স্তব্ধ ঢাকা: রাতে ধানমন্ডিতে ‘জয় বাংলা’ বলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা

দিনভর বিক্ষোভ। রাস্তা অবরোধ। নো ভ্যাট, গুলি কর- প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন, স্লোগানে -স্লোগানে মুখরিত রাজপথ। উত্তপ্ত, উত্তাল এবং অচল ঢাকা। সীমাহীন দুর্ভোগ। টিউশন-ফি থেকে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রত্যাহারের দাবিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এই ছিল গতকালের দৃশ্যপট। রাজধানীর কমপক্ষে ছয়টি স্পটে  বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভের একপর্যায়ে অচল হয়ে পড়ে গোটা মহানগরী। বিভিন্ন সড়কে তৈরি হয় তীব্র যানজট। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয় নগরবাসীকে। বহু মানুষকে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। রাজধানী ছাড়া চট্টগ্রাম এবং সিলেটেও বিক্ষোভ হয়েছে। একপর্যায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, শিক্ষার্থী নয়- বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই ভ্যাট দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একই কথা বলেন। ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিও নাকচ করে দেন তিনি।
ওদিকে, রাতে ধানমন্ডির রাপা প্লাজার সামনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। রাত সাড়ে আটটার দিকে হঠাৎ করে ২০-২৫ জন যুবক অতর্কিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তাঁরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়। দু-এক মিনিট হামলা চালানোর পর ওই যুবকেরা সেখানে দাঁড়ালে পুলিশ তাদের চলে যেতে বলে। এ ঘটনার পর গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতি বাড়লে ওই যুবকেরা চলে যায়। আবার রাত ৯টার দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে কয়েকজন যুবক আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে দ্রুত চলে যায়। তবে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আজম মিয়া জানান, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার কোন ঘটনা আমাদের জানা নেই।
বেসরকারি উচ্চশিক্ষায় সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে কয়েকমাস ধরেই আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার রামপুরায় ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা চালায়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ও ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসেন। রামপুরা, ধানমন্ডি ও সোবহানবাগে শুরু হয় বিক্ষোভ। পরে রাজধানীর আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার উপর কর মানবো না, নো ভ্যাট অন এডুকেশন, আমি ছাত্র, পণ্য নই, শিক্ষা কি পণ্য, শিক্ষার উপর ভ্যাট কি জন্য- ইত্যাদি লেখা বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ছিল শিক্ষার্থীদের হাতে। আন্দোলরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ভ্যাট প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টায় ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডে স্টামফোর্ড, ড্যাফোডিল, স্টেস্ট ইউনিভার্সিটি ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়কে যানচলাচল একরকম বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষোভের কারণে সকাল থেকে মিরপুর রোডগামী আসাদগেট থেকে শুক্রাবাদ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ১১টায় উত্তরার নর্থ টাওয়ারের সামনে উত্তরা ইউনিভার্সিটি ও শান্তা-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ আর্টসের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে করে এয়ারপোর্ট-টঙ্গী রোডে সব যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সকালে রামপুরা সেতুর ওপর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির (ইডব্লিউইউ) মূল ফটকের সামনে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী অবস্থান নিলে এই রাস্তায় সব ধরনের যান বন্ধ হয়ে যায়। একই সময় বসন্ধুরা আবাসিক এলাকা সামনে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। এতে কুড়িল বিশ্বরোডে যানবাহন বন্ধ থাকে কয়েক ঘণ্টা। বেলা ১১টায় মহাখালী-গুলশান-১ রোডে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। এতে ওই রুটের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে।
