আত্মঘাতী by মাহবুব তালুকদার

মনটা খারাপ হয়ে আছে। অনেক সময়ে কারণে বা অকারণে মন খারাপ হয়। আজ মন খারাপের একটা কারণ আছে। ক’দিন আগে একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখেছি বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকা মহানগরীর স্থান দ্বিতীয়। এক্ষেত্রে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক আমাদের ঢাকার চেয়ে একধাপ এগিয়ে। ঢাকা প্রথম হতে পারেনি বলে আমার মন খারাপ নয়। মন খারাপ হয়েছে ঢাকা দ্বিতীয় হয়েছে বলে। এই জরিপে ঢাকার স্থান যদি শীর্ষে না থেকে তালিকার তলে স্থান পেতো, তাহলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু বাস্তব অবস্থার নিরিখেই তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। আর বাস্তব অবস্থার বিষয়টি ভেবে ভেবে আমার মন খারাপ।
আমার কথা শুনে চাচা হেসে বললেন, জরিপে যা-ই বলা হোক না কেন, পৃথিবীর অনেক শহরের চেয়ে আমরা ভালো আছি। ঢাকা একটা ঐতিহাসিক শহর। এককালে বায়ান্ন বাজার আর তেপ্পান্ন গলির শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। মসজিদের শহর হিসেবে এর খ্যাতিও ছিল এক সময়ে।
আর এখন?
এখন এটাকে বিলবোর্ডের শহর বলতে পারো। সারা শহর ছোট-বড় হাজার হাজার বিলবোর্ডে ছেয়ে আছে।
ভেবেছিলাম, এ বিষয়ে কথা বলবো না। কিন্তু কথাটা আপনি যখন তুলেছেন, তখন কি নির্ভয়ে বলতে পারি?
অবশ্যই নির্ভয়ে বলবে। দেশে এখন বাকস্বাধীনতা বিদ্যমান।
চাচা! ১৫ই আগস্ট আমাদের জাতীয় শোক দিবস। এ দিনটি পালিত হয় পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই মহান দিনটিতে সারা শহর জুড়ে অসংখ্য বিলবোর্ড ও প্ল্যাকার্ডে যে ধরনের আত্মপ্রচারের উৎসব লক্ষ্য করা গেছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। বিলবোর্ডগুলোতে জাতির পিতার ক্ষুদ্রাকৃতির ছবি এক কোণায় রেখে অন্যদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছোট আকারের ছবি দিয়ে নিজেদের ছবি বিশাল আকারে ছেপে যেভাবে আত্মপ্রচার চালানো হয়েছে, তা যুগপৎ দুঃখ ও বেদনার উদ্রেক করে।
কিন্তু এসব বিলবোর্ডের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার প্রতি ভালোবাসাই প্রকাশিত হয়েছে।
ভালোবাসার প্রকাশ বুঝতাম, যদি তাতে নিজেদের ছবি আর আত্মপরিচয় তুলে না ধরা হতো। আরও একটি কথা আছে।
কী কথা, বলো।
জাতীয় শোক দিবস হিসেবে রাস্তার মোড়ে মোড়ে তোরণ বানানো হয়েছে। তোরণের সঙ্গে শোকের সম্পর্ক কি, আমি বুঝতে পারি না। আমার মতে তোরণ হচ্ছে উৎসবের প্রতীক। কিন্তু জাতীয় শোক দিবসের সঙ্গে উৎসবের সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি না।
তোরণ উৎসবের প্রতীক?
আমি তা-ই মনে করি। আগের দিনে সৈন্যরা যুদ্ধ জয় করে ফিরলে তোরণ তৈরি করে তাদের স্বাগত জানাতে হতো। এখনও কোন অতিথিকে স্বাগত জানাতে বা সংবর্ধনা জানাতে তোরণ তৈরি করা হয়ে থাকে। আমি মনে করি, জাতীয় শোক দিবসের শোকাবহ অনুভূতির সঙ্গে তোরণ নির্মাণ খাপ খায় না।
তোমার কথাটা একেবারে ফেলে দিতে পারছি না। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখি তারা কি বলেন? চাচা আরও বললেন, এব্যাপারে আমাদের মেয়র দুজন ব্যবস্থা নিতে পারেন।
মেয়ররা নিজেরাই এখন বিলবোর্ডের মাঝখানে ঠাঁই পেয়েছেন। তারা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, নগরীর অবৈধ বিলবোর্ড তারা সরিয়ে দেবেন। কিন্তু তাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়।
কেন সম্ভব নয়?
