। মৌলভীবাজারে মাইকিং করে বলা হয়, শহরবাসী যাতে মনু সেতুর কাছে উপস্থিত হয়। অনেকেই ভয়ে আসতে চায়নি। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা অনেককে বাধ্য করেছে মনু সেতুর কাছে আসতে। উপস্থিত জনসাধারণের উদ্দেশে ঘোষণা করা হয়, দুজন দুষ্কৃতকারীকে ধরা হয়েছে। তাদের বিচার হবে। সেতুতে যে দুজনকে হাজির করা হয়, তাঁরা হলেন সদর উপজেলার হিলালপুর গ্রামের যুক্তরাজ্যপ্রবাসী হাজি মো. উস্তোওয়ার ও সিরাজুল ইসলাম ওরফে কলমদর মিয়া। আগের দিন তাঁদের আটক করা হয়েছে।
বলা হলো, তাঁরা দুজন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁরা ‘দেশের শত্রু’। মনুর সড়কসেতুর ওপর দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানি সেনারা প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুজনকে। নিচে নদীর পানিতে ফেলে দেওয়া হয় লাশ। পানির স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় লাশ দুটি। তাঁদের কোনো হদিস মেলেনি। সিরাজুল ইসলাম ওরফে কলমদর মিয়ার একমাত্র ছেলে মহসিন ইসলাম (৫২) তাঁদের হিলালপুরের বাড়িতে বসে গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাবা আমাদের সম্বদপুরে (সদর উপজেলার আমতৈল ইউনিয়নের একটি গ্রাম) পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা ও দাদাকে ধরে নেওয়ার পর আমরা জানতে পারি। আমাদের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তাঁদের ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী ছাড়েনি। প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে মাইকিং ও প্রদর্শনী করে চাঁদনীঘাটের পুলের (মনু সেতু) ওপর বাবা ও উস্তোওয়ার মিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। লাশ পানিতে ফেলে দিলে আর পাওয়া যায়নি। আর দাদা আব্দুল মন্নানকে ছালামিটিলা (শহরতলির একটি এলাকা) এলাকায় মেরে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে।’ মহসিন ইসলাম বলেন, তিনি তখন মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন। তাঁরা তখন দুই বোন ও এক ভাই। সিরাজুল ইসলাম সে বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে এসেছিলেন। মহসিন ইসলাম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অভিযোগ আনে পাকিস্তানি সেনারা। অথচ তিনি সরাসরি রাজনীতি করতেন না। আমরা এখন পর্যন্ত বাবার শহীদ হওয়ার স্বীকৃতি পাইনি। আমাদের দাবি, শহীদ সিরাজুল ইসলাম ও মো. উস্তোওয়ারের নামে যাতে মনু সেতুর নামকরণ করা হয়।’ শহীদ সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী ছইদুন্নেছা (৭৭) শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাড়িতে ছিলাম না। শুনেছি তারা (পাকিস্তানি সেনারা) এসে বলেছে, তাঁর (সিরাজুল ইসলামের) ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। অথচ এই ছেলে তখন কত ছোট।’ মো. উস্তোওয়ারের ভাইয়ের ছেলে আব্দুল মুকিত ও আব্দুল হান্নান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা তখন ছোট। কিন্তু তাঁদের মনে আছে। চাচাকে কাপড় শুকানোর বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে মারধর করা হয়েছে। পরদিন মনু সেতুর ওপর প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। মো. উস্তোওয়ারের ছেলেমেয়েরা যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। মনু সেতু এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল আরও বেশ কিছুদিন আগে,
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ থেকে। সেদিন (২৮ মার্চ) পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে অবরুদ্ধ মৌলভীবাজার শহরকে মুক্ত করতে প্রথম প্রতিরোধে নামে এলাকাবাসী। লাঠিসোঁটা নিয়ে শহরের দিকে ছুটে আসে মানুষ। মনু নদের চাঁদনীঘাট প্রান্তে লোকজন এলে পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের মুখে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধকারীদের। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ডার জামাল উদ্দিন সেদিনের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে গুজারাই গ্রামের লুন্দুর মিয়া নামে দশ-বারো বছরের এক শিশু মারা যায়। এরপর পাকিস্তানি সেনারা মনু সেতুর পূর্ব দিকের একটি ইটখোলার সাতজন শ্রমিককে হত্যা করে। সেদিনের পর থেকেই মনু সেতু এলাকা হয়ে ওঠে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি। সেতুর দুপাশে দুটি ক্যাম্প ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের সালাম না দিলে লোকজনকে নির্যাতন করা হতো। কে মুসলিম কে হিন্দু পরখ করত পাকিস্তানি সেনারা। মনু সেতুর কাছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ডাকবাংলোতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্পে লোকজনকে ধরে এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হতো। রাতের বেলায় ধরে এনে মনু সেতুতে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। পানির স্রোতে ভেসে যেত লাশ। এ কারণে কতজনকে এখানে হত্যা করা হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানে তাদের টানা হত্যাযজ্ঞ চলে। ইটখোলায় শহীদ সাতজন শ্রমিককে স্মরণ করতে মৌলভীবাজার শহরের শাহ মোস্তফা সড়কের বেরিরপার এলাকায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। জামাল উদ্দিন বললেন, মনু সেতুর বধ্যভূমিতে পাকিস্তানি বাহিনীর সবচেয়ে আলোচিত ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডটি হচ্ছে প্রদর্শনীর মাধ্যমে মো. উস্তোওয়ার ও সিরাজুল ইসলামকে হত্যা। এভাবে মাইকিং করে শহরবাসীর সামনে প্রকাশ্যে আর কাউকে মারা হয়নি।
অসমাপ্ত স্মৃতিসৌধ
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মনু সেতুর কাছে ‘স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু প্রায় দেড় যুগেও সেই স্মৃতিস্তম্ভটির নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। ১৯৯৮ সালে মনু সেতুর কাছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজের) জায়গার ওপর ‘স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু আর্থিক সংকটে পরবর্তী সময়ে স্মৃতিস্তম্ভটির কাজ আর শেষ করা যায়নি। স্মৃতিস্তম্ভের উদ্যোক্তা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ডার জামাল উদ্দিন গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত প্রতিরোধযুদ্ধ ও স্থানীয় শহীদদের স্মরণ করতেই মনু সেতুর কাছে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই স্মৃতিস্তম্ভের মাধ্যমে যাতে নতুন প্রজন্ম শহরের মধ্যে একটি বধ্যভূমি সম্পর্কে জানতে পারে। আর্থিক কারণে কাজ করানো সম্ভব হচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দের জন্য গত বছরও লিখেছি। এখনো কোনো সাড়া পাইনি। অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই স্মৃতিস্তম্ভটি পড়ে আছে।’

No comments

Powered by Blogger.