ধানমন্ডির ২৭ নং এলাকায় ৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় সকাল ১১টায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এক সময় জনসমুদ্রে পরিণত হয় পুরো এলাকা। আটকে পড়ে তিনদিকে চলাচল করা যানবাহন। দু’-একটি অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া এ সময় কোন যানবাহনই চলাচল করেনি। রাপা প্লাজা থেকে শঙ্কর রোড় এবং  মিরপুর থেকে আজিমপুর রোড়ের যানবাহন আটকে  পড়ে। এ সময় বাসযাত্রীরা নেমে চলাচল করেন। ভোগান্তিতে পড়ে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ৪টার দিকে রাপা প্লাজার সামনে অবরোধে আটকা পড়া একটি কাভার্ড ভ্যানের চালক মো. সোহেল জানান, তিনি বেলা সাড়ে ১১টা থেকে এখানে অপেক্ষা করছেন। কখন ছাড়বে জানেন না। তিনি জানান, কাভার্ড ভ্যানটিতে গার্মেন্টসামগ্রী নিয়ে তিনি সাভার যাচ্ছিলেন। দুপুরের খাওয়াটাও হয়নি তার। আজিমপুর থেকে রাপা প্লাজা পর্যন্ত তারমতো আটকে পড়ে শ’ শ’ যানবাহন। এদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, ভ্যাট প্রথ্যাহার না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন। বেলা আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে রাসেল জানান, বুধবারের ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার  ঘটনায় এবং ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে তারা রাস্তায় নেমেছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত দায়ী পুলিশদের বিচার এবং ভ্যাট প্রত্যাহার করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা এখানে অবস্থান করবেন। রাতে রাস্তায় মশাল জালিয়ে অবস্থান নেবেন।
পুলিশের বাধা ও তীব্র গরমের মধ্যে গতকালও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রামপুরা ব্রিজের রাস্তা অবরোধ করে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের এই কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করে যোগ দেন আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তারা ‘নো ভ্যাট গুলি করো, আমার বাবা এটিএম বুথ না’ এমন অসংখ্য প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা নিজেরাই দুইদিকের রাস্তা বন্ধ করে এই কর্মসূচি পালন করেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি পালন করা হয়। তাদের অবরোধের কারণে বাড্ডা থেকে রামপুরা ও মালিবাগগামী রাস্তায় সকল প্রকারের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যানজট ছড়িয়ে পড়ে এদিকে গুলশান লিংক রোড, মধ্য বাড্ডা, ভাটারা থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পযর্ন্ত। রামপুরা থেকে মালিবাগ-মৌচাক এলাকা থেকে  শান্তিনগর পর্যন্ত। এতে দুর্ভোগে পড়েন পথচারীরা। বাধ্য হয়ে পথচারীরা হেঁটে তাদের গন্তব্যস্থলে চলে যান। রাস্তায় গণপরিবহনের গাড়িগুলো খালি পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুলিশ রামপুরা থেকে আসা গাড়িগুলো বামদিক দিয়ে হাতিরঝিলে ও বাড্ডার গাড়িগুলো গুলশানের দিকে পাঠিয়ে দেয়। এতে আশপাশের এলাকায় প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়। কাভার্ড ভ্যানের চালক রবিউল ইসলাম জানান, সকাল ১০টায় গুলিস্তান থেকে কাপড়ের মাল নিয়ে গাজীপুরের উদ্দেশে যাওয়ার জন্য মালিবাগের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করি। সেখান থেকে রামপুরার টিভি সেন্টারের সামনে আসতে সময় লেগেছে ৪ ঘণ্টা। দীর্ঘ এই সময় গাড়ির মধ্যে বসে ছিলাম। অসহ্য গরম আর অপেক্ষার প্রহরে থাকায় চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে।
ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইমন জানান, শিক্ষা কোন পণ্য নয়। সরকার এটাকে বাণিজ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। এটা মেনে নেয়া যায় না। তার বিবিএ কোর্স করতে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৪০০ টাকা খরচ হবে। নতুনভাবে ৭.৫ ভ্যাট আরোপ করায় অতিরিক্ত তাকে ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা গুনতে হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, এমনিতেই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অতিরিক্তি টাকা গুনতে হয়।  আমার বাবাতো এটিএম বুথ না যে, টাকা তুলবো আর দিবো। আরেক শিক্ষার্থী আবুল কালাম জানান, ১২ সেমিস্টারে তার খরচ হবে প্রায় ৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। নতুন ভ্যাট কার্যকর হলে তাকে আরও ৬৫ হাজার টাকা গুনতে হবে। এটা মেনে নেয়া যায় না। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানান তিনি।
নো ভ্যাট অন এডুকেশনের মুখপাত্র ফারুক আহমাদ আরিফ বলেন, সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রসমাজ ঘরে ফিরে যাবে না। আমরা সরকারের কাছে আবারও আহ্বান জানাচ্ছি, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসকারী ভ্যাট তুলে নিয়ে আমাদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় ছাত্রসমাজ, শিক্ষার্থী-শিক্ষক, অভিভাবক, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষাবিদ, সাধারণ মানুষসহ দেশের আপামর জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো।
গুলশান জোনের পুলিশের ডিসি মোস্তাক আহমেদ জানান, আইনশৃঙ্খলা যেন বিঘ্ন না ঘটে এজন্য পুলিশ শুরু থেকে সতর্ক ছিল। গত ৪ঠা জুলাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি প্রজ্ঞাপনে জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি’র ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট কর দিতে হবে। গতকাল এনবিআর জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের নয়, ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে এনবিআরের এ ঘোষণার পরও আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, শিক্ষা থেকে কর প্রত্যাহারের জন্যই তাদের আন্দোলন। রাতেও কয়েকটি স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.