গণমাধ্যমকে চতুর্থ এস্টেট হিসেবে কাজ করতে দেয়া উচিত -সুমিত গালহোত্রা

সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্যতম বিদিত সংবাদপত্রের সম্পাদক মাহফুজ আনাম যখন কয়েক বছর আগের একটি সম্পাদকীয় বিবেচনার ত্রুটি স্বীকার করেছিলেন, তিনি ধারণা করতে পারেন নি এর জের ধরে আইনি প্রতিক্রিয়া আসবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কিত অসমর্থিত তথ্য প্রকাশ নিয়ে আনামের স্বীকারোক্তি তার বিরুদ্ধে একের পর এক অবমাননা ও রাষ্ট্রদোহ মামলার স্তুপ সৃষ্টি করেছে। সেইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আর দ্য ডেইলি স্টার বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ মাসে আনামের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ইতিমধ্যে নিষ্পেষিত স্বতন্ত্র গণমাধ্যম কি ধরণের চাপের মুখে আছে। মি. আনামের বিরুদ্ধে যারা রাষ্ট্রদোহ ও মানহানির মামলা দায়ের করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ৫৩টিরও বেশি জেলার আইনজীবী, দলের সদস্য এবং রাজনৈতিক গ্রুপ। আর নারায়নগঞ্জের একটি আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে (সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী)। দ্য ডেইলি স্টারের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মামলার সংখ্যা ৭৯টিতে ঠেকেছে। আর অবমাননার দায়ে যে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে তার অঙ্ক ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে রাষ্ট্রদোহ মামলায় যাবজ্জীবন পর্যন্ত হতে পারে।
৩রা ফেব্রুয়ারিতে এটিএন নিউজ চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানে মাহফুজ আনামের স্বীকারোক্তি থেকে আইনি চ্যালেঞ্জগুলোর সূত্রপাত। স্বীকারোক্তিটা ছিলÑ ২০০৭-০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি ডিজিএফআই (ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স) থেকে দেয়া তথ্য স্বতন্ত্রভাবে যাচাইবাছাই ছাড়াই ছেপেছিলেন। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, কমপক্ষে ১১টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল পর্যাপ্ত যাচাই বাছাই ছাড়া; যেসব প্রতিবেদনে হাসিনা ও তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বি খালেদা জিয়াকে বিরূপভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
‘নিউজ আওয়ার এক্সট্রা’ অনুষ্ঠানে আনামের স্বীকারোক্তির প্রতিক্রিয়া আসার পর, ডেইলি স্টার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। গোয়েন্দা সংস্থা এখনও কোন প্রতিক্রিয়া জানায় নি।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আনাম তার সম্পাদকীয় বিবেচনার ত্রুটিকে ‘একটি বড় ভুল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এটা তাকে প্রশংসা এনে দেয়া উচিত, নিন্দা নয়। সম্পাদকীয়কে ডেইলি স্টার উল্লেখ করেছে যে, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেষ হওয়ার অনেক বছর পরও সাংবাদিকরা স্বতন্ত্রভাবে যাচাই বাছাই ছাড়া কতৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য প্রকাশ করা অব্যাহত রেখেছে। 
অন্যান্য গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সময়ে অনেক বাংলাদেশি সংবাদপত্র একই তথ্য প্রকাশ করেছিল। দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত এ মাসে একটি টক শোতে বলেন, তার পত্রিকাও এমন প্রতিবেদন ছেপেছিল। তিনি বলেন, ওই সময়ে সম্পাদকরা অনুভব করেছিলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাল মেলানো ছাড়া তাদের কোন সুযোগ নেই, এপির রিপোর্ট।
সরকারপন্থী কিছু গণমাধ্যমে মি. আনামকে যেমন ‘গণতন্ত্রের শত্রু’ হিসেবে বলা হচ্ছে , পক্ষান্তরে অপর সম্পাদকরা তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান এক সম্পাদকীয়তে মাহফুজ আনামের প্রতি আসা প্রতিক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘গনতন্ত্রকে নস্যাত করা এবং অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠার কোন এজেন্ডার অংশ হিসেবে তিনি (আনাম) তা করেছিলেন এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আর যে মানুষটি তার এ দেশের সেবায় নিজের জীবনকে নিয়োজিত করেছেন এবং জাতীয় স্বার্থ ও গণতন্ত্রের মূল্যবোধের জন্য কাজ করবার যার দীর্ঘ ও গর্বের রেকর্ড রয়েছে তার প্রতি এমন ধারণা পোষণ করা বিরাট অন্যায়।’
আনাম ও তার পত্রিকার ওপর আরোপিত চাপ, দেশের স্বতন্ত্র গণমাধ্যমের ওপর বিদ্যমানে চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। গত বছর আমার বাংলাদেশ সফরে আমি যেমনটা উল্লেখ করেছিলাম- ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফের পর থেকে হাসিনা বলতে গেলে রাজনৈতিক বিরোধীদের নিষ্ক্রিয় করেছেন। সেইসঙ্গে নিষ্ক্রিয় হয়েছে বিরোধী-সংশ্লিষ।ট অনেক গণমাধ্যম। ডেইলি স্টারের সহ-প্রকাশনা প্রথম আলোর সাংবাদিকরা আমাকে বলেছেন, তারা আইনি হওয়ানির মুখোমুখি হন। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা ও মানহানির অনেক মামলা রয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগই অমীমাংসীত থাকে। ২০১৪ সালে বিশেষ একটি যুদ্ধাপরাধ আদালতের কাজ নিয়ে লেখার পর ঢাকা-ভিত্তিক বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে অবমাননার দায়ে দ-িত করে ওই আদালত। আর চলমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে মতিউর রহমান চৌধুরির টক শো ‘ফ্রন্টলাইন এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। অনুষ্ঠানটি সমালোচনামূলক অতিথিদের জন্য সুপরিচিত ছিল। সম্প্রচার বন্ধের কারণ হিসেবে সে সময় চ্যানেলের চেয়ারমেন সাময়িক কারিগরি জটিলতার কথা বলেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দলের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে সংসদের প্রায় সব আসন। হাসিনা যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে বিবেচনা করেন, তাহলে তার উচিত গণমাধ্যম যেন চতুর্থ এস্টেট হিসেবে কাজ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। আনামের স্বীকারোক্তির পর কিভাবে বাংলাদেশের সাংবাদিকতাকে আরও শক্তিশালী করা হয় তা নিয়ে অর্থবহ বিতর্ক হওয়া উচিত, এক ঝাক আইনি চ্যালেঞ্জ উস্কে দেয়া আর স্বতন্ত্র গণমাধ্যমের ওপর হামলা নয়।
[সিপিজের ব্লগে প্রকাশিত ‘৭৯ কেসেস এন্ড কাউন্টিং: লিগ্যাল চ্যালেঞ্জেস পাইল আপ ফর ডেইলি স্টার এডিটর হু এডমিটেড এরর ইন জাজমেন্ট’ শীর্ষক লেখার ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ। লেখক সুমিত গালহোত্রা, সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, সিপিজের এশিয়া কার্যক্রমের গবেষণা অ্যাসোসিয়েট। অতীতে তিনি সিএনএন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচে কর্মরত ছিলেন।]

No comments

Powered by Blogger.