অবৈধ বিলবোর্ড সরানো একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তাছাড়া, রাজনৈতিক বিলবোর্ড অবৈধ বলার ধৃষ্টতা দেখানোও ঠিক হবে না। আমি কেবল বলতে চাই, যে কোন উপলক্ষ করে আত্মপ্রচারের বিলবোর্ড জাতির পিতা বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুদ্রাকৃতির ছবি সংবলিত হওয়া উচিত নয়।
সবাই তো আত্মপ্রচার করতে চায়। এটা বাস্তব সত্য।
আমার মনে হয়, নগরীর জনসভার স্থানে মাঠের একপাশে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আত্মপ্রচারের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তবে সেখানে জাতির পিতার ছবি ব্যবহার করা যাবে না। জাতির পিতার ছবি সংবলিত কোন বিলবোর্ডে আর কারও ছবি থাকা সমীচীন হবে না।
হুঁ। এ কথা থাক। অন্য কথা বলো। ঢাকা মহানগরীর এখনকার পরিচয় কী হিসেবে? বায়ান্ন বাজার, তেপ্পান্ন গলি, মসজিদের শহর, না অন্য কিছু?
ঢাকা হচ্ছে যানজটের শহর।
দেড় কোটির ওপর লোক এই শহরে বসবাস করে। যানজট তো হবেই।
এটা মেনে নিয়েই আমি বলতে চাই অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার কারণে যানজট এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। পথচারী, যাত্রী ও যানবাহনে চলাচলকারীদের এখন দুর্গতি ও দুর্ভোগের শেষ নেই। যাতায়াত ব্যবস্থাও একরকম ভেঙে পড়েছে বলা যায়।
এর জন্য কে দায়ী? পুলিশ, যাতায়াতকারী, যানবাহনের চালক, না অন্য কেউ? চাচার জিজ্ঞাসা।
দায়ী আমরা সবাই। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় এখন আর কোন শৃঙ্খলা নেই। রাজপথে উল্টো দিক দিয়ে প্রভাবশালীরা গাড়ি চালাচ্ছেন। রিকশাচালকরা একমুখী রাস্তায় উল্টোদিক দিয়ে গাড়ি চালাতে বেশি পছন্দ করেন, মোটরসাইকেল আরোহীরা হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে ফুটপাথ ধরে গাড়ি চালালেও তাদের রোখার কেউ নেই। অন্যদিকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অবস্থা খুবই শোচনীয়।
পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যাপারে অবশ্য অনেক অভিযোগ।
হ্যাঁ। বেসরকারি বাসগুলোর অধিকাংশের কোন ফিটনেস নেই। অনেক চালকের লাইসেন্স নেই। এসব যাচাই করতে গেলে পরিবহন মালিকরা গাড়ি বন্ধ করে রাখেন। সরকার সর্বদাই পরিবহন মালিকদের সমঝে চলে। তার কারণ পরিবহন মালিকদের গোড়া ভারি শক্ত। ভাড়া বৃদ্ধিসহ তাদের অনেক অন্যায় আবদারকে সরকারের মেনে নিতে হয়। এবার একটা মজার ঘটনা ঘটছে।
কী মজার ঘটনা?
সরকারিভাবে অটোরিকশার ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
এটাকে মজার ঘটনা বলছো কেন? চাচা জানতে চাইলেন।
মজার ঘটনা বলছি এ কারণে যে, অটোরিকশার ভাড়া কি নির্দিষ্ট আছে?
কেন থাকবে না? ভাড়ার একটা চার্ট তো অবশ্যই আছে।
সেই ভাড়ার চার্ট মেনে নিয়ে কি অটোরিকশা চালানো হয়?
তা অবশ্য হয় না।
ওই চার্ট হওয়ার আগে পরে কি যাত্রীরা মিটার অনুযায়ী চলাচল করতে পেরেছে?
তা হয়তো পারেনি।
আমি বললাম, গত কয়েক বছরে কেউ মিটারের ভাড়ায় অটোরিকশায় চেপেছে, এমন খবর জানা যায়নি। তা যদি হতো, তাহলে সেটা পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হতো। পত্রিকায় নিশ্চয়ই অটোরিকশার চালকের ছবিও ছাপা হতো। তেমন ঘটনা অবশ্য এ দেশে ঘটেনি।
তাহলে? কী বলতে চাও তুমি?
এখন বিআরটিএ যদি অটোরিকশার ভাড়া বাড়াতে চায়, তার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি? অটোরিকশা কি মিটার মেনে রাস্তায় চলবে?
তারা তো সে রকমই বলছে।
আগের বারও তারা সে কথাই বলেছিল। কিন্তু ভাড়া নির্ধারণের পর থেকে কেউ মিটারের নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচল করেছে, এমন কোন সৌভাগ্যবানের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
তাহলে বিআরটিএ ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করছে কেন?
অটোরিকশার মালিক ও চালকদের মনস্তাত্ত্বিক সুখ দেয়ার জন্য তারা এমনটা করছে বলে ধারণা করি। এতে চালক ও মালিকরা আরেক দফা ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ পাবে। আসলে অটোরিকশার ভাড়া ডবল করলেও কেউ মিটার অনুযায়ী চলতে পারবে- এমন দুরাশা কোন আহাম্মকেও করবে না। আমি অটোরিকশা সম্পর্কে কোন অবাস্তব বিভ্রান্তিতে থাকতে চাই না। অটোরিকশাকে মুক্ত করে দেয়া উচিত।
মুক্ত করে দেয়া উচিত মানে?
মানে অটোরিকশা থেকে মিটার তুলে দেয়া উচিত।
তাহলে ভাড়া নির্ধারিত হবে কিভাবে?
চালকরা যে ভাড়া চাইবে, যাত্রী তাই দিতে বাধ্য থাকবে।
সেটা কী কথা!
সেটাই বাস্তব কথা। এখনও তো তাই হচ্ছে। আমি বললাম, আজকাল চালকরা যাত্রীকে বলে দেয়, পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে যাত্রী যে মিটারে চলছে, তা পুলিশকে জানায়।
হ্যাঁ। আমি নিজেও এমন অবস্থায় পড়েছি। মিটার ঠিক আছে, কিন্তু সিএনজি অটোরিকশা মিটারে চলছে না। পুলিশ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দেখলো মিটার ঠিক আছে। পুলিশও খুশি, চালকও খুশি।
আপনিও কি খুশি হননি?
না হয়ে উপায় কী? অসংখ্য অটোরিকশাকে আমার গন্তব্য জানালে তারা প্রত্যেকেই প্রত্যাখ্যান করলো। একজনকে অনুনয় বিনয় করে রাজি করানো হলো প্রায় ডবল টাকার বিনিময়ে।
ওরা গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না কেন?
ওদের এক কথা। ওদিকে খুব জ্যাম। চাচা বিরক্তির ভঙ্গি করে বললেন, ঢাকা শহরে তো যানজট আছেই। অটোরিকশার চালকদের কথা শুনে মনে হয় ওরা আমেরিকা থেকে এসেছে।
আমি বললাম, শুধু যানজটের ব্যাপার নয়। এ শহরকে ক্ষমতাসীনরা যার যার মতো ভোগদখলের উপকরণ বানিয়ে ফেলেছে।
নতুন আবার কিছু হলো নাকি? চাচার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতার আভাস।
পত্রিকায় দেখলাম, ওয়ারীর একটা রাস্তা দখল করে ‘ওয়ারী সিটি কাঁচাবাজার’ নাম দিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজনকে ইজারা দেয়া হয়েছে। তারা সেখানে দোকানপাট সাজিয়ে বসেছেন।
সিটি করপোরেশনের লোকেরা তাহলে কী করে?
সিটি করপোরেশনের কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা এতে সহযোগিতা করেছে। তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, রাস্তা ইজারা দেয়ার অধিকার কারো নেই।
তাহলে আর চিন্তা কি?
চিন্তা তো আছেই। তিনি ওই ইজারা বাতিল করা সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করেননি। ইতিমধ্যে অনেকগুলো দোকান মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে হস্তান্তর হয়েছে। সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হবে কীভাবে?
চাচা বেজার মুখে বললেন, ঢাকা শহরে রাস্তাঘাট এমনিতে খুব কম। এভাবে যদি রাস্তাগুলো দখল হতে থাকে, তাহলে সমস্যা আরও বাড়বে।
সে কথাটা কেউ ভাবছে না। অন্তত মেয়রদের তা ভাবা উচিত বলে মনে করি।
একটু চুপ থেকে চাচা বললেন, আমারও তো মনটা খারাপ হয়ে গেল।
কেন? আপনার মন খারাপের কারণ কি?
ওই যে তুমি বললে পৃথিবীর সবচাইতে অ-বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকার স্থান দ্বিতীয়। প্রথম হয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক? আচ্ছা, দামেস্ক কি ঢাকার চেয়েও খারাপ শহর? সেটা কিভাবে সম্ভব হলো?
চাচা! দামেস্ক হচ্ছে একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত শহর। সেখানে জীবন ও জীবনযাপন, সবকিছুই অনিশ্চিত। নিতান্ত বাধ্য না হলে সেখানে কেউ থাকতে চায় না। ঢাকার পক্ষে দামেস্কের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন।
আমি প্রতিযোগিতার কথা বলছি না। চাচা বিষণ্নমুখে বললেন, আমি বলছি ওই তালিকায় ঢাকাকে নিচের দিকে নামিয়ে আনা যাবে কি? যাই কিছু বলি না কেন, ঢাকা যে আমাদের প্রাণের শহর।
আমি নিজেও আপনার সঙ্গে একমত। আমি বললাম, ঢাকা মহানগরীকে অবাসযোগ্য করার জন্য যা কিছু করা হচ্ছে, তা সবই আত্মঘাতী। এই প্রাণের শহরকে যারা প্রতিনিয়ত খুন করছে, তাদের প্রতিরোধ করতে না পারলে এ শহর প্রাণে বাঁচবে না।

No comments

Powered by Blogger.